আল্লাহ তাআলা মানুষকে শ্রেষ্ঠতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সৃষ্টজগতে অনেকের চেয়ে মানুষকেই অধিকতম শ্রেষ্টত্ব ও সম্মান প্রদান করেছেন। মানুষের দেহ সৃষ্টি-বিচিত্রে তাঁর বিস্ময়কর শক্তি এবং সীমাহীন প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি ঘটেছে। মানুষের দেহ-বিচিত্রে মস্তিষ্ক ও বুদ্ধি আল্লাহর এক মহাদান। যার দ্বারা মানুষ ভালোকে মন্দ হতে এবং হককে বাতিল হতে পার্থক্য করতে পারে। শরীয়তের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে বলা হয়েছে। এই জ্ঞান ও বিবেক যাতে বিনষ্ট হয়ে যায়, তার বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু মানুষ এই অমূল্য জ্ঞান-সম্পদকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও অবহেলার শিকার হয়েছে। কিছু মানুষ আছে যারা কোন বিষয়ে জ্ঞান খাটাতেই চায় না; বরং অন্ধভাবেই সবকিছু বিশ্বাস করে ও মেনে নেয়। এমন কি যেখানে শরীয়ত আদেশ করেছে, সেখানেও জ্ঞানকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য বা আলস্য করে। আল্লাহ পাক বলেন,
سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ ۗ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
অর্থাৎ, আমি ওদের জন্য আমার নিদর্শনাবলী বিশ্বজগতে ব্যক্ত করব এবং ওদের নিজেদের (দেহ) মধ্যেও; ফলে ওদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তা সত্য। একি যথেষ্ট নয় যে, তোমার প্রতিপালক সর্ববিষয়ে সাক্ষী? (সুরা ফুসসিলাত ৫৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,
كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ
অর্থাৎ, এভাবে আল্লাহ সকল নিদর্শন তোমাদের জন্য প্রকাশ করেন; যাতে তোমরা চিন্তা কর। (সূরা বাকারাহ ২১৯ আয়াত)
তিনি অন্যত্র বলেন,
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَىٰ وَالْبَصِيرُ ۚ أَفَلَا تَتَفَكَّرُونَ
অর্থাৎ, বল অন্ধ ও চক্ষুষ্মন কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন কর না? (সুরা আনআম ৫০ আয়াত)
এইভাবে কুরআন মাজীদের বহু স্থানে “তোমরা কি বুঝনা? যাতে তোমরা বুঝ, যদি তোমরা বুঝ, ওরা কি জ্ঞান করে না? জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, তোমরা কি
চিন্তা কর না? যাতে তোমরা চিন্তা কর, যাতে ওরা চিন্তা করে, চিন্তাবিদদের জন্য নিদর্শন রয়েছে” প্রভৃতি বলে জ্ঞান ও চিন্তা করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে জ্ঞান খাটায় না।
পক্ষান্তরে কতক মানুষ আছে, যারা সর্ববিষয়ে নিজের আকেলকেই প্রাধান্য দেয়, সবকিছুকেই বিবেকের নিক্তিতে ওজন করে। জ্ঞানকেই ভালো-মন্দ বুঝার উৎস। মনে করে। নিজেদের জ্ঞান যাকে সত্য বলে তারা তাকে সত্য মানে এবং যাকে অসত্য বলে তাকে তাই মানে যদিও তা কিতাব ও সুন্নাহর (প্রকৃত জ্ঞানের) প্রতিকূল হয়। যার ফলে বহু বিদআত এই আকেলের ছাঁচে সৃষ্টি হয়েছে। আর এরই জন্য ভ্রষ্টতা ও বহু সংখ্যক ফিতনা, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি সংঘটিত হয়েছে, কত সুন্নত উঠে গেছে, উম্মাহর মাঝে বিছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে এবং কিতাব ও সুন্নাহর। বিভিন্ন উক্তিকে বিকৃত ও হেরফের করা হয়েছে।
