আল্লাহ তা‘আলা যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং মুসলিমগণের মক্কা বিজয় দান করেন, তখন মক্কাবাসীদের উপর একটি অধিকার সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং তাদের বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয়ে যায় যে ইসলাম ছাড়া কৃতকার্যতার আর কোন পথই নেই। এ জন্যই তারা ইসলামের আনুগত্য ও আজ্ঞাবর্তী হওয়ার শপথ গ্রহণের জন্য একত্রিত হয়। সাফা পাহাড়ে উপবিষ্ট অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কাবাসীদের আজ্ঞানুবর্তিতা শপথ গ্রহণ শুরু করেন। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর উপবেশন স্থানের নীচে বসে জনগণের অঙ্গীকার গ্রহণ করছিলেন। লোকজনেরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ বলে ও‘য়াদা করেন যে, ‘আপনার কথা আমরা শ্রবণ করব এবং সাধ্যমতো তা মান্য করে চলব।’
তাফসীর মাদারিকের মধ্যে উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন পুরুষদের বাইয়াত গ্রহণ সমাপ্ত করে অবকাশ প্রাপ্ত হলেন তখন সাফা পাহাড়ের উপরেই মহিলাদের বাইয়াত গ্রহণ আরম্ভ করলেন। উমার (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর নীচে অবস্থান করে তাঁর নির্দেশমতো বাইয়াত গ্রহণ করছিলেন এবং তাঁদের নিকট নাবী কারীম (ﷺ)-এর বাণী পৌঁছে দিচ্ছিলেন।
উল্লেখিত সময়ের মধ্যে আবূ সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবাহ বেশভূষার পরিবর্তন সহকারে আগমন করল। প্রকৃতই হামযাহ (রাঃ)-এর লাশের সঙ্গে সে যে গর্হিত আচরণ করেছিল সে কারণেই ভীত সন্ত্রস্ত্র ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যদি তাকে চিনে ফেলেন।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাইয়াত গ্রহণ কালে ইরশাদ করলেন, (أُبَايِعْكُنَّ عَلٰى أَلَّا تُشْرِكْنَ بِاللهِ شَيْئًا) ‘আমি তোমাদের নিকট এ বলে অঙ্গীকার গ্রহণ করছি যে, আমরা কখনও আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করব না।’
উমার (রাঃ) ঐ কথার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মহিলাদের বাইয়াত গ্রহণ করেন যে, তারা কখনও আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন, ‘চুরি করবে না।’ এ প্রেক্ষিতে হিন্দা বলে উঠল, ‘আবূ সুফইয়ান কৃপণ ব্যক্তি। তার সম্পদ থেকে তার অজানতে আমি যদি কিছু নেই তাহলে?’ আবূ সুফইয়ান সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, বললেন, আমার সম্পদ থেকে তুমি যা নিয়ে নেবে তা তোমার জন্য হালাল হবে।’
হিন্দাকে চিনতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ‘তুমিই হিন্দা।’
হিন্দা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমিই হিন্দা।’ অতীতে যা কিছু হয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দিন। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন।’
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (وَلَا يَزْنِيْنَ) ‘ব্যভিচার করবে না।’
প্রত্যুত্তরে হিন্দা বলল, ‘আচ্ছা স্বাধীন মহিলারা কি কখনো জেনা করে?’
নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ) ‘নিজ সন্তানদের হত্যা করবে না।’
হিন্দা বলল, ‘বাল্যকালে আমরাও তাদের লালন-পালন করেছি, কিন্তু বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর আপনারা তাদের হত্যা করেছেন। এ জন্য তারা এবং আপনিই ভাল জানেন।’ প্রকাশ থাকে যে হিন্দা সন্তান হাঞ্জালা বিন আবূ সুফইয়ান বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। হিন্দার মুখ থেকে এ কথা শুনে উমার (রাঃ) হাসতে হাসতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও মৃদু মৃদু হাসলেন।
অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (وَلَا يَأْتِيْنَ بِبُهْتَانٍ) ‘কাউকেও মিথ্যা অপবাদ দেবেনা।’ হিন্দা বলল, ‘আল্লাহর কসম! মিথ্যা অপবাদ অত্যন্ত খারাপ কথা। আপনি বাস্তবিকই হিদায়াত এবং উত্তম চরিত্রের নির্দেশ প্রদান করছেন।’ এরপর নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (وَلَا يَعْصِيْنَكَ فِيْ مَعْرُوْفٍ) ‘কোন সদুপদেশে রাসূল (ﷺ)-এর অবাধ্য হবে না।’ হিন্দা বলল, ‘আল্লাহর কসম, আমরা এমন মনোভাব নিয়ে এ বৈঠকে বসি নি যে, আপনার আবাধ্য হব।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমত থেকে ফিরে এসে হিন্দা তার উপাস্য মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলে। মূর্তি ভাঙ্গার সময় সে বলছিল, ‘আমরা তোমার সম্পর্কে ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত ছিলাম। আমাদের সে ভুল এখন ভেঙ্গে গেছে।’’[1]
সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত আছে, হিন্দা বিনতে ‘উতবাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকটে এসে আরজ করলো, হে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জমিনের বুকে তার চেয়ে বেশী প্রিয় আমার নিকটে কেউ ছিল না যে আপনাকে অপমান করতে পারে। অতঃপর আজকের দিনে জমিনের বুকে আমার নিকট সেই অধিক প্রিয় আপনাকে যে অপমান করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অতঃপর আবার বললো, হে রাসূলুল্লাহ! আবু সুফইয়অন খুব কৃপণ লোক। আমি যদি তার সম্পদ হতে আমাদের পরিবারের জন্য ব্যয় করি তা অন্যায় হবে?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করলেন, না অন্যায় হবে না, তবে তা নিতে হবে ইনসাফের সাথে।