৩. ৬. ৬. বাইবেলীয় জিহাদ বনাম ইসলামের জিহাদ - প্রথম অংশ

উপরে আমরা ইসলামী শরীয়তে জিহাদের পরিচয়, তার উদ্দেশ্য ও শর্তাবলি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জানি যে, ইসলাম বিরোধী সকল প্রচারণার মূল দাবি যে, ইসলামই ধর্মের নামে যুদ্ধ বৈধ করেছে। বিশেষত খৃস্টান ধর্মগুরুগণ খৃস্টধর্মকে ‘‘ভালবাসা ও মানবতার ধর্ম’’ ও ইসলামকে যুদ্ধ, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ধর্ম বলে চিত্রিত করেন। ইউরোপে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সন্ত্রাসী রূপে চিত্রিত করে কার্টুন ছাপা হচ্ছে এবং ‘‘কুরআন’’-কে সন্ত্রাসী গ্রন্থ বলে দাবি করে তা নিষিদ্ধ করতে দাবি জানানো হচ্ছে। ক্যাথলিক খৃস্টান জগতের বর্তমান ধর্মগুরু পোপ ১৬শ বেনিডিক্ট (Benedict XVI) ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জার্মানির রিগেনসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনায় বাইজানটাইন সম্রাট ম্যানুয়েল-২ এর ইসলামের প্রতি চরম বিদ্বেষমূলক নিম্নোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন: "Show me just what Mhuammad brought that was new and there you will find things only evil and inhuman, such as his command to spread by the sword the faith he preached." ‘‘তুমি আমাকে দেখাও তো, মুহাম্মাদ (ﷺ) নতুন কি এনেছেন? তরবারীর মাধ্যমে তার ধর্ম প্রচার করার নির্দেশের মত অমানবিক ও অশুভ বিষয় ছাড়া আর কিছুই তুমি পাবে না।’’
মানবতার জন্য মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্যিই কী নতুন শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন সে বিষয়ে বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের সাথে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শিক্ষার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে ‘‘কী নতুন নিয়ে এলেন মুহাম্মাদ (ﷺ)’’ নামে একটি গ্রন্থ রচনার একান্ত ইচ্ছা রয়েছে। মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করছি। এখানে ‘‘জিহাদ’’ পরিভাষার অপব্যবহার বিষয়ে আলোচনার পূর্বে আমরা জিহাদের বিষয়ে বাইবেলের নির্দেশাবলি পর্যালোচনা করতে চাই, যেন আমরা অন্তত জিহাদ বিষয়ে মুহাম্মাদ (ﷺ) নতুন কী নিয়ে এসেছিলেন তা আমরা জানতে পারি।

এখানে উলে­খ্য যে, ইহূদী-খৃস্টানগণের মধ্যে প্রচলিত বাইবেলের ‘‘ভার্সনগুলির’’ মধ্যে ব্যাপক বৈপরীত্য ও অমিল রয়েছে। ইহূদী বাইবেলের সাথে খৃস্টান বাইবেলের অমিল রয়েছে। তেমনি ক্যাথলিক খৃস্টানগণের বাইবেলের সাথে প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টানগণের বাইবেলের অমিল রয়েছে। সর্বাবস্থায় আমরা মুসলিমগণ বিশ্বাস করি যে, প্রচলিত বাইবেল কখনোই আল্লাহর কিতাব নয়। এর মধ্যে তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জিল ইত্যাদি আসমানী গ্রন্থের কিছু অংশ থাকলেও তা পুরোহিতদের সংযোজন, বিয়োজন ও বিকৃতির সাথে সংমিশ্রিত হয়ে রয়েছে। যে সকল অমানবিক ও অশুভ বিষয় রয়েছে তা সবই এরূপ বিকৃত তথ্য।[1] তবে ইহূদী ও খৃস্টানগণ প্রচলিত এ বাইবেলকেই তাদের ধর্মগ্রন্থ ও আসমানী গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করেন। ইহদীগণ শুধু ‘পুরাতন নিয়ম’কেই ধর্মগ্রন্থ বলে বিশ্বাস করেন। আর খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, প্রচলিত বাইবেলের পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়মের প্রতিটি শব্দ, বাক্য ও কথাই আল্লাহর বাণী।[2] উপরন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের বাণী বা বিধান কখনো রহিত হতে পারে না। কাজেই বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের প্রতিটি বাণী ও বিধান কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য পালনীয় অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ।[3] বাইবেল থেকে জানা যায় যে, জিহাদ বা যুদ্ধের জন্যই যীশুখৃস্ট আগমন করেছিলেন। তিনি বলেন: Think not that I am come to send peace on earth: I came not to send peace, but a sword ‘‘মনে করিও না যে, আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে আসিয়াছি; শান্তি দিতে আসি নাই, কিন্তু খড়্গ দিতে আসিয়াছি।’’[4]

