তাশরীকের দিনসমূহের ফযীলত

১১,১২,১৩ই যুলহজ্জকে ‘আইয়্যামে তাশরীক’ বলা হয়। তাশরীকের অর্থ হল, রৌদ্রে মাংস শুকানো। যেহেতু এই দিনগুলিতে কুরবানীর মাংস বেশী দিন রাখার জন্য রৌদ্রে শুকানো হত, তাই উক্ত দিনগুলির এই নামকরণ হয়।

এ দিনগুলিও শ্রেষ্ঠ ও ফযীলতপূর্ণ দিনসমূহের অন্যতম; যে মহান কাল-সময়ে আল্লাহ পাক তাঁর যিক্র করতে আদেশ করেছেন। (সূরা বাক্বারাহ ২০৩ আয়াত)

ইবনে আববাস (রা.) বলেন, ‘আইয়্যামে মা’লূমাত’ (বিদিত দিনসমূহ) বলে উদ্দেশ্য হল, (যুলহজ্জের) দশ দিন এবং ‘আইয়্যামে মা’দূদাত’ (নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনসমূহ) বলে উদ্দেশ্য হল, তাশরীকের (কুরবানী ঈদের পরের তিন) দিনসমূহ। আর এই ব্যাখ্যা অধিকাংশে উলামার।[1]

মুফাসসির কুরতুবী বলেন, ‘উলামাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, ‘আইয়্যামে মা’দূদাত’ এর উদ্দেশ্য মিনার দিনসমূহ এবং তাই তাশরীকের দিন। আর এই তিনটি নাম ঐ দিনগুলির জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই আয়াতে যিক্র করার আদেশ নিয়ে হাজী-অহাজী নির্বিশেষে সকলকেই সম্বোধন করা হয়েছে। আর বিশেষ করে নামাযসমূহের সময়ে নামাযীকে - একাকী হোক অথবা জামাআতে- যিক্র করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কথার উপর সাহাবা ও তাবেয়ীনদের প্রসিদ্ধ ফকীহগণ একমত।’[2]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তাশরীকের দিনগুলি পান-ভোজনের ও যিক্র করার দিন।’’[3]

তিনি আরো বলেছেন, (যেমন পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে) ‘‘আরাফাহ, কুরবানী ও তাশরীকের দিনসমূহ আহলে ইসলাম, আমাদের ঈদ।’’ আর ‘‘আল্লাহর নিকট সর্বমহান দিন কুরবানীর দিন। অতঃপর তাশরীকের (ঈদের দ্বিতীয়) দিন।’’

আইয়্যামে তাশরীক শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ দিন। যেহেতু এ দিনগুলি যুলহজ্জের প্রথম দশ দিনের সংলগ্নেই পড়ে; যার ফযীলত এই পুস্তিকার প্রারম্ভে আলোচিত হয়েছে। পক্ষান্তরে এই দিনগুলিতে হজ্জের কিছু আমল পড়ে, যেমন রম্ই, তওয়াফ ইত্যাদি। যাতে মূল শ্রেষ্ঠতেক্ষ ঐ দিনগুলির সাথে মিলিত হয়। যেমন তকবীর বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে দুই প্রকারের দিনগুলিই সম্পৃক্ত।

উপর্যুক্ত হাদীস হতে বুঝা যায় যে, তাশরীকের দিনগুলিও পান-ভোজনের দিন। আনন্দ ও খুশী করার, আত্মীয়-স্বজনকে সাক্ষাৎ করার এবং বন্ধু-বান্ধব মিলে ফলপ্রসূ বৈঠক করার দিন। এই দিনগুলিতে অধিকরূপে উত্তম পানাহার; বিশেষ করে মাংস ব্যবহার করা দূষণীয় নয়। তবে তাতে যেন কোন প্রকারের অপচয়, নষ্ট ও আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা না হয়।

এই দিনগুলি আল্লাহকে বিশেষভাবে স্মরণ ও তার যিক্র করার দিন। এই যিক্র হবে বিবিধ প্রকারেরঃ-

১। প্রতি ফরয নামাযের পর তকবীর পাঠ। যা তাশরীকের শেষ দিনের আসর পর্যন্ত পড়তে হয়। অবশ্য অনেক উলামাগণ মনে করেন যে, তকবীর কেবল নামাযের পরেই সুনির্দিষ্ট নয়। বরং এই দিনগুলিতে যে কোন সময় সর্বদা পড়াই উত্তম।

অভিমতটি অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। যেহেতু আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলিকে যিক্র দ্বারা বিশিষ্ট করেছেন। কিন্তু তাতে কোন নির্ধারিত সময় নির্দিষ্ট করেন নি। তিনি বলেন, ‘‘এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনগুলিতে আল্লাহর যিক্র কর।’’ (সূরা বাক্বারাহ ২০৩ আয়াত) আর এই আদেশ হাজী-অহাজী সকলের জন্য সাধারণ। তদনুরূপ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও বলেন, ‘‘এই দিনগুলি আল্লাহর যিক্র করার দিন।’’ অতএব এই নির্দেশ পালন স্পষ্টভাবে তখনই সম্ভব হয় যখন তকবীরাদি সর্বাবস্থায় (যে অবস্থায় আল্লাহর যিক্র করা চলে) পাঠ করা হয়। যেমন, নামাযের পরে, মসজিদে, বাড়িতে, পথে, মাঠে ইত্যাদিতে।[4]

