ইসলামের অপরাধ আইন (criminial law) সম্পর্কে ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার পাশ্চাত্যে ও মুসলিম সমাজগুলিতে বিদ্যমান। ইসলামী অপরাধ আইনের কিছু বিষয়কে আংশিকভাবে উপস্থাপন করে এগুলির ভিত্তিতে ইসলামী আইন, বিচার ও বিচারব্যবস্থাকে বর্বর, মধ্যযুগীয় এবং পুরোহিততান্ত্রিক বলে অপপ্রচার করা হয়। আবার অনেক আবেগী মুসলিম ইসলামী অপরাধ আইনের কয়েকটি দিককেই ‘‘ইসলামী আইন’’, এগুলির অনুপস্থিতিকে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং এগুলি প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামী রাষ্ট্রের একামত্র পরিচয় বলে মনে করেন।
যে কোনো রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব (১) নাগরিকদের বৈষম্যহীন অধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা (২) বহির্শত্রুর আগ্রাসন থেকে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলামেও এ দুটি বিষয়কে রাষ্ট্রের মূল দায়িত্বগুলির অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামে ‘‘জিহাদ’’-এর বিধান প্রদান করা হয়েছে। আর প্রথম দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামে আইন ও বিচারব্যবস্থা বিষয়ক নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে।
ইসলামী আইন ও আইন প্রয়োগের দুটি দিক রয়েছে: (১) আইন ও (২) বিচারব্যবস্থা। ইসলামী আইন বিষয়ে অনেক অপপ্রচার থাকলেও যে কোনো মতের ও ধর্মের গবেষক ইসলামী বিচারব্যবস্থার শ্রেষ্ঠতের বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। বিচারকের নিরপেক্ষতা, বিচারের সচ্ছতা, সাক্ষ্য গ্রহণ, সাক্ষ্য-প্রমাণের সঠিকত্ব প্রমাণ, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, সন্দেহের সুযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকললের জন্য ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম অত্যন্ত কার্যকর, মানবিক ও সচ্ছ বিচারব্যবস্থা প্রদান করেছে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বিচারব্যবস্থার অনেক বিষয় ইসলামী বিচারব্যবস্থা থেকে গৃহীত।
ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক, সাম্পদিক, অধিকার বিষয়ক ও অন্যান্য সকল দেওয়ানী (civil) আইনের বিষয়েও অবিকল একই কথা বলতে হবে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি দেওয়ানী, সামাজিক, পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয়ে ইসলামী আইন গৃহীত, প্রচলিত বা স্বীকৃত হয়েছে। আমাদের দেশের ও অন্যান্য মুসলিম দেশের বিচারব্যবস্থা ও দেওয়ানী আইন সবই মূলত ইসলামী।
এগুলির পাশাপাশি ইসলামে ‘‘অপরাধ আইন’’ রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের অপরাধ-আইনের উদ্দেশ্য অপরাধীর শাস্তি ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। ইসলামের অপরাধ আইনেরও একই উদ্দেশ্য। পার্থক্য শাস্তির প্রকৃতিতে। ইসলামে অল্প কয়েকটি অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট সকল অপরাধের ক্ষেত্রে যুগ, জাতি ও সমাজের প্রেক্ষাপটে শাসক, পার্লামেন্ট, সরকার বা বিচারক শাস্তির প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারেন।
ইসলামে নির্ধারিত শাস্তিগুলি নিম্নরূপ: (১) ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। (২) ইচ্ছাকৃত অঙ্গহানির শাস্তি অনুরূপ অঙ্গহানি। (৩) চুরির শাস্তি কব্জি থেকে হাত কেটে দেওয়া। (৪) ব্যভিচারের শাস্তি ১০০ বেত্রাঘাত ও বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। (৫) কারো বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ করে তা ৪ জন সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে না পারলে অভিযোগকারী ও সাক্ষীগণের শাস্তি ৮০ বেত্রাঘাত। (৫) জেনে বুঝে ইসলাম গ্রহণ করার পর ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। (৬) মদপানের শাস্তি ৪০ বা ৮০ বেত্রাঘাত।
এ সকল শাস্তি কেবলমাত্র মুসলিম নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষত ব্যভিচার ও মদপানের উপর্যুক্ত শাস্তি একান্তভাবেই মুসলিম অপরাধীর জন্য প্রযোজ্য। কোনো মুসলিম নাগরিক এ সকল অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে তিনি এ শাস্তি ভোগ করবেন। অমুসলিমদের জন্য এ সকল শাস্তি প্রযোজ্য নয়। তারা তাদের ধর্মীয় আইনে বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার ও শাস্তি ভোগ করবেন।
