বনী মুসতালেকের যুদ্ধেই আয়িশা (রাঃ) এর গলার হার হারিয়ে যায়। কারণ এই সফরে নাবী (ﷺ) এর স্ত্রী আয়িশা (রাঃ) শরীক ছিলেন। ফেরার পথে এক স্থানে যখন কাফেলা যাত্রা বিরতি করল তখন তিনি ইসেত্মনজা করার জন্য মাঠের দিকে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন গলার হার হারিয়ে গেছে। তা অনুসন্ধান করার জন্য তিনি পুনরায় মাঠের দিকে ফেরত গেলেন। এই সময় কাফেলার লোকেরা যাত্রা করল। লোকেরা আয়িশা (রাঃ) এর হাওদাজ (পালকী) দ্রুত উটের উপর উঠিয়ে বেঁধে দিল। তারা মনে করল আয়িশা (রাঃ) এর ভিতরেই আছেন। কারণ উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ) ছিলেন তখন খুব হালকা-পাতলা। তাই লোকেরা অনুভব করতে পারেনি।
এই সময় সাফওয়ান বিন মুআত্তাল কাফেলার পিছনে চলতেন। কোন জিনিষ পড়ে থাকলে তা উঠিয়ে নিতেন। সেখানে আয়িশা (রাঃ) কে দেখে তিনি ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজীউন পাঠ করলেন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। সাফওয়ান পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে আয়িশা (রাঃ) কে একবার দেখেছিলেন। তাই তিনি তাঁকে সহজেই চিনতে পেলেন। ইন্না লিল্লাহ ব্যতীত সাফওয়ান একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন নি। অতঃপর তিনি আদবের সাথে উট নিকটবর্তী করলেন। আয়িশা (রাঃ) উটের উপর আরোহন করলেন। সাফওয়ান উটের রশি ধরে পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। পরিশেষে আয়িশা (রাঃ) কাফেলার সাথে মিলিত হলেন। লোকেরা এই দৃশ্য দেখে নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী ব্যাখ্যা ও মন্তব্য করতে লাগল। আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই যখন বিষয়টি জানতে পারল তখন কোন প্রকার বিলম্ব না করেই সাফওয়ানের সাথে ব্যভিচারের তুহমত (অপবাদ) লাগিয়ে দিল। কথাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।
নাবী (ﷺ) এ ব্যাপারে প্রথমে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করলেন। অতঃপর তিনি সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। আলী (রাঃ) তালাক দেয়ার পরামর্শ দিলেন। কেননা বিষয়টি সন্দেহযুক্ত। আর সন্দেহযুক্ত কোন বিষয়ে সন্দেহ পরিহার করে নিশ্চিত বিষয়ের দিকে ধাবিত হওয়াই অধিক উপযুক্ত। আলী (রাঃ) এর উদ্দেশ্য ছিল, এতে করে নাবী (ﷺ) লোকদের বলাবলি শুনে যে পেরেশানীতে পড়েছিলেন, তা থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন।
কিন্তু উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) তালাক দেয়ার বিরোধীতা করলেন। কেননা তিনি জানতেন যে, রসূল (ﷺ) আয়িশা এবং তাঁর পিতা আবু বকর (রাঃ) এর সাথে অপরিসীম ভালবাসা রাখেন ও আয়িশা (রাঃ) এর পূর্ণ পবিত্রতা এবং দ্বীনদারী সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, আল্লাহর রসূলের প্রিয় জীবন সঙ্গিনীকে এ ধরণের অপরাধে জড়ানো হবে- এটা কখনই হতে পারেনা। এই বুনিয়াদ তথা আয়িশা (রাঃ) এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস থেকেই উসামা (রাঃ) কথা বলেছিলেন এবং আল্লাহর রসূল থেকে টেনশন দূর করার জন্যই আলী (রাঃ) উপরোক্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন। আয়িশা (রাঃ) এর পবিত্রতার ব্যাপারে তাঁর কোন প্রকার সন্দেহ থেকে তিনি কথাটি বলেন নি। মুনাফেকরা যেই রকম ধারণা করেছিল, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীবের জন্য সেই রকম মানের একজন সঙ্গিনী নির্ধারণ করবেন- তা হতেই পারেনা।
মূলতঃ সকল সাহাবীর পূর্ণ ইয়াকীন এটিই ছিল যে, আয়িশা (রাঃ) এর চরিত্র সম্পূর্ণ পবিত্র এবং সকল প্রকার সন্দেহ থেকে মুক্ত। নাবীয়ে আকরাম (ﷺ) এর জীবন সঙ্গিনীর ক্ষেত্রে এ ধরণের কল্পনা তাদের মনে আসতেই পারেনা। এ জন্যই আবু আইয়্যুব আনসারী এবং অন্যান্য সাহাবীগণ কথাটি শুনার সাথে সাথেই বলেছিলেন-
مَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهَذَا سُبْحَانَكَ هَذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ
‘‘এ বিষয়ে কথা বলা আমাদের উচিৎ নয়। আল্লাহ্ তো পবিত্র, মহান। এটা তো এক গুরুতর অপবাদ’’।[1]
এই ঘটনার পর পূর্ণ একমাস অহী আসা বন্ধ ছিল। পরিশেষে যখন আয়িশা (রাঃ) এর পবিত্রতায় কুরআন নাযিল হল এবং নাবী (ﷺ) তা পাঠ করলেন তখন আবু বকর (রাঃ) খুশীতে আত্মহারা হলেন। তিনি তাঁর কন্যা আয়িশাকে বলতে লাগলেনঃ উঠ! রসূল (ﷺ) এর শুকরিয়া আদায় কর। এই কথা শুনে আয়িশা (রাঃ) যেই সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন এবং যেই বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেনঃ মুসলিম জাতি তা চিরদিন স্মরণ রাখবে। তিনি বলেছিলেন- আল্লাহর শপথ! আমি এ ব্যাপারে কখনই তাঁর শুকরিয়া আদায় করবনা। আমি শুধু সেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব, যিনি আমার পবিত্রতায় কুরআন নাযিল করেছেন। এই কথায় তাঁর নির্মল চরিত্র, সৎসাহস এবং ঈমানী দৃঢ়তার বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে।
অহীর মাধ্যমে যখন আয়িশা (রাঃ) এর পবিত্রতা ছাবেত (প্রমাণিত) হয়ে গেল তখন তিনি অপবাদ প্রদানকারীদের প্রত্যেককেই আশিটি করে বেত্রাঘাত করলেন। কেননা তাদের মিথ্যাচারিতা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।