যীশুর প্রেরিতদের মধ্যে কোনো মহিলা ছিলেন না। তবে যীশুর শিষ্যদের মধ্যে মহিলাদের আধিক্য ও তাঁদের আন্তরিকতা লক্ষণীয়। আমরা দেখেছি যে, যীশুর গ্রেফতারের পর প্রেরিত ও পুরুষ শিষ্যরা পালিয়ে যান। এরপর ক্রুশের সময়ে, কবর দেওয়ার সময়ে এবং পুনরুত্থানের সময়ে পুরুষদের পরিবর্তে মহিলাদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। যীশুর অনেক মহিলা সেবিকা ছিলেন, যারা দূর-দূরান্তের ভ্রমণে যীশুর সাথে সাথে থাকতেন ও সেবা করতেন: ‘‘অনেক স্ত্রীলোকও সেখানে দূরে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলেন। ঈসার সেবা করবার জন্য তাঁরা গালীল থেকে তাঁর সংগে সংগে এসেছিলেন।’’ (মথি ২৭/৫৫, মো.-০৬)
মহিলা সেবিকাদের বিষয়ে ইঞ্জিলগুলোর কিছু বক্তব্য নিয়ে আপত্তি করেছেন সমালোচকরা। ইঞ্জিলের এ জাতীয় কিছু বক্তব্য দেখুন:
(ক) লূক ৭/৩৭-৫০ ‘‘আর দেখ, সেই নগরে এক জন গুনাহগার স্ত্রীলোক ছিল; সে যখন জানতে পারল, তিনি সেই ফরীশীর বাড়িতে ভোজনে বসেছেন, তখন একটা শ্বেত পাথরের পাত্রে সুগন্ধি তেল নিয়ে আসল। পরে পিছনের দিকে তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিতে তাঁর পা ভিজাতে লাগল এবং তার মাথার চুল দিয়ে তা মুছে দিল, আর তাঁর পা চুমবন করতে করতে সেই সুগন্ধি তেল মাখাতে লাগল। তা দেখে, যে ফরীশী তাঁকে দাওয়াত করেছিল সে মনে মনে বললো, এ যদি নবী হত, তবে জানতে পারতো, একে যে স্পর্শ করছে, সে কে এবং কি রকম স্ত্রীলোক, কারণ সে গুনাহগার। ... পরে তিনি সেই স্ত্রীলোককে বললেন, তোমার গুনাহ মাফ হয়েছে। .... তোমার ঈমান তোমাকে নাজাত দিয়েছে; শান্তিতে প্রস্থান কর।’’ (মো.-১৩)
(খ) যোহন ১১/১-৫: ‘‘বৈথনিয়ায় এক ব্যক্তি পীড়িত ছিলেন, তাহার নাম লাসার; তিনি মরিয়ম ও তাঁহার ভগিনী মার্থার গ্রামের লোক। ইনি সেই মরিয়ম, যিনি প্রভুকে সুগন্ধি তৈল মাখাইয়া দেন, এবং আপন কেশ দিয়া তাঁহার চরণ মুছাইয়া দেন; তাঁহারই ভ্রাতা লাসার পীড়িত ছিলেন। ... যীশু মার্থাকে ও তাঁহার ভগিনীকে এবং লাসারকে প্রেম করিতেন।’’ (মো.-১৩)
(গ) লূক ৮/১-৩: ‘‘ইহার পরেই তিনি ঘোষণা করিতে করিতে এবং ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করিতে করিতে নগরে নগরে ও গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করিলেন, আর তাঁহার সঙ্গে সেই বারো জন, এবং যাঁহারা দুষ্ট আত্মা কিমবা রোগ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন, এমন কয়েক জন স্ত্রীলোক ছিলেন, মগ্দলীনী নামণী মরিয়ম, যাঁহা হইতে সাতটি ভূত বাহির হইয়াছিল, যোহানা, যিনি হেরোদের বিষয়াধ্যক্ষ কূষের স্ত্রী, এবং শোশন্না ও অন্য অনেক স্ত্রীলোক ছিলেন; তাঁহারা আপন আপন সম্পত্তি হইতে তাঁহাদের পরিচর্যা করিতেন।’’
