ইমাম ইবনে আব্দিল বার আসারের মাধ্যমে দলীল উল্লেখ করার পর তাক্বলীদকে নিন্দনীয় ও নিষেধ উল্লেখ করে বলেন, ফক্বীহ ও আহলে নাযরদের একটি দল নাযরিয়া (চিন্তাগত) ও আকলিয়া (বুদ্ধিজাত) দলীল দ্বারা তাক্বলীদকে বৈধ মনে করেন। অতঃপর তিনি বলেন:[1]
‘‘এ ব্যাপারে আমি মাযিনী (রাহ.) এর চেয়ে উত্তম কথা আর কাউকে বলতে দেখি নি। আর তা হলো, যে তাক্বলীদ দিয়ে বিধান বাস্তবায়ন করতে চায়, তাকে যদি বলা হয়, তুমি যে বিধানটি বাস্তবায়ন করলে এ ব্যাপারে কি কোন দলীল রয়েছে? যদি সে উত্তরে বলে যে হাঁ, তাহলে তাক্বলীদ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এ ক্ষেত্রে দলীলটাই তার জন্য আবশ্যক হয়ে গেছে, তাক্বলীদ নয়।
আর যদি বলে দলীল ছাড়াই এর বিধান দিয়েছি। তাহলে তাকে বলা হবে, তুমি মানুষ খুন কর না কেন? গুপ্তাঙ্গ বৈধ মনে কর না কেন ও সম্পদ বিনষ্ট কর না কেন? অথচ আল্লাহ্ কি এগুলোকে দলীল ছাড়াই হারাম করেছেন? আল্লাহ্ তায়ালা বলেন:
﴿إِنْ عِنْدَكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بِهَذَا﴾
তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ নেই? (সূরা ইউনূস-৬৮) অর্থাৎ: এ ব্যাপারে কি কোন প্রমাণ রয়েছে?
যদি সে বলে, দলীল না জানলেও আমি জানি যে এ ব্যাপারে আমি ঠিকই করছি। কেননা আমি এ ব্যাপারে একজন বড় বিদ্বানের তাক্বলীদ করেছি। আর আমার বিশ্বাস যে, তিনি কখনও দলীল ছাড়া কথা বলতে পারেন না। যা হয়তো আমার কাছে অস্পষ্ট রয়েছে।
তাহলে তাকে বলা হবে, যখন তুমি তোমার শিক্ষকের তাক্বলীদকে বৈধ মনে করছ। কেননা তোমার বিশ্বাস যে, তিনি দলীল ছাড়া কথা বলেন না, যা হয়তো তোমার কাছে গোপন রয়েছে। তাহলে তো তোমার শিক্ষকের যিনি শিক্ষক তার তাক্বলীদ করা বেশি উত্তম। কেননা তিনিও দলীল ছাড়া কথা বলেন না, যা হয়তো তোমার শিক্ষকের কাছে গোপন রয়েছে। যেমনটি তোমার শিক্ষক দলীল ছাড়া কথা বলেন না যা হয়তো তোমার কাছে গোপন রয়েছে। যদি সে বলে যে, আসলে কথাটি ঠিকই বলেছেন। তাহলে এমন কথা মেনে নিলে সে তার শিক্ষকের তাক্বলীদসহ উর্ধ্বতন যত শিক্ষক রয়েছে সকলেরই তাক্বলীদ বাতিল করল। এভাবে বিষয়টি রাসূল (ﷺ) এর সাহাবাগণ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
আর যদি সে এটাকে অস্বীকার করে, তাহলে তার কথা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তাকে বলা হবে যে, কিভাবে তুমি একজন ছোট ব্যক্তির তাক্বলীদ করছ যিনি স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী? আর এর চেয়ে বড় ব্যক্তির তাক্বলীদ করা বৈধ মনে করছ না যিনি তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। এটাতো বৈষম্যপূর্ণ?
যদি সে বলে যে, আমার শিক্ষক ছোট হলেও তার উর্ধ্বতন ব্যক্তির কাছ থেকেই জ্ঞানার্জন করেছেন। সুতরাং তিনি যা গ্রহণ করেছেন তা তিনি স্বচক্ষ দেখেছেন। আর তিনি যা পরিত্যাগ করেছেন তাও তিনি জানেন।
এক্ষেত্রে তাকে বলা হবে, এটা পূর্বের মতোই হলো, তুমি তোমার শিক্ষকের কাছ থেকে জেনেছ। আর তোমার শিক্ষক তার উর্ধ্বতন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে তার তাক্বলীদ করাই আবশ্যক, তোমার শিক্ষকের তাক্বলীদ ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এরূপভাবে তুমি যদি ভেবে দেখ, তাহলে দেখবে তোমার শিক্ষকের চেয়ে তোমার নাফসের তাক্বলীদ করাই বেশি উত্তম। কেননা তুমি তোমার শিক্ষকের ও তার উর্ধ্বতন শিক্ষকের জ্ঞান একত্রিত করেছ।
তাক্বলীদ পন্থিদের এ কথার মর্মার্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, সাহাবাদের তাক্বলীদ করার চেয়ে একজন কম বিজ্ঞ আলিমের তাক্বলিদ করা শ্রেয়, যিনি অভিজ্ঞতায় কম এমন আলিমের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। তাদের কথা অনুযায়ী এটাও বুঝা যায় যে, শীর্ষ মুক্বালিস্নদের জন্য তাক্বলীদুত তাবেঈ (অনুসারীর অনুসরণ) হওয়া আবশ্যক। আর অনুসারী সেই, যে নিমেণর স্তরের হয়ে থাকে। কেননা একটি নিয়ম আছে যে, উচ্চমানের ব্যক্তি নিম্নমানের ব্যক্তির উর্ধ্বে থাকে। এ কথাটিই তাদের যুক্তি বাতিল ও পরিত্যাজ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
অতঃপর আবূ উমার (রাহ.) বলেন, যে তাক্বলীদের কথা বলে, তাকে যদি বলা হয় তুমি কেন তাক্বলীদের কথা বলছ ? সালাফগণ (পূর্বসূরী) তো তাক্বলীদ করেন নি, অতএব তুমি কেন তাদের বিরোধিতা করছ? উত্তরে সে যদি বলে, আমি তাক্বলীদ করি এ জন্যই যে, আল্লাহ্র কিতাব ব্যাখ্যা করার জ্ঞান আমার নেই এবং রাসূল (ﷺ) এর হাদীস আয়ত্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমি যার তাক্বলীদ করি তিনি এ বিষয়গুলো জানেন। সুতরাং তিনি আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী এ দেখেই আমি তার তাক্বলীদ করি। তাহলে তাকে এর জবাবে বলা হবে, বিদ্বানগণ যখন কুরআন হাদীস বা কোন ঘটনার ব্যাখ্যার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং তাদের মতামতের উপর ইজমা সাব্যাস্ত হয়; তখন সেই মতটা সঠিক বলে বিবেচিত হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই । কিন্তু যখন তারা এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে ইজমা না করে মতভেদ করেন, তখন তুমি এক্ষেত্রে কতিপয়ের তাক্বলীদ কর ও কতিপয়কে বাদ দিয়ে রাখ। কতিপয়ের তাক্বলীদ করা ও কতিপয়কে বাদ দেয়ার ব্যাপারে তোমার দলীল কোথায়? অথচ প্রত্যেকেই তো আলিম। এমনও তো হতে পারে, তুমি যে আলিমের মতামত বাদ দিচ্ছ তিনি তোমার মাযহাবের আলিমের চেয়ে বেশি জ্ঞানী। সে যদি আবার বলে, আমি তার তাক্বলীদ করছি এই জেনে যে, এটাই ঠিক।
তাহলে তাকে বলা হবে, তুমি কি এটা কুরআন, হাদীস ও ইজমার দলীলের মাধ্যমে জেনেছ? যদি সে উত্তরে বলে যে, হাঁ! তাহলে তার তাক্বলীদ বাতিল হবে এবং তার দাবির পেছনে দলীল চাওয়া হবে।
আর যদি সে বলে, তিনি আমার চেয়ে বেশি জানেন তাই আমি তার তাক্বলীদ করি। তখন তাকে বলা হবে, তাহলে তোমার চেয়ে যে সব আলিম বেশি জানেন, তাদের প্রত্যেকেরই তাক্বলীদ কর। এতে তুমি তোমার চেয়ে জ্ঞানী অনেককেই পাবে, তাই তুমি যার তাক্বলীদ কর শুধু তাকেই নির্দিষ্ট করবে না। কেননা তুমি একটি মাত্র কারণ দেখিয়েছ যে, ‘‘তিনি আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী’’।
