৩. ৬. ৩. জিহাদের ফযীলত ও বিধান

নিঃসন্দেহে জিহাদের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদ কুরবানী দেওয়া অত্যন্ত বড় ত্যাগ এবং মানবীয় প্রকৃতির জন্য খুবই কষ্টকর। এজন্য এ ইবাদতের সাওয়াব ও পুরস্কারও অভাবনীয়। কুরআন ও হাদীসে জিহাদের অফুরন্ত সাওয়াব ও পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে এবং জিহাদের ইবাদত পালনের জন্য বিশেষ উৎসাহ ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের অর্থ জিহাদ যখন বৈধ বা শরীয়ত সম্মত হবে তখন যে ব্যক্তি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে জিহাদের দায়িত্ব পালন করবে তখন সে এ অভাবনীয় পুরস্কার লাভ করবে। এছাড়া জিহাদের আবেগ ও আগ্রহ মুমিনের হৃদয়ে থাকবে। জিহাদের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদের কুরবানীর প্রতি অনীহা ঈমানের দুর্বলতা প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَن مات ولم يَغزُ ، ولم يحدِّث به نفسَه ، مات علَى شُعبةٍ من نفاقٍ

‘‘যদি কেউ এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি এবং যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণের কোনো কথাও নিজের মনকে কখনো বলে নি, তবে সে ব্যক্তি মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল।’’[1] আমরা দেখব যে, সাধারণভাবে জিহাদ ফরয কিফায়া এবং রাষ্ট্র শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ফরয আইন। ফরয কিফায়া অবস্থায় যদি সকল মুসলিম তা পরিত্যাগ করে এবং ফরয আইন অবস্থায় যদি মুসলিমগণ তা পরিত্যাগ করে তবে তা তাদের জাগতিক লাঞ্ছনা বয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إذا تبًايعتم بًالعينة وأخذتم أذناب البقر ، ورضيتم بًالزرع ، وتركتم الجهاد سلط الله عليكم ذلا لا ينزعه حتى ترجعوا إلى دينكم

‘‘যখন তোমরা অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত হবে, গবাদিপশুরু লেজ ধারণ করবে, চাষাবাদেই তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন, দীনে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যা তিনি অপসারণ করবেন না।’’[2] এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে অনেক সময় আবেগী মুমিন ভুল বুঝেন যে, জিহাদের বিষয়ে যেহেতু বেশি বেশি নির্দেশ ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং বেশি বেশি পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেহেতু জিহাদ সালাত-সিয়ামের মতই ইবাদত অথবা সালাত সিয়ামের চেয়েও বড় ইবাদত। কারণ মহান আল্লাহ সালাত ও সিয়াম ফরয করেছেন এবং তিনিই জিহাদ ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেছেন (كتب عليكم الصيام) তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে’’[3] এবং তিনিই বলেছেন (كتب عليكم القتال) তোমাদের উপর কিতাল বা যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করা হয়েছে’’।[4] কাজেই সালাত, সিয়াম ও জিহাদ-কিতালের মধ্যে পার্থক্য করলে বা সালাত পালন করে জিহাদ-কিতাল পালন না করলে ইসলাম পালন করা হবে না। আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের সাথে খারিজীগণের কথোপকথনে আমরা এর নমুনা দেখেছি।

আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে, কুরআনে কোনো ইবাদতেরই বিস্তারিত বিধান ও শর্তাবলি উল্লেখ করা হয় নি। কুরআন ও সুন্নাতের সামগ্রিক নির্দেশনার আলোকে তা জানতে হয়। কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, জিহাদ সালাত সিয়াম ইত্যাদির মত ‘ফরয আইন’ বা দীনের রুকন নয়, বরং তা ফরয কিফয়া ইবাদত। জিহাদের শর্তগুলি পূরণ সাপেক্ষ জিহাদ বৈধ বা ফরয হলে উম্মাতের কিছু সদস্য তা পালন করবেন। এতে উম্মাতের সকলের দায়িত্ব পালিত হয়ে যাবে। অন্যরা পাপমুক্ত হবেন, তবে এ ইবাদত পালনের সাওয়াব তারা পাবেন না। যারা এ ইবাদত পালন করবেন তারা এ ইবাদত পরিত্যাগকারীদের চেয়ে অধিক মর্যাদা লাভ করবেন, তবে পরিত্যাগকারীরা পাপী হবেন না। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন:

لَا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ...

