জ্ঞাতব্য বিষয় যে, সালাফী বা আহলে সুন্নাহ কোন মযহাব বা দলের নাম নয়। বরং তা এক নীতি ও পদ্ধতির নাম; যার ভিত্তি আল্লাহর রসুল ঐ স্থাপন করেছেন এবং তাঁর পর তাঁর সাহাবাবৃন্দ যার অনুসরণ করেছেন; আর তাঁরাই সলফ এবং পরবর্তীতে যাঁরা তাঁদের অনুগমন করেন ও ঐ আসল নীতির অনুসরণ করেন। তাঁরাও সলফ। আল্লাহ পাক বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
অর্থাৎ, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রাথমিক অগ্রানুসারী এবং (এক বিশ্বাস, এক কথা ও এক আমল ইত্যাদি) সদনুষ্ঠানের সাথে তাদের অনুগমন করে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে (আল্লাহতে) সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন; যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এ হল মহাসাফল্য। (সুরা তওবা ১০০ আয়াত)
অতএব যাঁরা তাঁদের অনুগমন করেন, তাঁদের বুঝে কুরআন ও সুন্নাহ বুঝেন, তাঁদের মত আল্লাহ ও তদীয় রসুলকে ভালোবাসেন এবং তাঁদের পদ্ধতি মত শরীয়তের আনুগত্য করেন, তাঁরাই সালাফী। যাঁরা দ্বীনী কোন কথা বিশ্বাস করতে, বলতে অথবা কোন কাজ করতে কুরআন ও সহীহ হাদীসের দলীল খোঁজেন। যাঁরা সহীহ হাদীস ও সলফদের সহীহ উক্তি অনুসারে কুরআনের ব্যাখ্যা করেন, তাঁরাই আহলে সুন্নাহ। সেই সলফে সালেহীনদের জামাআতই একমাত্র ইসলামী জামাআত। ইসলামে আর ভিন্ন কোন জামাআত নেই। এই জামাআতই পৃথিবীতে সাহায্য প্রাপ্ত এবং আখেরাতে মুক্তি প্রাপক। অন্যথা কুরআন ও হাদীস তথা সলফের জ্ঞান ব্যতিরেকে যারা মনের খেয়ালবশে অন্য পথ রচনা করে বা বরণ করে ও এই জামাআত ও তার নীতি হতে ভিন্ন নাম ও নীতি নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়, তারাই ধ্বংস প্রাপক।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট দুরদর্শী চিন্তানায়ক মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, “বানী ইস্রাঈলরা বাহাত্তর ফিকায় বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত তিয়াত্তর ফির্কায় বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে বাহাত্তরটি ফির্কা জাহান্নামে যাবে এবং একটি মাত্র ফির্কা জান্নাতবাসী হবে। ঐ জান্নাতী ফির্কা তাদের, যারা আমার ও আমার সাহাবার আদর্শের উপর কায়েম থাকবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ)
পীরশ্রেষ্ঠ হযরত আব্দুল কাদের জীলানী (রঃ) বলেন, জাহান্নাম থেকে নাজাত প্রাপ্ত ঐ দলটি আহলে সুন্নাহ অল-জামাআহর দল। যার একটি মাত্র নাম আছে তা হল ‘আহলে হাদীস। (গুনিয়াতুত তালেবীন)।
সুতরাং আহলে সুন্নাহ, হাদীস বা আসার অথবা সালাফীর নীতি এক পূর্ণাঙ্গ সঠিক ইসলামের নীতি যে নীতির উপরে ছিলেন আল্লাহর রসুল প্লঃ তাঁর সাহাবাগণ , তাবেঈন ও সকল আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীন - ইমাম আবু হানীফা, মালেক, শাফেয়ী, আহমাদ বিন হাম্বল এবং অন্যান্য ইমাম (রাহেমাহুমুল্লাহ)গণ। আয়েম্মাগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন বাক্যে একই কথা বলে গেছেন, ‘সহীহ হাদীসই আমার মযহাব।”
সেই শ্রেষ্ট ও চিরন্তননীতি সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
(১) আলকুরআনে বর্ণিত সমস্ত কথা ও কাজকে নিঃসন্দেহে ও নিঃসংকোচে বিশ্বাস ও ধারণ করা (যে কুরআনে) পূর্ববর্তী কোন প্রকার মিথ্যা ও বাতিল প্রক্ষিপ্ত হয় না।
(২) সহীহ সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা, যা আল-কুরআনের ব্যাখ্যাতা ও দ্বিতীয় ওহী (ঐশীবাণী)। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থাৎ, তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বোঝাবার জন্য--[{সূরা নাহল ৪৪ আয়াত) তিনি অন্যত্র বলেন,
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ * إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
অর্থাৎ, এবং সে (নবী) নিজের ইচ্ছামত কোন কথা বলেন না। তা তো অহী, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা নাজম ৩-৪ আয়াত)
(৩) আল্লাহকে একমাত্র প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা, বিধায়ক এবং একমাত্র উপাস্য ও মাবুদরূপে বিশ্বাস করা। তিনি ছাড়া আর কেউই (সত্য) উপাস্য নেই। গুপ্ত ও প্রকাশ্য বিশ্বাস্য, কথনীয় এবং করণীয় যাবতীয় ইবাদত কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যলাভের উদ্দেশ্যে তাঁকেই নিবেদন করা।
(৪) তাঁর সমুদয় আসমা ও সিফাত (নাম ও গুণাবলী)র উপর সেই মত ঈমান রাখা, যে মত তিনি তাঁর কিতাবে নিজে বর্ণিত ও ব্যক্ত করেছেন এবং যে মত তাঁর রসুল ও তাঁর সুন্নাহতে বর্ণনা দিয়েছেন। তার স্পষ্ট অর্থ ও সহজাৰ্থ গ্রহণ করা এবং কোন প্রকার বিকৃতি, হেরফের বা দুর ব্যাখ্যার অনুপ্রবেশ না ঘটানো। অথবা সেই সমুহকে অর্থহীন কিংবা আল্লাহ জাল্লাহ তাআলার ঐ অর্থবহগুণহীন না মনে করা এবং ঐ অর্থের বা গুণের কোন প্রকার উপমা, উদাহরণ, সাদৃশ্য বা সূরূপতা বর্ণনা না করা। বরং তা কেমন, কি প্রকার, কিরূপ ইত্যাদি প্রশ্নও মনে না আনা। মহান আল্লাহ বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
অর্থাৎ, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরা ১১ আয়াত)
(৫) আল্লাহ পাক যা অবতীর্ণ করেছেন তা নিজেদের এবং রাষ্ট্রের (জীবন) সংবিধান করা এবং রসূল ৪-এর আদর্শ ও বিধান দ্বারা সকল সমস্যার ও বিপদবিসম্বাদের ও বিচার-মীমাংসা করা। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থাৎ, কিন্তু না, তোমার প্রতি পালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার তোমার উপর অর্পণ করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়। (সুরা নিসা ৬৫ আয়াত)।
(৬) সৎকার্যের আদেশ এবং অসৎ বাধা দান করা এবং সৎপথের প্রতি মানুষকে আহবান করা। আল্লাহ পাক বলেন,
قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ ۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي ۖ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
অর্থাৎ, বল, এটিই আমার পথ; আমি এবং আমার অনুসারীগণ সজ্ঞানে আল্লাহর প্রতি (মানুষকে) আহবান করি, আল্লাহ মহিমান্বিত এবং যারা আল্লাহর অংশী স্থাপন। করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সুরা ইউসুফ ১০৮ আয়াত)
তিনি অন্যত্র বলেন,
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