যদি সে বলে যে, তিনি সকল মানুষের চেয়ে জ্ঞানী তাই আমি তার তাক্বলীদ করি। এর জবাবে তাকে বলা হবে, তাহলে তো তিনি সাহাবাদের চেয়েও জ্ঞানী। আর মন্দ কথা হিসেবে এটিই তার জন্য যথেষ্ট।
যদি সে আবারও বলে, আমি কতিপয় সাহাবার তাক্বলীদ করব। তাহলে তাকে বলা হবে, তাদের মধ্যে কতিপয়ের তাক্বলীদ বর্জন করার কারণ কি? এমনও তো হতে পারে যে, তাদের মধ্যে যার কথাকে বর্জন করছ তার কথাটিই উত্তম তুমি যার কথা গ্রহণ করছ তার চেয়ে। এমনি ভাবে কোন ব্যক্তির মর্যাদার কারণেই তার কথা বিশুদ্ধ হবে এমনটি নয়। বরং সে কথাই বিশুদ্ধ যার পেছনে দলীল রয়েছে।
ইবনে মাযীন ঈসা বিন দিনার হতে, তিনি ইবনে কাইয়ুম হতে, তিনি মালিক হতে বর্ণনা করে বলেন ‘‘মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হলেই যে তার প্রত্যেকটি কথার অনুসরণ করতে হবে এমনটি আবশ্যক নয়। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
﴿الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ﴾
যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে অতঃপর এর যা উত্তম তা অনুসরণ করে (সূরা যুমার-১৮)।
যদি কেউ বলে যে, আমার অবহেলা ও স্বল্প জ্ঞান আমাকে তাক্বলীদ করতে উদ্বুদ্ধ করছে।
তাহলে তাকে বলা হবে: যে ব্যক্তি শরীয়াতের কোন বিধানের ব্যাপারে সমস্যাগ্রসত্ম হয়ে এমন আলিমের তাক্বলীদ করে যার জ্ঞানের ব্যাপারে সবার ঐকমত্য রয়েছে। ফলে যদি কোন ব্যক্তি সেই আলিমকে জিজ্ঞেস করে, আর আলিম তার উত্তর দেন, তাহলে এ ব্যক্তিটি ওযর প্রাপ্ত। কেননা তার যতটুকু দায়িত্ব ছিল তা সে আদায় করেছে এবং তার অজ্ঞতার কারণে সে যে সমস্যাগ্রসত্ম হয়েছিল তাও সে পূরণ করেছে। বিদ্বানদের ঐকমত্যে অজ্ঞ ব্যক্তির জন্য কোন আলিমের তাক্বলীদ করা আবশ্যক। যেমন কোন অন্ধ ব্যক্তি এমন নির্ভরশীল ব্যক্তির তাক্বলীদ করতে পারে যে তাকে কিবলার ব্যাপারে খবর দেয়। কেননা সে এর চেয়ে আর বেশি কিছু করতে সক্ষম নয়।
কিন্তু যার অবস্থা এরূপ, অর্থাৎ যে নিজেই অজ্ঞ সে কি আল্লাহ্র দ্বীনের বিধানের ব্যাপারে ফাৎওয়া দিতে পারে? ফলে যে কথার বিশুদ্ধতা জানা নেই এবং যে ব্যাপারে তার কোন দলীল নেই, এমন কথার মাধ্যমে সে লজ্জাস্থান, রক্ত প্রবাহিত করা ও দাস বানানোকে বৈধ মনে করতে পারে এবং যার হাতে মালিকানা ছিল, তার হাত থেকে তা কেড়ে নিয়ে অন্যের কাছে হসত্মান্তর করতে পারে। এমন করা কি তার জন্য বৈধ হবে?
এ কথা স্বীকৃত যে, এভাবে মতামত দিলে সে ভুলও করতে পারে আবার সঠিকও করতে পারে। আর যে এর বিরোধিতা করছে সেও কোন ক্ষেত্রে সঠিক হতে পারে। যে ব্যক্তি মৌলিকতা সম্পর্কে, অর্থ সম্পর্কে ও শাখা-প্রশাখা আয়ত্ত করার ব্যাপারে অজ্ঞ, তার পক্ষ থেকে যদি ফাৎওয়া প্রদান করা বৈধ মনে করা হয়, তাহলে তো সবার জন্য ফাৎওয়া দেয়া জায়েয হয়ে যাবে। আর এটাই মূর্খ হওয়ার জন্য এবং কুরআনকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট।
আল্লাহ্ বলেন:
﴿وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ﴾
আর যে বিষয় তোমার জানা নেই তার অনুসরণ করো না। (সূরা ইসরা:৩৬)
আল্লাহ্ আরও বলেন:
﴿أَمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾
নাকি আল্লাহ্র উপর এমন কিছু বলছ, যা তোমরা জান না? (সূরা বাক্বারাহ:৮০)
বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে একমত , যে বিষয়টি স্পষ্ট নয় এবং যে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না, সেটা জ্ঞান নয়। বরং এটা ধারণা মাত্র। আর ধারণা সত্যের কোনো উপকার করে না। এ কথাগুলো ইবনু আব্দিল বার (রাহি.) এর সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে।