আল্লাহর যেই বান্দা সর্বোত্তম জিহাদ করেছেন

সেই বান্দা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক কামেল যিনি জিহাদের সকল স্তর ও প্রকার বাস্তবায়ন করেছেন। এ জন্যই আল্লাহর সর্বশেষ নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) ছিলেন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক কামেল ও মর্যাদাবান। কারণ তিনি জিহাদের সকল স্তরই বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি আল্লাহর রাস্তায় যথার্থরূপে জিহাদ করেছেন। নবুওয়াত ও রিসালাত পাওয়ার পর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছেন। যখন তাঁর উপর কুরআনের এই আয়াত গুলো নাযিল হল-

يَاأَيُّهَا الٌمُدَّثِّرُ، قُمٌ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ وَلاَتَمْنُنْ تَسْتَكْثِرْ وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ

‘‘হে চাদরাবৃত! উঠ, সতর্ক কর। তোমার প্রভুর বড়ত্ব ঘোষণা কর। তোমার পোশাক পবিত্র কর এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো। অধিক প্রতিদানের আশায় অন্যকে কিছু দিবেনা এবং তোমার পালন কর্তার উদ্দেশ্যে সবর কর। (সূরা মুদ্দাসি্সর-৭৪:১-৭) তখনই তিনি দাওয়াতের কাজে লেগে গেলেন এবং ভালভাবে উঠে দাঁড়ালেন। দিনে ও রাতে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে দাওয়াতী কাজে মশগুল থাকলেন। আর যখন তাঁর উপর কুরআনের এই বাণী অবতীর্ণ হল-

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ

‘‘অতএব তুমি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দাও যা তোমাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেনা।’’ (সূরা হিজর-১৫:৯৪) তখন তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন এবং আল্লাহর কথা প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন। তাঁর জাতির লোককে খোলাখুলি দাওয়াত দিলেন। এতে কোন নিন্দুকের নিন্দা এবং সমালোচকের সমালোচনার ভয় করেন নি। ছোট-বড়, স্বাধীন-ক্রীতদাস, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো এবং জিন-ইনসান সকলকেই আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করার আহবান জানালেন। তাদের মূর্তীসমূহের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলেন এবং তাদের প্রতিমাগুলোর অক্ষমতার ব্যাপারে নানা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলেন। তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা এবং শির্কের ভয়াবহতার বর্ণনা দিতে লাগলেন। এতে মক্কাবাসী চরম ক্রোধে ফেটে পড়ল। শুরু হল ইসলামের বিরোধীতা। রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এবং মুসলিমগণ মুশরিকদের থেকে নানা প্রকারের শত্রুতা, অত্যাচার ও ঠাট্টা-বিদ্রম্নপের সম্মুখিন হতে লাগলেন।

এটিই আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিগত সুন্নাত (বৈশিষ্ট্য)। যে কেউ হকের দাওয়াত দিবে তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

مَا يُقَالُ لَكَ إِلا مَا قَدْ قِيلَ لِلرُّسُلِ مِنْ قَبْلِكَ إِنَّ رَبَّكَ لَذُو مَغْفِرَةٍ وَذُو عِقَابٍ أَلِيمٍ

‘‘আপনাকে তো তাই বলা হয়, যা বলা হত পূর্ববর্তী রসূলগণকে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার কাছে রয়েছে ক্ষমা এবং রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’। (সূরা ফুস্সিলাত-৪১:৪৩) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-

وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِىٍّ عَدُوّاً شَيَاطِينَ الإنْسِ وَالْجِنِّ

‘‘এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নাবীর জন্যে শত্রু করেছি শয়তান, মানব ও জিনকে’’ (সূরা আনআম-৬:১১২) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-

كَذَلِكَ مَا أتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّنْ رَسُولٍ إِلاَّ قَالُواْ سَاحِرٌ أوْ مَجْنُونٌ أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ

‘‘এমনিভাবে, তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল আগমন করেছে, তারা বলেছেঃ যাদুকর, না হয় উম্মাদ। তারা কি একে অপরকে এই উপদেশই দিয়ে গেছে? বস্ত্ততঃ ওরা দুষ্ট সম্প্রদায়’’।(সূরা যারিয়াত-৫১: ৫২-৫৩) এই আয়াতগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নাবীকে সান্তনা দিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন যে, পূর্ববর্তী নাবীগণ হচ্ছেন তাঁর আদর্শ। আর আল্লাহ্ তা‘আলা নাবীর অনুসারীদেরকেও এই বলে সান্তনা দিয়েছেন যে,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوْا الجَنَّةَ وَلَمَّا يأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ البَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيبٌ

‘‘তোমরা কি এই ধারণা করে নিয়েছ যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ তোমাদের সামনে সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করেনি, যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে? তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনিভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নাবী ও তার প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত এ কথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য। তোমরা শুনে নাও, আল্লাহর সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী’’। (সূরা বাকারা-২:২১৪) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-

أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لا يُفْتَنُونَ * وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِينَ صَدَقُواْ وَليَعْلَمَنَّ الْكَّاذِبِينَ * أمْ حَسِبَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّـيِّئاتِ أَن يَسْبِقُونَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ * مَنْ كَانَ يَرْجُواْ لِقَاءَ اللهِ فَإنَّ أَجَلَ اللهِ لآتٍ وَهُوَ السَّمِيعُ العَلِيمُ * وَمَنْ جَاهَدَ فَإنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ إِنَّ اللهَ لَغَنِىٌ عَنِ العَالَمِينَ * وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَـيِّئاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِى كَانُوا يَعْمَلُونَ * وَوَصَّيْنَا الإنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً وَإن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِى مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلا تُطِعْهُمَا، إِلَىَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَـبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ * وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِى الصَّالِحِينَ * وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللهِ فَإذَا أُوذِىَ فِى اللهِ، جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللهِ وَلئِنْ جَاءَ نَصْرٌ مِّن رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ أَوَ لَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِى صُدُورِ العَالَمِينَ

‘‘মানুষ কি মনে করে যে, তারা এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করেছি। ফলে তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। তদ্বারা আল্লাহ্ অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকেও। যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফয়সালা খুবই মন্দ। যে আল্লাহর সাক্ষাত কামনা করে, আল্লাহর সেই নির্ধারিত সময় অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। যে জিহাদ করে (কষ্ট স্বীকার করে), সে তো নিজের জন্যেই জিহাদ করে। আল্লাহ্ বিশ্ববাসী থেকে অমূখাপেক্ষী। আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজগুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব। আমি মানুষকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করোনা। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দেব যা কিছু তোমরা করতে। যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকাজ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত করব। কিছু লোক বলে, আমরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তারা নির্যাতিত হয়, তখন তারা মানুষের নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মত মনে করে। যখন তোমার পালনকর্তার কাছ থেকে কোন সাহায্য আসে তখন তারা বলতে থাকে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। বিশ্ববাসীর অন্তরে যা আছে, আল্লাহ্ কি তা সম্যক অবগত নন? (সূরা আনকাবুত-২৯:২-১০)

বান্দার উচিৎ উপরোক্ত আয়াতগুলো, তার বর্ণনাভঙ্গি এবং তার মধ্যকার হুকুম-আহকামগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। কেননা মানব জাতির কাছে যখন নাবী-রসূল প্রেরণ করা হয়েছে তখন তাদের সামনে দু’টি সুস্পষ্ট কথা চলে এসেছে। তাদের কেউ বলেছে- আমরা ঈমান আনয়ন করলাম। আবার অন্য একদল বলেছেঃ না, আমরা ঈমান আনয়ন করবনা। এই বলে তারা কুফরী ও অন্যায়ের পথে অবিচল রয়ে গেছে। যারা বলেছে, আমরা ঈমান আনয়ন করলাম, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ফিতনায় ফেলেছেন। এখানে ফিতনা অর্থ হচ্ছে বিপদাপদে ফেলে পরীক্ষা করা। যাতে করে সত্যবাদীগণ মিথ্যুকদের থেকে পৃথক হয়ে যায়। আর যারা ঈমান আনয়ন করেনি; বরং কুফরীতেই রয়ে গেছে তারা যেন এ কথা না ভাবে যে, আমরা আল্লাহকে অক্ষম করে দিয়েছি এবং তাঁকে পরাজিত করে ফেলেছি। অচিরেই তাকে তিনি টান দিবেন এবং পাকড়াও করবেন।

