হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি ইসলামহাউজ.কম ৮৭ টি
হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি ইসলামহাউজ.কম ৮৭ টি

 সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি আমাদেরকে সর্বোত্তম দীনের অনুসারী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূলের উম্মত হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মদ ইব্‌ন আব্দুল্লাহর উপর, যিনি আমাদেরকে কল্যাণকর সকল পথ বাতলে দিয়েছেন ও সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে সতর্ক করেছেন। আরো সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তার পরিবারবর্গ ও সাথীদের উপর, যারা তার আনীত দীন ও আদর্শকে পরবর্তী উম্মতের নিকট যথাযথ পৌঁছে দিয়েছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা তাদের অনুসরণ করবে সবার উপর। অতঃপর:

ইসলামি ইলমের উৎস কুরআন ও হাদিস থেকে ইলমের একাধিক শাখা বের হয়েছে। কতক ইলম মৌলিক যেমন ‘ইলমে তাফসির’, ‘ইলমে হাদিস’, ‘ইলমে তাওহিদ’ ও ‘ইলমে ফিকহ’। আর কতক সম্পূরক ও সাহায্যকারী ইলম যেমন ‘উসুলে হাদিস’, ‘উসুলে ফিকাহ’ ও ‘উসুলে তাফসির’ ইত্যাদি। ‘উসুলে হাদিস’ হাদিসের সুরক্ষাদানকারী ইলম। যে উসুলে হাদিস জানে না, সে নিজে ভুল করে ও অপরের ভুলের কারণ হয়, হোক সে মুফাসসির, ফকিহ বা ওয়ায়েজ। কতক মুফাসসির হাদিস দ্বারা তাফসির করেন, অথচ তার হাদিস নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। কতক ফকিহ দুর্বল ও জাল হাদিস থেকে মাসআলা বলেন। কতক নীতিশাস্ত্রবিদ দুর্বল ও জাল হাদিস থেকে নীতি তৈরি করেন। কতক ওয়ায়েজ, যারা স্বীয় ধারণায় মানুষদেরকে হিদায়েতের প্রতি আহ্বান করেন, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যা বলেন, যা তিনি বলেননি তাই প্রচার করেন তার নামে। এভাবে তারা নিজেরা গোমরাহ হন ও অপরকে গোমরাহ করেন! আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿فَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّنِ ٱفۡتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبٗا لِّيُضِلَّ ٱلنَّاسَ بِغَيۡرِ عِلۡمٍۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٤٤ ﴾ [الانعام: ١٤٤]

“সুতরাং তার চেয়ে অধিক জালেম কে, যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিনা দলিলে আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়েত করেন না”।[1] নবী সাল্লল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

«إِنَّ كَذِبًا عَلَيَّ لَيْسَ كَكَذِبٍ عَلَى أَحَدٍ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»

“নিশ্চয় আমার উপর মিথ্যা বলা, কারো উপর মিথ্যা বলার মত নয়, যে আমার উপর মিথ্যা বলল সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[2]

হাদিস শাস্ত্র না-জানার কারণে তারা আল্লাহ্‌ ও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যা বলেন। এমন আমলের প্রতি আহ্বান করেন, যার উপর শরীয়ত নাযিল হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ »

“যে এমন আমল করল, যার উপর আমাদের আদর্শ নেই তা পরিত্যক্ত”।[3] অতএব তাদের আমল বাতিল, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ মোতাবেক নয়।

ভারত উপমহাদেশে সঠিকভাবে হাদিস চর্চাকারিগণ জানেন অত্র ভূখণ্ডে হাদিস শাস্ত্রের দুরবস্থা কেমন। এ অবস্থা দশ-বিশ বছর হাদিসের দরস দানকারী কথিত মুহাদ্দিস, শায়খুল হাদিস ও হাদিস বিশারদদের, তাদের ছাত্র বা সাধারণের কথা বলাইবাহুল্য। যে কারণে দীনের নামে বেদীন, সুন্নতের নামে বিদআত, সংস্কারের নামে কুসংস্কার ও তাওহিদের নামে শির্কের ছড়াছড়ি অত্র ভূখণ্ডে। তাই ইমান ও আকিদার সুরক্ষা এবং সুন্নত প্রতিষ্ঠার জন্য উসুলে হাদিস চর্চা ব্যাপক করার বিকল্প নেই। বৈষয়িক বিষয়াদির ন্যায় সবাই তাদের দীনের ব্যাপারে সতর্ক হোক, সহি হাদিসসমূহ গ্রহণ করুক এবং সচেতনভাবে দুর্বল হাদিসগুলো পরিহার করুক, এ মহান উদ্দেশ্যে আমাদের অত্র প্রয়াস।

‘হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি’ বইখানা মৌলিক গ্রন্থ নয়, বাইকুনি রাহিমাহুল্লাহ্ রচিত المنظومة البيقونية এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ, যা তিনি হাদিসের প্রাথমিক স্তরের ছাত্রদের জন্য রচনা করেছেন। শায়খ ওমর ইব্‌ন মুহাম্মদ বাইকুনি রাহিমাহুল্লাহ্ হাদিস শাস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কতক প্রকার অতি সহজ, সাবলীল ও প্রাঞ্জলভাষায় এতে জমা করেছেন, যা চৌত্রিশটি পঙ্‌ক্তিতে সীমাবদ্ধ। আরব বিশ্বের অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাদের ছাত্রদেরকে প্রথমপাঠ হিসেবে বইটি পাঠদান করেন। একাধিক বিখ্যাত মুহাদ্দিস তার ব্যাখ্যা লিখেছেন, যা তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ।[4]

এ কিতাবের প্রথম লক্ষ্য হাদিসের ছাত্রগণ, তবে সাধারণ শিক্ষিত সমাজ যেন বইটি পাঠ করে উপকৃত হন, সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। তাই বইটি আহলে ইলম, হাদিসের ছাত্র ও সাধারণ শিক্ষিত সবার উপযোগী। বইটি পড়লে উসুলে হাদিসের পরিভাষা ও তার সংজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন হবে। আরো জানা যাবে যে, মানুষের কথা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী পৃথক করার জন্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসকে নানাভাবে পরখ করেছেন, বিভিন্ন পর্যায়ে তার উপর গবেষণা পরিচালনা করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকার গবেষণার পৃথক নাম দিয়েছেন।

ব্যাখ্যায় অনুসৃত নীতিমালা:

ক. লেখক থেকে সংঘটিত বিচ্যুতিগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কতক স্থানে তিনি ক্রমবিন্যাস রক্ষা করেননি, বুঝার সুবিধার্থে সেগুলো চিহ্নিত করেছি।

খ. গুরুত্বের দাবি হিসেবে লেখকের বাদ দেওয়া কতক প্রকার যোগ করেছি।

গ. শায়খ আব্দুস সাত্তার আবু গুদ্দাহ লেখকের কতক বিচ্যুতি শুদ্ধ রূপে পাল্টে দিয়েছেন, যথাস্থানে আমরা সেগুলো উল্লেখ করেছি।

ঘ. পরিভাষার যথাযথ অনুবাদ পেশ করা দুরূহ কাজ, বিশেষ করে আরবি থেকে বাংলা করা। তাই পরিভাষার অনুবাদের পরিবর্তে বাংলা উচ্চারণ পেশ করেছি।

ঙ. আরবি শব্দের বাংলা উচ্চারণ পেশ করা আরেকটি কঠিন কাজ, বরং অসম্ভব, যে কারণে বাংলা উচ্চারণ দেখে সঠিক শব্দ উদ্ধার করা যায় না। আগ্রহীদের সঠিক শব্দ জানাও জরুরি, যা আরবি দেখা ব্যতীত সম্ভব নয়। আবার বাংলা শব্দের মাঝে আরবি শব্দের অধিক প্রয়োগ বেমানান, তাই সুবিধে মত স্থানে হুবহু আরবি লিখে অবশিষ্ট স্থানে তার উচ্চারণ পেশ করেছি।

চ. ব্যাখ্যার শুরুতে উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের উপর নাতিদীর্ঘ ভূমিকা পেশ করেছি, যেন পাঠকবর্গ জানেন আমাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত হাদিস বিদ্যমান। দীনের সুরক্ষার স্বার্থে আল্লাহ প্রত্যেক যুগে একদল আলেম প্রস্তুত করেন, যারা তার নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস হিফাজত করেন, যাদের প্রচেষ্টার ফলে আমরা সহি হাদিসের ভাণ্ডার লাভ করেছি। আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন এবং আমাদেরকে তাদের কাতারে শামিল করুন। আমীন।

[1] সূরা আনআম: (১৪৪)

[2] বুখারি: (১২৯১), মুসলিম: (৩)

[3] মুসলিম: (১৭২১)

[4] আব্দুল আযিয ইব্‌ন আহমদ "المدخل إلى البيقونية دراسة حول المنظومة والناظم" নামে একখানা গবেষণা সন্দর্ভ লিখেছেন। তাতে তিনি ‘মানযুমাহ বাইকুনিয়া’র ৫৪-টি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাগ্রন্থ, ২৬-টি ব্যাখ্যামূলক রেকর্ড বক্তৃতা, ৮-টি অসমাপ্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও রেকর্ড বক্তৃতা এবং ৩৯-টি হস্তাক্ষরে লিখিত ব্যাখ্যার তালিকা পেশ করেছেন। হাতে লিখা ব্যাখ্যাগুলো مكتبة المخطوطات কুয়েত-এ সংরক্ষিত আছে। এ ব্যাখ্যা লেখার সময় আমার সামনে ১৩-টি ব্যাখ্যাগ্রন্থ ছিল, আমি তার অধিকাংশ থেকে উপকৃত হয়েছি। বিশেষভাবে ১. আবুল হাসান মুস্তফা ইব্‌ন সুলাইমানি রচিত الجواهر السليمانية بشرح المنظومة البيقونية ২. শায়খ উসাইমিন রহ. রচিত شرح المنظومة البيقونية ‏ ৩. শায়খ আব্দুর রহমান ইব্‌ন নাজদি রচিতالباكوراة الجنية من قطاف متن البيقونية ‏ ও ৪. শায়খ ইয়াহইয়া ইব্‌ন আলি হাজুরি রচিত شرح المنظومة البيقونية থেকে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। আল্লাহ তাদের সবাইকে ক্ষমা করুন এবং তাদের কবরসমূহ প্রশস্ত করে দিন।
উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ[1]

 সার্বজনীন দীন: ইসলাম আল্লাহর একমাত্র দীন। ইসলাম ব্যতীত কোনো দীন তার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। ইরশাদ হচ্ছে:

﴿ إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ١٩ ﴾ [ال عمران: ١٩]

“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম”।[2] তিনি অন্যত্র বলেন:

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ ٣﴾ [المائ‍دة: ٣]

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে”।[3] অন্যত্র বলেন:

﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥﴾ [ال عمران: ٨٥]

“আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায়, তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”।[4]

আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের নিকট তার দীন প্রচারের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। ইরশাদ হচ্ছে:

﴿ قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ١٥٨ ﴾ [الاعراف: ١٥٧]

“বল, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল’।[5] অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন:

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٢٨﴾ [سبا: ٢٨]

“আর আমি তো কেবল তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না”।[6] অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন:

﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠﴾ [الاحزاب : ٤٠]

“মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী, আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ”।[7] অতএব ইসলাম সার্বজনীন দীন, যা সমগ্র মানবজাতির নিকট পৌঁছানোর দায়িত্ব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ন্যাস্ত।

একটি প্রশ্ন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির নিকট সর্বশেষ রাসূল, তারপর কোনো নবী ও রাসূল আসবে না, তাহলে তিনি সবার নিকট কিয়ামত পর্যন্ত কিভাবে দীন পৌঁছাবেন, কারণ তিনি একা, তার হায়াত মাত্র তেষট্টি বছর?

তিনটি উত্তর: প্রথমটি অসম্ভব, যেমন তিনি সবার নিকট সশরীরে গিয়ে দীন পৌঁছাবেন। দ্বিতীয়টি অবাস্তব, যেমন সকল মানুষ তার নিকট এসে দীন শিখবে। তৃতীয়টি যৌক্তিক ও বাস্তব, যেমন তিনি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন, যার সাথে তার সাক্ষাত হবে, কিংবা যারা তার নিকট আসবে, তাদেরকে তিনি দীন শিখাবেন। অতঃপর তারা পরবর্তীদের দীন শিখাবে, যারা তার সাক্ষাত পায়নি, কিংবা তার নিকট উপস্থিত হতে পারেনি। এভাবে সমগ্র বিশ্বে সবার নিকট কিয়ামত পর্যন্ত দীন পৌঁছবে। কেউ বলতে পারবে না, আমার নিকট দীন পৌঁছেনি, কিংবা দীন শিখার সুযোগ আমি পাইনি। উসুলে হাদিসের পরিভাষায় এ পদ্ধতির নাম "علم الرواية" অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির নিকট রিসালাত পৌঁছে দেওয়ার পদ্ধতিকে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ বলা হয়।‘ইলমুর রিওয়াইয়া’র পদ্ধতিতে সবার নিকট দীন পৌঁছবে, কিন্তু দীনের স্বকীয়তা ও অক্ষুণ্নতা বহাল রাখার জন্য এ পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। কারণ এ পদ্ধতিতে দীনের বাহন মানুষ, মানুষ ভুলের স্থান। তাদের থেকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল হতে পারে। তাই পৌঁছানো দীন সঠিক কি-না যাচাইয়ের উপায় থাকা জরুরি। তাহলে দীনের অক্ষুণ্নতা বজায় থাকবে ও সঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হবে। উসুলে হাদিসের পরিভাষায় এ পদ্ধতির নাম "علم الدراية" অর্থাৎ সহি, দ্বা‘ঈফ ও জাল হাদিস চিহ্নিত করার নীতিকে ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ বলা হয়। আমরা ‘উসুলে হাদিসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’-এ ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ এবং মূলগ্রন্থে ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ সম্পর্কে আলোচনা করব।[8]

[1] أ.د. عبد الرحمن البر ‘আব্দুর রহমান’ কর্তৃক উসুলের হাদিসের উপর লিখিত ১-৭টি প্রবন্ধ এ ভূমিকার উৎস।

[2] সূরা আলে ইমরান: (১৯)

[3] সূরা মায়েদা: (৩)

[4] সূরা আলে ইমরান: (৮৫)

[5] সূরা আরাফ: (১৫৮)

[6] সূরা সাবা: (২৮)

[7] সূরা আহ্‌যাব: (৪০)

[8] অর্থাৎ হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি মুক্ত বর্ণনা করাকে ‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’ বলা হয়। আর হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃত মুক্ত বর্ণিত হল কি না, তা নির্ণয়ে সনদ ও মতন যাচাই করার নিয়ম-নীতিকে ‘ইলমুদ দিরাইয়াহ’ বলা হয়। এ প্রকারকেই উসুলে হাদিস বলা হয়। [দেখুন, ইবন উসাইমীন, শারহুল মানযূমাতিল বাইকূনিয়্যাহ, পৃ. ১১-১২ (সম্পাদক)]

‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইলমুর রিওয়াইয়া’র সূচনা করেন। অতঃপর প্রয়োজনের তাগিদে ধীরে ধীরে তার পরিসর বর্ধিত হয়। এ ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَة»

“একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও”।[1] অন্যত্র তিনি বলেন:

