উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসই ইসলামী আকীদা এবং সকল ইসলামী জ্ঞান ও কর্মের ভিত্তি ও উৎস। এজন্য সাহাবীগণের যুগ থেকেই আলিমগণ হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচইয়ের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা দ্বিবিধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন: সংকলন ও যাচাই-বাছাই।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর ওফাতের প্রায় ৯০ বৎসর পর থেকে পরবর্তী প্রায় ২০০ বৎসরের মধ্যে তাঁর নামে বর্ণিত প্রায় সকল হাদীস এবং সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবেয়ীগণের বক্তব্য, কর্ম ও মতামত বিভিন্ন ‘হাদীস’-গ্রন্থে সনদ সহকারে সংকলিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন তাফসীর, ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থেও কিছু হাদীস সনদ সহকারে সংকলন করা হয়েছে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের লক্ষ্য ও পদ্ধতি ছিল সনদ সহকারে প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করা। এজন্য তাঁরা সনদসহ সহীহ, যায়ীফ, মাউযূ ইত্যাদি সকল প্রকার হাদীস সংকলন করতেন। এছাড়া তাফসীর, ইতিহাস ও এ জাতীয় গ্রন্থগুলিতে গ্রন্থকারগণ মূলত বিষয় সংশ্লিষ্ট সকল হাদীস সনদ সহ জমা করতেন, সহীহ বা মাউযূ কোনো বিচার করতেন না বা উল্লেখও করতেন না। অল্প সংখ্যক মুহাদ্দিস কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও আলিম সনদ-সহ হাদীস উল্লেখ করলে আর তা সহীহ না বানোয়াট তা বলার প্রয়োজন মনে করতেন না। কারণ যেহেতু সনদ উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু সকলেই তা বিচার করতে পারবে।[1]
মুহাদ্দিসগণের সংকলন-পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষ মনে করেন যে, হাদীসের নামে যা কিছু বলা হয় তা সবই সহীহ। অথবা বড় বড় আলিমগণ তাদের গ্রন্থে যা কিছু সংকলন করেছেন তা যাচাই-বাছাইয়ের পরেই করেছেন, কাজেই সংকলিত সব হাদীসই বোধহয় সহীহ। হাদীস সংকলন সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞতাই এরূপ চিন্তার কারণ।
আল্লামা ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি) বলেন: ‘‘বুখারী ও মুসলিমের বাইরে সহীহ হাদীস খুজতে হবে মাশহুর হাদীসের বইগুলিতে, যেমন আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু খুযাইমা, দারাকুতনী ও অন্যা্ন্যদের সংকলিত গ্রন্থ। তবে এ সকল গ্রন্থে যদি কোনো হাদীস উদ্ধৃত করে তাকে সুস্পষ্টত ‘সহীহ’ বলে উল্লেখ করা হয় তবেই তা সহীহ বলে গণ্য হবে, শুধুমাত্র এ সকল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে বলেই হাদীসটিকে সহীহ মনে করা যাবে না; কারণ এ সকল গ্রন্থে সহীহ এবং যয়ীফ সব রকমের হাদীসই রয়েছে।’’[2]
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২ হি) বলেন: ‘‘দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের রীতি ছিল যে, সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ, বাতিল সকল প্রকার হাদীস সনদ-সহ সংকলন করা। তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, সনদ উল্লেখ করার অর্থই হাদীসটি বর্ণনার দায়ভার রাবীদের উপর ছেড়ে দেওয়া, সংকলকের আর কোনো দায় থাকে না।’’[3]
দ্বাদশ হিজরী শতকের অন্যতম আলিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬হি/ ১৭৬২খৃ) হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থ: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এই তিনখানা গ্রন্থের সকল সনদসহ বর্ণিত হাদীসই গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এসকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন ও তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থ: সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী। ইমাম আহমদের মুসনাদও প্রায় এই পর্যায়ের।
তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে বিশুদ্ধ, দুর্বল, মিথ্যা, ভুল সব ধরনের হাদীসই রয়েছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ভিন্ন এসকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দিসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছে : মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবন হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বাইহাকীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (সুনানে কুবরা, দালাইলুন নুবুওয়াত, শুয়াবুল ঈমান,... ইত্যাদি), ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (শার্হ মায়ানীল আসার, শার্হ মুশকিলিল আসার,... ইত্যাদি), তাবারানীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ (আল-মু’জামুল কবীর, আল-মু’জামুল আওসাত, আল-মু’জামুস সাগীর,... ইত্যাদি)। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তাঁরা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।
চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলি হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রন্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন প্রকারের হাদীস সংকলন করেছেন:
(১). যে সকল ‘হাদীস’ পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারণে পূর্ববতী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, (২). যে সকল হাদীস কোনো অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, (৩). লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়ায়েযদের ওয়াযে প্রচারিত বিভিন্ন কথা, যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে স্থান পায়নি, (৪). বিভিন্ন দুর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, (৫). যে সকল ‘হাদীস’ মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদিদের গল্প বা পূর্ববতী যামানার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা, যেগুলিকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোনো বর্ণনাকারী হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৬). কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতীয় কথা যা ভুলক্রমে কোনো সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৭). হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূবক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, অথবা (৮). বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। এধরনের হাদীসের সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইবনু হিববানের আদ-দুয়াফা, ইবনু আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম আল-আসফাহানী, ইবনু আসাকির, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। ... এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় দুর্বল অথবা বানোয়াট।
পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহে ঐ সকল হাদীস রয়েছে যা ফকীহগণ, সূফীগণ বা ঐতিহাসিকগণের মধ্যে প্রচলিত ও তাঁদের লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। যে সকল হাদীসের কোনো অস্তিত্ব পূর্বের চার পর্যায়ের গন্থে পাওয়া যায় না। এসব হাদীসের মধ্যে এমন হাদীসও রয়েছে যা কোনো ধর্মচ্যুত ভাষাজ্ঞানী পন্ডিত পাপাচারী মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি তার বানোয়াট হাদীসের জন্য এমন সনদ তৈরি করেছেন যার ত্রুটি ধরা দুঃসাধ্য, আর তার বানোয়াট হাদীসের ভাষাও এরূপ সুন্দর যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে সহজেই বিশ্বাস হবে। এ সকল বানোয়াট হাদীস ইসলামের মধ্যে সুদূর প্রসারী বিপদ ও ফিতনা সৃষ্টি করেছে। তবে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ভাষা ও সনদের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তার ত্রুটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) বলেন: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্থের উপরেই শুধুমাত্র মুহাদ্দিসগণ নির্ভর করেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ থেকে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ইলমুর রিজাল ও ইলাল শাস্ত্রে পন্ডিত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ছাড়া কেউ উপকৃত হতে পারেন না, কারণ এ সকল গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্য থেকে মিথ্যা হাদীস ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের পার্থক্য শুধু তাঁরাই করতে পারেন। আর চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ সংকলন করা বা পাঠ করা এক ধরনের জ্ঞান বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। সত্য বলতে, রাফেযী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সকল বিদ‘আতী ও বাতিল মতের মানুষেরা খুব সহজেই এসকল গ্রন্থ থেকে তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন হাদীস বের করে নিতে পারবেন। কাজেই, এ সকল গ্রন্থের হাদীস দিয়ে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করা বা কোনো মতের পক্ষে দলিল দেওয়া আলিমদের নিকট বাতুলতা ও অগ্রহণযোগ্য।[4]
চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগন্থসমূহে সংকলিত হাদীসসমূহের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রাহ)-এর পুত্র শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী (১২৩৯ হি) বলেন: এই পর্যায়ের হাদীসগুলির অবস্থা এই যে, প্রথম যুগের (প্রথম তিন হিজরী শতাব্দীর) মুহাদ্দিসদের মধ্যে এগুলি পরিচিতি লাভ করে নি, অথচ পরবর্তী যুগের আলিমগণ তা বর্ণনা ও সংকলন করেছেন। এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে: প্রথম সম্ভাবনা এই যে, প্রথম যুগের মুহাদ্দিসগণ এগুলির বিষয়ে জেনেছিলেন এবং এগুলির সনদ বা সূত্র সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছিলেন। তাঁরা এগুলির কোনো সনদ বা ভিত্তি জানতে পারেন নি, এজন্য তাঁরা এ সকল হাদীস সংকলন করেন নি।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা এই যে, তাঁরা এগুলির সনদ বা সূত্র জানতে পেরেছিলেন। তবে তাঁদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে এগুলির সনদে কঠিন আপত্তি ও ত্রুটি জানতে পেরেছিলেন, যে ত্রুটির কারণে হাদীসগুলি প্রত্যাখ্যান করা জরুরি ছিল। এজন্য তাঁরা হাদীসগুলি সংকলন করেন নি।
সর্বাবস্থায় এ সকল হাদীসের উপর কোনো অবস্থাতেই নির্ভর করা যায় না এবং এগুলি দ্বারা কোনো আকীদা বা কর্ম প্রমাণ করা যায় না। এই পর্যায়ের হাদীসগুলি অনেক মুহাদ্দিসকেই বিভ্রান্ত করেছে এবং তাঁদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে। কারণ, এ সকল গ্রন্থে বিদ্যমান এ সকল হাদীসের অনেক সনদ দেখে প্রতারিত হয়ে তারা এগুলিকে ‘মুতাওয়াতির’ বলে গণ্য করেছেন এবং ‘সুনিশ্চিত জ্ঞান’ ও সুদৃঢ় বিশ্বাস প্রমাণের জন্য এগুলির উপর নির্ভর করেছেন। এভাবে তাঁরা প্রথম দুই পর্যায়ের বিপরীতে নতুন মতবাদের উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন।’’[5]
[2] ইরাকী, আত-তাকঈদ ওয়াল ঈদাহ শারহু মুকাদ্দিমাতি ইবনুস সালাহ, পৃ. ৩১-৩২।
[3] ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/৭৪।
[4] শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/৩৮৫-৩৯১।
[5] সিদ্দীক হাসান কান্নুজী, আল-হিত্তাহ, পৃ. ৫৭-৫৮।