যারা নাবী-রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে এবং তাদের আনুগত্য করেছে, শত্রুরা তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেছে ও কষ্ট দিয়েছে। সুতরাং তারা এমন বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছেন, যা তাদেরকে কষ্ট দিয়েছে। আর যারা নাবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনেনি এবং তাদের আনুগত্যও করেনি, তাদেরকে উভয় জগতে শাস্তি দেয়া হয়েছে বা হবে। তাদের এই শাস্তি ও কষ্ট নাবী-রসূলদের অনুসারীদের কষ্টের চেয়ে অধিক যন্ত্রনাদায়ক ও দীর্ঘতম।

মোটকথা বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী সকল মানুষকেই কষ্ট ভোগ করতে হবে। কিন্তু বিশ্বাসীর কষ্ট আর অবিশ্বাসীর কষ্টের মধ্যে পার্থক্য এই যে, মুমিনগণ দুনিয়াতে প্রথমে দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতনের সম্মুখীন হবেন। অতঃপর দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের পরিণাম খুবই ভাল হবে। আর ঈমান থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নিবে প্রথমে তারা অল্প দিনের জন্য সুখ ও শান্তি পেলেও অচিরেই তারা স্থায়ী কষ্ট ও আযাবের দিকে ধাবিত হবে।

ইমাম শাফেঈ (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল- বান্দার জন্য কোন্টি উত্তম? কষ্টের মধ্যে ফেলে পরীক্ষা ছাড়াই তাকে প্রতিষ্ঠিত করা? না বিপদাপদে ফেলে পরীক্ষা করার পর প্রতিষ্ঠা দান করা? ইমাম শাফেঈ (রহঃ) জবাবে বললেন- প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে পরীক্ষা না করে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করেন না। তিনি উলুল আযম তথা সুদৃঢ় ঈমানের অধিকারী রসূলদেরকেও বিপদাপদের সম্মুখীন করেছেন। তারা যখন ধৈর্য ধারণ করেছেন তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করেছেন। সুতরাং কোন মুমিন যেন কখনই এ কথা না ভাবে যে, সে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ হতে রেহাই পাবে। যে সমস্ত মুমিন বিপদাপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হবে তাদের বুদ্ধি ও বিবেকের মধ্যেও পার্থক্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বুদ্ধিমান হচ্ছে ঐ মুমিন, যে অস্থায়ী সামান্য কষ্টের বিনিময়ে বিরাট এবং স্থায়ী কষ্টকে বিক্রি করে দিল আর সবচেয়ে নির্বোধ ও হতভাগ্য হল ঐ ব্যক্তি যে অস্থায়ী এবং সামান্য কষ্টের বদলে চিরস্থায়ী বিরাট কষ্টকে ক্রয় করে নিল।

যদি বলা হয় বিবেকবান ব্যক্তি কিভাবে এটি (মহা সাফল্যের বিনিময়ে ক্ষুদ্র বস্ত্ত) নির্বাচন করতে পারে? উত্তরে বলা যেতে পারে যে, নগদ ও বাকীর বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নফস সবসময় সামনে যা উপস্থিত আছে তাই গ্রহণ করতে চায়। দূরবর্তী কোন জিনিষের জন্য অপেক্ষা করতে চায়না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

كَلاَّ بَلْ تُحِبُّونَ العَاجِلَةَ * وَتَذَرُونَ الآخِرَةَ

‘‘কখনও না,বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে ভালবাস এবং পরকালকে উপেক্ষা কর’’।(সূরা কিয়ামাহ-৭৫:২০২১) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-

إِنَّ هَؤُلاءِ يُحِبُّونَ العَاجِلَةَ وَيَذَرُونَ وَرَاءَهُمْ يَوْماً ثَقِيلاً

 