«لِيُبَلِّغْ الشَّاهِدُ مِنْكُمُ الْغَائِبَ»

“তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে পৌঁছে দেয়”।[2] অন্যত্র তিনি বলেন:

«تَسْمَعُونَ مِنِّى، وَيُسْمَعُ مِنْكُمْ، وَيُسْمَعُ مِمَّنْ يَسْمَعُ مِنْكُمْ»

“তোমরা আমার নিকট শ্রবণ কর, তোমাদের থেকে শ্রবণ করা হবে এবং যারা তোমাদের থেকে শ্রবণ করে তাদের থেকেও শ্রবণ করা হবে”।[3]

সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশিত কথা, কর্ম, সমর্থন ও তার গুণগান হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত দ্বিতীয় স্তরের রাবি বা বর্ণনাকারীদের নিকট বর্ণনা করবে। অতঃপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পরবর্তী স্তরের রাবিগণ তাদের পরবর্তী রাবিদের নিকট হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত পূর্ববৎ বর্ণনা করবে। দীনকে চলমান ও অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত রাখা জরুরি, অন্যথায় দীন বিকৃত ও মৌলিকত্ব হারাতে বাধ্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বৃদ্ধি থেকে বারণ করেছেন, কখনো হ্রাস থেকে সতর্ক করেছেন, কখনো বিকৃতির উপর কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন, যেমন:

দীনে বৃদ্ধি করা নিষেধ:

দীনে যেন বৃদ্ধি না ঘটে, এ জন্য বক্তা ও শ্রোতা উভয়কে পৃথক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বক্তাকে সত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও মিথ্যা থেকে বারণ করা হয়েছে, আর শ্রোতাকে বক্তার সংবাদ যাচাই পূর্বক গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বক্তাকে উদ্দেশ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»

“যে আমার উপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[4] মিথ্যাবাদী বক্তার পরিণতি জাহান্নাম। এ কথা তিনি বারবার বলেছেন, প্রায় সত্তুরজন সাহাবি থেকে এ হাদিস বর্ণিত, জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবি যাদের মধ্যে অন্যতম। তাই এ হাদিসকে আহলে ইলম মুতাওয়াতির বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ ٦﴾ [الحجرات: ٦]

“হে ইমানদারগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও”।[5] এ আয়াতে আল্লাহ শ্রোতাদের সতর্ক করেছেন, যেন তারা বক্তাদের কথা যাচাই ব্যতীত গ্রহণ না করে।

সাহাবিগণ মিথ্যা বলতেন না, তখন আরবের কাফেরদের মধ্যেও মিথ্যা বলার প্রবণতা ছিল না, মিথ্যাকে তারা ঘৃণা করত। জনৈক কাফের সম্পর্কে আছে, সে তার মরুভূমির তৃষ্ণার্ত বোবা উটের সাথেও মিথ্যা বলেনি, সে মিথ্যা না-বলার কারণ সম্পর্কে বলেছিল:

أُرِيدُ أُمَنِّيكِ الشَّرَابَ لِتَهْدَئِي وَلَكِنَّ عَارَ الْكَاذِبِينَ يَحُولُ

‘আমার ইচ্ছা হয় তোমাকে পানীয় বস্তুর আশা দেই, যেন তুমি শান্ত হও, কিন্তু মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপবাদ প্রতিবন্ধক হয়েছে’। মরুভূমিতে একটি উটকে পানি পান করানোর মিথ্যা আশ্বাস দিতে বিব্রত বোধ করেছেন জনৈক মুশরিক! আবু সুফিয়ানের ঘটনা তো প্রসিদ্ধ। বাদশাহ হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করার প্রাক্কালে তার সাথীদের বলে দেন: “আমি তাকে মুহাম্মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি, সে যদি আমাকে মিথ্যা বলে তোমরা তাকে মিথ্যা বলবে”। আবু সুফিয়ান বলেন: ‘আল্লাহর শপথ, আমার উপর মিথ্যার অপবাদ আরোপ করা হবে এ লজ্জা যদি না হত, তাহলে অবশ্যই আমি তার সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম’।[6] সে সময় আবু সুফিয়ান নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিপক্ষ ছিল, সে জানত মিথ্যা বললেও তার সাথীরা হিরাক্লিয়াসের সামনে তাকে মিথ্যারোপ করবে না, কারণ তারা সবাই কাফের, তবুও আবু সুফিয়ান অপবাদের ভয়ে মিথ্যা বলেনি।

>
[1] বুখারি: (৬/৪৯৬), হাদিস নং: (৩৪৬১), হাদিসটি আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন আস রা. থেকে বর্ণিত।

[2] বুখারি: (১/১৯৯), হাদিস নং: (১০৫), হাদিসটি আবু বাকরাহ নুফাই ইব্‌ন হারেস রা. থেকে বর্ণিত।

[3] আবু দাউদ: (৩/৩২১), হাদিস নং: (৩৬৫৯), ইব্‌ন আব্বাস রা. থেকে সহি সনদে বর্ণিত।

[4] বুখারি: ((৩/১৬০), হাদিস নং: (১২৯১), হাদিস নং: (১১০), মুসলিম: (১/১০), এ হাদিস বুখারি ও মুসলিম একাধিক সাহাবি থেকে একাধিক স্থানে বর্ণনা করেছেন, যেমন মুগিরাহ ইব্‌ন শু‘বাহ, আবু হুরায়রাহ, আলি ইব্‌ন আবি তালিব, জুবায়ের ইব্‌নুল ‘আউআম, আনাস ইব্‌ন মালেক, সালামাহ ইব্‌ন আকওয়া‘ প্রমুখ সাহাবিগণ।

[5] সূরা হুজুরাত: (৪৯/৬)

[6] বুখারি: (১/৩১), হাদিস নং: (৬)

 সাহাবিরা একে অপরকে বিশ্বাস করতেন, তাদের সময় মিথ্যা ছিল না। উপস্থিত সাহাবি থেকে অনুপস্থিত সাহাবি পূর্ণ আস্থার সাথে দীন গ্রহণ করতেন। বারা ইব্‌ন আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«لَيْسَ كُلُّنَا كَانَ يَسْمَعُ حَدِيثَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَتْ لَنَا ضَيْعَةٌ (يعني عقاراً وأراضي) وَأَشْغَالٌ، وَلَكِنِ النَّاسُ لَمْ يَكُونُوا يَكْذِبُونَ يَوْمَئِذٍ، فَيُحَدِّثُ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ»

“আমাদের প্রত্যেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিস শ্রবণ করত না, আমাদের জায়গা-জমি ও ব্যস্ততা ছিল। তবে তখন মানুষেরা মিথ্যা বলত না, উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট বর্ণনা করত”।[1] আনাস ইব্‌ন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«وَاللَّهِ مَا كُلُّ مَا نُحَدِّثُكُمْ بِهِ سَمِعْنَاهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ، وَلَكِنْ كَانَ يُحَدِّثُ بَعْضُنَا بَعْضًا، وَلا يَتَّهِمُ بَعْضُنَا بَعْضًا»

“আল্লাহর শপথ, তোমাদেরকে আমরা যা বলি, তা সব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রবণ করিনি, তবে আমাদের কতক কতককে বলত, কেউ কাউকে অপবাদ দিত না”।[2]

সাহাবিগণ যেরূপ পরস্পর মিথ্যা বলেনি, অনুরূপ তাবে‘ঈদের সাথেও তারা মিথ্যা বলেনি। ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহ্ নিজ সনদে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইয়াযিদ খাতমি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«حَدَّثَنَا الْبَرَاءُ بْنُ عَازِبٍ وَهُوَ غَيْرُ كَذُوبٍ، قَالَ: كُنَّا نُصَلِّي خَلْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا قَالَ: " سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، لَمْ يَحْنِ أَحَدٌ مِنَّا ظَهْرَهُ حَتَّى يَضَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَبْهَتَهُ عَلَى الْأَرْضِ»

