মাইয়্যেতের গোসলের নিয়ম-কানুন নিম্নরূপঃ
১. গোসল দেওয়ার স্থানটি পাঁচ দিকে ঘেরাও করবে। উপর দিকেও সামিয়ানা অথবা পর্দা থাকতে হবে।
২. গোসলদাতা সহায়তার জন্য ২/১ জন ভালো লোক সঙ্গে নিতে পারে। বাকি ঐ পর্দারসীমার ভিতরে যেন কেউ না থাকে ও গোসল না দেখে। অবশ্য গোনাহ করে এমন লোককেও সঙ্গে রাখা চলে। যাতে সে মুর্দার হাল দেখে উপদেশ গ্রহণ এবং তাওবা করতে পারে। আর উপদেশের জন্য মৃত্যু যথেষ্ট।
৩. গোসলদাতা নিজের মুখ বন্ধ করে নিতে পারে অথবা নাকে-মুখে কাপড় বেঁধে নিতে পারে; যদি দুর্গন্ধ পাওয়ার কোন রকম আশঙ্কা থাকে তবে। অতিরিক্ত এমন কোন কাপড় শরীরের সম্মুখ ভাগে বেঁধে নিতে পারে যাতে কোন নাপাকী তার শরীর বা পোশাকে লেগে না যায়। উভয় হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরা উত্তম। যাতে হাতে ময়লা না লাগে এবং লাশের লজ্জাস্থান সরাসরি স্পর্শ না হয়।
৪. একই উদ্দেশ্যে দুই পায়ে ‘গাম-বুট ব্যবহার করতে পারে।
৫. মাইয়্যেতের দেহ অনুযায়ী পরিমাণমতো পানি প্রস্তুত রাখবে। ১ বালতি সাদা সাধারণ পানি, ১ বালতি বড়ই পাতা মিশ্রিত পানি এবং অপর আর ১ বালতি কর্পূর মিশ্রিত পানি প্রস্তুত রাখবে। বড়ই পাতা পিষে পানিতে দিয়ে এমনভাবে ঘটবে যাতে পানিতে ফেনা দেখা যায়। প্রতি লিটার পানিতে দুই টুকরা কপুর দিতে হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজনে সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করাও উত্তম।
৬. লাশ তুলে আস্তে করে একটি তক্তা বা কাঠের উপর রাখবে। এ তক্তার যেদিকে লাশের মাথা রাখা হবে সেদিকটা যেন একটু উঁচু হয় যাতে কোমরের দিকের পানি পায়ের দিকে গড়িয়ে নেমে পড়তে পারে। এই তক্তা কেবলামুখী হওয়া জরুরি নয়। উল্লেখ্য যে, লাশ তোলা-নামা করার সময় লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’র যিকির করা বিদআত। এরপর লাশের লজ্জাস্থানের উপর একটি মোটা কাপড় রেখে গায়ের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলবে। নবী (সা.)-এর যুগে এরূপই আমল ছিল (হাকেম- ৩/৫৯-৬০)। উল্লেখ্য যে, নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত সতর ও লজ্জাস্থান দেখা সকলের জন্যই হারাম। মহিলা গোসলদাত্রীও মহিলার ঐ স্থান দেখবে না।
৮. বরফে জমা লাশ হলে অথবা কোন কাপড় খুলতে অসুবিধা হলে কাপড় কেটে বের করে নেবে।
৯. নখ গোঁফ ইত্যাদি কেটে ফেলার ব্যাপারে হাদীসে কোন নির্দেশ আসেনি। কোন কোন আলেম এসব কাটা বিদআত বলেছেন। (আলবানীর আহকামুল জানায়িয)।
১০. নাক ও মুখের ভিতরে ময়লা থাকলে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে পরিষ্কার করে নেবে। এগুলো দিয়ে ময়লা বের হতে থাকলে তুলা বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে ছিদ্র পথ বন্ধ করে দেবে।
