মমতা ওরফে মম। তিন তিনটে উপন্যাস লিখেছেন। শব্দের মায়ায় মোহিত করেছেন শ্রোতা-পাঠকদের। বাক্যের গাঁথুনীতে গড়ে তুলেছেন নায়ক-নায়িকার কল্পনার সুরম্য প্রাসাদ। হাসি-বেদনার সংমিশ্রণে পাঠকদের অভিভূত ও বেদনাহত রাখার যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ঔপন্যাসিকের কল্পনাশক্তি ব্যয় করে পাঠকদের ঘুরিয়েছেন কল্পনার ইথারে-পাথারে। কিন্তু সামান্য একটা ভুলে তিনি এক সময় এমন গল্পের নায়িকায় পরিণত হয়েছেন- কোনো কবি, গল্পকার বা ঔপন্যাসিকের কল্পনায় যে গল্পের চিত্রায়ন সম্ভব হয়নি কখনও।
কল্পলেখকদের এই এক সমস্যা। কল্পনার জাল বিছিয়ে যিনি পাঠকদেরকে অবাস্তব চত্বরে ছোটাছুটি করান তিনিই আবার পাঠকের অবাস্তব রচনায় বিভ্রান্ত হন। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গল্পের খোরাকে পরিণত হন।
আমাদের আলোচ্য ব্যক্তির নাম মমতা। সংক্ষেপে মম। বগুড়ার মেয়েটি দীনদার পরিবারের। বাবা তাকে প্রথমে আলিয়া মাদরাসায় পড়তে দিয়েছেন। সেখান থেকে কামিল (আলিয়া মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি) পাশ করার পর ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ঢাকার মিরপুরে আত্মীয়ের বাসায় থেকে ভার্সিটির লেখাপড়া শুরু। ধার্মিক বাবা মেয়ের ধর্মপরায়ণতার ভরসায় মেয়েকে ঢাকায় ছেড়েছেন। নতুবা ঢাকার পরিবেশ নিয়ে তারও ভয় ও শঙ্কা ছিল। মম বাবাকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হন এবং কখনও বিপথগামী হবেন না বলে বাবাকে নির্ভার করেন।
প্রথম কিছুদিন বাবাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করেছেন তিনি। কখনও অন্য মেয়েদের মতো ফালতু কাজে জড়াতেন না। ছেলেবন্ধুর পাল্লায় পড়তেন না। মোবাইল-বন্ধুও পাত্তা দেন না। কিন্তু একপর্যায়ে এসে তার আত্মশাসনের বাঁধন ঢিলে হয়ে যায়। ঢাকার তরুণ-তরুণীদের উতলা জীবন ও বাঁধভাঙা উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচার মমকেও স্পর্শ করে। মামুন নামের একটা লোক মমের ওপর নজর বিছায় এবং তার খালাতো বোনের মাধ্যমে তার মোবাইল নাম্বারটা সে হস্তগত করে ফেলে। মামুন মমকে নিজের পরিচয় দিল তার ভক্ত পাঠক বলে। তার লেখা বইয়ের শব্দগুলো তার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে বলেও অভিব্যক্তি প্রকাশ করল। এরপর ফোন দেয়ার মূল কারণ উল্লেখ করে কোনোরূপ রাখঢাক না করেই বলল, আমি আপনার ভক্তপাঠক। আমি জানি আপনি অনেক কঠিন মেয়ে। পাথরের চেয়েও হয়ত কঠিন। আমার জীবনে এমন মানুষই দরকার। আমি এমন মানুষই আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই।
অপ্রস্তুত মমের কাছে মামুনের কথাগুলো একেবারেই নতুন। আনুখা, অপরিচিত। তিনি কখনও এধরনের কথার সঙ্গে পরিচিত নন। তাই এসব কথার পিঠে কেমন কথা ছুঁড়তে হয় তাও তিনি জানেন না। তাই কোনোমতে ‘কথা রাখা সম্ভব নয়’ বলে লোকটাকে তাৎক্ষণিক নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি।