হত্যা, অঙ্গহানি ও চুরি এ তিনটি অপরাধের বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। তবে শাস্তির প্রকৃতি সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। ইসলামী শাস্তিকে পাশ্চাত্য পন্ডিতগণ কঠোর বা মধ্যযুগীয় বলে দাবি করেন। ব্যভিচার, মদপান ও ধর্মত্যাগকে তারা অপরাধ বলে গণ্য করতে নারাজ। এগুলির শাস্তিপ্রদানকেও তারা মধ্যযুগীয় ও ধর্মান্ধতা বলে আখ্যায়িত করেন। প্রকৃত সত্য হলো, ‘‘অপরাধ নিয়ন্ত্রণ’’-এর লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী বিচারব্যবস্থা ও ইসলামী দেওয়ানী আইন-এর পাশাপাশি ইসলামী অপরাধ-আইনের সঠিক বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় সহায়ক। এ সকল আইন কঠোর হলেও তা অমানবিক বা বর্বর নয়; বরং মানবতার সংরক্ষণে ও বর্বরতা নিয়ন্ত্রণে তা সর্বোচ্চ সহায়ক। এখানে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:
(১) ইসলামের এ সকল শাস্তি যেমন কঠোর করা হয়েছে প্রয়োগ তার চেয়ে অনেক কঠিন ও প্রায় অসম্ভব করা হয়েছে, যেন কোনোভাবেই নিরপরাধ বা কম অপরাধী শাস্তি না পায়। অপরাধ শতভাগ প্রমাণিত হওয়া, অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কোনোরূপ ওযর না থাকা এবং অপরাধের শাস্তিযোগ্যতার পর্যায় নিশ্চিত হওয়া এ সকল নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগের পূর্বশর্ত। সামান্য সন্দেহ হলে বিচারক অপেক্ষাকৃত হালকা শাস্তি প্রদান করবেন। হত্যা, অঙ্গহানী ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিহতের উত্তরাধিকারিগণ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ইচ্ছা করলে ক্ষতিপূরণ নিয়ে বা কিছু না নিয়ে ক্ষমা করতে পারেন। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী অথবা ব্যক্তির স্বেচ্ছায় স্বীকৃতির ভিত্তিতেই বিচার শুরু হতে পারে। সাক্ষীগণের সাক্ষ্য ত্রুটিপূর্ণ হলে সাক্ষীগণ ও অভিযোগকারী প্রত্যেকে ৮০ বেত্রাঘাত শাস্তি ভোগ করবেন। উপরন্তু সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বিচারিক সকল ক্ষেত্রে তাদেরকে স্থায়ীভাবে ‘‘সাক্ষ্যদানের অযোগ্য’’ বলে ঘোষণা দেওয়া হবে। স্বেচ্ছায় স্বীকৃতি প্রদানকারী ব্যক্তি পরে অস্বীকৃতি জানালে তার অস্বীকৃতিই কার্যকর হবে।
(২) বস্ত্তত, এ সকল শাস্তির উদ্দেশ্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। সহজ শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয় না। এছাড়া শাস্তি সহজ হলে নিরপরাধের শাস্তি পাওয়ার সুযোগ বেশি হয়। শাস্তি হালকা হওয়ার কারণে বিচারক সহজেই শাস্তি দেন এবং শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিরপরাধ হলেও তা মেনে নেন। আর কঠিন শাস্তির ক্ষেত্রে বিচারক, সমাজ, রাষ্ট্র, বিচারকৃত ব্যক্তি সকলেই অত্যন্ত সজাগ থাকেন, যেন নিরপরাধ শাস্তি না পায় বা অল্প অপরাধে কঠিন শাস্তি না হয়।
(৩) অপরাধ বিষয়ক গবেষণা প্রমাণ করে যে, অল্পসংখ্যক অপরাধীর শাস্তি দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা ইসলামী আইনের মাধ্যমেই সম্ভব। অতীতের মুসলিম সমাজগুলিতে খুব কম মানুষেরই হাত কাটা হয়েছে বা মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শাস্তির ভয়াবহতার কারণে অপরাধ কম সংঘটিত হয়েছে। বর্তমানেও সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচীয় কয়েকটি দেশে এ সকল শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে খুব কম সময়ে এ সকল শাস্তি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু শাস্তির বিদ্যমানতার কারণে অপরাধী ভয় পায়। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হয় না, বরং অপরাধীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
(৪) পাশ্চাত্যে অধিকাংশ দেশে ‘ড্রাগস’ বা ‘মাদকদ্রব্য’ গ্রহণ ও বিপনন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও মদপান অপরাধ নয়। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি ও সমাজের ক্ষতির দিক থেকে মদ ও ড্রাগস উভয়ই সমান, বরং মদের ক্ষতি অধিক। প্রায় আড়াই শতাব্দী ধরে ইউরোপ ও আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে। নারীরা এ সকল আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এ সকল আন্দোলনের ভিত্তিতে গত শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশে মদ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। আমেরিকায় ১৯২০ সালে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মদব্যবসায়ীদের চাপে ১৯৩৩ সালে তা আবার বৈধ করা হয়।
