সহীহ সূত্রে নাবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন- তোমাদের কেউ যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে তখন সে যেন কাজটি শুরু করার পূর্বে দু’রাকআত সলাত পড়ে নেয়। এর মাধ্যমে তিনি জাহেলী যামানার অভ্যাসকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। অন্ধকার যুগের লোকেরা সফরে বের হওয়ার পূর্বে পাখি উড়িয়ে এবং তীরের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করত। এ রকমই মুশরিকরা লটারীর মাধ্যমে ভবিষ্যতের ঐ সমস্ত বিষয় জানার চেষ্টা করে, যা তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কাজটিকে ভাগ্য পরীক্ষা বলে নাম দেয়া হয়।[1]
ইসলাম এসে পূর্বের এই প্রথাগুলো পরিবর্তন করে এমন একটি দু’আ নির্ধারণ করেছে, যাতে রয়েছে তাওহীদ, আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষীতা, ইবাদত, একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা এবং সেই আল্লাহর কাছে কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করা, যার হাতেই রয়েছে সকল প্রকার কল্যাণ, যিনি ব্যতীত অন্য কেউ কল্যাণ দিতে পারেনা এবং অন্যায়কে প্রতিহত করতে পারে না। তিনি যদি তাঁর কোন বান্দার জন্য রহমতের দরজা খুলে দেন, কেউ তা বন্ধ করতে পারেনা এবং তিনি যদি তা বন্ধ করে দেন পাখি উড়িয়ে, তারকা গণনা করে কিংবা নক্ষত্রের উদয়াস্তাচল নির্ণয় করে কেউ তা খুলে দিতে পারবে না। এটি হচ্ছে সেই বরকতময় দু’আ যা সৌভাগ্যবানদের জন্য সৌভাগ্যের নিশানা স্বরূপ; যারা আল্লাহর সাথে অন্যদেরকেও মাবুদ সাব্যস্ত করে সেই সমস্ত মুশরিকের জন্য নয়। এই দু’আতে রয়েছে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ সিফাত, রুবুবীয়াত, আল্লাহর উপর ভরসা করার ঘোষণা এবং বান্দার এ কথার স্বীকৃতি প্রদান যে, সে নিজেও নিজের কল্যাণ সম্পর্কে অজ্ঞ ও তা অর্জনে অক্ষম।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) থেকে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর কাছেই কল্যাণ প্রার্থনা করা ও তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা বান্দার সৌভাগ্যের লক্ষণ এবং আল্লাহর কাছে ইসেত্মখারা না করা (কল্যাণ না চাওয়া) ও তাকদীরের নির্ধারণের প্রতি সন্তুষ্ট না থাকা বান্দার দুর্ভাগ্যের আলামত।
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) সফরের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যানবাহনে আরোহন করে তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন। অতঃপর এই দু’আ পাঠ করতেনঃ
سُبْحَانَ الَّذِى سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ اللّٰهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِى سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى اللّٰهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ اللّٰهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِى السَّفَرِ وَالْخَلِيفَةُ فِى الأَهْلِ اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوءِ الْمُنْقَلَبِ فِى الْمَالِ وَالأَهْلِ
‘‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি আমাদের জন্য এসব জিনিষকে বশীভূত করে দিয়েছেন। আমরা অবশ্যই আমাদের পালনকর্তার দিকে ফিরে যাবো এবং আমরা এদেরকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলামনা’’। হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে এই সফরে নেকী ও তাকওয়া প্রার্থনা করছি। আর তোমার কাছে এমন আমল করার তাওফীক প্রার্থনা করছি, যাতে তুমি খুশী হও। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের উপর এই সফরকে সহজ করে দাও, এর দূরত্বকে কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ! সফরে তুমিই আমাদের সাথী এবং ঘরে অবস্থানকারী স্বজনদের দেখা-শুনাকারী। হে আল্লাহ্! তুমি সফরে আমাদের সাথে থাক এবং আমাদের পরিবার-পরিজনের হেফাজত কর। ভ্রমণ থেকে ফেরত এসে তিনি এই দু’আ পাঠ করতেনঃ
آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ
‘‘আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, ইবাদতকারী এবং আমাদের রবের প্রশংসাকারী’’। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বর্ণনা করেন, নাবী (ﷺ) যখন শহরে প্রবেশ করতেন তখন বলতেন-
تَوْبَاً تَوْباً، لِرَبِّنَا أوْباً لا يُغادِرُ عَلَيْنَا حَوْباً
‘‘আমরা সফর থেকে ফেরত আসছি, আমাদের প্রভুর কাছে তাওবা করছি, তিনি আমাদের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন’’।
তিনি যখন বাহনে পা রাখতেন তখন বিসমিল্লাহ্ বলতেন এবং তাতে সোজা হয়ে বসে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলতেন। অতঃপর বলতেন-
سُبْحَانَ الَّذِى سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ
নাবী (ﷺ) যখন তার কোন সাহাবীকে সফরে যাওয়ার সময় বিদায় জানাতেন তখন বলতেন-
أَسْتَوْدِعُ الله دِينَكَ وَأَمَانَتَكَ وَخَواتيمَ عَمَلِكَ
‘‘আমি তোমার দ্বীন, তোমার আমানত এবং শেষ আমল আল্লাহর উপর সোপর্দ করে দিচ্ছি’’। এক লোক নাবী (ﷺ)কে বলল- আমি সফরে বের হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছি। তিনি তখন বললেন- আমি তোমাকে আল্লাহর ভয় এবং প্রতিটি উঁচু স্থান দিয়ে যাওয়ার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলার উপদেশ দিচ্ছি। নাবী (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীগণ সফর অবস্থায় যখন উঁচু স্থানে উঠতেন তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন এবং যখন নীচু স্থানে অবতরণ করতেন তখন ‘সুবহানাল্লাহ্’ বলতেন। সলাতেও এভাবেই তাকবীর ও তাসবীহ পাঠ করা হয়। অর্থাৎ রুকু ও সিজাদাতে মাথা ও শরীর নত করা হয় বলেই তাতে ‘সুবহানা রাববীয়াল আলা’ পাঠ করা হয় আর সিজদা ও বসা হতে উঠার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলার বিধান রাখা হয়েছে। আনাস (রাঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) যখন যমীনের কোন উঁচু স্থানে উঠতেন তখন বলতেন-
اللّٰهُمَّ لَكَ الشَّرَفُ عَلَى كُلِّ شَرَفٍ وَلَكَ الحَمْدُ عَلَى كُلِّ حَالٍ
‘‘হে আল্লাহ্! সকল বড়র (উচ্চতার) উপর তোমার বড়ত্ব এবং সকল অবস্থায় তোমার প্রশংসা’’। তিনি বলেছেন- যেই কাফেলার সাথে কুকুর এবং ঘন্টা থাকে সেই কাফেলায় ফিরিস্তাগণ অংশগ্রহণ করেনা।
নাবী (ﷺ) রাতে একা ভ্রমণ করা অপছন্দ করতেন। তিনি বলেন- একা ভ্রমণ করার ক্ষতি সম্পর্কে মানুষেরা যদি জানতে পারত তাহলে রাতে কেউ একা ভ্রমণ করতনা। শুধু তাই নয়, তিনি একা ভ্রমণ করতে নিষেধও করতেন। তিনি বলেছেন- একা ভ্রমণকারী একটি শয়তান, দু’জন ভ্রমণকারী দু’টি শয়তান এবং তিন জন মিলে একটি কাফেলা তৈরী হয়।[2] তিনি বলতেন- তোমাদের কেউ যখন কোন স্থানে অবতরণ করে তখন সে যেন এই দু’আটি পাঠ করেঃ
أعُوذُ بِكَلِمَاتِ الله التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
‘‘আল্লাহর কলেমাসমূহের উসীলায় আমি সেই অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। এই দু’আটি পাঠ করলে সেই স্থান ত্যাগ না করা পর্যন্ত কোন কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবেনা।
নাবী (ﷺ) বলতেন- যখন তোমরা ঘাস ও তৃণলতা বিশিষ্ট যমীনের উপর দিয়ে চলবে তখন তোমরা যমীন থেকে উটের হক প্রদান কর (উটকে ঘাস খাওয়ার সুযোগ দাও)। আর যখন বিরান ভুমির উপর দিয়ে যাবে তখন সেই স্থানের উপর দিয়ে দ্রুত চল। যখন তোমরা রাতে কোথাও যাত্রা বিরতি করবে তখন রাস্তার উপর অবস্থান করবেনা। কেননা রাতে জীব-জানোয়ারও পথ দিয়ে চলাচল করে এবং ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ রাতের বেলায় তাতে আশ্রয় নেয়।
তিনি এই আশঙ্কায় শত্রুদের দেশে কুরআন নিয়ে ভ্রমণ করতে নিষেধ করতেন, যাতে শত্রুরা কুরআনকে অপদস্ত করার সুযোগ না পায়। যেই পথ অতিক্রম করতে এক দিন এক রাত সময় লাগে সেই পরিমাণ দূরত্বে তিনি মহিলাদেরকে মাহরাম ছাড়া একা ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছেন। সফরের কাজ শেষ করে তিনি মুসাফিরকে দ্রুত ঘরে ফেরার আদেশ করতেন। দীর্ঘ দিন নিজ বাসস্থানের বাইরে থাকার পর তিনি আগন্তুককে রাতের বেলায় বিনা খবরে হঠাৎ করে গৃহে প্রবেশ করতে নিষেধ করতেন।[3]
নাবী (ﷺ) যখন সফর থেকে ফেরত আসতেন তখন নিজ পরিবারের শিশুদের সাথে সর্বাগ্রে মিলিত হতেন। আব্দুল্লাহ বিন জাফর (রাঃ) বলেন- তিনি একবার সফর থেকে ফিরলেন। আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি আমাকে বাহনে তার সামনে বসালেন। অতঃপর ফাতেমা (রাঃ) এর কোন একটি ছেলে হাসান বা হুসাইনকে আনয়ন করা হলে তিনি তাকে বাহনে তাঁর পিছনে বসালেন। আমরা তিনজন মিলে একটি বাহনে আরোহন করে মদ্বীনায় প্রবেশ করলাম। সফর থেকে আগমণকারীর সাথে তিনি কোলাকুলি করতেন। পরিবারের কোন লোক হলে তিনি তাকে চুম্বন করতেন। ইমাম শাবী (রহঃ) বলেন- রসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণ যখন সফর থেকে ফিরতেন তখন তারা কোলাকুলি করতেন। সফর থেকে ফিরে তিনি মসজিদ থেকে কাজ শুরু করতেন। তিনি তাতে দু’রাকআত সলাত পড়তেন।
[2]. একা সফর করা মাকরুহ। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একা সফর করাকে শয়তানের কাজ বলেছেন। কারণ শয়তান লাগামহীনভাবে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকেই চলে, যা ইচ্ছা তাই করে। এমনিভাবে একা ভ্রমণকারীর জন্য সফর অবস্থায় কোন সাহায্যকারী থাকে না, ভুল করলে সংশোধন করে দেয়ার মত কেউ থাকে না এবং পথ হারিয়ে ফেললে পথ দেখিয়ে দেয়ার লোক খুঁজে পায়না। তা ছাড়া একা ভ্রমণকারী বিপদাপদে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় অসুস্থ হলে সেবা করার জন্য কাউকে পাবে না। সে মারা গেলে তার কাফন-দাফন ও স্বজনদেরকে খবর দেয়ারও কেউ থাকে না। মূলতঃ অবস্থাভেদে একা ভ্রমণের হুকুম ভিন্নও হতে পারে। বিশেষ করে যখন কোন সাথী পাওয়া যাবে না এবং ভ্রমণ করা অত্যন্ত জরুরী তখন একা ভ্রমণ করা জায়েয। দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করার অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমন বিপদাপদে পরস্পর সহযোগিতা করা, কাফেলার কেউ অসুস্থ হলে অন্যদের সেবা করা, জামআতে সলাত পড়া ইত্যাদি।
[3]. এমতাবস্থায় যদি হঠাৎ করে গৃহে প্রবেশ করা হয় তাহলে নিজ স্ত্রীকে এলোকেশে ও অপছন্দীয় অবস্থায় দেখার আশঙ্কা রয়েছে। পরিণামে স্বামীর পক্ষ হতে এমন আচরণ প্রকাশ পেতে পারে, যা কোন স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ হতে কামনা করে না। তাই রাতের বেলা হঠাৎ প্রবেশ না করে যদি আগাম সংবাদ দেয়া হয়, তাহলে স্ত্রী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সাজগোজ গ্রহণ করার সুযোগ পাবে এবং স্বামীকে প্রফুল্ল মনে গ্রহণ করতে পারবে। তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হঠাৎ করে রাতের বেলায় স্ত্রীর কাছে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন।