অভিশাপ বা বদদুআ মূলতই অবাঞ্ছনীয় কর্ম। মহাপুরুষরা অভিশাপ বর্জন করেন। এরপরও কখনো কখনো বিশেষ মহাপাপের জন্য অপরাধীকে অভিশাপ দেওয়া অনেকটা সহনীয় মনে হয়। কারণ এক্ষেত্রে মূলত পাপকে অভিশাপ দেওয়া হয়; পাপের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণেই পাপী অভিশাপে সংশ্লিষ্ট হয়। তবে নিরপরাধকে অভিশাপ দেওয়া যে কোনো মানুষের দৃষ্টিতে একটা অমানবিক কর্ম, অপরাধ ও পাপ। যীশু ইঞ্জিলের মধ্যে শত্রুকে ভালবাসতে এবং জালিমের জন্য দুআ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা মহান শিক্ষা। কিন্তু ইঞ্জিল লেখকদের বর্ণনায় আমরা দেখি যে, যীশু নিজের শত্রুকেই শুধু নয়, নিরপরাধদেরকেও ঢালাও অভিশাপ দিয়েছেন।
আমরা দেখেছি যে, মথির ২৩ অধ্যায়ে যীশু ইহুদি আলিমদের অনেক গালি দিয়েছেন। শেষে যীশু বলেন: ‘‘যেন দুনিয়াতে যত ধার্মিক লোকের রক্তপাত হয়ে আসছে, সেসব তোমাদের উপরে বর্তে- ধার্মিক হাবিলের রক্তপাত থেকে, বরখিয়ের পুত্র যে জাকরিয়াকে তোমরা বায়তুল-মোকাদ্দসের ও কোরবানগাহ্র মধ্যস্থানে খুন করেছিলে, তাঁর রক্তপাত পর্যন্ত। আমি তোমাদেরকে সত্যি বলছি, এই কালের লোকদের উপরে এ সবই বর্তাবে।’’ (মথি ২৩/৩৫-৩৬, মো.-১৩)
প্রথম বাক্যে যীশু অভিশাপ দিলেন বা বদ-দুআ করলেন: ‘তোমাদের উপরেই বর্তুক/ পতিত হোক সকলের রক্তের দায়! (upon you may come all the righteous blood shed upon the earth)। এরপর তিনি নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন যে, ‘তাঁর প্রজন্মের মানুষদের উপরেই রক্তের দায় পড়বেই পড়বে (Verily ... All these things shall come upon this generation)।’ কিন্তু প্রশ্ন হল, একের অপরাধে অন্যের শাস্তি হবে কেন? আমরা দেখেছি, বাইবেলে বলেছে, যে পাপ করবে সেই শাস্তি পাবে, একের অপরাধে অন্য কেউ শাস্তি পাবে না। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬; ২ রাজাবলি ১৪/৬; ২ বংশাবলি ২৫/৪; যিরমিয় ৩১/৩০; যিহিষ্কেল ১৮/৪; ১৮/১৯-২৮) তাহলে কিভাবে পূর্ববর্তী খুনিদের খুনের দায় পরবর্তী মানুষদের উপর বর্তায়? এরূপ অযৌক্তিক ও অমানবিক বদদুআ যীশু কিভাবে করতে পারেন?
আমরা জানি, এ সকল ইঞ্জিল লেখা হয়েছিল রোমানদের হাতে জেরুজালেমের ধ্বংসের পর। আর এ ধ্বংসের কৃতিত্ব যীশুকে দেওয়ার জন্য এ সকল অভিশাপ ও ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর নামে বানানো হয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। নইলে যীশুর মত মহান ব্যক্তি কিভাবে একের অপরাধের জন্য অন্যের শাস্তির বদ-দুআ করতে পারেন?
অন্য ঘটনায় যীশু ঢালাওভাবে কয়েকটা জনপদের বিরুদ্ধে অভিশাপ দেন: ‘‘ঈসা যে সব গ্রামে ও শহরে বেশীর ভাগ অলৌকিক কাজ করেছিলেন সেই সব জায়গার লোকেরা তাওবা করেনি। এজন্য সেই জায়গাগুলোকে তিনি ধিক্কার দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ঘৃণ্য কোরাসীন, ঘৃণ্য বৈৎসৈদা! (woe unto thee অভিশাপ/ দুর্ভোগ তোমার জন্য) তোমাদের মধ্যে যে সব অলৌকিক কাজ করা হয়েছে সেগুলো যদি টায়ার (Tyre) ও সিডন (Sidon) শহরে করা হত তবে অনেক আগেই তারা চট পরে ছাই মেখে তাওবা করত। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, রোজ হাশরে টায়ার ও সিডনের অবস্থা বরং তোমাদের চেয়ে অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে। আর তুমি কফরনাহূম! তুমি নাকি বেহেশত পর্যন্ত উঁচুতে উঠবে? কখনও না, তোমাকে নীচে কবরে ফেলে দেওয়া হবে। যে সব অলৌকিক কাজ তোমার মধ্যে করা হয়েছে তা যদি সাদুম শহরে করা হত তবে সাদুম (Sodom) আজও টিকে থাকত। আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, রোজ হাশরে সাদুমের অবস্থা বরং তোমাদের চেয়ে অনেকখানি সহ্য করবার মত হবে।’’ (মথি ১১/২০-২৪; লূক ১০/১২-১৫, মো.-২০০৬)
এখানে ইঞ্জিল লেখকের বর্ণনা অনুসারে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
(ক) যীশুর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ তিন জনপদে তিনি অনেক অলৌকিক কর্ম দেখিয়েছিলেন এবং একজনও বিশ্বাস করে নি। ইঞ্জিল লেখক এখানে মূলত যীশুকেই অভিযুক্ত করলেন যে, তাঁর অলৌকিক কর্মগুলো আকর্ষণীয় ছিল না। যেখানে অতি সাধারণ অলৌকিক কর্ম দেখিয়ে ভণ্ডরা অনেক ভক্ত জুটিয়ে ফেলেন। সেখানে যীশুর মহা মহা অলৌকিক কর্ম একজন মানুষকেও প্রভাবিত করতে পারল না!
(খ) এ তিন জনপদের সকল মানুষ তাঁর অলৌকিক কর্ম দেখে নি, তাদের মধ্যে অনেক শিশু, কিশোর ও বালক-বালিকা ছিল যারা তাঁর অলৌকক কর্ম অনুধাবনের মত বুদ্ধিমত্তা অর্জন করে নি এবং এ সকল জনপদের আগত প্রজন্মগুলো কোনো অপরাধই করে নি। তিনি বলতে পারতেন যে, যারা আমার কর্ম দেখেও বিশ্বাস করল না তাদের এ পরিণতি হবে..। কিন্তু তিনি তা না বলে, ঢালাওভাবে এ তিনটা জনপদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকলকে অভিযুক্ত ও অভিশপ্ত করলেন।
সম্মানিত পাঠক, আপনি যদি দেখেন যে, টিভির পর্দায় বা গণসমাবেশে কোনো ধর্মগুরু তার কথায় বিশ্বাস না করার কারণে ঢালাওভাবে কোনো দেশ, জাতি বা জনপদকে এভাবে অভিশাপ দিচ্ছেন তবে আপনি বিষয়টা কিভাবে নেবেন?
(গ) যীশুকে সবচেয়ে বেশি অপমান করেছিল ‘নাসরত’ নগরের মানুষেরা। যীশু অন্যান্য গ্রামকে অভিশাপ দিলেও নাসরতকে কিছুই বলেননি। এ কি পক্ষপাতিত্ব?[1]