মাদকাসক্তি/মদ-নির্ভরতা (Alcoholism/Alcohol Dependence) আধুনিক সভ্যতার ভয়ঙ্করতম ব্যধিগুলির অন্যতম। বিশ্বে অগণিত সফল ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, টেকনিশিয়ান, শ্রমিক ও অনুরূপ সফল মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের ৭৬ মিলিয়ন মানুষ মদ পানের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রকমের কঠিন রোগে ভুগছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ এবং রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মদপান জনিত মারাত্মক রোগব্যধিতে ভুগছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ মদপান ও মদ-নির্ভরতাকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা বলে চিহ্নিত করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমান বিশ্বের সকল রোগব্যাধির শতকরা ৩.৫ ভাগ মদপান জনিত। মদপান ও মাতলামির কারণে প্রতি বৎসর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১৮৫ বিলিয়ন ডলার নষ্ট হয়।[1] ইসলাম ঈমান ও আল্লাহর ভয়ের পাশাপাশি আইনের মাধ্যমে এ ভয়ঙ্কর ব্যাধিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ আইনে একমাত্র মদব্যবসায়ী ছাড়া কারো কোনো ক্ষতি হয় না, শাস্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা বাড়ে না কিন্তু এ আইনের মাধ্যমে এ ভয়ঙ্কর ব্যাধি নির্মূল হয় বা নিয়ন্ত্রিত হয়।
(৫) ইহূদীধর্ম, খৃস্টধর্ম ও অন্য সকল ধর্মেই ব্যভিচারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, বিশেষত বাইবেলে ব্যভিচার ও সকল প্রকার অবৈধ যৌনতাকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় ধর্ষণকে অপরাধ বলা হলেও ব্যভিচারকে বৈধ করা হয়েছে এবং বিষয়টিকে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু ‘ড্রাগস’ বিক্রয় ও গ্রহণকে এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে গণ্য করা হয় না। অথচ ব্যক্তি, সমাজ ও মানবসভ্যতার জন্য ড্রাগসের চেয়ে ব্যভিচার অনেক বেশি ক্ষতিকর। আধুনিক সভ্যতা প্রমাণ করেছে যে, ব্যভিচারের মাধ্যমে পরিবার নষ্ট হয়, সন্তানগণ পারিবারিক স্নেহ ও প্রতিপালন থেকে বঞ্চিত হয়, তাদের মধ্যে মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ ব্যহত হয় এবং হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। বস্ত্তত ড্রাগসের কারণে ব্যক্তির জীবন নষ্ট হয় আর ব্যভিচারের মাধ্যমে মানবসভ্যতা বিনষ্ট হয়। এজন্য ইসলামে মদপান, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, বিপনন ও ব্যভিচারকে কাছাকাছি পর্যায়ের কঠিন অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(৬) ইহূদী-খৃস্টীয় ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে বিধর্মী ও ধর্মত্যাগীর মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। যদি কোনো গ্রাম বা নগরীর অধিবাসীরা ধর্মত্যাগ করে তাহলে তথাকার সকল মানুষকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে এবং সকল পশুও হত্যা করতে হবে। তথাকার সকল সম্পদ ও দ্রব্যাদি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। অগ্নিদগ্ধ জনপদটি চিরিকালীন ঢিবি হয়ে থাকবে। কখনোই আর তা পুনর্বার নির্মিত হবে না। উপরন্তু ধর্মের নির্দেশ সামান্য লঙ্ঘন করলেও মৃত্যুদন্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। যেমন, শনিবারে খড়ি কুড়ালে বা কর্ম করলে তাকে জনসমক্ষে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।[2] ইসলাম অন্য ধর্মের অনুসারীদের ইসলাম গ্রহণের জন্য চাপপ্রয়োগ বা প্রলোভন নিষিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি মুসলিমের জন্য অন্যধর্ম গ্রহণ মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র রোধ করতেই এ বিধান দেওয়া হয়েছে। যারা বাইবেলকে ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাস করেন তাদের মুখে এবং আধুনিক যুগে যারা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার নামে অমানবিক আইন তৈরি করছেন বা সমর্থন করছেন তাদের মুখে ইসলামের এ আইনকে অমানবিক বলা মোটেও মানায় না।
(৭) মুমিন বিশ্বাস করেন যে, কিভাবে মানুষের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং কোন্ অপরাধে কোন্ শাস্তি সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য তা মহান স্রষ্টা আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। আইনের বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ প্রশস্ততা দিয়েছেন এবং যুগ ও সমাজের আলোকে আইন তৈরির সুযোগ দিয়েছেন। শুধু যে সকল বিষয়ে প্রয়োজন সেক্ষেত্রেই তিনি শাস্তি নির্ধারিত করে দিয়েছেন।
মুমিনের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ মহান আল্লাহর বিধানের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করা। সালাত, সিয়াম, বিবাহ ইত্যাদি সকল বিষয়ের ন্যায় বিচারব্যবস্থা, দেওয়ানী আইন ও অপরাধ আইনের ক্ষেত্রেও আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা মুমিনের ঈমান ও ইসলামের দাবী। যদি কোনো মানুষ মনে করেন যে, সালাতের ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশ সর্বজনীন, সর্বকালীন এবং সর্বোত্তম, কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশ সর্বোত্তম নয় বা সর্বজনীন নয় তাহলে তিনি মুমিন বলে নিজেকে দাবি করতে পারেন না।
(৮) অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী যে কোনো দেশের জন্য ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন এ আগ্রহ পূরণের অন্যতম সহায়ক। বিশেষত মুসলিম দেশগুলির আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা অবস্থার উন্নয়নে ইসলামী অপরাধ-আইন বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সকল মুসলিম দেশের সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব আল্লাহর প্রতি ঈমান, ধর্মীয় প্রেরণা, দেশপ্রেম ও নাগরিকদের স্বার্থে ইসলামী আইনের সঠিক বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া।
(৯) আল্লাহর পথে আহবানকারী যেমন সালাত, সিয়াম, যিকর ইত্যাদি কুরআন নির্দেশিত ইবাদত বাস্তবায়নের আহবান করবেন, তেমনি কুরআন নির্দেশিত আইন, বিচার ইত্যাদির বাস্তবায়নের আহবান করবেন। সালাত পালনে আল্লাহর নির্দেশের অবহেলা যেমন তাকে ব্যথিত করে, বিচার পালনে আল্লাহর নির্দেশের অবহেলাও তাকে তেমনি ব্যথিত করে। এ তার ঈমানের দাবি। কুরআন-সুন্নাহর কোনো নির্দেশনার প্রতি অবহেলা দেখে ব্যথিত না হলে ঈমান থাকে না।
(১০) সালাত, সিয়াম ইত্যাদির দাওয়াতের ন্যায় আইন ও বিচার বিষয়ক দাওয়াতও বিনম্রতা, উত্তম আচরণ ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ মুমিনের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কোনো নির্দেশ অমান্য হতে দেখলে কোনোরূপ ব্যাথা ও আপত্তি হৃদয়ে অনুভব না করা ঈমান হারাণোর লক্ষণ। সাধ্য থাকা সত্ত্বেও দাওয়াত না দিয়ে নীরব থাকলে পাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্তত কেউই যদি কথা না বলেন তবে সকলেরই পাপী হওয়ার সম্ভাবনা। বিনম্রতা ও শোভন আচরণের সাথে দাওয়াতের দায়িত্ব আদায় করলে সুনিশ্চিত সাওয়াবের আশা করা যায়। আর অশোভন আচরণ, উগ্রতা, বলপ্রয়োগ বা সহিংসতার আশ্রয় গ্রহণ করলে সুনিশ্চিত কঠিন পাপ অর্জন ছাড়া কোনোই লাভ হবে না। এতে নিজের মনের ক্ষোভ বা প্রতিশোধস্পৃহা পূরণ হতে পারে এবং মুমিনকে জাহান্নমে নেওয়ার ও মুসলিম সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শয়তান ও তার অনুসারীদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি মুমিনের বা মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। আমরা দেখছি যে, আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থা, দেওয়ানী আইন ও কোনো কোনো অপরাধ-আইন ইসলাম নির্দেশিত বা ইসলাম সম্মত। আর কিছু ইসলামী আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এজন্য কি কোনো মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রকে কাফির বা অনৈসলামিক রাষ্ট্র বলা বৈধ?
আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে তা পর্যালোচনা করতে চাই। মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করছি।
[2] বিস্তারিত দেখুন: যাত্রাপুস্তক ৩২ অধ্যায়, ২২ অধ্যায়ের ২০ শ্লোক, ৩৫ অধ্যায়ের ২য় শ্লোক, গণনাপুস্তক: ১৫ অধ্যায়ের ৩২-৩৬। দ্বিতীয় বিবরণ ১৩ অধ্যায়: ১-১৬ শ্লোক; দ্বিতীয় বিবরণ ১৭ অধ্যায় ২-৭ শ্লোক।