জানাযা দর্পণ সমবেদনা প্রকাশ আবদুল হামীদ ফাইযী

“যে যাবার সে চলে যায় ফিরে নাহি আসে গে,

সে আঁধার অমানিশায় চাঁদ নাহি হাসে গো। ”

মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন যেহেতু শোকাহত, তাই তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা প্রকাশ করা মুসলিমের কর্তব্য। সমবেদনা প্রকাশ হবে তাদেরকে সওয়াব স্মরণ করিয়ে ধৈর্য ও সহ্যের তাকদীর করে এবং তাদের জন্য ও মাইয়্যেতের জন্য নেক দুআ করে।

যে ব্যক্তি অনুরূপ সমবেদনা প্রকাশার্থে এবং মড়াবাড়ির লোকদেরকে সান্ত্বনা দিতে যায়, তার জন্য রয়েছে মহা প্রতিদান। বিশ্বনবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন মসীবতের সময় তার মুসলিম ভাইকে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা প্রকাশ করে তাকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন সবুজ রঙের লেবাস পরাবেন; যা অন্যান্য লোকে দেখে ঈর্ষা করবে।” (তারীখে বাগদাদ, খতীব ৭/৩৯৭, তারীখে দিমাঞ্চ, ইবনে আসাকির ১৫/৯১/১, ইবনে আবী শাইবাহ ৪/ ১৬৪ ইরওয়াউল গালীল ৭৫নং)।

সমবেদনা প্রকাশ করার সময় এমন কথা বলা কর্তব্য যাতে মাইয়্যেতের আত্মীয়-স্বজন সান্ত্বনা পায়, দুঃখের ভার হাল্কা হয়, আল্লাহর তকদীরে সন্তুষ্টি প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয় এবং তকদীরে যা ছিল তা-ই হয়েছে মনে করে ধৈর্যের বাধ না ভাঙ্গে।

সমাজ-বিজ্ঞানী নবী (ﷺ) বহু পরিবারকেই অনুরূপ সাক্ষাৎ করে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁর সেই মধুমাখা কথামালা স্মরণে থাকলে তো অতি উত্তম। নচেৎ নিজের তরফ থেকে সেইরূপ কথা বলা কর্তব্য, যা বিপদগ্রস্তের মনে শান্তির মলম হয়, আসল উদ্দেশ্য সাধিত হয় এবং তা যেন শরীয়তের অনুকূল হয়। প্রিয় রসূল (ﷺ) হতে যে সব কথামৃত প্রমাণিত তার কিছু নমুনা নিম্নরূপঃ

১। এক ব্যক্তির ছেলে মারা গেলে তাঁকে সাক্ষাৎ করে সান্ত্বনা দেওয়ার সময় তিনি বললেন,“হে অমুক! তোমার নিকট কোনটা অধিক পছন্দনীয় ছিল? তোমার ছেলেকে নিয়ে দুনিয়াতে সুখ উপভোগ করা, নাকি কাল যখন তুমি জান্নাতে যে কোন দরজায় যাবে, তখন সে তোমার আগে পৌছে তোমার জন্য দরজা খুলে দেবে সেটা?” লোকটি বলল, হে আল্লাহর নবী! বরং সে আমার আগে জান্নাতে গিয়ে আমার জন্য তার দরজা খুলবে এটাই আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়। মহানবী (ﷺ) বললেন, “অতএব তাই তুমি পাবে। (ধৈর্য ধর)।” (নাসাঈ ২০৮ ৭নং, হাকেম ১/৩৮৪, আহমদ ৫/৩৫)।

২। প্রিয় রসূল (ﷺ) এর কন্যা যয়নাব (রাঃ) এর এক শিশু-সন্তানের অন্তিম অবস্থা হলে তিনি পিয়ারা আব্বাকে ডেকে পাঠালেন। মহানবী (ﷺ) এক সাহাবী দ্বারা কন্যাকে সালাম দিয়ে এবং এই বলে পাঠালেন যে, “নিশ্চয় আল্লাহ যা নিয়েছেন তা তো তাঁরই ছিল। আর যা দিয়েছিলেন তাও তাঁরই ছিল। (জন্মমৃত্যু) সব কিছুই তার নির্ধারিত সময়সীমা অনুসারে ঘটে থাকে। অতএব সে যেন ধৈর্য ধরে এবং সওয়াবের আশা রাখে।” (বুখারী ১২৮৪, মুসলিম ৯২৩নং, আহমাদ ৫/ ২০৪, ২০৬, ২০৭, প্রমুখ।