২। কুরবানী যবেহ করার সময় তাসমিয়াহ ও তাকবীর পাঠ।

৩। পান ও ভোজনের পর যিক্র ও দুআ। যেহেতু দিনগুলি অধিক রূপে খাওয়া ও পান করার দিন, যাতে পূর্বে আল্লাহর নাম ও পরে তার প্রশংসা করায় যিক্র হয়।

৪। (হাজীদের জন্য) রম্ই জিমার করার সময় তকবীর পাঠ।

সুতরাং মুসলিমকে গাফলতি থেকে সতর্ক হওয়া উচিত। তার উচিত, এই সময়গুলিতে আল্লাহর যিক্র ও নেক আমল দ্বারা আবাদ করা। নচেৎ আল্লাহ-ভোলা মানুষদের মত ফালতু বেশী বেশী রাত্রি জেগে কোন বিলাস ও প্রমোদ যন্ত্রের সম্মুখে বসে শুক্রিয়ার পরিবর্তে পাপ করা আদৌ উচিত নয়।

অধিক খেয়ে-পান করে আল্লাহর যিক্র ও ইবাদতে সাহায্য নেওয়ায় তাঁর নিয়ামতের এক প্রকার শুকরিয়া আদায় করা হয়। কিন্তু আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত দ্বারা উদরপূর্তি করে তার অবাধ্যাচরণ ও পাপকাজে সাহায্য নেওয়ায় তাঁর অকৃতজ্ঞতা করা হয়। আর তাঁর দেওয়া সম্পদকে অসবীকার করলে এবং তাঁর কৃতঘ্নতা করলে কখনো তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। পক্ষান্তরে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে সম্পদ অধিকরূপে বর্ধমান হতে থাকে।

যেহেতু তাশরীকের দিনগুলিকেও ঈদ বলা হয়েছে, তাই তাতে কোন প্রকারের রোযা পালন করা শুদ্ধ নয়। কারো অভ্যাসমত যদিও এই দিনগুলিতে রোযা পড়ে, তবুও তার পরবর্তী কোন দিনে রেখে নেবে এবং এই দিনগুলিতে খান-পানের মাধ্যমে আল্লাহর যিক্র করবে।[5]

অবশ্য যে তামাত্তু হজ্জের হাজী কুরবানী দিতে সক্ষম না হয়, সে এই দিনগুলিতে তিনটি রোযা পালন করবে কিনা তা নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকে বলেন, ‘কেবল ঐ হাজী রোযা রাখবে। কারণ আল্লাহ বলেন, ‘‘অতএব যে ব্যক্তি (কুরবানী) না পায় সে হজ্জে তিনটি রোযা (পালন করবে)। (সূরা বাক্বারাহ ১৯৬ আয়াত) আর ‘হজ্জে’ বলতে কুরবানীর পূর্বের ও পরের দিনকেও বুঝায়।’ পরন্তু ইবনে উমার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, ‘কুরবানী দিতে অক্ষম এমন ব্যক্তি ছাড়া আর কারো জন্য তাশরীকের দিনগুলিতে রোযা রাখার অনুমতি নেই।’[6]

তাশরীকের দিনগুলিতেও কুরবানী যবেহ করা যায়। তাই সর্বমোট চার দিন কুরবানী বৈধ। যেহেতু তাশরীকের দিন, কুরবানীর পরের তিন দিনকে বলা হয়।[7] আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তাশরীকের সমস্ত দিনগুলিতেই যবেহ করা যায়।’’[8] যেমন দিনের বেলায় সুযোগ না হলে রাতেও কুরবানী যবেহ করা যায়।[9] রাতে কুরবানী যবেহ করার ব্যাপারে হাদীস সহীহ নয়।[10] আর নামাযের নিষিদ্ধ সময়গুলোতে কুরবানী যবেহ করা নিষিদ্ধ নয়।

[1] (ফাতহুল বারী ২/৪৫৮, লাতায়িফুল মাআরিফ ৩২৯পৃঃ)

[2] (তফসীর কুরতুবী ৩/১,৩)

[3] (মুসলিম ১১৪১নং)

[4] (নাইলুল আওতার ৩/৩৫৮)

[5] (লাতায়িফুল মাআরিফ ৩৩৩পৃঃ)

[6] (বুখারী ১৮৯৮, ফাতহুল বারী ৪/২৪৩, নাইলুল আওতার ৪/২৯৪)

[7] (তাফসীর ইবনে কাষীর ৫/৪১২, আল-মুমতে ৭/৪৯৯)

[8] (আহমাদ ৪/৮২, বাইহাকী ৯/২৯৫, সিলসিলাহ সহীহাহ ৫/৬১৭)

[9] (আল-মুমতে ৭/৫০৩)

[10] (মাযাঃ ৪/২৩)