আমাদেরকে বারা ইব্‌ন আযেব বলেছেন, আর তিনি মিথ্যাবাদী নয়, তিনি বলেছেন: আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে সালাত আদায় করতাম, যখন তিনি বলতেন: سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ আমাদের কেউ স্বীয় পিঠ নিচু করত না, যতক্ষণ না তিনি নিজ কপাল মাটিতে রাখতেন”।[3]

এখানে তাবে‘ঈ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইয়াযিদ খাতমি সাহাবি বারা ইব্‌ন আযেব সম্পর্কে বলেছেন: وَهُوَ غَيْرُ كَذُوبٍ বা ‘তিনি মিথ্যাবাদী নয়’। তার এ কথার অর্থ সন্দেহ দূর করা নয়, বরং হাদিস শক্তিশালী করা ও সাহাবির সত্যায়ন করা উদ্দেশ্য।

ইমাম খাত্তাবি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: এ কথার অর্থ রাবিকে অপবাদ দেওয়া নয়, বরং বক্তার কথায় পূর্ণ আস্থা প্রকাশের জন্য আরবরা এরূপ বলে, যেমন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন: سمعت خليلي الصادق المصدوق ‘আমি আমার সত্যবাদী ও সত্যায়িত বন্ধুকে বলতে শুনেছি’। ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন: حدثني الصادق المصدوق ‘সত্যবাদী ও সত্যায়িত সত্ত্বা আমাকে বলেছেন’। এসব বাক্য দ্বারা সাহাবিগণ যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আস্থা পোষণ করেছেন, একইভাবে তাবী‘ঈগণ সাহাবিদের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন, সন্দেহ দূর করার জন্য তা বলেননি; কারণ তারা সন্দেহ করতেন না।নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মুসলিম ও অমুসলিম কারো মাঝে মিথ্যার প্রচলন ছিল না, তবুও মিথ্যা হাদিস রচনাকারীকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। বক্তার সংবাদ গ্রহণ করার পূর্বে আল্লাহ শ্রোতাদেরকে যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমরা নিশ্চিত সাহাবিদের যুগে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীতে কোনো প্রকার বৃদ্ধি ঘটেনি।

[1] রামাহুরমুযী রচিত: ‘আল-মুহাদ্দিসুল ফাসিল’: (পৃ.২৩৫), (১৩৩), ইমাম খতিব রহ. রচিত আল-জামে‘: (১/১৭৪), (১০২)

[2] হাকেম: (৩/৫৭৫), আত-তাবকাত লি ইব্‌ন সাদ: (৭/২১), আল-জামে: (১/১৭৪)

[3] বুখারি: (২/১৮১), হাদিস নং: (৬৯০)

দীনের কোনো অংশ যেন হ্রাস না পায়, সে জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন: ১. দীন প্রচারের নির্দেশ ও ২. দীন গোপন করার নিষেধাজ্ঞা। এ মর্মে কয়েকটি হাদিস আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এখানে অপর একটি হাদিস উল্লেখ করছি, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«نَضَّرَ اللهُ امْرَءاً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثاً، فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ غَيْرَهُ، فَإِنَّهُ رُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ. ثَلاثُ خِصَالٍ لا يَغِلُّ عَلَيْهِنَّ قَلْبُ مُسْلِمٍ أَبَداً: إِخْلاصُ الْعَمَلِ لِلّهِ، وَمُنَاصَحَةُ وُلاةِ الْأَمْرِ، وَلُزُومُ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ، فَإِنَّ دَعْوَتَهُمْ تُحِيطُ مِنْ وَرَائِهِمْ»

“আল্লাহ সে ব্যক্তিকে শুভ্রোজ্জল করুন, যে আমাদের থেকে কোনো হাদিস শ্রবণ করল এবং অপরকে পৌঁছানো পর্যন্ত তা সংরক্ষণ করল। কারণ অনেক ফিকহধারণকারী ফকিহ হয় না, আবার অনেক ফিকহ ধারণকারী তার চেয়ে বিজ্ঞ ফকিহ এর নিকট ইলম পৌঁছায়। তিনটি স্বভাব যেগুলোতে কোনো মুসলিমের অন্তর খিয়ানত বা বিদ্বেষ থাকতে পারে না (অর্থাৎ মুসলিমের অন্তরে তা থাকাই স্বাভাবিক; অথবা এগুলো থাকলে সে অন্তরে হিংসা, হানাহানি থাকবে না) : আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে আমল করা, দায়িত্বশীলদের সৎ উপদেশ প্রদান করা ও মুসলিমদের জামা‘আত আঁকড়ে ধরা। কারণ মুসলিমদের দাওয়াত তাদের সবাইকে বেষ্টন করে নেয়”।[1]

দীন গোপনকারীকে সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡتُمُونَ مَآ أَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلۡهُدَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا بَيَّنَّٰهُ لِلنَّاسِ فِي ٱلۡكِتَٰبِ أُوْلَٰٓئِكَ يَلۡعَنُهُمُ ٱللَّهُ وَيَلۡعَنُهُمُ ٱللَّٰعِنُونَ ١٥٩ إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُواْ وَأَصۡلَحُواْ وَبَيَّنُواْ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَتُوبُ عَلَيۡهِمۡ وَأَنَا ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٠﴾ [البقرة: ١٥٩، ١٦٠]

“নিশ্চয় যারা গোপন করে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও হিদায়েত যা আমি নাযিল করেছি, কিতাবে মানুষের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর, তাদেরকে আল্লাহ লানত করেন এবং লানতকারীগণ লানত করে। তারা ছাড়া, যারা তওবা করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব, আমি তাদের তওবা কবুল করব। আর আমি তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু”।[2] উল্লেখ্য ইলম গোপন করে যে পাপ করে, তার তাওবা হচ্ছে গোপন করা ইলম প্রকাশ করে দেওয়া।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

«مَنْ كَتَمَ عِلْما ً تَلَجَّمَ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

“যে কোনো ইলম গোপন করল, সে কিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পড়বে”।[3]

এসব আয়াত ও হাদিসের প্রভাব আমরা সাহাবিদের জীবনে দেখতে পাই। তারা দীন প্রচারের দায়িত্ব আঞ্জাম ও দীন গোপন করার পাপ থেকে মুক্তির জন্য জীবন সায়াহ্নেও ইলম প্রচার করেছেন। একদা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে অধিক হাদিসের কারণে দোষারোপ করা হয়, তিনি প্রতিবাদ করে বলেন: “আল্লাহর শপথ, যদি আল্লাহর কিতাবে দু’টি আয়াত না থাকত, আমি তোমাদেরকে কোনো হাদিস বলতাম না”। অতঃপর তিনি সূরা বাকারার উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন”।[4] উসমান ইব্‌ন আফ্‌ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«والله لأحدثنكم حديثاً، والله لولا آية في كتاب الله ما حدَّثْتُكُمُوه»

“আল্লাহর শপথ, আমি তোমাদেরকে একটি হাদিস শুনাব, আল্লাহর শপথ যদি আল্লাহর কিতাবে একটি আয়াত না থাকত আমি তোমাদেরকে হাদিস বলতাম না”।[5] তার উদ্দেশ্যও উপরোক্ত আয়াত। এ থেকে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, সাহাবিগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনা কোনো বাণী গোপন করেননি, কিংবা তার কোনো অংশ তারা হ্রাস করেননি।

>
[1] আবু দাউদ: (৩/৩২২), হাদিস নং:(৩৬৬০), তিরমিযি: (৫/৩৩), হাদিস নং: (২৬৫৬), ইব্‌ন মাজাহ: (১/৮৪), হাদিস নং: (২৩০), সহিহ ইব্‌ন হিব্বান: (১/২৭০), হাদিস নং: (৬৭) এবং (২/৪৫৪), হাদিস নং: (৬৮০), হাদিসটি জায়েদ ইব্‌ন সাবেত রা. থেকে বর্ণিত। এ হাদিসের একাধিক সনদ ও শাহেদ রয়েছে।

[2] সূরা বাকারা: (১৫৯-১৬০)

[3] সহি ইব্‌ন হিব্বান: (১/২৭১), হাদিস নং: (৯৫), হাদিসটি আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত।

[4] বুখারি: (৫/২৮), হাদিস নং: (২৩৫০)

[5] মুসলিম: (১/২০৫), হাদিস নং: (২২৭)

 দীনের স্বকীয়তা রক্ষার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিকৃতিহীন হাদিস বর্ণনা করা। এ ধাপ অতিক্রম করা খুব কঠিন, কারণ ভুল মানুষের স্বভাব। ভুল ও সন্দেহ থেকে নবী ব্যতীত কেউ নিরাপদ নয়। অতএব প্রত্যেক হাদিসে শব্দ ও অর্থের অক্ষুণ্নতা এবং রাবিদের সন্দেহ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার দাবি করা খুব কঠিন। তাহলে প্রশ্ন হয়, এ ক্ষেত্রে করণীয় কি?

এ ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় বর্তায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর। তিনি সাহাবিদেরকে হাদিস মুখস্থ করাবেন, তারা তার কথা ও কর্মগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও মুখস্থ করবেন। ভুল হলে শুধরানোর ব্যবস্থা করবেন এবং সন্দেহ কিংবা গাফলতি হলে দূর করার পন্থা অবলম্বন করবেন। এটাই এ ক্ষেত্রে করণীয়, এ ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। তাই দেখি হাদিস সংরক্ষণ ও তাতে বিকৃতি ঠেকানোর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করেছেন, যেমন:

হাদিস শিক্ষা দেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি:

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কথা বারবার বলতেন, কখনো তিনবার, কখনো তার চেয়ে অধিক বলতেন, যেন শ্রোতারা তার কথা বুঝে ও মুখস্থ করতে সক্ষম হয়। ইমাম বুখারি প্রমুখ আনাস ও আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন:

«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا تَكَلَّمَ بِكَلِمَةٍ أَعَادَهَا ثَلاَثاً حَتَّى تُفْهَمَ عَنْهُ، وَإِذَا أَتَى عَلَى قَوْمٍ فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ سَلَّمَ عَلَيْهِمْ ثَلاَثًا».

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো বিষয়ে কথা বলতেন, তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তার কথা বুঝা যায়। যখন তিনি কোনো কওমের নিকট আসতেন, তাদেরকে সালাম করতেন, তিনবার সালাম করতেন”।[1]

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শব্দসমূহ পৃথক উচ্চারণ করতেন ও ধীরে কথা বলতেন, যেন শ্রোতারা মুখস্থ ও স্মরণ রাখতে সক্ষম হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলতেন, যদি কোনো গণনাকারী গণনা করতে চাইত অবশ্যই গণনা করতে সক্ষম হত”।[2] অপর বর্ণনায় তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের ন্যায় দ্রুত বলতেন না, তিনি পৃথক পৃথক বাক্য উচ্চারণ করতেন, যে তার কাছে বসত মুখস্থ করতে সক্ষম হত”।[3]

৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথার সময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন, যেন শ্রোতারা বিরক্ত না হয় এবং তাদের আলস্য না আসে। কখনো কয়েকটি শব্দে কথা শেষ করতেন, যেমন একদা তিনি বলেন: «النَّدَمُ تَوْبَةٌ» ‘লজ্জিত হওয়াই তওবা’।[4] অপর হাদিসে তিনি বলেন:

«الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ، وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ»

“একতা রহমত ও বিচ্ছিন্নতা শাস্তি”।[5]

৪. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশের জন্য উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন, যেন শ্রোতারা গভীর আগ্রহে শ্রবণ করে ও মুখস্থের প্রতি যত্নশীল হয়। কখনো দু’টি উপদেশের মাঝে দীর্ঘ বিরতি নিতেন, যেন তাদের উদ্যমতা বৃদ্ধি পায় ও স্মৃতি শক্তি প্রখর হয়। আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَتَخَوَّلُنَا بِالْمَوْعِظَةِ فِي الْأَيَّامِ، كَرَاهَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا»

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াযের জন্য দিনসমূহে উপযুক্ত সময় অন্বেষণ করতেন, কারণ তিনি আমাদের বিরক্তিকে অপছন্দ করতেন”।[6]

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো উদাহরণ পেশ করতেন, কারণ উদাহরণ বুঝা সহজ, দ্রুত অন্তরে আছর কাটে এবং অর্থগত বস্তুকে সহজে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে পরিণত করা যায়। বিশেষ করে অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের নিকট উদাহরণের খুব মূল্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক উদাহরণ পেশ করতেন, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক হাজার উদাহরণ মুখস্থ করেছি”।[7]

এ ছাড়া তিনি আরো পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, যে কারণে সাহাবিগণ তার কথা, কর্ম, সমর্থন ও গুণগানগুলো সংরক্ষণ ও পরবর্তীদের নিকট পূর্ণরূপে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।শ্রোতা হিসেবে সাহাবিরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আদব ও মনোযোগসহ শ্রবণ করতেন, যেন কোনো বাণী তাদের থেকে বিচ্যুত না হয়, কোনো হাদিসে ভুল কিংবা সন্দেহ প্রবেশ না করে। নিম্নে তার কয়েকটি নমুনা পেশ করছি:

[1] বুখারি: (১/১৮৮), হাদিস নং: (৯৪,৯৫), আবু উমামার হাদিস তাবরানি ফিল কাবিরে দেখুন: (৮/২৮৫), হাদিস নং: (৮০৯৫), হায়সামি তার সনদকে হাসান বলেছেন। আল-মাজমা: (১/১২৯)

[2] আবু দাউদ: (৩/৩২০), হাদিস নং: (৩৬৫৪)

[3] তিরমিযি: (৫/৬০০), হাদিস নং: (৩৬৩৯), আহমদ: (৬/২৫৭)

[4] ইব্‌ন মাজাহ: (২/১৪২০), হাদিস নং: (৪২৫২), ইব্‌ন হিব্বান: (২/৩৭৭), হাদিস নং: (৬১২-৬১৪)

[5] মুসনাদুশ শিহাব: (১/৪৩), হাদিস নং: (১৫), আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আহমদ: (৪/২৭৮), হাদিস নং: (১৮৪৪৯, ১৮৪৫০), বাজ্জার: (২/২২৬), হাদিস নং: (৩২৮২), হায়সামি ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’: (৫/২১৮) গ্রন্থে বলেন: ‘এ হাদিসের রাবিগণ সেকাহ’ বা শক্তিশালী।

[6] বুখারি: (১/১৬২), হাদিস নং: (৬৮)

[7] ‘আল-আমসাল’ লি রামাহুরমুযী: (পৃ.২৯-৩০), ‘আস-সিয়ার’ লিয যাহাবি: (৩/৮৭), আল-হিলইয়াহ’ লি আবি নু‘আইম: (৫/১৬৯)

১. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কথা বলতেন সাহাবিগণ চুপ করে শ্রবণ করতেন, যেন তার কোনো কথা তাদের হাত ছাড়া না হয়। ইমাম আবু দাউদ ও আহমদ রাহিমাহুমাল্লাহ্ উসামাহ ইব্‌ন শারিক থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«‏أَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم‏ ‏‏وَإِذَا أَصْحَابُهُ كَأَنَّمَا عَلَى رُءُوسِهِمْ الطَّيْرُ».