উপরন্তু যীশুখৃস্ট তার রাজত্বের বিরোধীদেরকে তাঁর সামনে জবাই করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন: "But those mine enemies, which would not that I should reign over them, bring hither, and slay them before me", ‘‘পরন্তু আমার এই যে শত্রুগণ ইচ্ছা করে নাই যে, আমি তাহাদের উপরে রাজত্ব করি, তাহাদিগকে এই স্থানে আন, আর আমার সাক্ষাতে বধ কর।’’[5] বাইবেলে সুস্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, নেককার সাধু-সন্তুদের মূল কাজ হলো আল্লাহর প্রশংসা করা এবং সর্বদা দু-ধারি তরবারী সাথে নিয়ে কাফির-বিধর্মীদের কতল করা ও শাস্তি দেওয়া। আর এভাবে কাফির-বিধর্মীদের হত্যা, বন্দী ও বিচার করাই সাধুদের মূল কর্ম ও মর্যাদা:
"Let the saints be joyful in glory... Let the high praises of God be in their mouth, and a twoedged sword in their hand; To execute vengeance upon the heathen, and punishments upon the people; To bind their kings with chains, and their nobles with fetters of iron; To execute upon them the judgment written: this honour have all his saints. ‘‘সাধুগণ গৌরবে উদ্ভাসিত হউক। ... তাহাদের কণ্ঠে ঈশ্বরের উচ্চ প্রশংসা, তাহাদের হস্তে দ্বি-ধার খড়্গ থাকুক; যেন তারা বিধর্মী-কাফিরদের[6] প্রতিফল দেয়, লোকবৃন্দকে শাস্তি দেয়; যেন তাহাদের রাজাগণকে, তাহাদের মান্যগণ্য লোকদিগকে লৌহ-নিগড়ে বদ্ধ করে; যেন তাহাদের বিরুদ্ধে লিখিত বিচার নিষ্পন্ন করে; ইহাই সমস্ত সাধুর মর্যাদা।’’[7]

বাইবেলের বিভিন্ন নির্দেশনা থেকে নারী, শিশু ও নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যার ঢালাও অনুমোদন বুঝা যায়। যেমন বলা হয়েছে: "Kill every male among the little ones, and kill every woman that hath known man by lying with him. But all the women children, that have not known a man by lying with him, keep alive for yourselves." ‘‘অতএব তোমরা বালক-বালিকাদের মধ্যে সমস্ত বালককে বধ কর, এবং শয়নে পুরুষের পরিচয়প্রাপ্ত সমস্ত স্ত্রীলোককেও বধ কর; কিন্তু যে বালিকারা শয়নে পুরুষের পরিচয় পায় নাই, তাহাদিগকে আপনাদের জন্য জীবিত রাখ।’’[8]

অন্যত্র বলা হয়েছে"And when the LORD the God hath delivered it tnto thine hands, thou shalt smite every male thereof with the edge of the swore; but the women, and the little ones, and the cattle, and all that is in the city, even all the spoil thereof, shalt thou take unto thyself; and thou shalt eat the spoil of thine enemies, which the LORD thy God hath given thee. Thus shalt thou do unto all the cities which are very far from thee, which are not of the cities of these nations. But of the cities of these which the LORD thy God doth give thee for an inheritance, thou shalt save alive nothing that breatheth; but thou shalt utterly destroy them." ‘‘পরে তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তাহা তোমার হস্তগত করিলে তুমি তাহার সমস্ত পুরুষকে খড়্গধারে আঘাত করিবে, কিন্তু স্ত্রীলোক, বালক-বালিকা ও পশুগণ প্রভৃতি নগরের সর্বস্ব সমস্ত লুটদ্রব্য আপনার জন্য লুট-স্বরূপে গ্রহণ করিবে, আর তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভুর দত্ত শত্রুদের লুট ভোগ করিবে। এই নিকটবর্তী জাতিদের নগর ব্যতিরেকে যে সকল নগর তোমা হইতে অতি দূরে আছে, তাহাদেরই প্রতি এইরূপ করিবে। কিন্তু এই জাতিদের যে সকল নগর তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু অধিকারার্থে তোমাকে দিবেন, সেই সকলের মধ্যে শ্বাসবিশিষ্ট কাহাকেও জীবিত রাখিবে না।’’[9]