কিন্তু মামুন তাতে মোটেও দমল না। মম সফল লেখিয়ে, আর মামুনের সফলতা লোক পটানোয়। এখানে লেখকের কারিশমা পাঠকের চাণক্যে ধরাশায়ী হলো। বহুবার নিবৃত করা সত্ত্বেও মামুন মমকে নিজ জালে আবদ্ধ করতে সক্ষম হলো। দ্বিধায়-সংকোচে এক সময় সাড়া দিলেন শক্তমনের অধিকারী মম! যিনি বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজধানীর উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেন না, রক্ষা করবেন পারিবারিক, ধর্মীয় ও ব্যক্তি আভিজাত্য। প্রতিশ্রুতির মাথা খেয়ে এভাবে ভক্তপাঠকের ছদ্মাবরণের মামুনের প্রেমে জড়িয়ে পড়লেন। বাবার নির্ভারতায় বাধাহীন গতিতে এগিয়ে চলল তার মামুন-সখ্য।
মামুন মমকে শুধু বিমোহিতই করলেন না; বিভ্রান্তও করলেন। তিনি সযত্নে তার পারিবারিক অবস্থা গোপন করতে সক্ষম হলেন। সখ্যের গভীরতা সম্বন্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। মামুন মমকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। মম তাতে সায়ও দিলেন কিন্তু পারিবারিকভাবে আসার প্রস্তাব দিলেন। মামুন জানেন, এধরনের প্রস্তাব আসবে মমতার পক্ষ থেকে। তাই কথাও সাজিয়ে রেখেছিলেন সেভাবেই। সে অনুযায়ী পারিবারিক নানান সমস্যার কথা বলে দুজন দুজনায় বিয়েকর্মটা সেরে নেয়ার পাঁয়তারা করলেন। মম এখানেও তেমন আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেন না। মনে পড়ল না মাবাবা ও সমাজ-সংসারের কথা। মামুনের বিয়ে না করলে আত্মহত্যার হুমকিই তার কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়। মামুন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, তার একমাত্র প্রেম ব্যর্থ হলে প্রকাশ্য রাজপথে গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে প্রাণ বিসর্জন দেবে সে। তবু অপবিত্র (?) হতে দেবে না তার প্রেমকে! মমের ভয়, তার কারণে যদি তার প্রিয় মানুষটি চিরতরে হারিয়ে যায়?
তাই কোনো সুযোগ নিলেন না আত্মনিয়ন্ত্রণের। স্মরণ করলেন না বাবার সঙ্গে কৃত ওয়াদার কথা। প্রিয় মানুষকে হারানোর আশঙ্কায় সব অভিভাবককে অন্ধকারে রেখে বগুড়ার এই মেয়েটি ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর মামুনের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন।
বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হলো কানামাছি খেলা। মামুন যেন শহরের জন্মসূত্রের বাসিন্দা। গ্রামে তার কোনো বাড়ি-ঘর নেই! বাড়ির কথা বলেও না, মমতাকে বাড়িতে নেয়ার চেষ্টাও করে না। এমনকি বাড়ির কারো সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেয় না তাকে। এভাবে অস্বস্তি বাড়ে মমতার। একপর্যায়ে তার বাড়িতেও সংবাদটা পৌঁছে। হতবাক হয়ে যান মমতার বাবা। মেয়ের এই গাদ্দারী তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না।
মা বাবার আঘাত, স্বামীর সন্দেহজনক আচরণ বিচলিত করে মমতাকে। এই প্রথম মনে হতে থাকে পিতামাতার স্নেহ ও মতামতের গুরুত্ব অবজ্ঞা করা মোটেও ভালো হয়নি। নারী জীবনের ভালো পাত্র নির্বাচন যে কত জরুরী তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকেন মমতা। ইমাম গাযালী রহিমাহুল্লাহ বলেন-
