(الصحابة) শব্দটি (صاحب) এর বহুবচন। আরবী ভাষায় এ বাক্যটি ব্যতীত (فاعل) এর বহুবচন (فعالة) অন্য কোনো শব্দের জন্য ব্যবহৃত হয় না।[1]

শর‘ঈ পরিভাষায় সাহাবী বলা হয়, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন এবং ইসলামের ওপর মারা গেছেন।[2] এটি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অধিকাংশ আলেমদের অভিমত। অতএব, সাহাবী সাব্যস্ত হতে এর চেয়ে আর বেশি শর্তাবলী আরোপ করার প্রয়োজন নেই। যেমন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দীর্ঘ সাহচর্য, তাঁর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা ইত্যাদি।

ইবন কাসীর রহ. বলেছেন, ‘‌যে ব্যক্তি মুসলিম অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন তিনিই সাহাবী; যদিও তার দীর্ঘ সাহচর্য নেই বা তাঁর থেকে কোন হাদীস বর্ণনা করেন নি।’ এটি সৎপূর্বসূরী ও উত্তরসূরী সব আলেমের অভিমত।[3]

ইমাম আহমাদ রহ. বলেছেন, ‘যে কেউ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে একবছর বা একমাস বা একদিন বা এক ঘন্টা ছিল বা এক মুহূর্ত তাঁকে দেখেছেন তিনি তাঁর সাহাবী। সাহচর্যের সময় অনুপাতে তাদের সাহাবীত্বের মর্যাদা নির্ণয় করা হবে।’[4]

ইমাম বুখারী রহ. তার সহীহ বুখারীতে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছেন অথবা যে মুসলিম তাঁকে দেখেছেন তিনি সাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত।’[5]

সুহবাত তথা সান্নিধ্যের শাব্দিক অর্থের সাথে এ অর্থ সামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনুরূপ। কেননা সুহবাত শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোন কিছুর সাথে তুলনা করা, তার সাথে লেগে থাকা ও সান্নিধ্যে থাকা। ইবন ফারিস রহ. বলেছেন, সাদ, হা ও বা (صحب) একই মূল ধাতু থেকে নির্গত, যা কোনো কিছুর সাথে মিল ও নিকটে অবস্থানের অর্থে বুঝায়, এ শব্দ থেকে বলা হয় (الصاحب) বা সাথী।[6] অতএব, এ সাহচর্যের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই এবং সাহাবী হতে দীর্ঘ সান্নিধ্য ইত্যাদি কোনো শর্তারোপও করা যাবে না।

এ কথার দলীল হচ্ছে নিম্নোক্ত আয়াত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَأَنجَيۡنَٰهُ وَأَصۡحَٰبَ ٱلسَّفِينَةِ﴾ [العنكبوت: ١٥]

“অতঃপর তাকে ও নৌকা আরোহীদেরকে আমি রক্ষা করলাম”। [সূরা আল-আনকাবূত, আয়াত: ১৫]

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿كَمَا لَعَنَّآ أَصۡحَٰبَ ٱلسَّبۡتِ﴾ [النساء : ٤٧]

“যেমনিভাবে লা‘নত করেছি আসহাবুস সাবত তথা শনিবার ওয়ালাদেরকে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৭]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّكُنَّ صَوَاحِبُ يُوسُفَ».

“নিশ্চয় তোমরা ইউসুফ আলাইহিস সালামের এর ঘটনার (নিন্দুক) নারীদের ন্যায় (সাথী) হয়ে পড়েছ।”[7]

