হজ সফরে সহজ গাইড হজ মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান
৯ যিলহজ: আরাফাহ দিবস
- এ দিনের মূল কাজ হলো সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফায় গমন করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা ও দো‘আ, যিকির, ইসতেগফার করা। আরাফায় যোহর-আছর সালাত একসাথে পরপর কসর করে আদায় করা এবং সূর্যাস্তের পর আরাফা ত্যাগ করে মুযদালিফায় গমন করা।
- আরাফা ময়দান বিচার দিবসের হাশরের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। এ দিবস সবচেয়ে বেশি আশির্বাদপ্রাপ্ত দিবস এবং এ দিবস আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ক্ষমাশীলতা, রহমত ও দয়া উপস্থাপন করেন। আরাফার ময়দান হারাম এলাকার সীমানার বাইরে অবস্থিত। আরাফার চর্তুদিকে সীমানা-নির্ধারণমূলক উঁচু ফলক রয়েছে। ১০.৪ কি.মি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত আরাফা ময়দান। মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ২২ কি.মি দূরে অবস্থিত আরাফার ময়দান। এ আরাফার ময়দানের প্রান্তে দাঁড়িয়েই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন, ‘‘হজের সব হলো আরাফায়”।[1]
- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আরাফা ব্যাতীত আর কোনো দিবস নেই যে দিন আল্লাহ তাঁর অধিক বান্দাহকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন এবং তিনি খুব সন্নিকটে চলে আসেন এবং ফিরিশতাদের সামনে তার বান্দাহদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘তারা আমার কাছে কী চায়?”[2]
- শয়তান এ দিনে সকল মানুষের আল্লাহর প্রতি যিকর, দো‘আ ও ইসতেগফার দেখে সবচেয়ে বেশি হীন ও লাঞ্ছিত হয়ে যায়। শয়তান ক্রোধান্বিত ও বেদনা বিধুর হয়ে যায়।
- ৯ যিলহজ মিনায় ফজরের সালাত আদায়ের পর আরাফার উদ্দেশে দলবদ্ধ হয়ে রওয়ানা হওয়া ভালো। এসময় একাকি অথবা ছোট দল হয়ে পাঁয়ে হেঁটে আরাফায় যাওয়ার চিন্তা না করাই উত্তম। কারণ আরাফা ময়দান অনেক বড় জায়গা ও এখানে মিনার মতো তাবু নম্বর, জোন, রোড নম্বর লেখা ফলক তুলনামূলক কম আছে। অনেক সময় বাস ড্রাইভাররাই তাবু লোকেশন ঠিক মতো বুঝতে পারেন না ও অনেক ঘুরাঘুরি করে তাবু খুঁজে বের করেন। তাই বাসে যাওয়া উত্তম। বাসে যেতে যেতে তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকুন। সম্ভব হলে আরাফায় প্রবেশের পূর্বে বা পরে গোসল করে নেওয়া উত্তম।
- বর্তমানে হজযাত্রী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে ৯ যিলহজ মধ্যরাত থেকে আরাফায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটা নিশ্চয় সুন্নতের খেলাফ; তবে যেহেতু সমস্যার কারণে এ কাজ করা হচ্ছে তাই এ সুন্নাতটি ছুটে গেলে ক্ষতি হবে না ইন-শাআল্লাহ।
- আরাফার সীমানার ভিতর প্রবেশ করে মুস্তাহাব হলো নামিরা মসজিদে ইমামের খুতবা শোনা এবং যোহরের আযানের পর যোহরের আউয়াল ওয়াক্তেই যোহর-আসর সালাত ইমামের পিছনে জামাআতে আদায় করা।
- তবে যেহেতু সকল লোকের একত্রে মসজিদে নামিরায় একত্রিত হওয়া সম্ভব নয় তাই আরাফার ময়দানের যে কোনো স্থানে তাবুতে অবস্থান গ্রহণ করা ও যোহরের ওয়াক্তেই যোহর-আসর সালাত তাবুতে জামাআত করে আদায় করা অথবা কেউ চাইলে একাকীও আদায় করতে পারেন।
- গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো; নিশ্চিতভাবে আরাফার সীমানার ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে অন্যথায় হজ হবে না। আরাফার ময়দানের চর্তুদিকে সীমানা-নির্ধারণমূলক উঁচু ফলক বা সাইনবোর্ড রয়েছে যা আপনাকে অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্য করবে। নামিরা মসজিদের সামনের দিকের কিছু অংশ আরাফার সীমানার বাইরে, তাই সেখানে অবস্থান গ্রহণ করা যাবে না। আবার আরাফা ও মুযদালিফার মধ্যবর্তী ‘উরানাহ’ উপত্যকা এলাকা আরাফার সীমানার বাইরে, তাই সেখানেও অবস্থান গ্রহণ করা যাবে না।
- এখানে সালাত আদায়ের নিয়ম হলো; যোহরের সালাতের আউয়াল ওয়াক্তেই এক আযান ও দুই ইকামাতে যথাক্রমে যোহর (২ রাকাত ফরয) ও আসর (২ রাকাত ফরয) কসর করে পরপর আদায় করা। এ দুই সালাতের আগে, মধ্যে ও পরে কোনো সুন্নাত পড়ার নিয়ম নেই।[3]
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই মক্কার মুকিম ও মুসাফিরদের নিয়ে কসর করে পরপর সালাত আদায় করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে মুকিম ও মুসাফিরদের জন্য আলাদা কোনো নিয়মের কথা উল্লেখ করেন নি। নামিরা মসজিদের ইমামও এইভাবেই সালাত পড়ান। তাবুতে সকল লোকদের এ একইভাবে একাকী বা জামাআতে সালাত আদায় করা উচিত। যদি দিনটি শুক্রবার হয় তবে জুমআর সালাত পড়ার দরকার নেই তবে কসর সালাত আদায় করতে হবে।
- আরাফার দিবসের রোজা, পূর্বের এক বছরের ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। তবে এ সাওম হাজীদের জন্য নয়, বরং যারা হজ করতে আসেন নি তাদের জন্য। আপনার পরিবারবর্গকে বাড়িতে এ দিনে সাওম রাখতে বলুন। হাজীদের জন্য আরাফার দিনে সাওম রাখা মাকরূহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিনে সাওম রাখেননি। তিনি সবার সন্মুখে দুধ পান করেছেন।[4]
- আরাফার ময়দানে আপনি যে কোনো স্থানে দাঁড়াতে পারেন বা বসতে পারেন অথবা শুয়েও থাকতে পারেন। আরাফার ময়দানে এ অবস্থান করাকে বলা হয় উকুফে আরাফাহ। আরাফার দিনে জাবালে রহমত পাহাড়ে উঠার বিষয়ে বিশেষ কোনো ফযিলত বা সাওয়াবের বর্ণনা হাদীসে কোথাও পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্য জাবালে রহমত তথা আরাফার পাহাড়ের নীচে উকুফ বা অবস্থান করেছেন কিন্তু তিনি বলেছেন, ‘‘আমি এখানে উকুফ করলাম, কিন্তু আরাফার পুরো এলাকা উকুফের স্থান”।[5]
- সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে গেলে (পূর্বে উল্লেখিত নিয়মে যোহর-আছর সালাতের পর) অত্যন্ত বিনয়ী ও তাকওয়ার সাথে আল্লাহর কাছে দো‘আ শুরু করুন। এখন আল্লাহর কাছে দৃঢ়-প্রত্যয়ী হয়ে আপনার আবেদন জানানোর সময়। এ দো‘আর গুরুত্ব অপরিসীম, এর জন্যই আপনার আরাফায় আসা। কিবলার দিকে মুখ করে দুই হাত উচুঁ করে (বগল উন্মুক্ত করে) চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, ক্ষমা চান, দয়া কামনা করুন, আপনার মনের আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ তা‘আলার কাছে ব্যক্ত করুন। আল্লাহর গুণবাচক নামসমূহ, দুরূদ ইবরাহীম, তালবিয়াহ, তাকবীর, যিকর, ইসতিগফার ও দো‘আ করতে থাকুন বেশি বেশি করে। যে কোনো দো‘আ পাঠ করার সময় ৩ বার করে পাঠ করা উত্তম। প্রথমে নিজের জন্য ও পরে পরিবার-আত্মীয়স্বজনদের জন্য অতঃপর প্রতিবেশী-পরিচিতজনদের জন্য এবং শেষে পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য দো‘আ করুন। দো‘আ করার সময় কোনো সন্দেহ না করা, ইতস্তত না করা ও সীমালঙ্ঘন না করা। দো‘আ শেষে ‘আমিন’ বলুন।[6]
- সব দো‘আ-যিকর যে আরবীতে করতে হবে তার কোনো নিয়ম নেই, যে ভাষা আপনি ভালো বোঝেন ও আপনার মনের ভাব প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দো‘আ করুন। তবে মনে রাখবেন; আওয়াজ করে, জোরে শব্দ করে বা দলবদ্ধ হয়ে কোনো দো‘আ পাঠ করা সুন্নাত নিয়ম এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এতে অন্যদের মনযোগ নষ্ট হয়। তবে কেউ দো‘আ পাঠ করলে তার পিছনে ‘আমিন’ বলা জায়েয আছে। দো‘আ করবেন আবেগ ও মিনতির সাথে মনে মনে। দো‘আর সময় তাওহীদকে জাগ্রত করুন। আরাফায় দো‘আর সময় ওযু অবস্থায় থাকা উত্তম তবে কেউ অযু বিহীন অবস্থায় থাকলেও সমস্যা নেই। এ বইয়ের শেষে কুরআন ও হাদীস থেকে বেশ কিছু দো‘আ সংযোজন করা হয়েছে যা আরাফার ময়দানে পড়তে পারেন। যে সব মহিলারা ঋতু অবস্থায় থাকবেন তারাও অন্যান্য হাজীদের মতো দো‘আ-যিকির করবেন - তারা শুধু সালাত আদায় করা, কুরআন স্পর্শ করা ও কা‘বা তাওয়াফ করা থেকে বিরত থাকবেন।[7]
- আরাফার দিনে এ দো‘আ পড়া উত্তম :
لا إله إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ، لَا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَئْيٍ قَدِيْرِ
‘‘লা ইলাহা ইল্লালাহু ওআহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু্, ওয়া হুয়া আ’লা কুল্লি শায়য়িন ক্বদির।’’
‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। সকল সার্বভৌমত্ব ও প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। তিনি সর্ব বিষয়ের ওপর সর্বশক্তিমান”।[8]
- ৯ যিলহজ আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ফরয। দুপুরের সূর্য পশ্চিমে ঢলে যাওয়ার পর থেকে আরাফাতে অবস্থানের প্রকৃত সময় শুরু হয়। আরাফার ময়দানে মধ্যপ্রহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। আর তার সময় শেষ হয় আরাফার দিবাগত রাত্রির শেষে দশ তারিখের সূর্য উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। কারো পক্ষে হতে অন্য কাউকে আরাফায় পাঠানো যাবে না, প্রত্যেকে স্বশরীরে আরাফায় উপস্থিত হতে হবে।
- অনিবার্য কারণবশত যদি আরাফায় দিনের বেলায় পৌছা না যায় এবং ঐ দিন রাতের বেলায় পৌছায় তবে রাতের কিছু অংশ আরাফায় অবস্থান করে মুযদালিফায় গিয়ে রাতের বাকি অংশ যাপন করলে তার হজ হয়ে যাবে। আবার কেউ যদি তার দেশ থেকে সরাসরি ৯ যিলহজ আরাফার ময়দানে চলে যায় তাহলেও তার হজ হয়ে যাবে।[9]
- আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পর লাল-হলুদ আভা বিলীন হওয়া পর্যন্ত ধীরস্থির অবস্থান করতে হবে এবং মাগরিবের আযানের পর সালাত আদায় না করেই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। মাগরিব সালাত আদায় করবেন মুযদালিফায় গিয়ে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটাই করেছেন। অনেকে সূর্যাস্ত হওয়ার আগেই রাস্তার জানজট কাটানোর জন্য আগেই বাসে উঠে রওনা হয়ে যান আর আরাফার ময়দান পার হতে হতে সূর্যাস্ত করেন। বুদ্ধিটি নিঃসন্দেহে ভাল! কিন্ত ইবাদতের বিষয়ে শর্টকার্ট, চটজলদি বা চালাকি বেশি খাটানো উচিৎ হবে না।
[1] মুসনাদে আহমদ (৪/৩৩৫)
[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪৮
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৬২
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১২৩
[5] আবু দাউদ, নাসাঈ
[6] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৩৭
[7] সূরা আল-আ‘রাফ: ২০৫
[8] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৮৫; আহমদ, হাদীস নং ৬৯৬১
[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১
[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪৮
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৬২
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১২৩
[5] আবু দাউদ, নাসাঈ
[6] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৩৭
[7] সূরা আল-আ‘রাফ: ২০৫
[8] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৮৫; আহমদ, হাদীস নং ৬৯৬১
[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১