উহুদ যুদ্ধের দিন যারা শহীদ হন তাদের মধ্যে হামজাহ, মুসআব বিন উমাইর এবং হানযালা (রাঃ) অন্যতম। রসূল (ﷺ) দেখলেন যে, ফিরিস্তাগণ হানযালাকে গোসল দিচ্ছে। তাই তিনি সাহাবীদেরকে বললেন- তোমরা তার স্ত্রীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস কর। সাহাবীগণ হানযালার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদেরকে জানালেন যে, যখন যুদ্ধের ডাক আসল তখন তিনি তাঁর স্ত্রীর বুকের উপর ছিলেন। ডাক শুনে তিনি দ্রুত জিহাদের ময়দানে বের হয়ে পড়েন। হানযালার ঘটনা থেকে আলেমগণ দলীল গ্রহণ করেছেন যে, অপবিত্র অবস্থায় যদি কেউ শহীদ হয়, তবে তাকে গোসল দিতে হবে।
এই যুদ্ধে আরও যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের মধ্যে আমর বিন ছাবেতও অন্যতম। তিনি উসাইরাম নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ ইসলাম কবুল করতে অস্বীকার করতেন। যখন উহুদ যুদ্ধের দিন আসল তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালবাসা ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি ইসলামে প্রবেশ করলেন। তলোয়ার হাতে নিয়ে উহুদ প্রান্তরে রসূল (ﷺ) এর নিকট চলে গেলেন। এ সময় তাঁর হাতে কয়েকটি খেজুর ছিল। তিনি সেখান থেকে খাচ্ছিলেন। খেজুরগুলো তিনি এই বলে ফেলে দিলেন যে, আমি যদি এগুলো শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তাহলে তা হবে এক দীর্ঘ জীবন। অতঃপর তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়ে গেলেন।
তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কেউ অবগত ছিলনা। যুদ্ধ শেষে তার গোত্রীয় লোকেরা শহীদদের মধ্যে স্বজনদের খোঁজ করতে গিয়ে উসাইরামকে পেয়ে গেলেন। তখনও তাঁর রূহ বের হয়ে যায়নি। তারা বলে উঠলঃ আল্লাহর শপথ! এ দেখছি উসাইরাম। সে এখানে কি জন্যে আসল? ইতিপূর্বে তাকে তো আমরা ইসলামের প্রতি নাখোশ অবস্থায় দেখেছি। অতঃপর তারা তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল। হে উসাইরাম! তুমি কি কারণে উহুদ প্রান্তরে এসেছিলে? স্বীয় গোত্রের লোকদেরকে রক্ষা করতে? না ইসলামের প্রতি অনুরাগী হয়ে? সে উত্তর দিল, বরং ইসলামকে ভালবেসে এবং এতে অনুরাগী হয়ে। আমি আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। এরপর আমি আল্লাহর রসূলের পক্ষে যুদ্ধ করে এই অবস্থায় পৌঁছেছি। এই বলে তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। সাহাবীগণ রসূল (ﷺ) এর নিকট উসাইরামের ঘটনা বর্ণনা করলেন। তখন তিনি বললেন- উসাইরাম জান্নাতী হয়ে গেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন- তিনি আল্লাহর জন্য একটি সিজদাও করেন নি। তার সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে যে, তিনি সামান্য কাজ করে বিরাট বিনিময় পেয়ে গেলেন।
উহুদ যুদ্ধে আরও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন জাবের (রাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারাম। তিনি বলেন- উহুদ যুদ্ধের পূর্বে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, মুবাশশির বিন মুনযির আমাকে বলছেনঃ অচিরেই তুমি আমাদের সাথে মিলিত হবে। আমি বললামঃ কোথায়? তিনি বললেন- জান্নাতে। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াব। আমি মুবাশশিরকে বললামঃ তুমি কি বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়ে যাওনি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। তবে আমি পুনরায় জীবিত হয়েছি। স্বপ্নের বিষয়টি রসূল (ﷺ) কে বলা হলে তিনি বললেন- হে জাবেরের পিতা! তুমি অচিরেই আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবে। তিনি উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আমর ইবনুল জামুহ ছিলেন একজন লেংড়া সাহাবী। তাঁর ছিল চারজন যুবক পুত্র সন্তান। পুত্রদের সকলেই রসূল (ﷺ) এর সকল যুদ্ধেই অংশ নিতেন। রসূল (ﷺ) যখন উহুদের উদ্দেশ্যে বের হলেন তখন তিনিও তাঁর সাথে বের হতে চাইলেন।
সন্তানেরা তাঁকে বলল- আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাকে যুদ্ধে না যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আপনি বাড়িতেই থাকুন। আমরাই আপনার পক্ষ হতে যথেষ্ট। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনাকে জিহাদ থেকে রেহাই দিয়েছেন। আমর বিন জামুহ এ কথা শুনে রসূল (ﷺ) এর নিকট এসে বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আমার এই ছেলেরা আমাকে আপনার সাথে জিহাদে বের হতে বারণ করছে। আল্লাহর শপথ আমি আমার এই লেংড়া পা নিয়ে জান্নাতে বিচরণ করতে চাই। রসূল (ﷺ) তাঁকে বললেন- আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাকে জিহাদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। আর তাঁর ছেলেদেরকে বললেন- তোমরা যদি তাকে জিহাদে যেতে দাও, তাহলেও তোমাদের কোন ক্ষতি হবেনা। সম্ভবতঃ আল্লাহ্ তাকে শাহাদাতের মাধ্যমে সম্মানিত করবেন। অতঃপর তিনি রসূল (ﷺ) এর সাথে উহুদের দিন জিহাদে বের হয়ে শহীদ হলেন।
উহুদ যুদ্ধ শেষে আবু সুফিয়ান তিনবার বলল- মুহাম্মাদ কি লোকদের মধ্যে জীবিত আছে? নাবী (ﷺ) লোকদেরকে জবাব দিতে নিষেধ করলেন। অতঃপর আবু সুফিয়ান তিনবার বলল- লোকদের মধ্যে আবু কুহাফার পুত্র আছে কি? পুনরায় তিনবার বলল- লোকদের মধ্যে খাত্তাবের পুত্র কি আছে? অতঃপর আবু সুফিয়ান তার সাথীদের কাছে গিয়ে বলল- এরা তিন জনই নিহত হয়েছে। এ কথা শুনে উমার (রাঃ) আত্মসংবরণ করতে না পেরে বলে উঠলেনঃ আল্লাহর শপথ! হে আল্লাহর দুশমন! তোমার ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তুমি যাদের নাম ধরে ডাকলে তাদের সবাই জীবিত আছেন। তোমার কষ্টের দিনগুলো বাকী রয়েছে। আবু সুফিয়ান বলল- আজকের দিন বদরের যুদ্ধের দিনের প্রতিশোধ হয়ে গেল। আর যুদ্ধ তো পানির পাত্রের মত। অর্থাৎ পানির পাত্র যেমন একজনের হাতে স্থির থাকে না, তেমনি যুদ্ধে একবার একজন, আরেকবার অন্য জন জয়লাভ করে থাকে। তোমরা তোমাদের কিছু লোককে মুছলা অবস্থায় তথা নাক কান কাটা পাবে। অবশ্য এরূপ করার জন্য আমি নির্দেশ করিনি। এতে আমার কোন দুঃখও নেই। এরপর আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে কবিতার ছন্দ উচ্চারণ করতে লাগল- হোবলের জয়! হোবলের জয়! নাবী (ﷺ) তখন বললেন- তোমরা কি তার কথার জবাব দেবে না? তাঁরা বললেন- হে আল্লাহর রসূল! বলুনঃ আমরা কি বলে তার জবাব দেব? তিনি বললেন- তোমরা বলঃ আল্লাহ মহান! তিনি সবচেয়ে বড়। আবু সুফীয়ান বলল- আমাদের আছে উয্যা। তোমাদের কোন উয্যা নেই। নাবী (ﷺ) বললেন- তোমরা কি তার কথার জবাব দেবে না? তারা বললেন- হে আল্লাহর রসূল! বলুনঃ আমরা কি জবাব দেব? নাবী (ﷺ) বললেন- তোমরা বলঃ আমাদের মাওলা হলেন আল্লাহ। তোমাদের কোন মাওলা নেই।
অতঃপর আবু সুফিয়ান বলতে লাগল- আজ আমরা বদরের যুদ্ধের বদলা নিতে সক্ষম হয়েছি। যুদ্ধের ক্ষেত্রে এ রকম সমান সমান হয়েই থাকে। উমার (রাঃ) তখন বললেন- সমান সমান হয় কিভাবে? আমাদের শহীদগণ জান্নাতী। আর তোমাদের নিহতরা জাহান্নামী।
আবু সুফিয়ান যখন শিরক, কুফর ও দেব-দেবী নিয়ে বাহাদুরী করল নাবী (ﷺ) তখন তাওহীদের বড়ত্ব প্রকাশ ও মুসলমানদের একমাত্র মাবুদ আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করার জন্য জবাব দিতে বললেন। এর আগে যখন সে বলেছিল- তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ বেঁচে আছে কি? আবু বকর বেঁচে আছে কি? উমার বেঁচে আছে কি? তখন তিনি জবাব দিতে নিষেধ করেছেন। কেননা তখনও তাদের প্রতিশোধ স্পৃহা শেষ হয়নি। অতঃপর আবু সুফিয়ান যখন বলল- এদের তিনজনই নিহত হয়েছেন। তখন উমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি বললেন- হে আল্লাহর দুশমন তুমি মিথ্যা বলেছ। এদের সকলেই জীবিত আছেন।
উমারের এই ঘোষণায় বিপদজনক অবস্থাতেও সাহসিকতা ও শত্রুদের প্রতি সজাগ থাকার পরিচয় পাওয়া যায়। এতে আরও পরিচয় পাওয়া যায় মুহাম্মাদের অনুসারীগণ বীরত্বের অধিকারী এবং তারা শত্রুদের থেকে ভীত নন। তার জবাবে শত্রুদের মর্ম জ্বালা সৃষ্টি হয়েছিল। আবু সুফিয়ান যখন প্রত্যেকের খবর আলাদাভাবে জানতে চেয়েছিল তখন তিনি জবাব দেন নি। আর যখন তিনজনের কথা একসাথে বলেছিল তখন জবাব দিয়েছেন। এতে তিনি তাদের শক্তিকে দুর্বল করতে চেয়েছেন। সুতরাং প্রথমবার জবাব না দেয়া উত্তম ছিল। দ্বিতীয়বার জবাব দেয়া উত্তম হয়েছে। প্রথমবার জবাব না দিয়ে তিনি আবু সুফিয়ানকে অপমানিত করতে চেয়েছেন। সে যখন তাদের তিনজনকে মৃত জেনে খুশী হতে চেয়েছিল এবং অহংকার করতে চেয়েছিল তখন জবাব দিয়ে তিনি তাকে নিরাশ করতে চেয়েছেন। সুতরাং উমার (রাঃ) এর জবাবে রসূল (ﷺ) এর নিষেধাজ্ঞার বিরোধীতা ছিলনা।