মুমিনদের মধ্যে যারা কোনো অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও (জিহাদ না করে) ঘরে বসে থাকে এবং যারা আল্লাহর পথে নিজেদের প্রাণ ও সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা নিজেদের প্রাণ ও সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। উভয় প্রকারের মুমিনকেই আল্লাহ কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ....।’’[5] এখানে মহান আল্লাহ সুস্পষ্টতই জানিয়েছেন যে, কোনোরূপ ওজর ও অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ জিহাদ পরিত্যাগ করে তবে সে পাপী হবে না, শুধু অতিরিক্ত সাওয়াব ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে। এ অর্থে এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,

أنَّ رجلًا أتى النبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ فقال : أيُّ الناسِ أفضلُ ؟ فقال رجلٌ يجاهد في سبيلِ اللهِ بمالِه ونفسِه قال : ثم من ؟ قال مؤمنٌ في شِعبٍ من الشِّعابِ ، يعبدُ اللهَ ربَّه (وفي رواية: يقيم الصلاة ويؤتي الزكاة ويعبد ربه حتى يأتيه اليقين) ويدعُ الناسَ من شرِّه

‘‘একব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর নিকট আগমন করে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম মানুষ কে? তিনি বলেন: যে মুমিন নিজের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। লোকটি বলে, এরপর সর্বোত্তম কে? তিনি বলেন: যে মুমিন মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বিজন উপত্যাকায় থেকে তার প্রতিপালকের ইবাদত করে (দ্বিতীয় বর্ণনায়: এভাবে নির্জনে একাকী সে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, মৃত্যু আগমন পর্যন্ত তার প্রতিপালকের ইবাদত করে) এবং মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।’’[6] এভাবে সমাজ ও জিহাদ পরিত্যাগ করে বিজনে নির্জনে একাকী বসবাস করে দীনের আরকান ও আহকাম পালনের কারণে দ্বিতীয় ব্যক্তি মর্যাদায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন, তবে পাপী বলে গণ্য হলেন না।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:


وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

‘‘মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। তাদের প্রতিটি দল থেকে একাংশ বের হয় না কেন? যাতে তারা দীনের জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যেন তারা সতর্ক হয়।’’[7] বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পিতামাতার খেদমত বা অনুরূপ দায়িত্বের কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) বলেন:

جاءَ رجلٌ إلى النبيِّ صلى الله عليه وسلم فاستأذَنَهُ في الجهادِ فقالَ: أحيٌّ والداكَ ؟ قال: نعَم قال: ففيهِما فجاهِدْ (فارجع الى والديك فأحسن صحبتهما)

‘‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর কাছে এসে জিহাদে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করে। তিনি বলেন: তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছেন? সে বলে : হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন : তোমার পিতামাতাকে নিয়ে তুমি জিহাদ কর। (অন্য বর্ণনায়: তাহলে তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং সুন্দরভাবে তাঁদের খেদমন ও সাহচার্যে জীবন কাটাও।’’[8] এ সকল আয়াত ও হাদীসের আলোকে মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ ফকীহগণ একমত যে, জিহাদ ফরয কিফায়া বা সামষ্টিক ফরয, কিছু মুসলিম তা পালন করলে অন্যদের ফরয আদায় হয়ে যায়। তবে যারা পালন করবেন তারাই শুধু সাওয়াব লাভ করবেন, অন্যরা গোনাহ থেকে মুক্ত হবেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে শত্রুবাহিনী যদি রাষ্ট্র দখল করে নেয়, বা রাষ্ট্র যদি বহির্শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, সেনাবাহিনীর পক্ষে আগ্রাসন রোধ সম্ভব না হয়, এবং রাষ্ট্রপ্রধান সকল নাগরিককে যুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন তবে এ অবস্থায় জিহাদ ফরয আইনে পরিণত হয়। আল্লামা কুরতুবী বলেন:

الذي استقر عليه الإجماع أن الجهاد على كل امة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين

‘‘ যে বিষয়ে ইজমা বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সকলের উপর জিহাদ ফরয কিফায়া। যখন কিছু মানুষ তা পালন করবে তখন অন্য সকলের দায়িত্ব অপসারিত হবে। তবে যখন শত্রুগণ ইসলামী রাষ্ট্রে অবতরণ করে তখন তা ফরয আইন হয়ে যায়।’’[9] তাফসীর, হাদীস-ব্যাখ্যা ও ফিকহের প্রায় সকল গ্রন্থেই বিভিন্ন শব্দে ও বাক্যে এ কথাই বলা হয়েছে।

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫১৭।

[2] আবু দাউদ, আস-সুনান ৩/২৭৪; আলবানী, সহীহাহ ১/১৫। হাদিসটি সহীহ।

[3] সূরা (২) বাকারা: ১৮৩ আয়াত।

[4] সূরা (২) বাকারা: ২১৬ আয়াত।

[5] সূরা (৪) নিসা: ৯৫ আয়াত।

[6] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫০৩।

[7] সূরা (৯) তাওবা: আয়াত ১২২।

[8] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৯৪; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৭৫।

[9] কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ (৬৭১ হি.), আল-জামি লি আহকামিল কুরআন ৩/৩৮।