৩। এক মহিলার শিশু সন্তান মারা গেলে তিনি তাকে সাক্ষাৎ করে বললেন, “আমি শুনলাম যে, ছেলেটি মারা যাওয়ায় তুমি বড় ধৈর্যহারা হয়েছ।” অতঃপর তাকে তিনি আল্লাহভীতি ও সহনশীলতার উপদেশ দিলেন। মহিলাটি বলল, হে আল্লাহর রসূল! কেন আমি ধৈর্যহারা হব না? আমি যে মৃতবৎসা নারী। ওই আমার একমাত্র ছেলে ছিল। আর হবে বলেও আশা নেই।” প্রিয় নবী (ﷺ) বললেন, “(তুমি মৃতবৎসা বা যার সন্তান বাঁচে না সে নারী নও।) কারণ প্রকৃত মৃতবৎসা সেই যার কোন সন্তান মারা যায় নি। (যেহেতু আখেরাতে উপকারে আসবে এমন সন্তানের মা-কে সন্তানহীনা মড়ুঞ্চে বলা হয় না।) শোন, যে কোন পুরুষ অথবা মহিলার তিনটি শিশুসন্তান মারা গেলে এবং তারা তাতে ধৈর্যধারণ করলে, তার প্রতিদানে আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত প্রবেশ করাবেন। উমার (রাঃ) নবী (ﷺ) এর ডাইনে বসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার আব্বা-আম্মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! আর যদি দুটি সন্তান মারা যায়?’ প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, “আর দুটি সন্তান মারা গেলেও (জান্নাত পাবে)।” (হাকেম ১/৩৮৪)

৪। আবু সালামাহর ইন্তেকাল হলে তিনি উম্মে সালামাহকে সাক্ষাৎ করে বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি আবু সালামাহকে মাফ করে দাও। ওর মর্যাদা উন্নীত করে ওকে হেদায়াতপ্রাপ্তদের দলভুক্ত কর। ওর বাকী বংশধরের মধ্যে ওর উত্তরসুরি দান কর। তুমি আমাদেরকে এবং ওকে ক্ষমা করে দাও হে সারা জাহানের প্রতিপালক! আর এর জন্য ওর কবরকে প্রশস্ত করে দাও এবং তা আলোময় করে দাও।” আর নবী (ﷺ) উম্মে সালামাহকে এমন এক দুআ শিখিয়ে দিয়েছিলেন যার ফলে তিনি হারিয়ে যাওয়া জিনিসের চেয়ে উত্তম জিনিস পেয়েছিলেন। (মুসলিম ১৫২৮ক, ইবনে মাজাহ ১৪৪৪ক, বুখারী ১৫২৫ক)।

৫। জাফর ইন্তেকাল করলে তিনি তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহকে সাক্ষাৎ করে দুআ করেছিলেন, “হে আল্লাহ! তুমি জাফরের বংশধরে ওর অনুরূপ উত্তসূরি দান কর। আর আব্দুল্লাহর ব্যবসায় বৰ্কত দান কর।” এই দুআ তিনি ৩ বার করলেন। (আহমাদ ১৭৫০নং, হাকেম ৩/২৯৮)।

সমবেদনা প্রকাশে মুস্তাহাব হল, এতীমের মাথায় হাত বুলানো ও তার প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করা। পুর্বোক্ত আব্দুল্লাহর মাথায় হাত বুলিয়ে দয়ার নবী (ﷺ) দুআ করেছিলেন। (আহমাদ ১৭৬০নং, হাকেম ১/৩৭২, বাইহাকী ৪/৬০)।

এই সময় শোকাহত ব্যক্তিদেরকে এ খবর দেওয়াও উচিত যে, তারা কাঁদাকাটি করলে তাদের মাইয়্যেতের আযাব হবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৭২৪নং) মাতম করা জাহেলিয়াতের কাজ। তওবা না করলে কিয়ামতে আযাব হবে। (মুসলিম, মিশকাত ১৭ ২৭নং) ইত্যাদি।

আর এই সময় এমন কথা না বলা বা এমন ঘটনার উল্লেখ না করা উচিত, যাতে শোকতপ্ত মানুষের শোক আরো বৃদ্ধি পায়। কেননা, বিস্মৃত স্মৃতির স্মরণে ব্যথিত হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে। পুরনো ব্যথা পুনরায় নতুন করে জেগে ওঠে। ঈমানের আলোকে আলোকমন্ডিত, তাকওয়ার ফুল-ফলে পরিশোভিত এবং সহায়তা ও সহানুভুতিতে সদাজাগ্রত যে সমাজ, সে সমাজেরই নিকট হতে এমন সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহারের আশা করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)

অর্থাৎ, শপথ মহাকালের! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু ওরা নয় যারা মু’মিন ও সৎকর্ম পরায়ণ এবং পরস্পরকে যারা সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। (সুরা আসর)

সমবেদনা প্রকাশের জন্য কোন দিন-ক্ষণ নেই, কোন সীমাও নেই। তিন দিন পার হয়ে গেলেও সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যে মাইয়্যেতের আত্মীয়-স্বজনকে দেখা করা উচিত। তাদের শোকব্যথা দূর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে সাক্ষাৎ করে এই কাজ করা উচিত।

সমবেদনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বাড়ি, কবরস্থান বা মসজিদে সকলের জমায়েত হওয়া এবং আগতদের জন্য মড়াবাড়ির লোকেদের বিশেষ পানাহার তৈরী করা বৈধ নয়। কারণ, এটা মাতমের পর্যায়ভুক্ত যা জাহেলিয়াতের কর্ম এবং তা হারাম। (আহমাদ, ইবনে মাজাহ)

প্রথম সাক্ষাতে মুসাফাহা সুন্নত। নচেৎ সমবেদনা প্রকাশের উদ্দেশ্যে কোন বিশেষ মুসফাহা, কোলাকুলি বা চুম্বন নেই। (সাবউনা সুআলান ২৮ পৃঃ)

এই উদ্দেশ্যে দূর থেকে সফর করাও বিধেয় নয়। তবে শোকাহত ব্যক্তি যদি একান্ত নিকটাত্মীয় কেউ হয় এবং দেখা করতে না গেলে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার শামিল হয়, তাহলে সফর করা বৈধ। (ফাতাওয়াত তাযিয়াহ ৯ পৃঃ)

পত্রিকার মাধ্যমে সমবেদনা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করার পর্যায়ভুক্ত। সুতরাং তা বৈধ নয়। (ঐ ৭পৃঃ)

দেখা-সাক্ষাৎ ও সান্ত্বনা দানের সময় কুরআন পাঠ বিধেয় নয়। যা বিধেয় তা হল মাইয়্যেত ও তার পরিবারের জন্য দুআ করা। পক্ষান্তরে এই উপলক্ষে সুরা ইয়াসীন বা অন্য কোন কুরআনের সূরা অথবা আয়াত পাঠ করা বিদআত। (ঐ ৪৬) অনুরূপ উক্ত সময় ওয়ায-নসীহত করা, মর্সিয়াখানি বা রকমারি খাদ্যসামগ্রী নিবেদন করাও বিদআত। (ঐ ৪৬ ৪৭পৃঃ) (অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠানো বিধেয়।) এই সময় শোকাহত লোকেদের বিশেষ ধরনের (যেমন কালো) লেবাস পরিধান করাও বিদআতের পর্যায়ভুক্ত।[৩৮ পৃঃ)

সমবেদনা প্রকাশার্থে মহিলারাও পর্দার সাথে যাবে। মাহরাম না হলে লাশ দেখা জরুরী নয়। বরং পুরুষের লাশের নিকট বেগানা মহিলাদের ভিড় করা এবং মাইয়্যেতের আত্মীয় স্বজনের নিকট বেপর্দায় সমবেদনা প্রকাশ করতে যাওয়া হারাম। মাইয়্যেতের আত্মীয়রা মাহরাম (অগম্য) হলে তাদেরকে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা প্রকাশ করবে। নচেৎ পর্দার সাথে রাত্রে অথবা লাশ নিয়ে পুরুষরা বের হয়ে গেলে সেই সময় গিয়ে মড়াবাড়ির মহিলাদের সাথে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানাবে। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে পুরুষদের উচিত, একান্ত নিকটাত্মীয় না হলে তাদের মহিলাদেরকে মড়াবাড়ি না নিয়ে যাওয়া, যেমন নিজে না গিয়ে মহিলাদেরকে। পাঠানো (!) অনুচিত। কারণ, এসব ক্ষেত্রে (এবং বিবাহেও বিশেষ করে ঐ বাড়িতে শরয়ী পর্দার যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকলে) বেপর্দা হয়ে এবং মড়ার উপর ঝুটা কান্না কেঁদে মেয়েরা মাথায় করে পাপ নিয়েই ঘর ঢুকবে। অথচ পুরুষ গেলে জানাযা পড়ে দাফনাদি করে মড়াবাড়ির উপকার করবে এবং নিজেও নেকীর বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু যেখানে মেয়েই মরদ, সেখানে দ্বীনের কি দরদ?’

কিছু মহিলা আছে যারা মড়াবাড়ি আসা মাত্রই মাইয়্যেতের পরিজনের মহিলাদের গলা ধরে এমন সুর করে কান্না শুরু করে দেয় যে, তাতে উপস্থিত পুরুষরাও না কেঁদে পারে না। আরো কিছু মহিলা আছে যারা কুমীরের কান্না কাঁদে! অনেকে লজার খাতিরে, লোক দেখিয়ে, নাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা বদনামের ভয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ছন্দ বানিয়ে, কান্না না এলেও জোর করে কাঁদে। অথচ এসব যে কত নিকষ্টস্বভাব তা বলাই বাহুল্য। পিয়ারা নবী (ﷺ) এমন মাতমকারিণী এবং শ্রোতা মহিলাকে অভিসম্পাত করেছেন। সুতরাং মহিলাদের জন্য এমন কর্ম করা অবশ্যই বৈধ নয়। যেমন, মাইয়্যেতের পরিজনদের উচিত, তাদেরকে এমন কান্নার সুযোগ না দেওয়া। মানা করা সত্ত্বেও যদি তারা বিরত না থাকে, তবে সম্ভব হলে তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া উচিত। (ঐ৩৭পৃঃ) কোন কাফেরকে অনুরূপ সান্ত্বনা দিতে যাওয়া বৈধ নয়। আর বৈধ নয় তাদের কারো শবযাত্রায় অংশগ্রহণ করা। কারণ, প্রত্যেক কাফের হল মুসলিমদের এক প্রকার শত্রু আর শত্রুকে সান্ত্বনা বা কোনরূপ উৎসাহ প্রদান বৈধ হতে পারে না।

যেমন, তাদের শেষক্রিয়ায় আমাদের অংশ গ্রহণ তাদের কোন উপকার দেবে না। কারণ, তাদের আত্মার কল্যাণার্থে দুআ করাই আমাদের জন্য হারাম। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَن يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَىٰ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ

অর্থাৎ, নিকটাত্মীয় হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও মুসলিমদের জন্য সংগত নয়; যখন তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামী। (সুরা তাওবাহ ১১৩ আয়াত)

পক্ষান্তরে তারা যদি আমাদের বিপদের সময় আমাদেরকে সান্ত্বনা দিতে আসে, তাহলে তা গ্রহণ করতে পারি এবং বিনিময়ে তাদের জন্য হেদায়াতপ্রাপ্তির দুআ করতেও পারি। (ঐ ৩৯পৃঃ)।