এরূপ অনেক নির্দেশ রয়েছে যা বাহ্যত অমানবিক ও গণহত্যার নির্দেশ বলে মনে হবে। যুদ্ধের সম্ভাবনা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। রাষ্ট্র থাকলেই যুদ্ধের সম্ভাবনা স্বীকার করতে হবে এবং যুদ্ধের জন্য নিয়ম, আইন ও বিধান রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র বা নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষা করতে অনেক সময় রাষ্ট্রকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। কিন্তু সকল শান্তিকামী মানুষই চেষ্টা করেন যুদ্ধকে যথাসম্ভব কম ধ্বংসাত্মক করতে এবং অযোদ্ধ মানুষদেরকে হত্যা না করতে। অযোদ্ধা মানুষদেরকে হত্যা করা বর্তমানে ‘যুদ্ধ অপরাধ’ বলে গণ্য। অথচ বাইবেলে এরূপই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু অযোদ্ধা মানুষই নয়, উপরন্তু গরু, ছাগল, উট, ভেড়া ইত্যাদি অবলা প্রাণীও নির্বিচারে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করতে নির্দেশ দিয়েছে বাইবেল। বিধর্মী বা অন্য দেবতার উপাসকদের হত্যা করার ঢালাও নির্দেশ দিয়ে বাইবেলে বলা হয়েছে: "He that sacrificeth unto any god, save unto the LORD only, he shall be utterly destroyed" ‘‘যে ব্যক্তি কেবল সদাপ্রভু ব্যতিরেকে কোন দেবতার কাছে বলিদান করে, সে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হইবে।’’[10]

ঈশ্বরের নির্দেশের সামান্য বিরোধিতা করলেই মৃত্যুদন্ড "Thou shalt not suffer a witch to live. Whosoever lieth with a beast shall surely be put to death". ‘‘তুমি মায়াবিনীকে জীবিত রাখিও না। পশুর সহিত শৃঙ্গারকারী ব্যক্তির প্রাণদন্ড অবশ্য হইবে।’’[11]
বিধর্মীর্দের ধর্মালয় ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছেঃ "Thou shalt not bow down to their gods, nor serve them, nor do after their works: but thou shalt utterly overthrow them, and quite break down their images." "But ye shall destroy their altars, break their images, and cut down their groves". ‘‘তুমি তাহাদের দেবগণের কাছে প্রণিপাত করিও না, এবং তাহাদের সেবা করিও না ও তাহাদের ক্রিয়ার ন্যায় ক্রিয়া করিও না; কিন্তু তাহাদিগকে সমূলে উৎপাটন করিও, এবং তাহাদের স্তম্ভ সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিও।’’[12] ‘‘কিন্তু তোমরা তাহাদের বেদি সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিবে, তাহাদের স্তম্ভ সকল খন্ড খন্ড করিবে, ও তথাকার আশেরা-মূর্তি সকল কাটিয়া ফেলিবে।’’[13]