১১. মাইয়্যেতের দেহের কোন অংশে জমাট বাঁধা ময়লা থাকলে এবং কুলের পাতা দ্বারা দূর হলে তা সাবান অথবা অন্য কিছু দিয়ে পরিষ্কার করে নেবে।
১২. বাম হাতে (গ্লাভসের উপরেই) একটি ন্যাকড়া জড়িয়ে নেবে। অতঃপর সাথী-সঙ্গীদের সাহায্যে লাশের মাথার দিক একটু তুলে অর্ধ বসার মতো বসাবে এবং ধীরে ধীরে ২/৩ বার পেটের উপর চাপ দেবে যাতে পেটে কোন নাপাকী থেকে থাকলে তা বের হয়ে যায়। ময়লা ন্যাকড়া হাত থেকে খুলে ফেলবে। তারপর গোসলদাতা গ্লাভস বা ন্যাকড়া জড়ানো বাম হাত পর্দার নিচে থেকে লজ্জাস্থান মাজাঘষা করে এবং উপর থেকে একজন পানি ঢেলে পরিষ্কার করে দেবে। তারপর গ্লাভস অথবা ময়লা ন্যাকড়াটি হাত থেকে খুলে ফেলবে।
১৩. ধোয়ার পরও যদি নাপাকী বারবার বের হতে থাকে, তাহলে ২/৩ বার ধুয়ে ফেলার পর ছিদ্র পথ তুলা বা কাপড়ের টুকরা দ্বারা বন্ধ করে দেবে। প্রয়োজন হলে এর উপর প্লাস্টার পট্টি ব্যবহার করতে পারে। তবে ন্যাকড়া ব্যবহার করাই উত্তম।
১৪. অতঃপর গোসলদাতা গোসল দেবার নিয়ত করে মাইয়্যেতের উভয় হাত ‘বিসমিল্লাহ বলে কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে দেবে। (ভিজে পরিষ্কার ন্যাকড়ার সাহায্যে) তিনবার মুখের ভিতর দাঁতসহ মাসেহ করবে। তিনবার নাকের ভিতর মাসেহ করে দেবে। অতঃপর সাধারণ ওযূর ন্যায় মুখমণ্ডল, হাত ইত্যাদি যথা নিয়মে ধুইয়ে মাথা ও কান মাসেহ করে পা ধুইয়ে মাইয়্যেতকে ওযু করিয়ে দেবে। তবে নাকে ও মুখে পানি দেবে না।
১৫. অতঃপর কুলের পাতা মিশ্রিত পানি দ্বারা মাইয়্যেতের মাথা ও মুখমণ্ডল (দাড়িসহ) উত্তমরূপে ধৌত করবে। মহিলার মাথায় খোপা বাঁধা থাকলে তা খুলে নিয়ে ভালোরূপে এবং প্রয়োজন হলে শ্যাম্পু দ্বারা ধৌত করবে।
১৬. অতঃপর মাইয়্যেতকে বামপার্শ্বে শয়ন করিয়ে ঐ পানি দ্বারা কাঁধ থেকে শুরু করে ডান পায়ের শেষাংশ পর্যন্ত ভালোভাবে মাজা-ঘষা করে দেবে। তারপর ডান কাতে শুইয়ে বাম পাশ অনুরূপ ধৌত করবে। পর্দার নিচে লজ্জাস্থানে কাপড় মোড়ানো হাত বুলিয়ে ধুয়ে দেবে। অনুরূপভাবে দ্বিতীয়বার ঐ একই পানি দ্বারা একই রূপে গোসল দেবে। অতঃপর কর্পূর মিশ্রিত পানি দ্বারা মাথা ও মুখমণ্ডল ধুয়ে দেওয়ার পর এভাবে আরেকবার গোসল দেবে। এরপরেও নাপাকী দেখা গেলে তিনের অধিক ৫ ও ৭ বার বা ততোধিকবার বিজোড় সংখ্যায় গোসল দেওয়া যায়। তবে শেষ বারে যেন কপূর মিশ্রিত পানি দ্বারা গোসল হয়। (বুখারী: ১১৭৫)