অর্থাৎ, তুমি (মানুষকে) প্রজ্ঞা (যুক্তি) ও সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর এবং ওদের সাথে সদ্ভাবে আলোচনা কর। অবশ্য তোমার প্রতিপালক। তাঁর পথ ছেড়ে যে বিপথগামী হয়; সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং যারা সৎপথে আছে তাও তিনি সবিশেষ জানেন। (সুরা নাহল ১২৫ আয়াত)
অতএব সৎকার্যের আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ এবং আল্লাহর পথে আহবান। (তবলীগ) এই দুটি আয়াতের ভিত্তিতে করা। প্রথমতঃ ইলম বা শরয়ী জ্ঞান ও দ্বিতীয়তঃ হিকমত বা প্রজ্ঞা বা যুক্তি ও দুরদর্শিতা। প্রত্যেক মুসলিম তার সম্বল ও সামর্থ্যানুযায়ী নিজের নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ও কর্মসীমার ভিতরে এই দাওয়াত কার্যে অংশ গ্রহণ করবে। আর আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত দায়িত্বভার অর্পণ করেন না। যেমন তাঁর রসুল প্ল বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন মন্দ কাজ দেখবে সে তার হাতের দ্বারা অপসারণ (বাধা দান করবে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে তার জিভের দ্বারা, যদি তাতেও সক্ষম না হয় তবে তার অন্তর দ্বারা (ঘৃণা জানবে) এবং তা দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। (মুসলিম)
সুতরাং হস্ত দ্বারা বাধা দেওয়া শাসন কর্তৃপক্ষের কর্তব্য এবং অনুরূপভাবে পরিবারের জন্য তার অভিভাবকের কাজ। মুখ দ্বারা বাধা দেওয়া প্রত্যেক মুসলিমের কাজ। যদি কথার সাহায্যেও গর্হিত কর্ম দুর করতে (ফিতনা ইত্যাদির ভয়ে) সক্ষম না হয়, তাহলে তার উচিত অন্তর থেকে ঐ মন্দকে ঘৃণা করা; নচেৎ ঈমান হারিয়ে যায়।
(৭) দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং মানুষকে মানুষ অথবা জড়ের ইবাদত করা হতে রক্ষা করে একমাত্র মানুষ ও জড়ের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক একক উপাস্যের ইবাদত করতে পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পথে সর্বপ্রকার জিহাদ করা।
(৮) কারো প্রতি বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ কিতাব ও সুন্নাহর নির্দেশমত করা (কোন দল বা ব্যক্তিত্বের খাতিরে নয়।) আহলে সুন্নাহ বা হাদীসকে ভালোবাসা এবং আহলে বিদআতকে ঘৃণা করা।
(৯) প্রথমে সংশোধন ও তরবিয়তের, অতঃপর সংগঠন ও রচনার পথ অনুসরণ করা।
(১০) কুরআন ও সহীহ হাদীসের প্রতিকূল কোনও বক্তার ব্যক্তিপুজা না করা। এই দুয়ের উপর কোন ইমাম, আলেম বা চিন্তাবিদের কথাকে প্রাধান্য না দেওয়া, এ দুয়ের পরিপন্থী সকল মত ও সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র এ দুয়েরই অনুসরণ করা।
(১১) নেতা, আমীর বা রাজার আনুগত্য করা, যদি তারা কোন পাপ কার্যের আদেশ না দেয় এবং স্পষ্ট সপ্রমাণ কুফরীর প্রকাশ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করা।
(১২) সংখ্যায় কম হলেই পথ চলতে আতঙ্কিত ও ভীত না হওয়া। কেবল মাত্র হক ও দলীলের সাথে সম্মত হওয়া; যদিও বা সারা দুনিয়া বিরোধী হয়।
(১৩) দ্বীনের যাবতীয় আদর্শ ও শিক্ষায়, ব্যবহার ও আচরণে পরস্পর সহানুভূতিশীল হওয়া। সকলে মিলে যেন একটি দেহ, যার কোন একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে জাগরণ ও জ্বরে সারা দেহ সমব্যথী হয়। যেমন রসুল ঐ-এর চরিত্র ছিল আলকুরআন, তদনুরূপ ছিলেন তাঁর সাহাবাবৃন্দ যাঁরা আমাদের আদর্শ ও সলফ।