‘‘নিশ্চয়ই এরা পার্থিব জীবনকে ভালবাসে এবং এক কঠিন দিবসকে পশ্চাতে ফেলে রাখে’’। (সূরা ইনসান-৭৬:২৭) মানুষ সমাজের অন্যান্য লোকদের সাথে বসবাস করে। মানুষের রয়েছে অনেক ইচ্ছা ও স্বপ্ন। যে মুমিন বান্দা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করে সেও মানুষ। সমাজের অন্যান্য মানুষেরা সাধারণতঃ চাইবে যে, সেও তাদের ইচ্ছানুপাতে চলুক। সে তাদের ইচ্ছা মোতাবেক না চললে; বরং তাদের বিরোধীতা করলে তারা তাকে কষ্ট ও শাস্তি দিবে। এটিই বাস্তব। আর সে যদি তাদের মর্জী অনুযায়ী চলে তাতেও সে কষ্ট পাবে। কখনও তাদের পক্ষ হতে আবার কখনও অন্যদের পক্ষ হতে। যেমন কোন দ্বীনদার ও মুত্তাকী লোক যদি ফাসেক ও জালেম সম্প্রদায়ের মাঝখানে বাস করে তাহলে সে ঐ সমস্ত জালেম ও পাপিষ্ঠদের পাপ কাজে সমর্থন ও সম্মতি দেয়া ব্যতীত কিংবা ফাসেকদের কর্মকান্ডে চুপ থাকা ব্যতীত কখনই তাদের অত্যাচার হতে রেহাই পাবেনা। সে যদি তাদেরকে সম্মতি দেয় কিংবা চুপ থাকে তাহলে প্রথমে হয়ত সে তাদের অনিষ্ট হতে রেহাই পাবে, কিন্তু অচিরেই তারা তার উপর চড়াও হবে, তারা তাকে কষ্ট দিবে এবং লাঞ্ছিত করবে। প্রথমে সে যেই পরিমাণ অত্যাচারের ভয় করেছিল এখন তাদের প্রতিবাদ করার কারণে সে আরও বহুগুণ বেশী অপমানের শিকার হবে। সে যদি তাদের অত্যাচার হতে বেঁচেও যায়, কিন্তু অন্যদের হাতে অবশ্যই লাঞ্ছিত হবে ও শাস্তি পাবে।

সুতরাং প্রথম হতেই মুমিন ও দ্বীনের দাঈদেরকে সাবধান হতে হবে এবং দৃঢ়তার সাথে ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে হবে। আয়িশা (রাঃ) আমীরুল মুমিনীন মুআবিয়া (রাঃ) কে যেই উপদেশ দিয়েছিলেন তার উপরই আমল করতে হবে। তিনি মুআবিয়া (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-

مَنْ أَرْضَى الله بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ الله مُؤْنَةَ النَّاسِوَمَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ الله لم يُغْنُوا عَنْهُ مِنَ الله شَيْئَاً

‘‘যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে মানুষের কষ্ট হতে তাঁকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করবে মানুষেরা তাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করতে পারবেনা’’।

যে ব্যক্তি পৃথিবী ও তার মধ্যে বসবাসকারী মানুষের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করবে সে ঐ সমস্ত লোকদের মধ্যে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবে যারা জালেম শাসক এবং বিদআতীদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাহায্য করে। আল্লাহ্ যাকে হিদায়াত করেন, সঠিক পথ দেখান এবং কুপ্রবৃত্তির অকল্যাণ থেকে বাঁচান সেই কেবল তাদের হারাম ও অন্যায় কাজে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকে এবং তাদের জুলুম নির্যাতনে ধৈর্য ধারণ করে। পরিণামে দুনিয়া ও আখিরাতে সে সুফল প্রাপ্ত হয়। যেমন সাফল্য অর্জিত হয়েছে নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীদের জন্য, আনসার ও মুহাজিরদের জন্য এবং পরীক্ষার কবলে পতিত উলামায়ে কিরামদের জন্য।

দ্বীনের দাঈগণ যেহেতু কষ্ট ও নির্যাতন হতে রেহাই পাবেনা তাই আল্লাহ্ তা‘আলা এই অস্থায়ী কষ্ট ভোগকারীদেরকে শান্তনা দিয়ে বলেন-

مَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللهِ لآتٍ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ إِنَّ اللهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

