ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে ঐ সমস্ত মুশরিকের বিরুদ্ধে হুজ্জত কায়েম করেছেন, যারা আল্লাহর এবাদতে তাদের শরীক ও সুপারিশ কারীদেরকে অংশীদার করত। অথচ এরা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং তারা কিভাবে সেই আল্লাহর অংশীদার হতে পারে, যারা তাঁর সৃষ্টি ও অনুগত বান্দা? আল্লাহ তাআলা আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, যারা তাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে, তারা সাহায্য প্রার্থীদের উপকার করার ক্ষমতা রাখেনা। এমনকি তারা নিজেরাও নিজেদের সাহায্য করতে পারেনা।
যাদেরকে আহবান করা হচ্ছে, তারা নিজেরাই যেহেতু নিজেদের সাহায্য করতে পারেনা, তাই অন্যদেরকে সাহায্য করার প্রশ্নই আসেনা। সুতরাং এই বিরাট দু’টি দলীলের মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের কাছে মুশরিকদের সাহায্য কামনা করা সম্পূর্ণ বাতিল। দলীল দু’টির সারসংক্ষেপ হচ্ছে, যাদেরকে মুশরিকরা সাহায্যের জন্য আহবান করছে, তারা তো আল্লাহর বান্দা ও অনুগত গোলাম, তিনি তাদেরকে তাঁর এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর বান্দা কখনই মাবুদ হতে পারেনা।
আরেকটি দলীল হচ্ছে যাদেরকে আল্লাহর শরীক মনে করা হচ্ছে, তারা নিজেরাই নিজেদের কল্যাণ ও সাহায্য করতে সক্ষম নয়। সুতরাং অন্যদেরকে তারা সাহায্য করতে পারবে- কিভাবে এ আশা পোষণ করা যেতে পারে? উপরোক্ত আয়াত এবং একই অর্থে কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা উচিৎ।
আল্লাহ তাআলা নিম্নের বাণী দ্বারা আয়াতগুলোর সূচনা করেছেনঃ
ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِنْ قِطْمِيرٍ (13) إِنْ تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ
‘‘তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। রাজত্ব তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা কিতমিরেরও[1] অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনেনা। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়না। কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ক অস্বীকার করবে। আর আল্লাহ্র ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবে না’’। (সূরা ফাতিরঃ ১৩-১৪)
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা এ আয়াতগুলোর শুরুতে বলেছেনঃ তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। রাজত্ব তারই। এখানে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্য। দুনিয়ার সকল বাদশাহ ও রাজত্ব এবং সকল সৃষ্টি তাঁরই পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাধীন। সকল মাখলুকই তাঁর অনুগ্রহ, ফজল ও করমের ছায়াধীন। কোন কিছুই তাঁর হিকমত ও ইলমের বাইরে নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা খেজুরের আuঁটর উপর যেই পাতলা আবরণ থাকে তারও অধিকারী নয়। সুতরাং যার অবস্থা ঠিক এ রকমই, আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে কল্যাণ কামনা করা কিংবা অকল্যাণ দূর করার কামনা করা কখনই জায়েয নয়। বরং ইখলাসের সাথে কেবল তাঁর কাছেই দুআ করা আবশ্যক। কেননা দুআ এবাদতের বিরাট একটি অংশ।
আল্লাহ তাআলা আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, মুশরিকরা যাদেরকে আহবান করছে, তারা কোনো কিছুরই মালিক নয়। তারা দুআকারীদের আহবান শুনতেও পায়না। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, তারা আহবানকারীদের ডাক শুনে, তথাপিও তারা আহবানকারীদের আহবানের সাড়া দিতে সক্ষম নয়। কিয়ামতের দিন তারা তাদের সাথে শির্ক করাকে অস্বীকার করবে। অর্থাৎ তারা তাদের কাজ-কর্ম থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে ঘোষণা করবে। উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে সর্ব বিষয়ে পরিজ্ঞাত আল্লাহ তাআলা এই বিষয়ের খবর দিয়েছেন। আসমান ও যমীনের কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়।
আল্লাহ তাআলা আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে দুআ করা আল্লাহর সাথে শির্কের অন্তর্ভূক্ত। আর যে ব্যক্তি শির্ক করা অবস্থায় তাঁর প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কখনই ক্ষমা করবেন না। কেননা মুশরিকরা আল্লাহ তাআলাকে সত্য বলে সত্যায়ন করেনি এবং আল্লাহর শরীয়ত ও হুকুমের আনুগত্য করেনি। বরং তারা বলেছে, মৃত অলীরাও ফরিয়াদ কারীদের দুআ শ্রবণ করে এবং উপকারও করে। এর মাধ্যমে তারা ঈমান ও ইসলামকে একদম ছেড়ে দিয়েছে। এই উম্মতের অধিকাংশের অবস্থাই ঠিক এ রকমই।
সহীহ বুখারীতে আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, উহুদ যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঘাত প্রাপ্ত হলেন এবং তাঁর সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুঃখ করে বললেনঃ
«كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا نَبِيَّهُمْ فَنَزَلَتْ لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَىْءٌ»
‘‘সে জাতি কেমন করে সাফল্য লাভ করবে, যারা তাদের নবীকে আহত করে’’। তখন لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ এই আয়াত নাযিল হল। যার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর এ ফয়সালার ব্যাপারে তোমার কোন হাত নেই’’।[2]
সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ফজরের নামাযের শেষ রুকু হতে মাথা উঠিয়ে سمع الله لمن حمده ربنا ولك الحمد বলার পর এ কথা বলতে শুনেছেন اللهم العن فلانا وفلانا ‘‘হে আল্লাহ! তুমি অমুক, অমুক ব্যক্তির উপর তোমার লানত নাযিল কর’’। তখন এ আয়াত নাযিল হয়, لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ ‘‘এ বিষয়ে তোমার কোনো এখতিয়ার নেই’’। আরেক বর্ণনায় আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা এবং সুহাইল বিন আমর এবং হারিছ বিন হিশামের উপর বদ দুআ করেন, তখন এ আয়াতلَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ নাযিল হয়েছে। পরে এই লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তারা খাঁটি মুসলিমে পরিণত হয়েছিলেন।
ব্যাখ্যাঃ হাদীছটি ইমাম বুখারী আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে হুমাইদ এবং ছাবিতের সূত্রে মুআল্লাক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইমাম তিরমিযী, ইমাম শাফেঈ আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে হুমাইদের সূত্রে মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ১৫৪ নং আয়াতে বলেনঃ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ ‘‘তুমি বলো, সবকিছুই আল্লাহ্র হাতে’’। আল্লাহ তাআলা সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
‘‘সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহরই রয়েছে সৃষ্টি করা ও হুকুম করার ক্ষমতা’’। এ অর্থে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।
উদ্দেশ্য হচ্ছে, যার অধীনে সকল বস্ত্ত এবং যার হাতেই সকল রাজত্ব, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের কোন অংশের মালিক নয়। এ অর্থেই আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেনঃ
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
‘‘তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে সৎপথে আনতে পারবেনা, তবে আল্লাহ্ তাআলাই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই অধিক জানেন’’।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বলেনঃ এ বিষয়ে তোমার কোন এখতিয়ার নেই। অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহর সর্বোত্তম বান্দা। তিনি সর্বদা মানুষকে এ কথার আহবান জানাতেন যে, তারা যেন সেই সত্তার এবাদত করে, যার হাতে সবকিছুর মালিকানা। তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ। এটিই হচ্ছে সেই দ্বীন, যা সহ তিনি প্রেরিত হয়েছেন এবং স্বীয় উম্মতের নিকট তা পৌঁছাতে এবং এর দিকে দাওয়াত দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দানের প্রতি আহবান করা’’ নামক অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
হে সম্মানিত পাঠক বৃন্দ! মুমিনদের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যে সরল-সোজা পথ নির্ধারণ করেছেন, তা বাদ দিয়ে অন্য কোনো পথের অনুসরণ করবেন না।
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যখন وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ নাযিল হল, তখন তিনি বললেনঃ
«يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ لاَ أُغْنِى عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا يَا عَبَّاسُ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللَّهِ لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِينِى مَا شِئْتِ مِنْ مَالِى لاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا»
‘‘হে কুরাইশ বংশের লোকেরা! অথবা এ ধরণেরই অন্য কোনো কথা বললেন। তোমরা তোমাদের জীবনকে খরিদ করে নাও। আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো উপকার করতে পারবোনা। হে আববাস বিন আবদুল মুত্তালিব! আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি আপনার কোনো উপকার করতে সক্ষম নই। হে আল্লাহর রাসূলের ফুফু সাফিয়্যাহ! আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি আপনার কোন উপকার করতে সক্ষম নই। হে মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা, আমার সম্পদ থেকে যা খুশী চাও। কিন্তু আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে তোমার কোনো উপকার করার ক্ষমতা আমার নেই’’।[3]
ব্যাখ্যাঃ আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর নামের ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ সঠিক কথা হচ্ছে, তাঁর নাম আব্দুর রাহমান বিন সাখর। তিনি ছিলেন দাওস গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। সাহাবীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাধিক হাদীছ মুখস্থকারী। সহীহ বুখারীতে ওহাব ইবনে মুনাবিবহ তার ভাই থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ আমি আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাহাবীদের মধ্যে আমার চেয়ে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী অন্য কেউ নেই। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের কথা ভিন্ন। তিনি আমার চেয়ে অধিক হাদীছ বর্ণনা করার কারণ হচ্ছে, তিনি লিখতেন, আর আমি লিখতাম না। ৭৮ বছর বয়সে হিজরী ৫৭ সালে মতান্তরে ৫৮ সালে অথবা ৫৯ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
এ হাদীছটি বিভিন্ন সনদে বুখারী, মুসলিম, মুসনাদ ও সুনানের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের জীবনকে খরিদ করে নাওঃ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যা নিয়ে এসেছেন, তার আনুগত্যের মাধ্যমে নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। এবাদতের মধ্যে আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করো এবং ইতিপূর্বে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যে সকল মূর্তি পূজা করতে, তা বর্জন করো। কেননা তারা ঐ শির্কের মাধ্যমে এমন সব বস্ত্তর গোলামে পরিণত হয়েছিল, যা উপকার ও ক্ষতি করতে পারেনা, কারো কথা শুনতে পায়না, শুনলেও জবাব দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা। অথচ ঐ মুশরিকরা জানত যে, তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য যে এবাদত করছে তা শির্ক। কেননা তারা তাদের তালবিয়াতে বলতঃ
لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট হাজির হয়েছি। তোমার ডাকে বারবার সাড়া দিয়েছি। তোমার কোন শরীক নেই। তবে তোমার একজন শরীক রয়েছে। আর তুমি ঐ শরীকেরও মালিক। এমনকি সে যা কিছুর মালিক তুমি তারও মালিক।
সুবহানাল্লাহ! তাদের বিবেকের মধ্যে কিভাবে এ কথা প্রবেশ করল যে, গোলাম মনিবের মালিক হতে পারে?
সূরা রোমের ২৮-২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
ضَرَبَ لَكُمْ مَثَلًا مِنْ أَنْفُسِكُمْ هَلْ لَكُمْ مِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ شُرَكَاءَ فِي مَا رَزَقْنَاكُمْ فَأَنْتُمْ فِيهِ سَوَاءٌ تَخَافُونَهُمْ كَخِيفَتِكُمْ أَنْفُسَكُمْ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ (28) بَلِ اتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَهْوَاءَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَمَنْ يَهْدِي مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেনঃ তোমাদেরকে আমি যে রুজী দিয়েছি, তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীরা কি তাতে তোমাদের সমান অংশীদার? তোমরা কি তাদেরকে সেরূপ ভয় করো, যেরূপ নিজেদের লোককে ভয় করো? এমনিভাবে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলি বিস্তারিত বর্ণনা করি। বরং যারা যালেম, তারা মূর্খতা বশতঃ তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে থাকে। অতএব, আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, কে তাকে হেদায়াত করবে? বস্ত্ততঃ তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।
لاَ أُغْنِى عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে আমি তোমাদের কোনো উপকার করতে সক্ষম নইঃ উপরে যা আলোচনা করা হয়েছে, তার সারমর্ম হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই স্বীয় হিকমত, জ্ঞান এবং ইচ্ছা অনুযায়ী সৃষ্টির সকল কাজকর্ম পরিচালনা করেন। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে এ ক্ষেত্রে যতটুকু জানান, বান্দা ঠিক ততটুকুই জানতে পারে। যে ব্যক্তি ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে ও শির্ক থেকে বিরত থাকবে এবং আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্যের এবাদত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে, শুধু সেই আল্লাহর শাস্তি হতে রেহাই পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
‘‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে শির্ক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। বস্ত্ততঃ যালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদাঃ ৭২)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হাদীছে তাঁর আত্মীয় স্বজনকে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি আল্লাহর মুকাবেলায় তাদের কোন উপকার করতে পারবেন না। তিনি তাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং তারা যেন কিয়ামতের দিন কোন অযুহাত পেশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থাও করেছেন। তাই তিনি কুরাইশ গোত্রের সকল শাখার লোকদেরকে এবং সমগ্র আরব গোত্রকেই বিভিন্ন মৌসুমে সতর্ক করেছেন। তিনি তাঁর চাচা, ফুফু এবং কন্যাকে সতর্ক করেছেন। এরা হচ্ছেন তাঁর সর্বাধিক নিকটের লোক। তিনি তাঁর এ সকল আত্মীয়কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা যদি ঈমান আনয়ন না করে এবং তিনি যে তাওহীদ নিয়ে এসেছেন, তা কবুল না করে এবং শির্ক বর্জন না করে, তাহলে তিনি তাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারবেন না।
سَلِينِى مَا شِئْتِ مِنْ مَالِى আমার সম্পদের যা খুশী চাওঃ কেননা তিনি এ বিষয়ে ক্ষমতা রাখেন। আর যে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ক্ষমতাবান, তাতে তিনি ব্যতীত অন্য কারো অধিকার নেই। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে উপরোক্ত হাদীছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণকারী আবু তালিব যখন ইন্তেকাল করল এবং আল্লাহর সাথে শির্ক করা বর্জন করলনা, তখন তিনি বললেনঃ নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবো। তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেনঃ
مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ
‘‘নবী ও মুমিনদের উচিত নয় যে, তারা মুশরেকদের জন্য মাগফেরাত কামনা করবে, যদিও তারা আত্মীয় হয়। এ কথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী’’। (সূরা তাওবাঃ ১১৩)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, আবু তালেব যেহেতু ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাক্ষ্য না দিয়েই মৃত্যু বরণ করেছে, তাই সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং তার এ স্বীকৃতি দেয়া যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হকের উপর রয়েছেন- এটি তার কোনো উপকারে আসেনি। কেননা সে তার পিতা আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন এবং শির্ক বর্জন করেননি।
সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে কোন প্রকার সাহায্য চাওয়া, চাই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে শাফাআত প্রার্থনা করা হোক বা অন্য কিছু চাওয়া হোক, তা আল্লাহর সাথে শির্ক করার অন্তর্ভূক্ত। এটি তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে বিপদ ডেকে আনবে। শাফাআত শুধু তাওহীদপন্থীদের জন্যই হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
‘‘আপনি এ কুরআন দ্বারা তাদেরকে ভয়প্রদর্শন করুন, যারা আশঙ্কা করে স্বীয় পালনকর্তার কাছে এমতাবস্থায় একত্রিত হওয়ার যে, তাদের কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবেনা। যাতে তারা গোনাহ্ থেকে বেঁচে থাকে’’। (সূরা আনআমঃ ৫১) এই অর্থে আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে। শাফাআত অধ্যায়ে ইনশা-আল্লাহ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) এ অধ্যায়ে উল্লেখিত দু’টি আয়াতের তাফসীর জানা গেল।
২) উহুদ যুদ্ধের কাহিনী জানা গেল।
৩) নামাযে সাইয়্যেদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ‘‘দুআয় কুনুত’’ পাঠ করা এবং সাহাবায়ে কেরামের আমীন বলার কথা জানা গেল।
৪) যাদের উপর বদ দুআ করা হয়েছে তারা ছিল কাফের।
৫) মক্কার কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে এমন আচরণ করেছিল, যা অতীতের অধিকাংশ কাফেররাই তাদের নবীদের সাথে করেনি। যেমন তারা তাদের নবীকে আঘাত করেছিল, তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল এবং একই বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও তারা উহুদ যুদ্ধের শহীদদেরকে বিকলাঙ্গ করেছিল। অর্থাৎ হাত-পা, নাক-কান ইত্যাদি কেটে ফেলেছিল।
৬) উপরোক্ত মসীবত আপতিত হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর আল্লাহর বাণীঃ لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ‘‘এ বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই’’, -এই আয়াতাংশটি নাযিল হয়।
৭) অতঃপর আল্লাহ তাআলা এই বাণী নাযিল করলেনঃأَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ অথবা ইচ্ছা করলে তিনি তাদেরকে তাওবা করার তাওফীক দিবেন, ফলে তারা তাওবা করবে অথবা তাদেরকে শাস্তি দিবেন। এরপর আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অনুগ্রহ করলেন। তারা তাওবা করল। আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করলেন, আর তারাও আল্লাহর উপর ঈমান আনল।
৮) বালা-মসীবতের সময় দুআ কুনুত পড়া।
৯) যাদের উপর বদ দুআ করা হয়, নামাযের মধ্যে তাদের নাম এবং তাদের পিতার নাম উল্লেখ করে বদ দুআ করা বৈধ।
১০) ‘‘কুনুতে নাযেলায়’’ নির্দিষ্ট করে লা’নত করা।[4]
১১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর যখন وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ অর্থাৎ তোমার নিকট আত্মীয়দেরকে সতর্ক করো- এই আয়াত নাযিলহল, তখন তিনি তাঁর আত্মীয় স্বজনদের মধ্য হতে একজন একজন করে ডেকে সতর্ক করেছেন।
১২) তাওহীদের দাওয়াত প্রচারের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এতে তাকে পাগল বলা হয়েছে। এমনি বর্তমানেও কেউ যদি তাওহীদের দাওয়াত দেয়, তার সাথেও একই আচরণ করা হবে।
১৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দূরবর্তী এবং নিকটাত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে বলেছেন لا أغني عنك من الله شيئا অর্থাৎ আল্লাহর কাছে জবাব দিহি করার ব্যাপারে আমি তোমাকে কোন প্রকার সাহায্য করতে পারবনা। এমনকি তিনি স্বীয় কন্যা ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, يا فاطمة لا أغني عنك من الله شيئا‘ ‘হে ফাতেমা! আমি আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে তোমার কোন উপকার করতে সক্ষম নই’’। তিনি নবীগণের নেতা হওয়া সত্ত্বেও নারীকুল শিরোমণির জন্য কোন উপকার করতে না পারার ঘোষণা দিয়েছেন। আর মানুষ যখন এটা বিশ্বাস করে নিবে যে, তিনি সত্য ছাড়া কিছুই বলেন না। অতঃপর যে ব্যক্তি বর্তমান সময়ের সাধারণ মানুষ, আলেম ও বিশেষ ব্যক্তিদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করবে, তার কাছে সঠিক তাওহীদ সুস্পষ্ট হবে এবং ইসলামের সঠিক শিক্ষার দৈন্যতার বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে।
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ এ বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই।
[3] - বুখারী, অধ্যায়ঃ (অসীয়তের ক্ষেত্রে) স্ত্রীলোক এবং সন্তান আত্মীয়-স্বজনের অন্তর্ভূক্ত কি না?
[4] - অর্থাৎ উক্ত হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করে নির্দিষ্টভাবে কারো উপর লা’নত করা জায়েয নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা করতে নিষেধ করেছেন। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ليس لك من الأمرشيئ ‘‘এ বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই’’।