বাইবেল থেকে জানা যায় যে, নির্বিচার গণহত্যার উপর্যুক্ত নির্দেশাবলি সুন্দরভাবে পালন করেছেন বাইবেলীয় ভাববাদীগণ। আমরা মুসলিমগণ কখনোই বিশ্বাস করি না যে, কোনো ভাববাদী (নবী) এরূপ গণহত্যা করতে পারেন। তবে বাইবেল তাদের বিষয়ে এরূপই লিখেছে এবং ইহূদী-খৃস্টানগণ এরূপই বিশ্বাস করেন। বস্ত্তত, লক্ষ-লক্ষ মানব সন্তানকে নির্বিচারের হত্যার অগণিত কাহিনীর সমন্বয় বাইবেল। পবিত্র ভাববাদীগণ, মহাযাজকগণ বা বিচারকর্তৃগন কিভাবে যুদ্ধ, ছলচাতুরি বা প্রবঞ্চনার মাধ্যমে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছেন তার অগণিত বিবরণ বাইবেলে রয়েছে। অযোদ্ধা ও যুদ্ধবন্দী নারী, পুরুষ ও শিশুদের নির্বিচারে ও গণহারে হত্যার বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এছাড়া নিরীহ যুদ্ধবন্দীদের কত বেশি কষ্ট দিয়ে হত্যা করা যায় সে বিষয়েও তাদের আগ্রহ লক্ষণীয়। লোহার মইয়ের নিচে রেখে, লোহার কুড়ালির নিচে রেখে এবং ইটের পাঁজার মধ্যে ঢুকিয়ে বা অনুরূপভাবে বর্ণনাতীত যন্ত্রণা দিয়ে নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যার কাহিনী বাইবেলে প্রচুর। এরূপ কর্মের জন্য ‘‘ভাববাদিগণকে’’ বাইবেলে বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে।
যদি কেউ কষ্ট করে বাইবেলে যিহোশূয়ের পুস্তক (Joshua) বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ (Judges), শমুয়েলের পুস্তক (Samuel), রাজাবলি (The Kings), বংশাবলি (The Chronicles) ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠ করেন তবে বর্বর গণহত্যা, কল্পনাতীত নিপীড়ন, উন্মাদ ধ্বংসযজ্ঞের লোমহর্ষক ঘটনাবলি দেখবেন। এগুলি পাঠ করলে একজন সাধারণ পাঠক অনুভব করবেন যে, বাইবেলের নির্দেশ অনুসাসের যুদ্ধ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য নয়, এমনকি অন্যের দেশ দখলের জন্যও যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ মূলত হত্যা ও ধ্বংসের মাধ্যমে আনন্দলাভের জন্য। বাইবেলের নতুন নিয়মেও এ সকল কর্মের জন্য ভাববাদীগণকে বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে।[14]
আমরা বলেছি যে, রাষ্ট্র থাকলেই যুদ্ধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে যুদ্ধকে যথাসম্ভব কম ধ্বংসাত্মক করতে হবে এবং সকল অযোদ্ধা মানুষ, দ্রব্য ও বস্ত্তকে যুদ্ধের আওতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ইসলামে এ কাজটিই সর্বোত্তমভাবে করা হয়েছে। তাত্বিকভাবে যেমন, তেমনি প্রায়োগিকভাবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব কম প্রাণহানি ঘটাতে। শুধু সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং তার সারাজীবনের সকল যুদ্ধে মুসলিম ও কাফির মিলে সর্বমোট প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। যে দেশে প্রতি মাসেই শতশত মানুষ মারামারি করে খুন হতো, সে দেশে মাত্র সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে সকল আগ্রাসন রোধ করে তিনি বিশ্বব্যাপী চিরস্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পক্ষান্তরে বাইবেলের একেক যুদ্ধেই হাজার হাজার ‘‘কাফির’’ হত্যার গৌরবময় বিবরণ লেখা হয়েছে। মহাভারত, গীতা বা রামায়ণের যুদ্ধেরও কাছাকাছি অবস্থা।

সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় যে, বাইবেলে যুদ্ধ, হত্যা ও প্রতিশোধের ক্ষেত্রে কোনোরূপ নীতি নৈতিকার প্রতি লক্ষ রাখা হয় নি। ইসলামে যুদ্ধের জন্য গোপনীয়তা ও শত্রুপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য কৌশল অবলম্বন বৈধ করেছে। কিন্তু চুক্তিভঙ্গ করা, প্রবঞ্চনা করা, নিরস্ত্রকে আক্রমন করা, অযোদ্ধা লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত করা, আহতদের হত্যা করা, মৃতদেহ অপমান করা ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এরূপ সকল কর্মই বাইবেলীয় জিহাদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই। বিধর্মী ও বিজাতীয়দের সাথে ইহূদীদের যুদ্ধ, ইহূদীদের সাথে ইহূদীদের যুদ্ধ, ইস্রায়েল রাজ্যের ইহূদীদের সাথে জুডাই রাজ্যের ইহূদীদের যুদ্ধ, একই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই আমরা চুক্তিভঙ্গ, মিথ্যাচার, অযোদ্ধাদেরকে হত্যা, মৃতদেহের অবমাননা ইত্যাদি অগণিত বিষয় দেখতে পাই। বাইবেলে এ সকল বিষয় অত্যন্ত গৌরবের সাথে প্রশংসনীয় কর্ম হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্ভবত এজন্যই ইস্রায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক শামির ১৯৪৮ সালে তার পরিচালিত সন্ত্রাসী বাহিনী ‘দি স্টার্ন গ্যাং’’ কর্তৃক জেরুজালেমে জাতিসংঘ মধ্যস্থতাকারী কাউন্ট বার্ণাডোটকে গোপনে হত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন: ‘‘ইহূদী নৈতিকতা ও ইহূদী ঐতিহ্য কোনটিই সন্ত্রাসকে রণনীতির পরিপন্থী মনে করে না। জাতীয় সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ততার মূহূতে আমরা নৈতিক দ্বিধাগ্রস্ততা বহু দূরে ছুঁড়ে ফেলে রাখি। সর্বাগ্রে, আমাদের জন্য সন্ত্রাস হল রাজনৈতকি যুদ্ধের অংশ যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই যথার্থ।’’[15]

এখানে লক্ষণীয় যে, ইহূদী নৈতিকতার আর খৃস্টান নৈতিকতা একই হওয়ার কথা; কারণ তাদের নৈতিকার ভিত্তি ধর্মগ্রন্থ এক। খৃস্টান পাদরি-প্রচারকগণ অনেক সময় মুসলিমদেরকে বলেন যে, যুদ্ধ, গণহত্যা ও বিধর্মী হত্যার উপর্যুক্ত নির্দেশাবলি বাইবেলের পুরাতন নিয়মের কথা বা তাওরাতের কথা, ইঞ্জিলের কথা নয়। আমরা আগেই বলেছি যে, খৃস্টানগণ বিশ্বাস করেন যে, পুরাতন ও নতুন নিয়মের প্রতিটি শব্দই আল্লাহর বাণী এবং কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য পালনীয়। তাঁরা আরো বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর কোনো নির্দেশ বা বাণী কখনো ‘‘নসখ’’ বা রহিত হতে পারে না। সর্বোপরি স্বয়ং যীশু খৃস্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে পুরাতন নিয়মের সকল নির্দেশ চিরন্তন, অপবির্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় ঐশ্বরিক নির্দেশ যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল খৃস্টানের জন্য পালনীয় এবং এগুলি পালন না করলে কেউ পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারবে না। তিনি বলেন "For verily I say unto you, Till heaven and earth pass, one jot or one tittle shall in no wise pass from the law, till all be fulfilled. Whosoever therefore shall break one of these least commandments, and shall teach men so, he shall be called the least in the kingdom of heaven: but whosoever shall do and teach them, the same shall be called great in the kingdom of heaven". ‘‘আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, যে পর্যনত আকাশ ও পৃথিবী লুপ্ত না হইবে, সেই পর্যনত ব্যবস্থার (তাওরাত বা পুরাতন নিয়মের বিধিবিধান) এক মাত্রা কি এক বিন্দুও লুপ্ত হইবে না, সমস্তই সফল হইবে। অতএব যে কেহ এই সকল ক্ষুদ্রতম আজ্ঞার মধ্যে কোন একটি আজ্ঞা লঙ্ঘন করে, ও লোকদিগকে সেইরূপ শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গরাজ্যে অতি ক্ষুদ্র বলা যাইবে; কিন্তু যে কেহ সেই সকল পালন করে ও শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গ-রাজ্যে মহান বলা যাইবে।’’[16] এছাড়া আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বাইবেলের নতুন নিয়মেও যীশু তাঁর রাজত্বের প্রতি অনীহা পোষণকারীদের তার সামনে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তরবারী বা যুদ্ধের জন্যই তাঁর আগমন।
বাইবেলে অন্য ধর্ম বা বর্ণের মানুষদেরকে শূকর, কুকুর ইত্যাদি বলে গালি দেওয়া হয়েছে। অ-ইস্রায়েলীয়দেরকে কুকুর ও শূকর আখ্যায়িত করে তাদেরকে খৃস্টান ধর্মের দীক্ষা দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যীশু বলেন: "Give not that which is holy unto the dogs, neither cast ye your pearls before swine...", ‘‘পবিত্র বস্ত্ত কুকুরদিগকে দিও না, এবং তোমাদের মুক্তা শূকরদের সম্মুখে ফেলিও না’’[17]

অ-ইস্রায়েলীয়দেরকে কুকুর আখ্যায়িত করে তাদের জন্য দুআ করতে বা তাদেরকে ঝাড়-ফুঁক দিতেও আপত্তি করেন যীশু খৃস্ট। মথি তাঁর সুসমাচারে লিখেছেন: "And, behold, a woman of Canaan came out of the same coasts, and cried unto him, saying, Have mercy on me, O Lord, thou Son of David; my daughter is grievously vexed with a devil. But he answered her not a word. And his disciples came and besought him, saying, Send her away; for she crieth after us. But he answered and said, I am not sent but unto the lost sheep of the house of Israel. Then came she and worshipped him, saying, Lord, help me. But he answered and said, It is not meet to take the children's bread, and to cast it to dogs."
‘‘আর দেখ, ঐ অঞ্চলের এক জন কনানীয় স্ত্রীলোক আসিয়া এই বলিয়া চেঁচাইতে লাগিল, হে প্রভু, দায়ূদ-সনতান, আমার প্রতি দয়া করুন, আমার কন্যাটি ভূতগ্রস্ত হইয়া অত্যন্ত ক্লেশ পাইতেছে। কিন্তু তিনি তাহাকে কিছুই উত্তর দিলেন না। তখন তাঁহার শিষ্যেরা নিকটে আসিয়া তাঁহাকে নিবেদন করিলেন, ইহাকে বিদায় করুন, কেননা এ আমাদের পিছনে পিছনে চেঁচাইতেছে। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, ইস্রায়েল-কুলের হারান মেষ ছাড়া আর কাহারও নিকটে আমি প্রেরিত হই নাই। কিন্তু স্ত্রীলোকটি আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, প্রভু, আমার উপকার করুন। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, সনতানদের খাদ্য লইয়া কুকুরদের কাছে ফেলিয়া দেওয়া ভাল নয়।’’[18]

[1] বিস্তারিত জানতে আল্লামা রাহমাতুল্লাহ রচিত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত “ইযহারুল হক্ক” গ্রন্থটি পাঠ করুন।

[2] Ahmed Deedat, The Choice (Jeddah, Abul Qasim Publications, 1st print, 1994), Vol-2, p73-74.

[3] Carl Gottaleb Pfander, Balance of Truth (The Mizanul Haqq), Part-1 (The Good way, Rikon, Switzerland), p 17.

[4] বাইবেল, মথি ১০/৩৪।

[5] লুক ১৯/২৭।

[6] এখানে ইংরেজীতে (heathen) বলা হয়েছে, যার অর্থ বিধর্মী বা কাফির। এভাবে এখানে কাফির হত্যার ঢালাও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলা অনুবাদে বিষয়টিকে অস্পষ্ট করার জন্য heathen অর্থ “জাতিগনকে” লেখা হয়েছে।

[7] গীতসংহিতা ১৪৯/৫-৯।

[8] গননা পুস্তক ৩১/১৭-১৮।

[9] দ্বিতীয় বিবরণ ২০/১৩-১৬।

[10] যাত্রাপুস্তক ২২/২০।

[11] যাত্রাপুস্তক ২২/১৮-১৯।

[12] যাত্রাপুস্তক ২৩/২৩-২৪।

[13] যাত্রাপুস্তক ৩৪/১২-১৩।

[14] নতুন নিয়ম, ইব্রীয় ১১/৩২-৩৪।

[15] আজহারুল ইসলাম, নিন্দিত বিশ্ব নন্দিত গন্তব্য, পৃ. ৫৯, from an August 1943 article tittled ‘Terror’ written by Yitzhak Shamir for Hazit the journal of Lehi.

[16] মথি ৫/১৮-২০।

[17] মথি ৭/৬।

[18] মথি ১৫/২১-২৬।