মহিলা ও পুরুষদের এরূপ প্রেম, একসাথে দীর্ঘ ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আপত্তি করেন সমালোচকরা। তারা বলেন, যীশু ও তাঁর শিষ্যরা মদপানে অভ্যস্ত ছিলেন। পাশাপাশি নারী-পুরুষের এরূপ সংমিশ্রণ কি অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে না? পাঠক হয়ত বলবেন, এগুলো ভাল মানুষদের বিষয়ে খারাপ চিন্তা! কিন্তু বাইবেল প্রমাণ করছে যে, ভাল মানুষরা, নবীরা, ঈশ্বরের পুত্র, প্রথম পুত্র, একজাত পুত্র ও খ্রিষ্টও এক্ষেত্রে নিরাপদ নন। খ্রিষ্টান চার্চগুলোর অতীত ও বর্তমান ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ধর্মগুরুরা এক্ষেত্রে মোটেও নিরাপদ নন।
পরিণত বয়সী নারীদের সাথে পুরুষদের একান্ত সংমিশ্রণ বিপদজনক। বিশেষত এক্ষেত্রে পুরুষ যদি যুবক, মধ্যবয়সী, অবিবাহিত ও মদ্যপ হন এবং মহিলা যদি ব্যভিচারে অভ্যস্ত হন, যুবকের ভালবাসার পাত্রী হন, তার সাথে সর্বদা একত্রে চলাচল ও রাত্রিযাপন করতে থাকেন এবং নিজের সম্পদ দিয়ে সদাসর্বদা এরূপ যুবকের সেবাযত্ন করতে থাকেন তবে সেক্ষেত্রে ব্যভিচার থেকে আত্মরক্ষার কোনোই আশা থাকে না।
বাইবেল নির্দেশ করে যে, সাধারণ মানুষ যে বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করতে পারে, ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ সেখানে ধৈর্য ধারণ করতে পারেন না, বরং অতি সামান্য কারণেই ব্যভিচারে লিপ্ত হন। ঈশ্বরের পুত্র, জাত পুত্র, প্রথমপুত্র ও মাসীহ দাউদের অবস্থা আমরা দেখেছি। একজন মহিলার প্রতি একবারের দৃষ্টি পড়ার কারণে তিনি তাকে ধর্ষণ করেন এবং তার স্বামীকে হত্যা করেন! অথচ তিনি ছিলেন বিবাহিত, তাঁর ঘরে ছিল অনেকগুলো সুন্দরী স্ত্রী এবং তাঁর বয়সও অনেক হয়েছিল!
বাইবেলে বারবার strange woman -এর সাথে সংমিশ্রণ থেকে সতর্ক করা হয়েছে। (হিতোপদেশ/ মেসাল ২/১৬; ৫/৩; ৫/২০; ১৬/২৪; ৭/৫; ২০/১৬; ২৩/২৭; ২৭/১৩)। এর অর্থ অপরিচিত নারী। বাংলায় মুসলিম পরিভাষায় সাধারণত ‘বেগানা নারী’ বলা হয়। বাইবেলের বিভিন্ন ইংরেজি ভার্শনে alien, adulterous, immoral, loose ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ অপরিচিত, নিজের নয় এমন, ব্যভিচারিণী, অনৈতিক, শিথিল... মহিলা বলা হয়েছে। বাংলা কেরির অনুবাদে ‘‘পরকীয়া স্ত্রী’’, জুবিলী বাইবেলে ‘‘বিজাতীয়া স্ত্রীলোক’’ এবং কিতাবুল মোকাদ্দসে ‘‘জেনাকারিণী’’ বলা হয়েছে। এছাড়া পরস্ত্রীর কাছে যাওয়া ও অবাধ সংমিশ্রণ থেকেও সতর্ক করা হয়েছে।
হিতোপদেশ/ মেসাল ৫/৩-২০ (মো.-১৩): ‘‘জেনাকারী স্ত্রীর (বেগানা-অনাত্মীয়ার strange; কেরি: পরকীয়া স্ত্রীর) কথা থেকে মধু ক্ষরে, তার কথা তেলের চেয়েও স্নিগ্ধ; কিন্তু তার শেষ ফল নাগদানার মত তিক্ত, দ্বিধার তলোয়ারের মত তীক্ষ্ণ। তার চরণ মৃত্যুর কাছে নেমে যায়, তার পদক্ষেপ পাতালে (hell) পড়ে।
হিতোপদেশ/ মেসাল ৬/২৭-২৯, মো.-২০০৬: ‘‘যদি কেউ আগুন তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখে তবে কি তার কাপড় পুড়ে যাবে না? যদি কেউ জ্বলন্ত কয়লার উপরে হাটে তবে তার পা কি পুড়ে যাবে না? যে লোক অন্যের স্ত্রীর কাছে যায় তার দশা এই রকমই হয়; যে সেই স্ত্রীলোককে ছোঁয় তাকে শাস্তি পেতেই হবে।’’
মো.-২০১৩: ‘‘কেউ যদি বক্ষঃস্থলে আগুন রাখে, তবে তার কাপড় কি পুড়ে যাবে না? কেহ যদি জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে চলে, তবে তার পা কি পুড়ে যাবে না? তদ্রূপ যে প্রতিবেশীর স্ত্রীর কাছে গমন করে; যে তাকে স্পর্শ করে, সে অদণ্ডিত (নিরপরাধ: innocent) থাকবে না।’’
সমালোচকরা প্রশ্ন করেন, ঈশ্বরের এ নির্দেশগুলো কি যীশু জানতেন না? তাহলে কিভাবে তিনি মরিয়মের মত বেশ্যা নারীকে তাঁকে স্পর্শ করার বা অনবরত চুম্বন করার সুযোগ দিলেন? তাঁর পূর্বপুরুষ ঈশ্বরের ঔরসজাত পুত্র, প্রথম পুত্র ও ঈশ্বরের খ্রিষ্ট বা ‘মাসীহ’ দাউদের কথা তাঁর মনে পড়ল না? তিনি কিভাবে ভুলে গেলেন যে, নারীকে স্পর্শ করে অদন্ডিত বা নিরপরাধ থাকা যায় না?
প্রিয় পাঠক, একটু কল্পনা করুন! আপনার সমাজে একজন হুজুর, ঠাকুর বা পাদরি, গোনাহ মাফের পাইকারি ওয়াদা দিয়ে নারীদেরকে কাছে টানছে, একান্ত খেদমত নিচ্ছে, একসাথে সফর এবং বসবাস করছে! আপনি তার বিষয়ে কী বলবেন? বিশ্বাস বা ঈমান খুবই ভাল বিষয়, কিন্তু সেজন্য একজন নারী একজন যুবক ধর্মগুরুকে অনবরত চুমু খাবে? নিজের চুল দিয়ে পা মোছাবে?
একজন সুপরিচিতা বেশ্যা, যে ইতোপূর্বে গোপনে বা প্রকাশ্যে তওবা করে নি বা তার পাপের পথ থেকে ফিরে আসে নি; এরূপ একজন বেশ্যাকে একজন পাদরি, পুরোহিত বা হুজুর অনুমতি দিলেন যে, তিনি যখন তার কোনো বন্ধুর বাড়িতে অতিথি হবেন তখন সে উপস্থিত সকলের সামনে তাঁর পদযুগল ধুইয়ে দেবে এবং অনবরত চুম্বন করবে। বিষয়টা কি খুব মানানসই হবে?
যীশু মরিয়মকে প্রেম করতেন। এ প্রেমকৃত রমণী ও অন্যান্য অনেক নারীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পথে পথে চলতেন ও রাত্রিযাপন করতেন। এ সকল রমণী তাঁর সেবাযত্ন করত। এরূপ অবাধ সংমিশ্রণ ও রাত্রিযাপনের পরেও যীশু বা তাঁর প্রেরিতদের পদস্খলন হয়নি? বিশেষত, বাইবেল বা পাক-কিতাবে আমরা দেখি যে, নবী, নবী-সন্তান, খোদার বেটা ও মসীহদের পদস্খলন সবচেয়ে বেশি।
পরবর্তী যুগের খ্রিষ্টান সাধু, পাদরি ও বিশপদের অবস্থা দেখলেও তা বুঝা যায়। মধ্যযুগে তাদের গীর্জাগুলো বেশ্যালয়ের মতই ব্যভিচারের কারখানায় পরিণত হয়েছিল। বর্তমানেও খ্রিষ্টান দেশগুলোতে পাদরিদের যৌন কেলেঙ্কারি ও শিশু ধর্ষণ ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় অন্যতম আলোচিত বিষয়।
প্রিয় পাঠক, মুসলিমরা বলেন যে, ইঞ্জিলের এ সকল বর্ণনা অসত্য। পক্ষান্তরে ইহুদি বা নাস্তিক সমালোচকরা বলেন, যীশু ও তাঁর প্রেরিতদের বিবাহের প্রয়োজন হয়নি; কারণ এ সকল মহিলার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের বিবাহের প্রয়োজন মিটিয়ে নেন । ঠিক যেভাবে ক্যাথলিক ফাদার ও পাদরিদের বিবাহের প্রয়োজন হয় না।