কুরআন ও হাদীসের উপরোক্ত প্রমাণাদি দ্বারা বুঝা যায় যে, সুহবাত তথা সাথী হওয়া একটি ইসমে জিনস তথা সামষ্টিক অর্থজ্ঞাপক নাম; যা অল্প ও বেশি উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই বলা হয়, সে অমুকের সাথে ছিল এক বছর বা এক মাস বা এক মুহূর্ত।[8]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামান্য সান্নিধ্য; এমনকি ঈমানের সাথে তাঁকে দেখলেই যে সাহাবী হয়ে যায় তার বর্ণনা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীসেই পাওয়া যায়। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ، يَغْزُو فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ، فَيُقَالُ لَهُمْ: فِيكُمْ مَنْ رَأَى رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَيَقُولُونَ: نَعَمْ، فَيُفْتَحُ لَهُمْ، ثُمَّ يَغْزُو فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ، فَيُقَالُ لَهُمْ: فِيكُمْ مَنْ رَأَى مَنْ صَحِبَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَيَقُولُونَ: نَعَمْ، فَيُفْتَحُ لَهُمْ، ثُمَّ يَغْزُو فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ، فَيُقَالُ لَهُمْ: هَلْ فِيكُمْ مَنْ رَأَى مَنْ صَحِبَ مَنْ صَحِبَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَيَقُولُونَ: نَعَمْ فَيُفْتَحُ لَهُمْ».

“(ভবিষ্যতে) মানুষের মাঝে এমন এক সময় আসবে যখন তাদের একদল জিহাদ করতে থাকবে। এরপর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন যিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন? তারা বলবেন, হ্যাঁ। তখন তাদেরকে বিজয় দান করা হবে। এরপর মানুষের মধ্য থেকে একদল যুদ্ধ করতে থাকবে। তখন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমাদের মধ্যে কি এমন কোনো ব্যক্তি আছেন, যিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণকে দেখেছন? তারা বলবেন, জি হ্যাঁ। তখন তাদেরকে বিজয় দান করা হবে। এরপর মানুষের আরেকটি দল জিহাদ করতে থাকবে। তখন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছেন, যিনি সাহাবীগণের সাহচর্য লাভকারী অর্থাৎ তাবে‘ঈগণকে দেখেছেন? তখন লোকেরা বলবে, জি হ্যাঁ। তখন তখন তাদেরকে বিজয় দান করা হবে।”[9]

উপরোক্ত হাদীসে দর্শন লাভকারীকে সাথী বলা হয়েছে। অতএব, কারো দেখা লাভকারী হলো তার সাহাবী।[10]

ঈমানের সাথে শুধু দেখা পাওয়াই যে সাহাবী হওয়ার জন্য যথেষ্ট এ অর্থে নিম্নোক্ত হাদীসটিও তার প্রমাণ। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«وَدِدْتُ أَنَّا قَدْ رَأَيْنَا إِخْوَانَنَا» قَالُوا: أَوَلَسْنَا إِخْوَانَكَ؟ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: «أَنْتُمْ أَصْحَابِي وَإِخْوَانُنَا الَّذِينَ لَمْ يَأْتُوا بَعْدُ».

“আমার বড় ইচ্ছা হয় আমাদের ভাইদেরকে দেখি। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি আপনার ভাই নই? তিনি বললেন, তোমরা তো আমার সাহাবী। আর যারা এখনো (পৃথিবীতে) আসে নি তারা আমাদের ভাই।”[11]

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أَنْتُمْ أَصْحَابِي، وَلَكِنْ إِخْوَانِي الَّذِينَ آمَنُوا بِي وَلَمْ يَرَوْنِي».

“তোমরা আমার সাহাবী; কিন্তু আমার ভাই তো তারাই যারা আমাকে দেখে নি অথচ আমার প্রতি ঈমান এনেছে”।[12]