والاحتياط في حقها أهم لأنها رقيقة بالنكاح لا مخلص لها ، والزوج قادر على الطلاق بكل حال. عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِى بَكْرٍ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّهَا قَالَتْ : إِنَّمَا النِّكَاحُ رِقٌّ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ أَيْنَ يُرِقُّ عَتِيْقَتَهُ ومن هنا وجب على الولي وعلى المرأة أن يتخيرا طيبا أصيلاً
বিয়ের ব্যাপারে নারীদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কেননা বিয়ের মাধ্যমে নারী আবদ্ধ হয়ে যায়, এ থেকে (স্বামীর মৃত্যু বা তালাক ছাড়া) সহজে নিষ্কৃতির কোনো পথ খোলা থাকে না। পক্ষান্তরে পুরুষ লোক যেকোনো সময় বিবাহবন্ধন ছিন্ন করার সামর্থ্য রাখে। আসমা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, বিবাহ হচ্ছে এক ধরনের বন্দিত্বের নাম। সুতরাং লোকেরা যেন খেয়াল করে তার প্রিয় আজাদ সন্তান (কন্যাকে) কোথায় বন্দি করছে।’ [সুনানে বায়হাকী : ১৩৮৬৩] একারণেই নারীর অভিভাবকের কর্তব্য হচ্ছে উত্তম, দীনদার ও সৎ ব্যক্তিকে বর হিসেবে নির্বাচন করা।
নারীর যে জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সেই জীবন সম্পর্কেই তারা সবচেয়ে বেশি উদাসীনতা, খামখেয়ালী ও আবেগপ্রবণতা দেখাচ্ছে! যে নারীজীবন সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকেই মুসলিম মনীষীগণ সতর্ক করে আসছেন, যে জীবন নারীজীবনের সবচেয়ে বড় মাইলফলক বলে অভিহিত করছেন সেই জীবনকে নিয়েই খেলছেন স্বয়ং নারীগণ! এই খেলার ফলাফল মোটেই নারীদের পক্ষে যাচ্ছে না। খেলতে গিয়ে নিজেরাই খেলনার পাত্রী হচ্ছেন। আমাদের আলোচ্য মমতাও সেই খেলনার নির্মমতার শিকার একজন নারী।
স্বামীর পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবে ঘরে তোলার প্রক্রিয়া না দেখে মমতা শঙ্কিত হন। তার বাড়ির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও হন ব্যর্থ। এরই মধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনার সূচনা হয়। মামুনের মোবাইল থেকে কৌশলে একটা নাম্বার সংগ্রহ করেন মমতা। একদিন ভয়ে ভয়ে কল দেন সেই নাম্বারে। কল গ্রহণ করেন একজন বৃদ্ধ। মমতা আমতা আমতা করে তার সঙ্গে কথা বলেন এবং খালু সম্বোধন করেন। বৃদ্ধের সরলতা মমতাকে মুগ্ধ করে। তিনি তাকে খালু থেকে বাবা সম্বোধন করে বসেন। সম্বোধনের নৈকট্যে অভিভূত হন ওই বৃদ্ধ। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন মারে! জীবনে এই প্রথম মেয়ের কণ্ঠে বাবা ডাক শুনলাম। তিনি আরো বললেন, মা! যেহেতু তুই আমাকে বাবা ডেকেছিস তাই আমিও তোকে মেয়ে হিসেবে বরণ করে নিলাম।
এরপর থেকে বাবা-মেয়ের সম্পর্কে কথোপকথন হতে থাকে তাদের। বিষয়টি মামুনও জানত না এবং ওই বৃদ্ধও জানতেন না এই মেয়েটি কে? মমতা অনুমান করতে থাকেন এই বৃদ্ধই হবেন মামুনের বাবা। তাই শ্বশুরের পরিচয় পোক্ত করতে বাবার পরিচয়টা আরো জোরালো করতে থাকেন। সম্পর্ক গভীর থেকে গভীর হলে একবার বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার আব্দার করেন মমতা। মমতার আব্দারে বর্তে যান বৃদ্ধ। তিনি কল্পনাই করতে পারেন না ঢাকার একটি মেয়ে সামান্য মেয়ের পরিচয়ের ভিত্তিতে তার বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। তাই সন্দিগ্ধ বৃদ্ধ বলেন, মা! আমাদের এই অজপাড়া গাঁয়ে তুমি বেড়াতে আসবে?
বৃদ্ধের কণ্ঠে যতটুকু না আকুতি মমতার কণ্ঠে তারচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা। তাই তিনি ততোধিক ব্যাকুলতার সঙ্গে এই নতুন বাবার বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে তিনি সময় করে সেই বাড়িতে যান। সেখানে যাওয়ার পথে প্রতিটি মুহূর্ত কাটে তার শঙ্কা, সংকোচ ও উত্তেজনায়। যদি সত্যিই তার শ্বশুরবাড়ি হয় এটা তবে কেমন লাগবে? দুরুদুরু বুকে তিনি নতুন বাবার বাড়িতে হাজির হন। ওই বাড়ির লোকজন মমতাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। নতুন বাবার অকৃত্রিম স্নেহ ও পরিবারের লোকদের একনিষ্ঠ আন্তরিকতায় আপ্লুত হন মমতা। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই পরিবারের একজন লোকের উপস্থিতি তাকে হতচকিত করে তোলে। তার এই নতুন বাবা বলেছিলেন, জীবনে কখনও মেয়ের কণ্ঠে বাবা ডাক শোনেননি অর্থাৎ তার কোনো কন্যাসন্তান নেই। তবে সন্তানসমেত এই মহিলা কে? ভাবনা তাকে অস্থির করে। তাই এধরনের অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা থেকে নিবৃত থাকেন তিনি।
রাতে ওই মহিলার সঙ্গে মমতার শোবার ব্যবস্থা হয়। ওই মহিলাও মমতাকে নিজের বোনের মতো আপন করে নেন। রাতে শুয়ে শুয়ে সুখ-দুঃখের গল্প জুড়ে দেন। গল্পের এক ফাঁকে বলেন, এই দাঁড়াও আমার স্বামীর সঙ্গে একটু কথা সেরে নিই। এই বলে মহিলা ঢাকায় তার স্বামীর সঙ্গে কথা শুরু করে দেন। পাশের মহিলার স্বামী-কথনে মমতাও নিজ স্বামীর সঙ্গে কথোপকথনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং মুঠোফোন বের করে মামুনের নাম্বারে কল দেন। কিন্তু যতবারই কল দেন ততবারই তার নাম্বার বন্ধ দেখতে পান। এভাবে ওই মহিলা যতক্ষণ কথা বলেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজ স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। অনেকক্ষণ পর ওই মহিলা মোবাইল ছাড়লে মামুনের নাম্বারে মমতার কল ঢোকে। তাই এবার তিনি নিজ স্বামীর সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হন।
মমতা তার স্বামীর সঙ্গে কথা শুরু করে দেয়ার কিছুক্ষণ পর ওই মহিলা কি এক অসম্পূর্ণ কথা শেষ করার জন্য স্বামীর নাম্বারে পুনরায় কল দেন। এবার তার পালা! মমতা যতক্ষণ পর্যন্ত তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই মহিলা পান তার স্বামীর নাম্বার বন্ধ! মমতা অনেকক্ষণ কথা বলে মোবাইলটা ছাড়লে তখন কল ঢোকে এই মহিলার স্বামীর নাম্বারে। বিষয়টা বেশ অদ্ভুত হলেও তখন আর কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামান না।
গল্পে গল্পে কেটে যায় রাত। রাতের গল্পে মমতা মেজবান বাড়ির অনেক কাহিনী শোনেন। শোনেন এই মহিলার বিয়ে এবং বিবাহপূর্বক বর্তমান স্বামীর সঙ্গে প্রেমকাহিনী। মহিলা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার প্রেম এবং তার প্রতি স্বামীর অগাধ ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেন।
সব কাহিনী গল্প আর পরিবারের সদস্যদের পরিচয় জানার পর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে মমতার। তিনি যে ধারণা করেছিলেন সেটাই ঠিক। তার বানানো এই বাবা তারই শ্বশুর, মামুনের বাবা! কিন্তু রাতে যে মহিলার সঙ্গে ঘুমালেন সে কে? মামুনের বউ, যাকে সে পরম ভালোবাসা দিয়ে বিয়ে করে এনেছে! ভেতরটা ভেঙে খান খান হয়ে যেতে চায় মমতার। পরেরদিন একটু আড়ালে গিয়ে বলে আমি অমুক জায়গায় অমুকের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। কথা শুনে মাথায় বাজ পড়ে মামুনের। নিজের গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। মমতাকে প্রথমে ধমকি এবং পরে অনুনয়-বিনয় করে পরিচয় প্রকাশ না করতে এবং ঢাকা আসলে সব কথা বলবে বলে মমতার পায়ে পড়তে থাকে।
মমতা দিশেহারা হয়ে যান। একবার ইচ্ছা করেন নিজের পরিচয়টা প্রকাশ করে দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই ভেসে ওঠে মামুনের বউটার কথা, রাতে যে তাকে তার স্বামীর পরম ও অকপট ভালোবাসার কথা শুনিয়েছে। এমন একজন সরল মনের মেয়েকে কষ্ট দিতে চান না মমতা। কষ্ট দিতে চান না মামুনের বাবাকে। তাই সফর সংক্ষিপ্ত করে সেদিনেই ঢাকা রওয়ানা হন। ঢাকা আসার পর মামুন তার প্রতি চরম ক্ষিপ্ত হয়। কেন তাকে না বলে সেখানে গেল- এই অপরাধে তাকে টর্চার করতে থাকে। মামুনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার বাবার কাছে সব তথ্য ফাঁস করে দেন মমতা। মমতার কথায় গোটা পরিবার মাথায় হাত দিয়ে বসে। বেশি আঘাত পান মামুনের পূর্বের বউ। মমতার কাছে ছোটো হয়ে যায় সে। বুকটা কত উঁচু করেই না মমতার কাছে স্বামীর গুণকীর্তন করেছিল সে। কিন্তু স্বামী তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু মমতার সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে তা নির্ঘাত সত্য।
কেননা ঘরে বউ-বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও অবিবাহিত বলে বিয়ে করেছে মমতাকে। তাই মমতার জন্য করুণা হয় তার। মামুনের বাবাও মমতাকে খুব স্নেহ করেছিলেন। এখন তাকে কোন মর্যাদায় ভূষিত করবেন তা ভেবে গলদঘর্ম হন। কারণ, মামুনের প্রথম বউকেও তিনি অনেক স্নেহ করেন। মেয়েটা অনেক ভালো। সংসারের সবাইকে সে আপন করে নিয়েছে অতি আন্তরিকতায়। তাই তার সমপর্যায়েও কাউকে রাখতে মনে সায় দেয় না তার। তাই মমতাকে অবাস্তব এক প্রস্তাব দিয়ে বসেন তিনি। তাকে তার মেয়ে হিসেবেই রেখে দিতে চান এই সংসারে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব মমতার জীবনে? স্বামীর সংসারে কেউ কি ‘রিজার্ভ সদস্য’ হয়ে থাকতে চায়?
মমতার উপলব্ধিতে আজ বাস্তবতা ফিরে এসেছে। তিনি ভাবেন, স্বরচিত উপন্যাসের কল্পিত গল্পের চেয়েও মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক ও অবিশ্বাস্য তার বাস্তব ও ঘটমানজীবন!