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করলাম, তখন তার সাথীগণ এমতাবস্থায় ছিল যে, যেন তাদের মাথার উপর পাখিকুল বসে আছে”।[1] ইমাম তাবরানি রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, উসামাহ ইব্‌ন শারিক বলেন:

«كُنَّا جُلُوساً عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَأَنَّمَا عَلَى رُؤُوسِنَا الطَّيْرُ، مَا يَتَكَلَّمُ مِنَّا مُتَكَلِّمٌ».

“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসে ছিলাম, যেন আমাদের মাথার উপর পাখিকুল রয়েছে। আমাদের কেউ কথা বলত না”।[2]

২. সাহাবিগণ জটিল বিষয় বারবার জিজ্ঞাসা করতেন, বুঝার আগ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি ছিল। ইব্‌ন আবি মুলাইকা থেকে ইমাম বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশার অভ্যাস ছিল অজানা বিষয় জিজ্ঞাসা করা, একদা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«‏َمْن حُوسِبَ عُذِّبَ»

“যার হিসাব নেওয়া হবে, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে”। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: আমি বললাম, আল্লাহ কি বলেননি:

﴿ فَسَوۡفَ يُحَاسَبُ حِسَابٗا يَسِيرٗا ٨ ﴾ [الانشقاق: ٨]

“অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে”।[3] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

«إِنَّمَا ذَلِكَ الْعَرْضُ، وَلَكِنْ مَنْ نُوقِشَ الْحِسَابَ يَهْلِكْ».

“এটা হচ্ছে শুধু সামনে পেশ করা, কিন্তু যাকে হিসাবের জন্য জবাবদিহি করা হবে সে ধ্বংস হবে”।[4]

৩. সাহাবিগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পর্যবেক্ষণ করতেন, অযথা প্রশ্ন করে বিরক্ত করতেন না। ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ ইব্‌ন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم‏ ‏: أَيُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «الصَّلَاةُ لِوَقْتِهَا» قَالَ: قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ ‏: «‏بِرُّ ‏‏الْوَالِدَيْنِ» قَالَ: قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: «الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ» فَمَا تَرَكْتُ أَسْتَزِيدُهُ إِلَّا ‏إِرْعَاءً ‏ ‏عَلَيْهِ. يعني رِفْقاً به صلى الله عليه وسلم.

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছি কোন্ আমল সর্বোত্তম? তিনি বললেন: সময়মত সালাত আদায় করা। আমি বললাম: অতঃপর? তিনি বললেন: ‘পিতা-মাতার সদাচরণ’। তিনি বলেন: আমি বললাম: অতঃপর? তিনি বললেন: ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। আমি আরো জিজ্ঞাসা করতাম, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থার খাতিরে ত্যাগ করেছি”।[5]

৪. সাহাবিদের মধ্যে যিনি লিখতে জানতেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী লিখে রাখতেন। ইমাম আবু দাউদসহ একাধিক মুহাদ্দিস সহি সনদে বর্ণনা করেন: আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনে মুখস্থ করার বস্তুগুলো আমি লিখে রাখতাম। কুরাইশরা আমাকে বারণ করল, তারা বলল: তুমি শোনা প্রত্যেক বিষয় লিখে রাখ, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ, তিনি সন্তুষ্টি ও গোস্বায় কথা বলেন?! আমি বিরত থাকি, অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘটনাটি বলি। তিনি মুখের দিকে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে বললেন:

«‏اكْتُبْ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ إِلَّا حَقٌّ».

“তুমি লিখ, ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার নফস, এ মুখ থেকে সত্য ব্যতীত কিছু বের হয় না”।[6]

৫. অধিকন্তু সাহাবিদের পরিষ্কার চিন্তা ও প্রখর স্মৃতিশক্তি স্মরণ রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। তাদের মাঝে শিক্ষার ব্যাপকতা না থাকার ফলে বংশ, বিভিন্ন ঘটনা, ওয়াদা ও চুক্তিপত্র তারা মুখস্থ রেখে অভ্যস্থ ছিল, যার ফলে তাদের স্মৃতি শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি পেত। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কর্মগুলো চর্চা করেন। এভাবে তারা আল্লাহর দীনকে হিফাজত করতে সক্ষম হন, শুধু দায়িত্বের খাতিরে নয়, দীন ও দীন প্রচারকের মহব্বতও তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আল্লাহ সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।এ ছিল প্রথম উস্তাদ ও প্রথম ছাত্রদের অবস্থা। এ থেকে আমরা জানলাম যে, যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করলে ছাত্রগণ তাদের আদর্শ উস্তাদের সকল শিক্ষা মুখস্থ করতে সক্ষম হন, তার প্রত্যেকটি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরণ করেছেন। অপর দিকে আদর্শ ছাত্র হিসেবে উস্তাদের পাঠ গ্রহণ করার যাবতীয় কৌশল সাহাবিগণ অবলম্বন করেছেন।

>
[1] আবু দাউদ: (৪/৩), হাদিস নং: (৩৩৪৫৫), আহমদ: (৪/২৭৮), হাদিস নং: (১৮৪৭৬)

[2] তাবরানি ফিল কাবির: (১/১৮), হাদিস নং: (৪৭১), হায়সামি রহ. বলেছেন: এ হাদিসের রাবিগণ সহি হাদিসের রাবি: (৮/২৪), হাকেম: (৪/৪০০), তিনি হাদিসটি সহি বলেছেন।

[3] সূরা ইনশিকাক: (৮)

[4] বুখারি: (১/১৯৬-১৯৭), হাদিস নং: (১০৩), মুসলিম: (৪/২২০৪), হাদিস নং: (২৮৭৬)

[5] মুসলিম: (১/৮৯), হাদিস নং: (১৩৭)

[6] আবু দাউদ: (৩/৩১৮), হাদিস নং: (৩৬৪৬)

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর সাহাবিগণ শিক্ষকরূপে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েন। তখন দীন প্রচার ও দীনকে অবিকৃত রাখা উভয় দায়িত্ব বর্তায় তাদের উপর, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জানার সুযোগ নেই। তাই সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে কতক নীতির অনুসরণ করেন, যেমন তারা হাদিস বর্ণনা কমিয়ে দেন, বর্ণনার পূর্বে শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন ও অপরকে শুনিয়ে যাচাই করেন, নিম্নে তার কতক নমুনা পেশ করছি:

১. সাহাবিগণ শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে হাদিস বর্ণনা কমিয়ে দেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর সাহাবিগণ হাদিস বর্ণনার সংখ্যা কমিয়ে দেন, যেন তাতে ভুল ও মিথ্যা প্রবেশ না করে। এক সাহাবি হাদিসের খিদমত আঞ্জাম দিতে সক্ষম হলে অপর সাহাবি চুপ থাকেন। কম বর্ণনা হাদিস স্মরণ রাখার একটি পদ্ধতি। অনেক সাহাবি বার্ধক্য জনিত স্মরণ শক্তি হ্রাস পেয়েছে সন্দেহে হাদিস বর্ণনা বন্ধ রাখেন। মাস ও বছর পার হত, তবু কতক সাহাবি বলতেন না: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন’। ভুল থেকে সুরক্ষার জন্য তারা এরূপ করতেন। কুরআন ত্যাগ করে মানুষ যেন হাদিসের প্রতি বেশী মনোযোগী না হয়, সে জন্যও তারা হাদিস বর্ণনা কম করেন।ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোনো দেশে মুজাহিদ বা শিক্ষকরূপে কাউকে প্রেরণ করার সময় বলতেন: “তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কম বর্ণনা কর, এ ক্ষেত্রে আমি তোমাদের অংশীদার”।[1] তার উদ্দেশ্য হাদিস গোপন করা নয়, বরং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো বিষয়কে সম্পৃক্ত করার পূর্বে সতর্কতা অবলম্বন করা। তাই অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবির সংখ্যা খুব কম।

>
[1] তাবরানি ফিল আওসাত: (২/৩২৬), হাদিস নং: (২১১৭), হাকেম: (১/১০২) হাদিসটি সহি বলেছেন, আর ইমাম হাবি তার সমর্থন করেছেন।

 হাজারের ঊর্ধ্বে মাত্র সাতজন সাহাবি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যথা: ১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (৫৩৭৪), ২. আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (২৬৩০), ৩. আনাস ইব্‌ন মালিক রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (২২৮৬), ৪. উম্মুল মুমেনিন আয়েশা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহা, হাদিস সংখ্যা: (২২১০), ৫. আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১৬৬০), ৬. জাবের ইব্‌ন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১৫৪০), ৭. আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১১৭০), তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন।

২. সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন:

হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সাহাবিগণ হাদিস বলতেন না। তবু ভুল হয়েছে ভয়ে হাদিস বর্ণনার সময় কেউ আঁতকে উঠতেন, কোথাও সন্দেহ হলে বিনা সংকোচে বলে দিতেন। কেউ একটি হাদিস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বহুদূর পর্যন্ত সফর করেন, যেমন জাবের ইব্‌ন আব্দুল্লাহ একটি হাদিসের জন্য আব্দুল্লাহ ইব্‌ন উনাইসের নিকট শামে গিয়েছেন।[1] আবু আইয়ূব আনসারি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটি হাদিসের জন্য উকবাহ ইব্‌ন আমের-এর নিকট মিসরে গিয়েছেন।[2]

৩. সাহাবিগণ হুবহু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করেন:

সাহাবিগণ হ্রাস-বৃদ্ধি ব্যতীত হুবহু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করতেন। কখনো হুবহু শব্দ বলা কঠিন হলে ভাবার্থ বলতেন। তারা ভাষা জানতেন, শরীয়তের উদ্দেশ্য বুঝতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেক্ষাপট দেখেছেন, তাই এতে সাধারণত তাদের ভুল হত না।

৪. সাহাবিগণ হাদিস যাচাই করেন:

সাহাবিগণ কোনো হাদিস প্রসঙ্গে সন্দেহ হলে যাচাই করেন। বিশেষভাবে আবু বকর এরূপ বেশী করেন, অতঃপর তার অনুসরণ করেন ওমর। তারা কখনো রাবির নিকট সাক্ষী তলব করেন, যেমন মুগিরা ইব্‌ন শু‘বা যখন বলেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাতির পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে দাদিকে এক ষষ্ঠাংশ মিরাস প্রদান করেছেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার নিকট সাক্ষী তলব করেন, আর মুহাম্মদ ইব্‌ন মাসলামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।[3] অনুরূপ আবু মুসা আশ‘আরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন তিনবার অনুমতি প্রসঙ্গে হাদিস বলেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার হাদিস গ্রহণ করেননি যতক্ষণ না আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সাথে সাক্ষ্য দিয়েছেন।[4] আলি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাদিসের শুদ্ধতার জন্য কখনো রাবি থেকে কসম নিতেন।

তাদের উদ্দেশ্য কখনো হাদিসের পথ সংকীর্ণ কিংবা রুদ্ধ করা ছিল না, বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভুল ও মিথ্যার সুযোগ নষ্ট করা, যেন সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো হাদিস সম্পৃক্ত করার পূর্বে সতর্ক হয়।

৫. সাহাবিগণ সনদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন:

সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে হাদিসের সনদ তলব করেন, অপরকে গ্রহণযোগ্য রাবি থেকে শ্রবণ করার নির্দেশ দেন। কারণ মানুষ যখন দলেদলে ইসলামে প্রবেশ করছিল, তখন একটি কুচক্রী মহল দীনের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা আরম্ভ করে, তাই হাদিস গ্রহণ করার পূর্বে রাবির অবস্থা জানা আবশ্যক হয়, বিশেষ করে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাত পরবর্তী সময়ে। তখন মুসলিম সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল:

«إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ»

“নিশ্চয় এ ইলম দীনের অংশ, অতএব পরখ করে দেখ কার থেকে তোমরা তোমাদের দীন গ্রহণ করছ”।[5] মুহাম্মদ ইব্‌ন সিরিন রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন:

«لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ، قَالُوا: سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ، فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ، وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ، فَلَا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ».

“তারা সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না, কিন্তু যখন ফিতনা (উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাত) সংঘটিত হল, তারা বলল: তোমরা আমাদেরকে তোমাদের রাবিদের নাম বল, আহলে সুন্নাহ হলে তাদের হাদিস গ্রহণ করা হবে, আর বিদআতি হলে তাদের হাদিস ত্যাগ করা হবে”।[6]

উকবাহ ইব্‌ন ‘আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সন্তানদের উপদেশ দিয়ে বলেন: “হে বৎসগণ, আমি তোমাদেরকে তিনটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি, ভালো করে স্মরণ রেখ: নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ব্যতীত কারো থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস গ্রহণ কর না, উলের মোটা কাপড় পরলেই দীনদার হবে না, আর কবিতা লিখে তোমাদের অন্তরকে কুরআন বিমুখ করো না”।[7]

আনাস ইব্‌ন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু স্বীয় ছাত্র সাবিত ইব্‌ন আসলাম আল-বুনানিকে বলেন: “হে সাবিত আমার থেকে গ্রহণ কর, তুমি আমার অপেক্ষা নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না, কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি, তিনি জিবরীল থেকে গ্রহণ করেছেন, আর জিবরীল আল্লাহ তা‘আলা থেকে গ্রহণ করেছেন”।[8]

৬. সাহাবি সাহাবির নিকট হাদিস পেশ করেন:

এক সাহাবি অপর সাহাবির নিকট হাদিস পেশ করে শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তাদের বিশ্বাস ছিল কোনো সাহাবি মিথ্যা বলে না, বা সজ্ঞানে বিকৃতি করে না, তবে কারো ভুল হতে পারে, কারো স্মৃতি থেকে কোনো বিষয় হারিয়ে যেতে পারে, তাই ভুল হওয়া অসম্ভব নয়। অতএব তারা অপরকে শুনিয়ে হাদিস যাচাই করতেন। ইমাম বুখারি ও মুসলিম[9] বর্ণনা করেন: ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

‏«‏إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبَعْضِ بُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»‏

“নিশ্চয় মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের কতক কান্নায় শাস্তি দেওয়া হয়”। ইব্‌ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যুর পর আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে এ হাদিস বলি। তিনি বললেন: আল্লাহ ওমরের উপর রহম করুন। আল্লাহর শপথ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বলেননি:

‏«‏إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبَعْضِ بُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»‏

তবে তিনি বলেছেন:

«إِنَّ اللَّهَ لَيَزِيدُ الْكَافِرَ عَذَابًا بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»

“নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরের শাস্তি বৃদ্ধি করেন, তার উপর তার পরিবারের কান্নার কারণে”। অতঃপর তিনি বলেন: (এ ব্যাপারে) তোমাদের জন্য কুরআন যথেষ্ট।

﴿ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰۚ ١٨ ﴾ [فاطر: ١٨]

“কোনো বোঝা বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না”।[10]

৭. রাবিদের সমালোচনার সূচনা:

সাহাবিদের যুগ থেকে রাবিদের যাচাই করা আরম্ভ হয়। কারো হাদিস তারা প্রত্যাখ্যান করেন, কারো হাদিস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ্ মুজাহিদ ইব্‌ন জাবর থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “ইব্‌ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট বুশাইর আদাবি এসে বলতে লাগল: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন”, কিন্তু ইব্‌ন আব্বাস তাকে হাদিস বলার অনুমতি দেননি, তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। সে বলল: হে ইব্‌ন আব্বাস, আপনি কেন মনোনিবেশ করছেন না! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বলছি, আপনি শুনছেন না! ইব্‌ন আব্বাস বলেন: “আমরা এক সময়ে ছিলাম, যখন কাউকে বলতে শুনতাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের চোখ তাকে লুফে নিত, তার দিকে আমরা মনোযোগ দিতাম, কিন্তু লোকেরা যখন কঠিন ও নরম বাহনে আরোহণ করল (হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রশংসিত ও নিন্দনীয় উভয় পন্থা অবলম্বন করল), তখন থেকে পরিচিত বস্তু গ্রহণ করি”। অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যখন মিথ্যা বলা হত না, তখন আমরা হাদিস বলতাম, কিন্তু লোকেরা যখন উঁচু-নিচু উভয় বাহনে আরোহণ করল, আমরা তার থেকে হাদিস বর্ণনা করা ত্যাগ করি”।[11]এভাবে সাহাবিদের যুগ শেষ না হতেই সনদ তলব করা আরম্ভ হয় এবং علم الجرح والتعديل তথা ‘সমালোচনা শাস্ত্রে’র সূচনা হয়। তারা সহি হাদিস ও সেকাহ রাবি চিহ্নিত করার কতক নীতি তৈরি করেন, যা সবার নিকট প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বতন্ত্র গ্রন্থে জমা করার প্রয়োজন হয়নি।

[1] বুখারি: (১/১৭৩)

[2] আহমদ: (৪/১৫৩, ১৫৯), ‘মুসনাদ’ লিল হুমাইদি: (১/১৮৮৯-১৯০), হাদিস নং: (৩৮৪), ‘মারেফাতু উলুমুল হাদিস’ লিল হাকেম: (৭-৮), ‘আর-রেহলাহ’ লিল খতিব: (পৃ.ই১১৮), হাদিস নং: (৩৪), ‘আল-আসমাউল মুবহামাহ’: (পৃ.৬৩-৬৪), হাদিস নং: (৩৭), ‘জামে বায়ানুল ইলম’: (১/৩৯২), হাদিস নং: (৫৬৭)

[3] আবু দাউদ: (৩/১২১), হাদিস নং: (২৮৯৪), তিরমিযি: (৪/৪১৯), হাদিস নং: (৪১৯-৪২০), ইব্‌ন মাজাহ: (২/৯০৯-৯১০), মালেক: (৪০৭)

[4] বুখারি: (১১/২৬-২৭), হাদিস নং: (৬২৪৫), মুসলিম: (৩/১৬৯৪-১৬৯৬)

[5] মুসলিম: (১/১৪), মুসলিমের ভূমিকা দেখুন।

[6] মুসলিম: (১/১৪), মুসলিমের ভূমিকা দেখুন।

[7] মু‘জামুল কাবির: (১৭/২৬৮), মাজমাউয যওয়ায়েদ: (১/১৪০)

[8] তিরমিযি: (৫/৬১৪), হাদিস নং: (৩৮৩১)

[9] বুখারি: (৩/১৫০), হাদিস নং: (১২৮৭), মুসলিম: (২/৬৪২), হাদিস নং: (৯২৯)

[10] সূরা ফাতের: (১৭)

[11] মুসলিম: (১/১৩), দেখুন: মুকাদ্দামাহ।

সাহাবিগণ ও মুনাফিকরা একসঙ্গে বাস করত, সে সুযোগে হয়তো কোনো মুনাফিক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার করেছে, আর মানুষেরা তাদের বাহ্যিক সাথীত্ব দেখে সেগুলো গ্রহণ করেছে, এ জাতীয় সন্দেহ হতে পারে। কারণ, মুনাফিকরা মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন:

﴿إِذَا جَآءَكَ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ قَالُواْ نَشۡهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُۥ وَٱللَّهُ يَشۡهَدُ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَكَٰذِبُونَ ١﴾ [المنافقون: ١]

“যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী”।[1] অতএব তাদের মিথ্যা প্রচার করার বাস্তবতা কতটুকু?

কয়েকটি কারণে তারা এরূপ করতে পারেনি:

১. মুনাফিকরা দীনের প্রচার থেকে বিমুখ ছিল। কতক মুনাফিক কুরআন শ্রবণ করত, কিন্তু কুরআনের কোনো অংশ তাদের অন্তরে প্রবেশ করত না, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمِنۡهُم مَّن يَسۡتَمِعُ إِلَيۡكَ حَتَّىٰٓ إِذَا خَرَجُواْ مِنۡ عِندِكَ قَالُواْ لِلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ مَاذَا قَالَ ءَانِفًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ طَبَعَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَٱتَّبَعُوٓاْ أَهۡوَآءَهُمۡ ١٦﴾ [محمد : ١٦]

“আর তাদের মধ্যে এমন কতক রয়েছে, যারা তোমার প্রতি মনোযোগ দিয়ে শুনে। অবশেষে যখন তারা তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যায় তখন তারা যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এই মাত্র সে কী বলল?’ এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে”।[2] তারা যেহেতু ভাল করে শ্রবণ করেনি, তাই তাদের পক্ষে দীন বিকৃত করা সম্ভব হয়নি।

২. মুসলিমরা কোনো বিষয়ে মুনাফিকদের শরণাপন্ন হত না, কারণ কুরআনে বর্ণিত তাদের স্বভাব ও নিদর্শনের কারণে তারা চিহ্নিত ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলে:

﴿ وَلَتَعۡرِفَنَّهُمۡ فِي لَحۡنِ ٱلۡقَوۡلِۚ ٣٠ ﴾ [محمد : ٣٠]

“তবে তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদের চিনতে পারবে”।[3] অতএব তারা চিহ্নিত ছিল, যার নিফাক স্পষ্ট ছিল না সেও সন্দেহের পাত্র ছিল। ইমাম বুখারি বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করতে পেরে কা‘ব ইব্‌ন মালিক আফসোস করে বলেন:

«فَكُنْتُ إِذَا خَرَجْتُ فِي النَّاسِ بَعْدَ خُرُوجِ رَسُولِ اللَّهِ ‏صلى الله عليه وسلم ‏فَطُفْتُ فِيهِمْ أَحْزَنَنِي أَنِّي لَا أَرَى إِلَّا رَجُلًا ‏مَغْمُوصًا ‏عَلَيْهِ النِّفَاقُ، أَوْ رَجُلًا مِمَّنْ عَذَرَ اللَّهُ مِنْ الضُّعَفَاءِ».

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্থানের পর আমি যখন মানুষের নিকট যেতাম ও তাদের মাঝে ঘুরতাম, আমাকে খুব দুঃখিত করত, কারণ আমি শুধু তাদেরকে দেখতাম যারা নেফাকের দোষে দুষ্ট ছিল, অথবা এমন কাউকে দেখতাম যাদেরকে আল্লাহ অক্ষমতার কারণে ছাড় দিয়েছেন”।[4]

এ থেকে প্রমাণিত হল যে, মুনাফিকরা চিহ্নিত ছিল, তাই কোনো মুসলিম দীনি বিষয়ে তাদের শরণাপন্ন হবে সম্ভব ছিল না।৩. আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি, সাহাবিগণ নির্দিষ্ট নীতির অধীন হাদিস শ্রবণ করতেন, বলতেন ও যাচাই করতেন এবং বিনা সংকোচে অপরের সমালোচনা করতেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো বিষয় সম্পৃক্ত করা হবে, যা তিনি বলেননি, আর তারা চুপ থাকবে, এরূপ সম্ভব ছিল না। আল্লাহ তার নবীকে মুনাফিকদের থেকে পূর্ণরূপে রক্ষা করেছেন।

>
[1] সূরা মুনাফিকুন: (১)

[2] সূরা মুহাম্মদ: (১৬)

[3] সূরা মুহাম্মদ: (৩০)

[4] বুখারি : (৮/১১৩), হাদিস নং:(৪৪১৮)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 8 9 পরের পাতা »