১৭. এরপর শুষ্ক কাপড় দ্বারা মাইয়্যেতের দেহ মাথা, বুক, মুখ, পেট, হাত, পা মুছে দেবে । লজ্জাস্থানের উপর ভিজা কাপড়টিকে সরিয়ে অন্য একটি শুকনা কাপড় দিয়ে দেবে। মাইয়্যেতের চুল আঁচড়ে দেবে। (বুখারী: ১১৭৬) মহিলার চুল আঁচড়ে বেণী গেঁথে কাফনের সময় লাশের পিছন দিকে ফেলে রাখবে। মাথার দুই পাশে দুটি এবং সামনের দিকে চুল নিয়ে একটি, মোট তিনটি বেণী করবে।(আহমাদ- ৫/৮৪-৮৫)। এ পর্যন্ত করলে লাশ কাফনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে ।
মাইয়্যেতের গোসল সংক্রান্ত বিবিধ মাসাইল
১. লাশের কোন অঙ্গ আগুনে পুড়ে গেলে বা কোন দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকলে কাপড় দিয়ে গোসলের পর ঐ অঙ্গে মাসাহ করে দেবে।
২. চারমাসের কম সময়ের গর্ভপাতজনিত ভ্রণের গোসল, কাফন ও কোন নামায নেই। একটি ছোট্ট কবর খুঁড়ে তাকে দাফন করা হবে।
৩. চার মাসের ঊর্ধ্বের ভ্রণের কাফন-দাফন সাত বছরের নিম্নের বালক-বালিকার মতোই। (আহকামল জানাইয)
৪. সর্বদা মাইয়্যেতের সম্মানের জন্য খেয়াল রাখবে, গোসলদাতা যাতে গোসল দেওয়ার সময় বা অন্যান্য ক্ষেত্রে লাশের সাথে ধস্তাধস্তি না হয় ও গোসলে শীতের সময় শীতল এবং গ্রীষ্মের সময় খুব গরম পানি ব্যবহার না করা হয়।
৫. লাশের মুখে বাঁধানো সোনার দাঁত থাকলে যদি মুখ এঁটে বন্ধ থাকে, তাহলে বল প্রয়োগ করে খোলার চেষ্টা করবে না। খোলা থাকলে এবং দাঁত সহজে বের করা সম্ভব হলে বের করে নেবে, নচেৎ বল প্রয়োগ করে বের করবে না। (আল-বিজায়াহ পৃ. ৭৫)
৬. হজ্জ বা উমরা করতে গিয়ে ইহরাম অবস্থায় মৃত মুহরিমের গোসলে কোন প্রকার সুগন্ধি বা কপূর ব্যবহার করা বৈধ নয়। যেহেতু ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মৃত হাজীর জন্য নবী (সা.) বলেছিলেন, ‘ওকে কুলপাতা-মিশ্রিত পানি দ্বারা গোসল দাও, ওর দুই কাপড়ে কাফন পরাও এবং সুগন্ধি লাগিয়ো না।...।”
৭. মাইয়্যেতের গোসল দেওয়ার সময় গোসলদাতা যদি মাইয়্যেতের দেহে কোন ত্রুটি বা অপ্রীতিকর কিছু দেখে থাকে- যেমন চেহারা কালো বা বিকৃত হয়ে যাওয়া, তার দেহ হতে দুর্গন্ধ বের হওয়া ইত্যাদি- তাহলে তা প্রচার করা বা কাউকে বলা বৈধ নয়। বরং ভালো কিছু দেখলে; যেমন হাসি মুখ, দেহে ঔজ্জ্বল্য প্রভৃতি দেখলে বা সুগন্ধ পেলে তা প্রচার করতে পারে। (আল-মুমতে- ৫/৩৭৬)।
৮. গোসল দেওয়ার সময় প্রত্যেক অঙ্গে পানি ঢালার সময় নির্দিষ্ট কোন দু'আ বা কালিমার যিকির করা, গোসল দেওয়ার স্থানে কয়েকদিন ধরে বাতি জ্বালানো বা ধূপ ইত্যাদি দিয়ে রাখা বিদ্আত।
৯. গোসল দেওয়ার সময় ব্যবহৃত ন্যাকড়া ফেলবার কোন নির্দিষ্ট জায়গা বাছাইয়ের প্রয়োজন নেই। যেকোন জায়গায় তা পুঁতে ফেলা বা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া যায়। এ কাপড় বা ময়লা এমন কিছু নয় যে, এতে ভূত (?) জড়িয়ে থাকে- যা অনেকেই ধারণা করে থাকে।
১০. অনেকে মনে করে মাইয়্যেত গোসলের পানি ডিঙ্গাতে নেই এবং ডিঙ্গালে কোন অমঙ্গল হয়। এগুলো ঠিক নয়।