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব ভাইদেরকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছেন তাদের ও সাহাবীগণের মধ্যে পার্থক্য হলো তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভ ও দেখা করা। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন ও তাঁকে দেখেছেন তিনি তাঁর সাহাবী।[13]উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেসব সাহাবী কেবল একনজর দেখেছিলেন, তাদের দেখা কেবল চোখের দেখাতে সীমাবদ্ধ ছিল না, (যেমন কাফির ও মুনাফিকরা দেখেছে) বরং আল্লাহ সেসব সৎলোকদেরকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ, আনুগত্য ও ভালোবাসার জন্য দেখার তাওফিক দিয়ে তাদেরকে সম্মানিত করেছেন, তারাও ঈমান আনয়ন, তাঁর ভালোবাসা ও বন্ধুত্বগ্রহণ, তাঁর শত্রুদের সাথে শত্রুতাপোষণের মানসে তাঁকে দেখেছেন। সুতরাং তাদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখার কারণে এ মহামূল্যবান উঁচুমর্যাদা তাদের জন্য অর্জিত হওয়া যথাযথ।[14] কেনই বা হবে না; রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখা, তাঁর সাক্ষাৎ লাভ ও তাঁর সান্নিধ্যে থাকা যে একাধারে কল্যাণ, বরকত ও হিদায়াতের আলো পাওয়া হিসেবে বিবেচিত, এটা হতভাগা অন্ধ ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না।[15]

>
[1] দেখুন, লিসানুল আরব, (৪/২৪০০); আন-নিহায়া ফি গরীবিল হাদীস ওয়াল আসার, (৩/১২); তাজুল ‘আরুস মিন জাওয়াহিরিল কামূস, (৩/১৮৬)। সাহাবী শব্দটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ব্যাপারেই ব্যবহৃত হয়; এমনকি তাদের নাম হিসেবেই শব্দটির ব্যবহার। এ কারণেই সাহাবীকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে নিসবত করা হয়। দেখুন, আল-কুল্লিয়্যাত, কাফাভী, পৃষ্ঠা ৫৫৮।

[2] আল-ইসাবা ফি তাময়ীযেস সাহাবাহ, ১/১৬।

[3] ইখতিসারু ‘উলুমিল হাদীস মা‘ আল-বা‘ইস আল-হাসীস, ১/৪৯১।

[4] আল-কিফায়া ফি ইলমির রিওয়াইয়া, পৃষ্ঠা ৫১।

[5] ইমাম বুখারী রহ. ফাযায়েলুস সাহাবা অধ্যয়ে এ শব্দ দ্বারা একটি বাব তথা পরিচ্ছেদ রচনা করেছেন। দেখুন ৩/৫। তার শব্দাবলী হচ্ছে,

بَابُ فَضَائِلِ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «وَمَنْ صَحِبَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَوْ رَآهُ مِنَ المُسْلِمِينَ، فَهُوَ مِنْ أَصْحَابِهِ»

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মর্যাদার পরিচ্ছেদ, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছেন অথবা যে মুসলিম তাঁকে দেখেছেন তিনি সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

[6] মু‘জামু মাকায়ীসুল লুগাহ, ইবন ফারিস, পৃষ্ঠা ৫৮৭।

[7] মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৬৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪১৮।

[8] মিনহাজুস সুন্নাহ, ৮/৩৮৮ ও ৩৮৯।

[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৬৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৩২, হাদীসের শব্দাবলী মুসলিমের।

[10] মিনহাজুস সুন্নাহ, ৮/৩৮৬। এ কিতাবের পরবর্তী অংশ দেখুন। সাহাবীর অর্থ বিস্তারিত জানতে এ অংশ সহায়ক হবে।

[11] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৪৯।

[12] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১২৬০১।

[13] মিনহাজুস সুন্নাহ, ৮/৩৮৯।

[14] মিনহাজুস সুন্নাহ, ৮/৩৮৮।

[15] উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, বর্তমানে কিছু নিকৃষ্টমানের বিদ‘আতী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু সাহাবীদের ব্যাপারে হিংসার বশবর্তী হয়ে যেসব কথা বলে থাকে যে, সাহাবী হতে হলে দীর্ঘ সাহচর্য ও সান্নিধ্যের শর্ত রয়েছে, এটা তাদের সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতি, কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যের দাবী মানতে অস্বীকৃতি। এর দ্বারা তারা মুমিনদের পথ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। সৎপূর্বসূরীদের অধিকারে আঘাত করেছে। সহীহ আক্বীদার সরাসরি বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে।