উপরোক্ত আয়াত সমূহে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ তারা আল্লাহর হক ও বান্দার হক দু’টিই নষ্ট করেছিল। আল্লাহর হক হিসাবে তারা বিশ্বাসের জগতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির পূজায় লিপ্ত হয়েছিল কিংবা আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করেছিল। তারা আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিয়েছিল। দুনিয়াবী ধনৈশ্বর্যে ও বিলাস-ব্যসনে ডুবে গিয়ে তারা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তাঁর হক সম্পর্কে গাফেল হয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে নিজেদের পাপিষ্ঠ জীবনের মুক্তির জন্য বিভিন্ন সৃষ্ট বস্ত্তকে শরীক সাব্যস্ত করে তাদের অসীলায় মুক্তি কামনা করত। এভাবে তারা আল্লাহ ও তাঁর গযবের ব্যাপারে নিঃশংক হয়ে গিয়েছিল। সেকারণ সকল নবীর ন্যায় শো‘আয়েব (আঃ) সর্বপ্রথম আক্বীদা সংশোধনের জন্য ‘তাওহীদে ইবাদত’-এর আহবান জানান। যাতে তারা সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করে এবং সকল ব্যাপারে স্রেফ আল্লাহর ও তাঁর নবীর আনুগত্য করে। তিনি নিজের নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ তাদেরকে মু‘জেযা প্রদর্শন করেন। যা স্বয়ং প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ’ রূপে তাঁর নিকটে আগমন করে।
দ্বিতীয়তঃ তারা মাপ ও ওযনে কম দিয়ে বান্দার হক নষ্ট করত। সেদিকে ইঙ্গিত করে শো‘আয়েব (আঃ) বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ কর এবং মানুষের দ্রব্যাদিতে কম দিয়ে তাদের ক্ষতি করো না’ (আ‘রাফ ৭/৮৫)। আয়াতের প্রথমাংশে খাছভাবে মাপ ও ওযন পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শেষাংশে সর্বপ্রকার হকে ত্রুটি করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সে হক মানুষের ধন-সম্পদ, ইযযত-আবরূ বা যেকোন বস্ত্তর সাথে সম্পর্কযুক্ত হৌক না কেন। বস্ত্ততঃ দ্রব্যাদির মাপ ও ওযনে কম দেওয়া যেমন মহা অপরাধ, তেমনি কারু ইযযত-আবরূ নষ্ট করা, কারু পদমর্যাদা অনুযায়ী তাকে সম্মান না করা, যাদের আনুগত্য করা যরূরী তাদের আনুগত্যে ত্রুটি করা অথবা যাকে সম্মান করা ওয়াজিব তার সম্মানে ত্রুটি করা ইত্যাদি সবই এ অপরাধের অন্তর্ভুক্ত, যা শো‘আয়েব (আঃ)-এর সম্প্রদায় করত। সে সমাজে মানীর মান ছিল না বা গুণীর কদর ছিল না।
তৃতীয়তঃ বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, সেখানে সংস্কার সাধিত হওয়ার পর’ (আ‘রাফ ৭/৮৫)। অর্থাৎ আল্লাহ পৃথিবীকে যেভাবে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সবদিক দিয়ে সুন্দর ও সামঞ্জস্যশীল করে সৃষ্টি করেছেন, তোমরা তাতে ব্যত্যয় ঘটিয়ো না এবং কোনরূপ অনর্থ সৃষ্টি করো না।
চতুর্থতঃ তোমরা মানুষকে ভীতি প্রদর্শন ও আল্লাহর পথে বাধা দানের উদ্দেশ্যে পথে-ঘাটে ওঁৎ পেতে থেকো না (আ‘রাফ ৭/৮৬)। এর দ্বারা মাদইয়ান বাসীদের আরেকটি মারাত্মক দোষের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তারা রাস্তার মোড়ে চৌকি বসিয়ে লোকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করত ও লুটপাট করত। সাথে সাথে তারা লোকদেরকে শো‘আয়েব (আঃ)-এর উপরে ঈমান আনতে নিষেধ করত ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করত। তারা সর্বদা আল্লাহর পথে বক্রতার সন্ধান করত’ (আ‘রাফ ৭/৮৬) এবং কোথাও অঙ্গুলি রাখার জায়গা পেলে আপত্তি ও সন্দেহের ঝড় তুলে মানুষকে সত্যধর্ম হ’তে বিমুখ করার চেষ্টায় থাকত।
মাদইয়ানবাসীদের আরেকটি দুষ্কর্ম ছিল যে, তারা প্রচলিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পার্শ্ব হ’তে সোনা ও রূপার কিছু অংশ কেটে রেখে সেগুলো বাজারে চালিয়ে দিত। শো‘আয়েব (আঃ) তাদেরকে একাজ থেকে নিষেধ করেন।[6]
পঞ্চমতঃ তাদের অকৃতজ্ঞতার বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘স্মরণ কর তোমরা যখন সংখ্যায় কম ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের বংশবৃদ্ধি করে তোমাদেরকে একটি বিরাট জাতিতে পরিণত করেছেন’ (আ‘রাফ ৭/৮৬)। তোমরা ধন-সম্পদে হীন ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রাচুর্য দান করেছেন। অথচ তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে নানাবিধ শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হয়েছ। অতএব তোমরা সাবধান হও এবং তোমাদের পূর্ববর্তী কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ ও কওমে লূত-এর ধ্বংসলীলার কথা স্মরণ কর (আ‘রাফ ৭/৮৬)। তাদের মর্মান্তিক পরিণাম ও অকল্পনীয় গযবের কথা মনে রেখে হিসাব-নিকাশ করে পা বাড়াও।
ষষ্ঠতঃ মাদইয়ানবাসীদের উত্থাপিত একটি সন্দেহের জবাব দেওয়া হয়েছে। তারা বলত যে, ঈমানদারগণ যদি ভাল ও সৎ হয়, আর আমরা কাফিররা যদি মন্দ ও পাপী হই, তাহ’লে আমাদের উভয় দলের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা একরূপ কেন? কাফিররা অপরাধী হ’লে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতেন। এর উত্তরে নবী বলেন, فَاصْبِرُوا حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَنَا وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ، ‘অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মাঝে ফায়ছালা করেন বস্ত্ততঃ তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী’ (আ‘রাফ ৭/৮৭)। অর্থাৎ আললাহ স্বীয় সহনশীলতা ও কৃপাগুণে পাপীদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর তারা যখন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়, তখন সত্য ও মিথ্যার ফায়ছালা নেমে আসে। তোমাদের অবস্থাও তদ্রূপ হবে। অবিশ্বাসী ও পাপীদের উপরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব সত্বর নাযিল হয়ে যাবে। একই ধরনের বক্তব্য উল্লেখিত হয়েছে সূরা হূদে (১১/৮৪-৮৬ আয়াতে)।
হযরত শো‘আয়েব (আঃ) একথাও বলেন যে, ‘(আমার এ দাওয়াতের জন্য) আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান বিশ্বপালনকর্তাই দেবেন’ (শু‘আরা ২৬/১৮০)। তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও শেষ দিবসের আশা রাখ। তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না’ (আনকাবূত ২৯/৩৬)।