একাদশ নবুওয়াত বর্ষে (জুলাই ৬২৩ খৃষ্টাব্দে) হজ্জ্বের মৌসুম ফিরে এলো। ইসলামী দাওয়াতের কয়েকটি কার্যকরী বীজ হস্তগত হল যা দেখতে দেখতে বিরাট বৃক্ষে পরিণত হল। এর ঘন শাখা-প্রশাখা ও পত্র পল্লবের সুশীতল ছায়ায় বসে মুসলিমগণ বহু বছরের অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের উত্তাপ থেকে কিছুটা আরামও শান্তি পেলেন।
মক্কাবাসী মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার এবং লোকজনকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখার জন্য প্রতিবন্ধকতার যে দেয়াল সৃষ্টি করে রেখেছিল তা এড়িয়ে চলার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর স্ট্রাটেজী বা কর্ম কৌশল পরিবর্তন করে নিলেন। মুশরিকরা যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে তদুদ্দেশ্যে দিবা ভাগের পরিবর্তে তিনি রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন গোত্রের নিকট যাতায়াতের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকেন।
এ কর্ম কৌশল বা পদ্ধতির অনুসরণে একরাত্রি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাকর (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। বানু যুহল ও বানী শায়বান বিন সা’লাবাহগণের বাসস্থানের নিকট দিয়ে যাবার সময় ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বললেন। আলাপ আলোচনার সময় তাদের সাড়া খুব অনুকূল বলে মনে হলেও ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তমূলক কোন কিছুই তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গেল না। এ সময় আবূ বাকর (রাঃ) ও বনু যুহলের এক ব্যক্তির সঙ্গে বংশ পরম্পরা সম্পর্কে খুব হৃদ্যতাপূর্ণ কথাবার্তা হল। উভয়েই বংশধারা সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন।[1]
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সঙ্গীদের নিয়ে মিনার চৌক দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় অদূরে কিছু সংখ্যক লোকের কথোপকথন তাঁর শ্রুতিগোচর হল।[2] কাজেই, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তিনি সে দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এ দলে ছিলেন ইয়াসরাবের খাযরাজ গোত্রের ছয় জন যুবক। তাঁদের নাম হল যথাক্রমে :
(১) আস’আদ বিন যুরারাহ, (বনু নাজ্জার গোত্রের)
(২) ‘আওফ বিন হারিস বিন রিফা’আহ (ইবনে আফরা-), (বনু নাজ্জার গোত্রের)
(৩) রাফি’ বিন মালিক বিন আজলান, (বনু যুরাইক্ব গোত্রের)
(৪) কুত্ববা বিন ‘আমির বিন হাদীদাহ, (বনু সালামাহ গোত্রের)
(৫) উক্ববাহ বিন ‘আমির বিন নাবী, (বনু হারাম বিন কা‘ব গোত্রের)
(৬) হারিস বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব। (বনু উবাইদ বিন গানম গোত্রের)
এটা ইয়াসরিববাসীগণের সৌভাগ্য যে, তাঁরা তাঁদের মিত্র ইহুদীদের নিকট থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, এ যুগে একজন নাবী প্রেরিত হবেন এবং শ্রীঘ্রই তা প্রকাশ পেয়ে যাবে। ইহুদীরা বলতেন যে, ‘আমরা তাঁর অনুসারী হয়ে তাঁর সঙ্গে তোমাদেরকে ইরম ও ‘আদদের মতো হত্যা করব।[3]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চলতে চলতে গিয়ে তাঁদের নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা খাযরাজ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ তিনি বললেন, ‘অর্থাৎ ইহুদীদের মিত্র?’
তাঁরা বললেন, ‘জী হ্যাঁ’।
তিনি বললেন, ‘আপনারা বসুন না, কিছু কথাবার্তা হোক।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’এর এ কথা শ্রবণের পর তাঁরা বসে পড়লেন। তিনি তাঁদের সম্মুখে ইসলামের হাকীকত বর্ণনা করার পর কুরআন মাজীদ থেকে তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত পেশ করলেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর থেকে দাওয়াত লাভের পর তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলেন, ‘ইনিতো সেই নাবী বলে মনে হচ্ছে যাঁর উল্লেখ করে ইহুদীগণ তোমাদেরকে ধমকাচ্ছে। কাজেই ইহুদীগণ যেন তোমাদেরকে পিছনে ফেলতে না পারে।’ এ কথা বলে তাঁরা তৎক্ষণাৎ ইসলামের দাওয়াত কবুল করে মুসলিম হয়ে গেলেন।
এঁরা ইয়াসরিবের জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। সাম্প্রতিককালে ইয়াসরিবে যে যুদ্ধ হয়ে গেল এবং যার ধোঁয়া এখনো ইয়াসরিবের আকাশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, যুদ্ধে তাঁদেরকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে। এ জন্য তাঁরা আশা করেছিলেন যে, ইসলামের এ দাওয়াতই এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর একটা সূত্র হতে পারে। এ জন্য তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের সম্প্রদায়কে এমন এক অবস্থায় রেখে এসেছি যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে এমন শত্রুতা ও দুশমনীর সৃষ্টি হয়েছে, যার কোন নজির নেই। আশা করি আপনার দাওয়াতই তাদেরকে একত্রিত করে দিবে। আমরা সেখানে ফিরে গিয়ে লোকদের আপনার কাজের প্রতি আহবান জানাব এবং আপনার দাওয়াতের কারণে আল্লাহ যদি তাঁদের একত্রিত করে দেন তবে আপনার চাইতে অধিক আর কেউই সম্মানিত হবে না।
এরপর তাঁরা যখন মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন তখন সেই সঙ্গে ইসলামের সংবাদ ও পয়গাম সঙ্গে নিয়ে গেলেন। যার ফলে সেখানে ঘরে ঘরে রাসূল (ﷺ)-এর দাওয়াত প্রসার লাভ করল।[4]
[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৮৪ পৃঃ।
[3] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫০ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৯ ও ৫৪১ পৃঃ।
[4] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪২৮ ও ৪৩০ পৃঃ।