অথচ শরীয়তে এমন কিছু নেই যা মানুষের জ্ঞান ও বিবেকের প্রতিকূল। অবশ্য অনেক বিষয় আছে, মানুষের সীমিত জ্ঞান যার প্রকৃতত্বের ছোঁয়া পায় না। ফলে সে তাতে বিমুঢ় ও হয়রান হয়ে যায়। কিন্তু তা বলে জ্ঞানের বাহুবলে তা অমান্য নয়। যেহেতু মানুষের জ্ঞান থাকলেও তার পরিসর সীমাবদ্ধ এবং সৃষ্টিকর্তা শরীয়তদাতার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অপরিসীম। তাঁর সকল হিকমত বুঝে ওঠা মানুষের সাধ্য নয়। সুতরাং শরীয়তের উপর জ্ঞানের চাকা সর্বক্ষেত্রে সচল নয়।
কিন্তু বিরলভাবে কতক মানুষ এই নিয়মের বিরোধিতা ও ব্যতিক্রম করে তারা নিজেদের অপরিসর জ্ঞানের বহরকে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে। বাড়িয়ে থাকে, তাদের শাক-বেচা দাড়িপাল্লাতে সুবৃহৎ পর্বত ওজন করতে চায়! কেবল বিবেককেই ধর্মাধর্মের কষ্টিপাথর মনে করে। শরীয়তের বিষয়াবলীকে জ্ঞানের মিটারে মেপে থাকে। তাদের জ্ঞানে ধরে না -এমন ইলাহী খবরকে র করে দেয় এবং জ্ঞান ও রুচি থেকে হালাল ও হারাম মানে; যদিও ইলাহী কানুনে তার বিপরীত বলে ঘোষিত থাকে। এতো ভালো জিনিস, ওতে ক্ষতি কি? এটা কুসংস্কার ইত্যাদি বলে নবনব ভিত্তিহীন ইবাদত-অনুষ্ঠান রচনা করে থাকে অথবা ধ্বংস করে থাকেযার অনুমতি মাবুদ দেননি।
আকেলের ঘোড়া ছুটিয়ে বাস্তববাদীরা বহু দ্বীনী প্রকৃতত্বকে অস্বীকার ও রদ করে থাকে। বিশেষ করে অদৃশ্য ও ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য বিভিন্ন ইলাহী ও নববী খবরকে অবিশ্বাস করে; যদিও বা তা শুদ্ধভাবে প্রমাণিত। যেমন ফিরিশ্যা ও জিন-জগৎ, কবরের আযাব, যাদু-প্রতিক্রিয়া, ইমাম মাহদী ও হযরত ঈসার (আঃ) আবির্ভাব, দাজ্জালের ফিতনা, রসুলের মিরাজ, সিনাচাক, পরকালে মীযান, হাওয, পুলসীরাত প্রভৃতি গায়বী বিষয়কে তারা অবিশ্বাস করে।
পক্ষান্তরে, প্রত্যেক সুস্থ-মস্তিষ্কের মুসলিমের নিকট বিদিত যে, আল্লাহ বা তাঁর রসুল থেকে যখন কোন খবর শুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়, তখন তা মান্য করা অথবা রদ্দ। করাতে আকেলের কোন হাত থাকে না। বরং তাতে দৃঢ় প্রত্যয় রাখা এবং মান্য করা ওয়াজেব হয়ে যায়; চাহে অজ্ঞান ও বিবেক সেই খবরের প্রকৃতত্বের নাগাল পায় অথবা না পায়। যেহেতু জ্ঞান প্রত্যেক বিষয়েরই প্রকৃতত্ব উপলব্ধি করতে অক্ষম। হাজারে আসওয়াদকে চুম্বনকালে হযরত উমার ফারূক (রাঃ) এই তত্ত্বকেই সামনে। রেখে বলেছিলেন, 'আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর; তুমি না কারো উপকার সাধন করতে পার, আর না-ই কারো অপকার। যদি রসুল (সা.)-কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।” (বুখারী)
সুতরাং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই যে, “যখন মুমিনদের আপোসের কোন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের দিকে আহবান করা হয়, তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ব্রাই হল সফলকাম।” (সুরা নুর ৫১ আয়াত)।