মাহরুয যাহরানে শিবির স্থাপনের পর আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাদা খচ্চরের উপর আরোহণ করে বের হলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যদি উপযুক্ত কোন লোক পাওয়া যায় তাহলে তার মাধ্যমে কুরাইশদের নিকট এ খবরটি পাঠানো যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মক্কা প্রবেশের পূর্বেই তারা যেন নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে।
এদিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরাইশদের নিকট খবর পাঠাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে এ সংক্রান্ত কোন খবরাখবরই তাদের নিকট পৌঁছেনি। তবে তারা অত্যন্ত ভীত ও আতঙ্কিত অবস্থায় কাল যাপন করছিল এবং আবূ সুফইয়ান বারবার বাইরে খবরাখবর নেয়ার চেষ্টা করছিল। ঐ সময় সে এবং হাকীম বিন হিযাম এবং বুদাইল বিন ওয়ারাক্বা খবর জানাবার জন্য বাহিরে গিয়েছিল।
আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর খচ্চরের উপর সোওয়ার হয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময় আবূ সুফইয়ান এবং বুদাইল বিন ওয়ারকার কথোপকথন আমার কর্ণগোচর হল। আবূ সুফইয়ান বলল, আল্লাহর কসম! অদ্য রাত্রির মতো এত অধিক আগুন এবং সৈন্য আমি ইতোপূর্বে কখনো দেখি নি।
উত্তরে বুদাইল বলল, ‘আল্লাহর কসম! এরা বনু খুযা’আহ। যুদ্ধ তাদের রাগান্বিত করেছে।’
আবূ সুফইয়ান বলল, ‘বনু খুযা’আহ সংখ্যায় কতই না অল্প এবং নিকৃষ্ট সৈন্যবাহিনীতে এত লোকজন এবং এত আগুন তারা পাবে কোথায়?’
আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘আমি তাদের কথোপকথন শুনে সব কিছু বুঝে নিলাম এবং বললাম, ‘আবূ হানযালাহ না কি? সে আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে বলল, ‘আবূ ফযল না কি?’
আমি বললাম, হ্যাঁ’।
সে বলল, ‘কী ব্যাপার? আমার পিতামাতা তোমার জন্য উৎসর্গিত হোক ।’
আমি বললাম, ‘সেখানে লোকজনসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রয়েছেন। হায় কুরাইশদের ধ্বংস! আল্লাহর শপথ!’
সে বলল, ‘এখন উপায় কী? আমার পিতামাতা তোমার জন্য উৎসর্গিত হোক ।’
আমি বললাম, ‘আল্লাহর কসম! তিনি যদি তোমাদের পেয়ে যান তাহলে গ্রীবা কর্তন করে ফেলবেন। অতএব, এসো আমার এ খচ্চরের পেছনে বসে যাও। আমি তোমাদেরকে রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর নিকট নিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ অতঃপর আবূ সুফইয়ান আমার পিছনে উঠে বসল। তার অন্য দু’ বন্ধু ফিরে চলে গেল।
আব্বাস (রাঃ) বলছেন, ‘আমি আবূ সুফইয়ানকে নিয়ে চললাম। যখন কোন উনুনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন সেখানকার লোকেরা বলছিলেন, কে যায়?’ কিন্তু পরক্ষণেই যখন দেখত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খচ্চর এবং আমি তার সোওয়ার তখন বলত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা এবং তাঁর (নাবী কারীম (ﷺ)) খচ্চর। এভাবে চলতে চলতে যখন উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর উনুনের নিকট গেলাম, তিনি বললেন, ‘কে’? অতঃপর গাত্রোত্থান করে আমার নিকট আসলেন এবং আমার পিছনে আবূ সুফইয়ানকে দেখে তিনি বললেন, ‘আবূ সুফইয়ান আল্লাহর দুশমন। যাক আল্লাহর অশেষ প্রশংসা যে কোন অঙ্গীকার কিংবা কৌশল ছাড়াই তাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া গেছে।’ এ কথা বলার পর সেখান থেকে বের হয়ে তিনি দ্রুতপদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অবস্থান স্থলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও খচ্চরকে উত্তেজিত করে দ্রুত এগিয়ে চললাম।
আমি কিছুক্ষণ আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম এবং খচ্চর পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপবিষ্ট হলাম। ইতোমধ্যে উমার (রাঃ)-ও এসে পৌঁছলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! ইনি আবূ সুফইয়ান! আমাকে নির্দেশ দেয়া হোক , আমি তাঁর গর্দান কেটে ফেলি।’ তখন আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছি। তারপরে আমি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট বসে তাঁর মাথা ধরে বললাম, ‘আল্লাহর কসম! আমি ছাড়া অন্য কেউ আজ রাত্রে আপনার সাথে কানাঘুষা করবে না।’ এদিকে আবূ সুফইয়ান সম্পর্কে উমার (রাঃ) বারবার বলতে থাকলেন। তখন আমি বললাম, উমার (রাঃ) থাম, আল্লাহর কসম! এ যদি বনু আদী বিন কা‘ব গোত্রের লোক হত, তুমি এমন কথা বলতে না । উমার (রাঃ) বললেন, ‘আব্বাস তুমি থাম, আল্লাহর কসম! তোমার ইসলাম গ্রহণ আমার নিকট খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে (সে যদি ইসলাম গ্রহণ করত) অধিক পছন্দনীয় ছিল। ইহার কারণ এই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তোমার ইসলাম গ্রহণ খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় ছিল।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (اِذْهَبْ بِهِ يَا عَبَّاسُ إِلٰى رَحْلِكَ، فَإِذَا أَصْبَحَتْ فَأْتِنِيْ بِهِ) ‘আব্বাস একে (আবূ সুফইয়ানকে) নিজ তাঁবুতে নিয়ে যাও, প্রত্যুষে আমার নিকট নিয়ে এসো। নাবী কারীম (ﷺ) এ নির্দেশ মোতাবেক তাকে তাঁবুতে নিয়ে যান এবং সকালে নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির করেন। তাঁকে দেখে তিনি (ﷺ) বললেন, (وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ، أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ؟) ‘হে আবূ সুফইয়ান! তোমার উপর দুঃখ হচ্ছে এ জন্য যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এ মহাসত্য উপলব্ধি করার সময় কি এখনো তোমার হয় নি?
আবূ সুফইয়ান বলল, ‘আমার পিতামাতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক । আপনি যে, কত সহনশীল, কত সম্মানিত এবং স্বজনরক্ষক! আমি বুঝে নিয়েছি যে, যদি অন্য কোন উপাস্য থাকত তাহলে এতদিন তা আমার কাজে আসত।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,(وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ، أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنِّيْ رَسُوْلُ اللهُ؟) ‘আবূ সুফইয়ান! তোমার জন্য সত্যিই দুঃখ হয়। এখনো কি তোমার বুঝবার সময় আসে নি যে, আমি সত্যিই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) অর্থাৎ আমি যে সত্যিই আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ সত্য উপলব্ধি করা কি এখনো তোমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।’
আবূ সুফইয়ান বলল, ‘আমার মাতাপিতা আপনার উপর উৎসর্গিত হোক। আপনি কতইনা ধৈর্য্যশীল, কতইনা দয়ালু ও আত্মীয়তা সম্পর্ক স্থাপনকারী! কিন্তু ঐ ব্যাপারে এখনো কিছু না কিছু সংশয় তো আছেই। এ প্রেক্ষিতে আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘ওহে শোন! গ্রীবা কর্তনের পূর্বেই ইসলাম কবুল করে নাও এবং এ কথা স্বীকার করে নাও যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল (ﷺ)। আব্বাস (রাঃ)-এর এ কথার প্রেক্ষিতে আবূ সুফইয়ান ইসলাম কবুল করলেন এবং সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে কালেমা পাঠ করলেন।
আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আবূ সুফইয়ান সম্মান প্রিয়, তাই তাঁকে কোন সম্মান প্রদান করুন। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,
(نَعَمْ، مَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِيْ سُفْيَانَ فَهُوْ آمْنٌ، وَمَنْ أَغْلَقَ عَلَيْهِ بَابَهُ فَهُوْ آمِنٌ، وَمَنْ دَخَلَ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ فَهُوَ آمِنٌ).
‘ঠিক আছে, যে ব্যক্তি আবূ সুফইয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে আশ্রিত হবে এবং যে নিজ ঘরের দরজা ভিতর হতে বন্ধ করে নেবে সে আশ্রিত হবে এবং যে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে সেও আশ্রিত হবে।