‘‘যে আল্লাহর সাক্ষাত কামনা করে, আল্লাহর সেই নির্ধারিত সময় অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। যে ব্যক্তি জিহাদ করে (কষ্ট স্বীকার করে), সে তো নিজের জন্যেই কষ্ট স্বীকার করে। আল্লাহ্ বিশ্ববাসী থেকে অমূখাপেক্ষী’’। (সূরা আনকাবুত-২৯:৫-৬) সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা এই অস্থায়ী কষ্টের জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করেছেন। আর সেটি হচ্ছে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত দিবস। বান্দা যেই স্বাদ উপভোগ করার জন্য কষ্ট ভোগ করেছে সেই কারণে সে দিন বান্দা অফুরন্ত স্বাদ গ্রহণ করবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে স্বীয় সাক্ষাত প্রদানের ওয়াদা করেছেন। যাতে বান্দা তাঁর সাক্ষাতের আশায় ক্ষণস্থায়ী দুঃখ-কষ্ট সহজেই ভোগ করতে পারে। বরং কখনও কোন কোন বান্দার অবস্থা এ রকম হয় যে, সে আল্লাহর সাক্ষাতের আগ্রহের মধ্যে ডুবে গিয়ে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায় এবং তা অনুভব করেনা। এ জন্যই নাবী (ﷺ) তাঁর প্রভুর সাক্ষাতের আকাঙ্খা করেছেন। আল্লাহর সাক্ষাতের ইচ্ছা ও কামনা অন্তরে জাগ্রত হওয়া বিরাট একটি নিয়ামাত। তবে এই নিয়ামাতটি পাওয়ার জন্য কিছু মৌখিক ও শারীরিক আমল রয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা সেই কথাগুলো শুনেন এবং সেই আমলগুলো সম্পর্কে অবগত আছেন। যারা এই নিয়ামাতটি পাওয়ার হকদার আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের সম্পর্কেও অবগত আছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَكَذَلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لِيَقُولُوا أَهَؤُلاءِ مَنَّ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنْ بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ

‘‘আর এভাবেই আমি কিছু লোককে কিছু লোক দ্বারা পরীক্ষায় ফেলেছি- যাতে তারা বলে যে, এদেরকেই কি আমাদের সবার মধ্য থেকে আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহ দান করেছেন? আল্লাহ্ কি কৃতজ্ঞদের সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত নন’’? (সূরা আনআম-৬:৫৩) বান্দার কাছ থেকে কোন নিয়ামাত ছুটে গেলে সে যেন এই আয়াতের এই অংশটি পাঠ করে- আল্লাহ্ কি কৃতজ্ঞদের সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত নন?

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুজাহিদদেরকে অন্য আরেকটি শান্তনা এভাবে দিয়েছেন যে, আল্লাহর রাস্তায় তাদের জিহাদ মূলতঃ তাদের নিজেদের জন্যই। এর ফল তারাই ভোগ করবে। আর আল্লাহ্ তা‘আলা বিশ্ববাসীদের প্রতি সম্পূর্ণ অমূখাপেক্ষী। এই জিহাদের ফায়দা তারাই হাসিল করবে। আল্লাহ্ তা‘আলার এতে কোন লাভ নেই।

আর মহান আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর পথে জিহাদ এবং তাঁর প্রতি অবিচল ঈমান তাদেরকে সালেহীনদের কাতারে শামিল করবে।

অতঃপর যারা বিনা ইলমে এবং না বুঝে ঈমান আনয়ন করে তাদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদেরকে যখন আল্লাহর পথে কষ্ট দেয়া হয় তখন তারা মানুষের দেয়া কষ্টকে আল্লাহর সেই আযাবের মতই মনে করে, যা থেকে বাঁচার জন্যই তারা ঈমান আনয়ন করেছে। আর আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তার সৈনিক ও বন্ধুদেরকে বিজয় দান করেন তখন তারা বলে আমরা তোমাদের সাথেই ছিলাম। তাদের অন্তরে যে নিফাক রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ অবগত আছেন।

মোটকথা আল্লাহ্ তা‘আলার হিকমতের দাবী হচ্ছে, তিনি অবশ্যই মানুষদেরকে পরীক্ষা করবেন। এর মাধ্যমে পবিত্র আত্মা অপবিত্র আত্মা থেকে আলাদা হয়ে যাবে, কে তার বন্ধুত্ব ও সম্মান পাওয়ার হকদার আর কে তা পাওয়ার হকদার নয় তাও পরিস্কার হয়ে যাবে। কেননা নফস্ মূলতঃ জাহেল ও জালেম হয়ে থাকে। অজ্ঞতার কারণে নফসের মধ্যে এমন অপবিত্রতা প্রবেশ করে যা থেকে আত্মাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা জরুরী। যদি এই দুনিয়া হতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আত্মা নিয়ে যেতে পারে তাহলে তো ভাল। অন্যথায় তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। বান্দা যখন পাক ও পবিত্র হবে তখনই তাকে জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে।