অভিধানে صيام (সিয়াম)-এর সাধারণ অর্থ হল, বিরত থাকা। আর এ জন্যই কথা বলা থেকে যে বিরত থাকে -অর্থাৎ চুপ ও নিস্তব্ধ থাকে তাকে صائم (সায়েম) বলা হয়। মহান আল্লাহ মারয়্যাম (আঃ)-এর ইতিহাস উল্লেখ করে বলেন,
(فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَداً فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْماً فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنْسِيّاً)
অর্থাৎ, (সন্তান ভূমিষ্ঠ করার পর) যদি তুমি কাউকে (কোন প্রশ্ন বা কৈফিয়ত করতে) দেখ, তবে তুমি বল, ‘আমি দয়াময় (আল্লাহর) জন্য (কথা বলা থেকে) বিরত থাকার নযর মেনেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথাই বলব না।’ (কুরআনুল কারীম ১৯/২৬)
বলা বাহুল্য, এখানে ‘সওম’-এর অর্থ হল কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
শরীয়তের পরিভাষায় ‘সওম’ বা ‘সিয়াম’-এর অর্থ হল, ফজর উদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী-সঙ্গম ইত্যাদি যাবতীয় রোযা নষ্টকারী কর্ম হতে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা।[1]
অবশ্য এই সংজ্ঞায় অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকাও শামিল রয়েছে। কারণ, প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়; বরং অসারতা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকার নামই হল (আসল) সিয়াম। সুতরাং যদি তোমাকে কেউ গালাগালি করে অথবা তোমার প্রতি মূর্খতা প্রদর্শন করে, তাহলে তুমি (তার প্রতিশোধ না নিয়ে) তাকে বল যে, ‘আমি রোযা রেখেছি, আমি রোযা রেখেছি।’’[2]
‘রোযা’ আভিধানিক অর্থে সিয়ামের সমার্থবোধক না হলেও পারিভাষিক অর্থে ফারসী, উর্দু, হিন্দী ও বাংলা ভাষায় সিয়ামের জায়গায় ‘রোযা’ শব্দটি ব্যবহার হয় বলেই সাধারণ জনসাধারণের বুঝার সুবিধার্থে আমিও এই পুস্তিকায় রোযা শব্দই প্রয়োগ করেছি। আর এ ব্যবহারে শরীয়তগত কোন ক্ষতি নেই।
[2] (হাকেম, মুস্তাদ্রাক, বাইহাকী, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, ইবনে হিববান, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৫৩৭৬নং)
মানুষের জন্য রমাযানের রোযাই প্রথম রোযা নয়। কারণ, রোযা হল এমন ইবাদত, যা আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টির পর থেকেই নিজের বান্দার জন্য ফরয করেছেন। তিনি কুরআন মাজীদে বলেন,
(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ)
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা পরহেযগার হতে পার। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৩)
এ থেকে বুঝা যায় যে, পূর্ববর্তী সকল উম্মতের জন্য রোযা ফরয ছিল। অবশ্য ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইয়াহুদী ধর্মের পূর্বের ধর্মাবলম্বী মানুষরা কিভাবে কোন্ পদ্ধতিতে রোযা পালন করত, তা নির্দিষ্টরূপে জানা যায় না। তবে ইয়াহুদ ও খ্রিষ্টানরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জিনিস থেকে বিরত থেকে রোযা পালন করত। তাওরাত ও ইঞ্জীলের বর্তমান সংস্কারগুলো থেকেও জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা রোযাকে তাঁর পূর্ববর্তী বান্দাদের উপর ফরয করেছিলেন।
বুখারী-মুসলিমের একটি হাদীসে পাওয়া যায় যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদ্বীনায় এলেন, তখন দেখলেন, ইয়াহুদীরা আশূরার দিনে রোযা পালন করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এটা কি এমন দিন যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখছ?’’ ইয়াহুদীরা বলল, ‘এ এক মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ মূসা ও তাঁর কওমকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন এবং ফিরআঊন ও তার কওমকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। তাই মূসা এরই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই দিনে রোযা পালন করেছিলেন। আর সেই জন্যই আমরাও এ দিনে রোযা রেখে থাকি।’
এ কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘মূসার স্মৃতি পালন করার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে আমরা অধিক হকদার।’’ সুতরাং তিনি ঐ দিনে রোযা রাখলেন এবং সকলকে রোযা রাখতে আদেশ দিলেন।[1]
অবশ্য আহলে কিতাব (ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান) ও মুসলিমদের রোযার মাঝে একটি পার্থক্য এই যে, আহলে কিতাবরা সেহরী ([2]) খায় না। কিন্তু মুসলিমরা খায়।[3]
তদনুরূপ আহলে কিতাবরা ইফতার করতে দেরী করে। পক্ষান্তরে মুসলিমরা সূর্য ডোবামাত্র তড়িঘড়ি ইফতার করে থাকে।[4]
ইনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকাতে বলা হয়েছে যে, জল, বায়ু, জাতি, ধর্ম ও পারিপার্শ্বিকতা ভেদে রোজার নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন হইলেও এমন কোন ধর্মের নাম উল্লেখ করা কঠিন যাহার ধর্মীয় বিধানে রোযার আবশ্যকতা স্বীকার করা হয় নাই।[5]
যাই হোক না কেন, এই খবরের মাঝে মুসলিমদের জন্য রয়েছে সান্ত্বনা ও আশ্বাস। কারণ, শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর উপরেই নয়; বরং পূর্ববর্তী সকল উম্মতের উপরেই রোযা ফরয ছিল। আর সে মনে করেই মুসলিমদের উপরেও রোযার ভার অনেক হাল্কা হয়ে যায়। কারণ, মুসলিম যখন জানতে পারে যে, এই রোযা রাখার পথ হল পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও তাঁদের অনুগামী নেক লোকদের, তখন সে এই পথ অবলম্বন করে আনন্দবোধ করে এবং রোযার কোন কষ্টকেই সে নিজের জন্য ভারী মনে করে না।[6]
৪ সেহরী কথাটি সাহারীর অপভ্রংশ। এটি شاذ في القياس وفصيح في الاستعمال । সেহরী শব্দটি উর্দু অভিধানে পাওয়া যায়, কিন্তু সাহারী শব্দটি কোন অভিধানে পাওয়া যায় না।
[3] (মুসলিম ১০৯৬নং)
[4] (আবূ দাঊদ, হাকেম, মুস্তাদ্রাক, ইবনে হিববান, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৭৬৮৯নং)
[5] (বাংলা মিশকাত, এমদাদিয়া লাইব্রেরী ছাপা ৪/২৬৪ দ্রঃ)
[6] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ৫পৃঃ)
মহাবিজ্ঞান ও হিকমতময় মহান আল্লাহর একটি হিকমত ও অনুগ্রহ এই যে, তিনি বান্দার উপর যে আদেশ-নিষেধ আরোপ করেছেন তার মধ্যে বহু বিষয়কেই পর্যায় অনুক্রমে ধীরে ধীরে ফরয অথবা হারাম করেছেন। অনুরূপ তাঁর এক ফরয হল সিয়াম বা রোযা। যা তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু করে ফরয করেছেন। যেমনঃ-
প্রথম পর্যায়ঃ-
প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক মাসে ৩টি করে রোযা পালন করতেন। আর এ দেখে সাহাবাগণও (রাঃ) তাঁর অনুসরণে ঐ রোযা রাখতেন। যাতে করে রোযার অভ্যাস তাদের জন্য সহজ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ-
কুরাইশদল জাহেলী যুগে আশূরার রোযা রাখত।[1] অতঃপর তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদ্বীনায় এলে মূসা u-এর অনুকরণে তাঁর স্মৃতি পালন করে আশূরার দিনে খুব গুরুত্বের সাথে রোযা রাখলেন এবং সাহাবাদেরকেও এ রোযা রাখতে আদেশ করলেন। তখন এ রোযা রাখা ফরয ছিল।
তৃতীয় পর্যায়ঃ-
অতঃপর রোযার বিধান নিয়ে কুরআন কারীমের উপর্যুক্ত আয়াত অবতীর্ণ হল। কিন্তু শুরুতে তখনও রোযা পূর্ণ আকারে ফরয ছিল না। যার ইচ্ছা সে রোযা রাখত এবং যার ইচ্ছা সে না রেখে মিসকীনকে খাদ্য দান করত। তবে রোযা রাখাটাই আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় ছিল। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর নির্দেশ ছিলঃ-
(وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْراً فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ)
অর্থাৎ, যারা রোযা রাখার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রোযা রাখতে চায় না, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তোমরা রোযা রাখ, তাহলে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণপ্রসূ; যদি তোমরা উপলব্ধি করতে পার। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৪)
চতুর্থ পর্যায়ঃ-
অতঃপর সন ২ হিজরীর শা’বান মাসের ২য় তারীখ সোমবারে ([2]) প্রত্যেক সামর্থ্যবান ভারপ্রাপ্ত মুসলিমের পক্ষে পূর্ণ রমাযান ([3]) মাসের রোযা ফরয করা হল। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ)
অর্থাৎ, রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
সুতরাং সামর্থ্যবান ভারপ্রাপ্ত (জ্ঞানসম্পন্ন সাবালক) গৃহবাসীর জন্য মিসকীনকে খাদ্যদানের বিধান রহিত হয়ে গেল এবং বৃদ্ধ ও চিররোগীর জন্য তা বহাল রাখা হল। অনুরূপ (কিছু উলামার মতে) এ বিধান গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মহিলার জন্যও বহাল করা হল; যারা গর্ভকালে বা দুগ্ধদান কালে রোযা রাখলে তার সন্তানের বিশেষ ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করে।
মুসলিমদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত এই ছিল যে, রোযার বহু কষ্টভার তিনি লাঘব করে দিয়েছেন। যেমন; শুরুর দিকে এ রোযা ফরয ছিল এশার নামায বা রাত্রে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর থেকে পর দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ, রাত্রে একবার ঘুমিয়ে পড়লে পানাহার ও স্ত্রী-সহবাস হারাম হয়ে যেত। এতে মুসলিমরা বড় কষ্টবোধ করতে লাগলেন। সময় লম্বা থাকার কারণে তাঁরা বড় দুর্বল হয়ে পড়তেন। অতঃপর মহান আল্লাহর তরফ থেকে সে ভার হাল্কা করা হল। পরিশেষে ফজর উদয়কাল থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত কাল পর্যন্ত হল রোযা রাখার সময়।
আনসার গোত্রের সিরমাহ নামক এক ব্যক্তি রোযা রাখা অবস্থায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতেন। একদিন তিনি বাড়ি ফিরে এসে এশার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়লেন এবং কোন প্রকার পানাহার না করেই তাঁর ফজর হয়ে গেল। সুতরাং এ অবস্থাতেই পরদিন রোযা রাখলেন। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁকে সেই কঠিন দুর্বল ও ক্লিষ্ট অবস্থায় দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কি ব্যাপার! আমি তোমাকে বড় দুর্বল দেখছি যে?’’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি গতকাল কাজ করার পর যখন এলাম তখন এলাম। তারপর (পরিশ্রান্ত হয়ে) শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর ফজর হয়ে গেলে আবার রোযা রেখে নিলাম।’[4]
উমার (রাঃ) এক রাত্রে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর উঠে স্ত্রী-মিলন করে ফেললেন। তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে ঘটনা উল্লেখ করলেন। অতঃপর এই সবের পরিপ্রেক্ষীতে আল্লাহর বিধান অবতীর্ণ হল,
(أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ عَلِمَ اللهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ )
অর্থাৎ, রোযার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোষাক। আল্লাহ জানতেন যে, তোমরা আত্ম-প্রতারণা করছ। তাই তো তিনি তোমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা (সন্তান, শবেকদর, সকল বৈধ বস্ত্ত বা আল্লাহর তরফ থেকে কোন কিছুর ব্যাপারে অব্যাহতি) লিখে রেখেছেন তা কামনা কর। আর তোমরা পানাহার কর; যতক্ষণ রাত্রির কালো রেখা হতে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশ না পায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর।(কুরআনুল কারীম ২/১৮৭) [5]
[2] ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৮৩ দ্রঃ
[3] রমাযান কথাটি আরবী রামাযান-এর অপভ্রংশ ও বাংলায় চলিত রূপ।
[4] (বুখারী ১৯১৫, সহীহ আবূ দাঊদ ২০২৯নং)
[5] (সহীহ আবূ দাঊদ ২০২৮নং, তাফসীর ইবনে কাসীর ১/২৯১, আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবূ সারী মঃ আব্দুল হাদী ২৩-২৫পৃঃ দ্রঃ)
সাধারণভাবে রোযার ফযীলত বর্ণনা করে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কতিপয় সহীহ হাদীস প্রণিধানযোগ্যঃ-
১। আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘আল্লাহ আয্যা অজাল্ল বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য; তবে রোযা নয়, যেহেতু তা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেব।’ রোযা ঢাল স্বরূপ। সুতরাং তোমাদের কারো রোযার দিন হলে সে যেন অশ্লীল না বকে ও ঝগড়া-হৈচৈ না করে; পরন্তু যদি তাকে কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়তে চায়, তবে সে যেন বলে, ‘আমি রোযা রেখেছি, আমার রোযা আছে।’ সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ আছে! নিশ্চয়ই রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্ত্তরীর সুবাস অপেক্ষা অধিকতর সুগন্ধময়। রোযাদারের জন্য রয়েছে দু’টি খুশী, যা সে লাভ করে; যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারী নিয়ে খুশী হয়। আর যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তার রোযা নিয়ে খুশী হবে।[1]
২। হুযাইফা (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘‘মানুষের পরিবার, ধন-সম্পদ ও প্রতিবেশীর ব্যাপারে ঘটিত বিভিন্ন ফিতনা ও গোনাহর কাফ্ফারা হল নামায, রোযা ও সদকাহ।’’[2]
৩। সাহ্ল বিন সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, জান্নাতের এক প্রবেশদ্বার রয়েছে, যার নাম ‘রাইয়ান।’ কিয়ামতের দিন ঐ দ্বার দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া তাদের সাথে আর কেউই ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে না। বলা হবে, ‘কোথায় রোযাদারগণ?’ সুতরাং তারা ঐ দরজা দিয়ে (জান্নাতে) প্রবেশ করবে। অতঃপর যখন তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তখন সে দ্বার রুদ্ধ করা হবে। ফলে সে দ্বার দিয়ে আর কেউই প্রবেশ করতে পারবে না।’’[3]
৪। আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘--- আর যে ব্যক্তি রোযা রাখায় অভ্যাসী হবে, তাকে (কিয়ামতের দিন) ‘রাইয়ান’ দুয়ার হতে (জান্নাতের দিকে) আহবান করা হবে। ---’’[4]
৫। আবু সাঈদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে বান্দা আল্লাহর রাস্তায় একদিন মাত্র রোযা রাখবে সেই বান্দাকে আল্লাহ ঐ রোযার বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে ৭০ বছরের পথ পরিমাণ দূরত্বে রাখবেন।’’[5]
৬। আম্র বিন আবাসাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন মাত্র রোযা রাখবে সেই ব্যক্তি থেকে জাহান্নাম ১০০ বছরের পথ পরিমাণ দূরে সরে যাবে।’’[6]
৭। আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি রোযা রাখবে, আল্লাহ সেই ব্যক্তি ও দোযখের মাঝে একটি এমন প্রতিরক্ষার খাদ তৈরী করে দেবেন; যা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী জায়গা সমপরিমাণ চওড়া।’’[7]
৮। উসমান বিন আবূল আস কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘রোযা হল দোযখ থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ; যেমন যুদ্ধের সময় নিজেকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের ঢাল হয়ে থাকে।’’[8]
৯। আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘রোযা হল জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য ঢাল ও দুর্ভেদ্য দুর্গস্বরূপ।’’[9]
১০। আব্দুল্লাহ বিন আম্র (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি ওকে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ আর কুরআন বলবে, ‘আমি ওকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘অতএব ওদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে।’’[10]
১১। আবু উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন কোন আমলের আজ্ঞা করুন; যদদ্বারা আল্লাহ আমাকে লাভবান করবেন।’ (অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যার মাধ্যমে আমি জান্নাত যেতে পারব।’) তিনি বললেন, তুমি রোযা রাখ, কারণ এর সমতুল কিছু নেই।’ পুনরায় আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে কোন আমলের আদেশ করুন।’ তিনিও পুনঃ ঐ কথাই বললেন, ‘‘তুমি রোযা রাখ, কারণ এর সমতুল কিছু নেই।’[11]
১২। হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমার বুকে হেলান দিয়ে ছিলেন। সেই সময় তিনি বললেন, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে একদিন রোযা রাখার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের আশায় কিছু সাদকাহ করার পর যে ব্যক্তির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে সেও জান্নাত প্রবেশ করবে।’’[12]
[2] (বুখারী ১৮৯৫, মুসলিম ১৪৪নং)
[3] (বুখারী১৮৯৬ নং, মুসলিম ১১৫২ নং, নাসাঈ, তিরমিযী)
[4] (বুখারী ১৮৯৭, মুসলিম ১০২৭নং)
[5] (বুখারী ২৮৪০ নং, মুসলিম ১১৫৩ নং , তিরমিযী, নাসাঈ)
[6] (নাসাঈ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৬৩৩০নং উকবাহ হতে,ত্বাবারানী কাবীর ও আওসাত্ব, সহীহ তারগীবঃ৯৭৫ নং)
[7] (তিরমিযী, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৬৩৩৩নং)
[8] (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮৭৯নং)
[9] (আহমাদ, মুসনাদ, বাইহাকী শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮৮০নং)
[10] (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম কাবীর, হাকেম, মুস্তাদ্রাক, ইবনে আবিদ্দুনয়্যার ‘কিতাবুল জু’, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৬৯ নং)
[11] (নাসাঈ, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, হাকেম, মুস্তাদ্রাক, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৭৩ নং)
[12] (আহমাদ, মুসনাদ, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৭২ নং)
মহান আল্লাহর ৯৯ এর অধিক সুন্দর নামাবলীর অন্যতম নাম হল ‘আল-হাকীম।’ ‘আল-হাকীম’ অর্থ হিকমত-ওয়ালা, বিজ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়। আর হিকমত ও প্রজ্ঞা হল সর্বকর্ম যথাযোগ্যভাবে নৈপুণ্যের সাথে সম্পাদন করা। মহান আল্লাহর এই নামের দাবী এই যে, তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন অথবা মানুষের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তার প্রত্যেকটার পশ্চাতে আছে পরিপূর্ণ যুক্তি ও হিকমত; তা কেউ বুঝতে সক্ষম হোক অথবা অক্ষম।
যে রোযা আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর ফরয ও বিধিবদ্ধ করেছেন তার মাঝে রয়েছে অভাবনীয় যৌক্তিকতা ও অচিন্তনীয় উপকারিতা। যেমনঃ-
১। রোযা হল এক এমন ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা প্রভুর নৈকট্যলাভ করতে সক্ষম হয়। এতে সে প্রকৃতিগতভাবে যে জিনিস ভালোবাসে তা বর্জন করে; বর্জন করে সকল প্রকার পানাহার ও যৌনক্রিয়া। আর এর মাধ্যমে সে নিজ প্রতিপালকের সন্তুষ্টি কামনা করে। আশা করে পরকালের সাফল্য ও বেহেশতলাভ। এতে এই কথাই স্পষ্ট হয় যে, সে নিজের প্রিয় বস্ত্তর উপর প্রভুর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয় এবং ইহকালের জীবনের উপর পরকালের জীবনকেই শ্রেষ্ঠত্ব দেয়।
২। রোযাদার যথানিয়মে রোযা পালন করলে রোযা তাকে মুত্তাকী ও পরহেযগার বানাতে সহায়ক হয়। তার জীবন পথে তাকওয়া ও পরহেযগারীর আলো বিচ্ছুরিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা পরহেযগার হতে পার।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৩)
সুতরাং রোযাদার রোযা রেখে তার জীবনের প্রত্যেক চিন্তা, কথা ও কর্মে ‘তাকওয়া’ আনবে -এটাই বাঞ্ছিত। আর ‘তাকওয়া’ হল সেই আল্লাহ-ভীতির নাম, যার মাধ্যমে বান্দা তাঁর সকল আদেশ যথাসাধ্য পালন করে চলবে এবং যাবতীয় নিষিদ্ধ কর্ম থেকে সুদূরে থাকবে। বলা বাহুল্য, এটাই হল রোযার মহান উদ্দেশ্য ও প্রধান লক্ষ্য। পানাহার ও যৌনক্রিয়া নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে মানুষকে বৃথা কষ্ট দেওয়া রোযার উদ্দেশ্য নয়। প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা ও তার উপর আমল ত্যাগ করতে পারল না, সে ব্যক্তির পানাহার ত্যাগ করার মাঝে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’’[1]
৩। রোযা আত্মাকে তরবিয়ত দান করে, চরিত্রকে সভ্য ও আদর্শভিত্তিক করে গড়ে তোলে এবং রোযাদারের আচরণে উৎকৃষ্টতার স্থায়িত্ব আনয়ন করে। মুসলিমের সবভাব-প্রকৃতিতে রোযা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। রোযার সংশোধনী বার্তা তার হৃদয়-মনে তাসীর রেখে যায়। রোযাদারের অন্তরে এমন জাগরণ সৃষ্টি করে এবং তার মনের দুয়ারে এমন অতন্দ্র প্রহরী খাড়া করে দেয় যে, সে নিজের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয় এবং এই প্রহরীর চোখে ফাঁকি দিয়ে কোনও নৈতিকতা-বিরোধী কর্ম করতে ইচ্ছা ও চেষ্টাও করতে পারে না।
এটা কি করে হতে পারে যে, রোযাদার তার প্রতিপালকের নিকট সত্যবাদিতার পরিচয় দেবে, অথচ মানুষের সঙ্গে মিথ্যা বলবে? নিজের রোযায় আন্তরিকতা রাখবে, অথচ নিজ সমাজের সঙ্গে ধোকাবাজী ও কপটতা প্রদর্শন করবে? ইখলাস ও আন্তরিকতা একটি সামগ্রিক বস্ত্ত; যা ভাগাভাগি হয় না। যার সর্বোচ্চ পর্যায় ও সারাংশ হল সৃষ্টিকর্তা অন্তর্যামী আল্লাহর সাথে আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততা। সুতরাং যে ব্যক্তির আল্লাহর সাথে আন্তরিকতা থাকবে, সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসম্ভব যে, সে মানুষকে ধোকা দেবে, আমানতে খেয়ানত করবে, অপরকে ঠকিয়ে খাবে, চুরি করবে, যুলম করবে অথবা অপরকে কষ্ট দেবে। পক্ষান্তরে যদি কারো চক্রান্তে পড়ে বা ভুলক্রমে এ ধরনের কোন পাপ করেই বসে, তাহলে সাথে সাথে সে সুপথে ফিরে আসে, আল্লাহর নিকট তওবা করে, অনুতপ্ত হয়, লজ্জিত হয় সীমাহীন।
সুতরাং রোযা হল একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সুচরিত্র গঠনের উপকরণ এবং তা সমৃদ্ধকরণের জন্য আভ্যন্তরীণ এক মৌলিক উপাদান। আর বিদিত যে, বাহ্যিক সৌন্দর্যের বাহার কোন মূল্য রাখে না; যদি না অভ্যন্তর সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। তাই রোযাদারের জীবনে তার আখলাক-চরিত্র স্থায়িত্ব, স্থিতিশীলতা, বর্ধনশীলতা ও শ্রীবৃদ্ধিশীলতার গুণাবলী গ্রহণ করে থাকে। কারণ, তার সকল আচরণ ভিতর ও বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত হয়ে যায়।[2]
৪। রোযা রোযাদারের আচার-ব্যবহারকে সুন্দর করার কাজে বড় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। পূর্ণ একটি মাস ধরে তাকে পাপ থেকে দূরে রাখে, নিষিদ্ধ ও হারাম বস্ত্ত থেকে নিরাপদে রাখে। বরং রোযা তাকে এক মহান ইবাদতে মশ্গুল রাখে, হীনতা ও নীচতা হতে রক্ষা করে, প্রত্যেক নোংরামীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। সুতরাং সে না চুগলী করে, না গীবত। না মিথ্যা বলে, না অশ্লীল। না ফিতনা সৃষ্টি করে, না ফাসাদ। না অসার বকে, না ফালতু। কোন প্রকারের পাপাচরণ তার দ্বারা সংঘটিত হয় না। ফলে প্রকৃত রোযাদার রোযার পরেও একটি নিষ্পাপ ও পবিত্র মানুষের মত যাবতীয় সচ্চরিত্রতার অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে সুখময় জীবন-যাপন করতে পারে।[3]
৫। রোযা মন ও প্রবৃত্তিকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার অনুশীলন দেয়। জিতেন্দ্রিয় ও সংযমী হতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে রোযাদার তার মন ও প্রবৃত্তিকে সেই কাজে ব্যবহার করতে পারে; যাতে ইহ-পারলৌকিক সকল প্রকার মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত আছে। আর এমন আচরণ ও কর্ম থেকে তাকে দূরে রাখে; যাতে সে একটি ইন্দ্রিয়সেবী ও পাশবিক গুণসম্পন্ন মানুষ বলে পরিচিত হতে পারে; যেখানে সে কামনা-বাসনা ও লালসার প্রবণতা থেকে তাকে রুখতে সক্ষম হয় না।
সুতরাং রোযা সেই মন্দপ্রবণ আত্মার বিরুদ্ধে লড়ায়ে বিজয়ী হতে মুসলিমকে সার্বিক সহযোগিতা করে, যে আত্মা সর্বদা হারাম কাজে লিপ্ত হতে চায়, অবৈধভাবে কাম-লালসা চরিতার্থ করতে চায়। রোযা রোযাদারের ইচ্ছাশক্তিকে সর্বপ্রকার পাপ ও কুপ্রবৃত্তির স্পর্শ থেকে দূরে থাকার ‘ট্রেনিং’ দেয়। রোযার মাঝে রয়েছে আত্মসংযম এবং কুপ্রবৃত্তির দমন।
আধুনিক যুগের মানুষ অধিকাংশে নিজ কামনা-বাসনার কাছে বড় দুর্বল, কুপ্রবৃত্তি ও মন্দ-প্রবণ খেয়ালখুশীর বশীভূত। আর মনকে সবল ও সুদৃঢ় করতে রোযা ছাড়া আর অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। কারণ, রোযাদার অত্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর থাকা সত্ত্বেও পানাহার বর্জন করে থাকে। আর নিঃসন্দেহে এ কাজে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা সৃষ্টি হয় এবং সর্বকাজে মনোবল প্রবল ও সুদৃঢ় হয়।
৬। রোযা রোযাদারকে কুঅভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তিদান করে। এমন বহু মানুষ আছে, যারা এমন বহু নোংরা অভ্যাসে অভ্যাসী হয়ে পড়ে এবং তার ফাঁদ থেকে বের হওয়ার কোন পথ খুঁজে পায় না। কিন্তু রোযা এলে তাদেরকে দেখা যায় যে, তারা তাদের সে সমস্ত কুঅভ্যাসকে পরিপূর্ণরূপে বর্জন করে ফেলেছে।
বলা বাহুল্য, এটাই হয় তাদের জন্য সুবর্ণ-সুযোগ; যার মাঝে তাদের সেই সকল মন্দ অভ্যাসের পঞ্জা থেকে নিজেদেরকে সহজ উপায়ে স্বাধীন করে নিতে পারে, যে সকল অভ্যাস তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও ব্যাধির একমাত্র কারণ।[4]
অতএব সেই সকল রোযাদারগণ যারা ধুমপানে অভ্যাসী; যাদের অবৈধ বিড়ি-সিগারেট বিনা ৩০ মিনিটও অতিবাহত হয় না, অথবা তা পান না পর্যন্ত পায়খানাও হয় না, যাদের দৈনিক ১ প্যাকেট সিগারেট পানে তাদের ৫০ বছর জীবনে প্রায় ১ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা এবং ১৫২০৮ ঘ¦টা ২০ মিনিট সময় অপচয় হয়, তাদের উচিৎ, রোযার এই পবিত্র অবসরে এই শ্রেণীর ‘বিষপান’ চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করা। কারণ, এ ‘সুখটান’ এমন ‘অগ্নিবাণ’ যে, তা মানুষের সুসবাস্থ্য, দেহ, অর্থ, দ্বীন, দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য বড় ক্ষতিকর। যে মানুষ ১২/১৩ ঘ¦টা আল্লাহর ওয়াস্তে তা বর্জন করে থাকতে পারে, সে মানুষ আল্লাহরই ভয়ে বাকী সময় পান না করলেও থাকতে পারবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে কোন জিনিস বর্জন করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছায় তার চাইতে উত্তম জিনিস অর্জন করবে। এটাই হল আল্লাহর রীতি। পরন্তু এ কোনক্রমেই উচিৎ নয় যে, রোযাদার সারাদিন হালাল জিনিস না খেয়ে রোযা রেখে পরিশেষে হারাম জিনিস দিয়ে রোযা খুলবে![5]
৭। রোযার মাঝে রয়েছে আল্লাহর প্রতি সুদৃঢ় ঈমান রাখার সবিশেষ প্রশিক্ষণ। কারণ, রোযা হল গুপ্ত ইবাদত। যেহেতু মানুষ এ ইবাদতে মুনাফেকী রাখতে পারে না। ইচ্ছা করলে সে গোপনে খেতে বা পান করতে পারে, অথবা উপবাস থেকেও নিয়ত ভেঙ্গে ফেলতে পারে। সুতরাং নিছক আল্লাহর প্রতি সুদৃঢ় ঈমান ও সত্য ভয় না থাকলে প্রকৃতরূপে রোযা রাখা যায় না।
বলা বাহুল্য, রোযা হল এমন একটি আন্তরিক ইবাদত, যা বান্দা ও প্রভুর মাঝে একান্ত গুপ্ত। অতএব গোপনে পানাহার করার সামর্থ্য ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা না করা এই কথাই প্রমাণ করে যে, সে বান্দা নিঃসন্দেহে এই বলে অটল বিশ্বাস রাখে যে, মহান আল্লাহ তার গোপন সব কিছুই দেখেন ও জানেন। আর এখান থেকেই রোযাদারের মনে ইবাদতে সততা ও আমানতদারী সৃষ্টি হয়। তাইতো আল্লাহ তাআলা রোযাকে পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করেছেন; বান্দার প্রত্যেক আমলের সওয়াবকে ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ; বরং আরো অনেক অনেক গুণ বর্ধিত করে থাকেন। কিন্তু রোযা নয়। রোযাকে তিনি নিজের জন্য খাস করে নিয়েছেন। আর তার সওয়াবের পরিমাণ যে কত, তা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য; তাতে তার সওয়াব ১০ থেকে ৭০০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রোযা নয়। রোযা হল আমার জন্য। আর আমি নিজে তার প্রতিদান দেব।’’[6]
৮। রোযা রোযাদারের মনে পরকালের প্রতি আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি করে। কারণ, সে আল্লাহর নিকট আখেরাতে যে সওয়াব ও প্রতিদান আছে তা পাওয়ার আশায় আগ্রহান্বিত হয়ে পার্থিব কিছু সুখ-উপভোগ থেকে বিরত থাকে। সে যে নিক্তিতে লাভ-নোকসান ওজন করে থাকে তা হল পারলৌকিক। রোযার দিনে পানাহার ও যৌনসুখ শুধু এই আশায় পরিহার করে যে, এতে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার সাথে সাথে কিয়ামতের দিন উত্তম প্রতিদান পাবে। সুতরাং এইভাবে রোযা রোযাদারের মনে পরকালের প্রতি ঈমান বদ্ধমূল করে, পরলোকের সাথে অন্তরকে জুড়ে রাখে এবং ক্ষণস্থায়ী এই ধরাধামের পার্থিব ভোগ-বিলাসে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে; যে ভোগ-বিলাস অনেক সময় মানুষকে আখেরাতের কথা বিস্মৃত করে এই ধারণা দেয় যে, সে পৃথিবীতে অমর ও চিরকাল থাকবে।[7]
৯। রোযা পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ এবং তাঁর পূর্ণ দাসত্ব করার কথা শিক্ষা দেয়। রোযা মুসলিমকে প্রকৃত দাসত্বের অনুশীলন দেয়। তাই তো সে রাতের বেলায় খায়, পান করে। কারণ, তার প্রভু যে বলেছেন,
(وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ)
অর্থাৎ, আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
বলা বাহুল্য, এ জন্যই ইফতার ও সেহরীর সময় খাওয়া হল সুন্নত ও মুস্তাহাব এবং না খেয়ে একটানা পরপর কয়েকদিন রোযা রাখা মকরূহ। অতএব রোযা রাখার জন্য সেহরী খাওয়া এবং রোযার শেষে ইফতারী খাওয়া হল এক প্রকার আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর নির্দেশের আনুগত্য।
তদনুরূপ ফজর উদয় হলে মুসলিম পানাহার সহ সেই সকল বস্ত্ত ও বিষয় থেকে দূরে থাকে, যাতে রোযা নষ্ট করে ফেলে। আর এর মাঝেও সে একমাত্র আল্লাহরই দাত্ব ও আনুগত্য করে। কারণ, তিনি বলেন,
(ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ)
অর্থাৎ, অতঃপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
সুতরাং এইভাবে মুসলিম মহান আল্লাহর পূর্ণ দাসত্ব ও আনুগত্যের উপর দীর্ঘ প্রশিক্ষণ লাভ করে থাকে।[8]
১০। রোযা মুসলিমের জন্য আল্লাহর এক প্রকার রহমত, করুণা ও অনুগ্রহ। মহান আল্লাহ মুসলিম জাতির প্রতি অনুগ্রহ ও করুণা প্রদর্শন করেই রোযা ফরয করেছেন। কারণ, এরই মাধ্যমে তিনি মুসলিমের পাপরাশি মার্জনা করে থাকেন, তার মর্যাদা উন্নীত করে থাকেন এবং বহুগুণ হারে তার সওয়াব বৃদ্ধি করে থাকেন।[9]
১১। রোযা হল গোনাহের কাফ্ফারা। কারণ, নেকীর কাজ গোনাহর কাজের গোনাহ নাশ করে দেয়। আর রোযা হল বড় নেকীর কাজ। মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ)
অর্থাৎ, নিশ্চয় পুণ্যরাশি (সওয়াবের কাজ) পাপরাশিকে দূরীভূত করে। (কুরআনুল কারীম ১১/১১৪)
আর প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘মানুষের পরিবার, ধন-সম্পদ ও প্রতিবেশী সংক্রান্ত পাপরাশিকে নামায, রোযা এবং সদকাহ মোচন করে দেয়।’’[10] অর্থাৎ, মুসলিম যে গোনাহ তার পরিবারকে অন্যায়ভাবে উচ্চবাচ্য করে, কষ্ট দিয়ে অথবা কোন বিষয়ে তাদের প্রতি ত্রুটি ও অবহেলা প্রদর্শন করে, অথবা প্রতিবেশীকে কোন কথায় বা কাজে কোন প্রকার কষ্ট দিয়ে, অথবা আর্থিক কোন প্রকার ত্রুটি ঘটিয়ে অথবা অনুরূপ অন্যান্য সাগীরা (ছোট) গোনাহ করে থাকে, সে সবকে তার নামায, রোযা এবং দান-খয়রাত মোচন করে দেয়।
পরন্তু প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশা রেখে রমাযানের রোযা রাখে, তার পূর্বেকার সকল গোনাহ মাফ হয়ে যায়।’’[11]
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘কাবীরাহ গোনাহ না করলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমআহ থেকে অপর জুমআহ এবং এক রমাযান থেকে অন্য রমাযান -এর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত পাপসমূহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)।’’ [12]
তদনুরূপ রোযা হল কসম ভাঙ্গার কাফ্ফারা (জরিমানা)। (কুরআনুল কারীম ৫/৮৯) যিহারের কাফ্ফারা। (কুরআনুল কারীম ৫৮/৪) কোন মুসলিমকে বা চুক্তিবদ্ধ কোন যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যা করে ফেলার কাফ্ফারা। (কুরআনুল কারীম ৪/৯২) ইহরামে নিষিদ্ধ কর্ম করে ফেলার কাফ্ফারা। (কুরআনুল কারীম ২/১৯৬, ৫/৫) তামাত্তু’ হজ্জের কুরবানী দিতে না পারলে তার কাফ্ফারা। (কুরআনুল কারীম ২/১৯৬) ইত্যাদি।
১২। রোযা রোযাদারের মনে ধৈর্য ও সহনশীলতা সৃষ্টি করে। কষ্টে ধৈর্য ধারণ ও সহনশীলতা অবলম্বন করতে অভ্যাসী বানায়। রোযা তাকে তার প্রিয় বস্ত্ত ব্যবহার বর্জন করতে ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। যেমন শিক্ষা দেয় কাম-দমন ও মনের যথেচ্ছাচার দমন করার; যা নিশ্চয় সহজ কাজ নয়।
বলা বাহুল্য, রোযা পালনে রয়েছে ৩ প্রকার ধৈর্য। মহান আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য, তাঁর হারামকৃত বস্ত্ত পরিহার করার উপর ধৈর্য এবং তাঁর নির্ধারিত তকদীরের বালা-মসীবতের উপর ধৈর্য। এই ৩ প্রকার ধৈর্য যে বান্দার মাঝে একত্রিত হবে, সেই হবে ইহকালে পরম সুখী এবং পরকালে আল্লাহর ইচ্ছায় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ)
অর্থাৎ, ধৈর্যশীলদেরকে তো অপরিমিত পুরস্কার ও সওয়াব দান করা হবে। (কুরআনুল কারীম ৩৯/১০)
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ক্ষুৎ-পিপাসা ও যৌনক্ষুধায় ধৈর্যধারণ করাই হল ধৈর্যের শেষ পর্যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি এই শ্রেণীর ধৈর্য ধারণ করতে পারঙ্গম হবে, সে ব্যক্তির জন্য অন্য শ্রেণীর ধৈর্য ধারণ করা সহজ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ করবে, সে ব্যক্তি লাভ করবে শুভপরিণাম।
মহান আল্লাহ বলেন,
(وَالَّذِينَ صَبَرُوا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرّاً وَعَلانِيَةً وَيَدْرَأُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ أُولَئِكَ لَهُمْ عُقْبَى الدَّارِ- جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا)
‘‘যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টিলাভের জন্য ধৈর্যকষ্ট বরণ করে, যথাযথভাবে নামায পড়ে, আমি যে রুযী তাদেরকে দান করেছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করে এবং যারা ভালো দ্বারা মন্দকে দূর করে- তাদেরই জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম; (আদ্ন) স্থায়ী বেহেশত, ওতে ওরা প্রবেশ করবে---।’’ (কুরআনুল কারীম ১৩/২২-২৩)
১৩। রোযা হল ঢালস্বরূপ; দোযখ থেকে রক্ষার ঢালস্বরূপ।[13] একটি মাত্র রোযা জাহান্নামকে রোযাদার থেকে ৭০ বছরের পথ দূরে সরিয়ে দেয়।[14] সুতরাং যে ব্যক্তি পূর্ণ রমাযান মাসের রোযা রাখে এবং প্রত্যেক মাসে ৩টি রোযা অথবা আরো অন্যান্য নফল রোযা রাখে, সে ব্যক্তি থেকে দোযখ কত বছরের পথ দূরে সরে যায় তা অনুমেয়।
১৪। রোযা হল চরিত্রহীনতা ও ব্যভিচার ইত্যাদি অশ্লীলতা থেকে ঢালস্বরূপ। রোযা রোযাদারকে অবৈধ যৌনাচার থেকে হিফাযতে রাখে, যেমন ঢাল মুজাহিদ (যোদ্ধা)কে শত্রুপক্ষের তীর ও তরবারির আঘাত থেকে রক্ষা করে থাকে।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘হে যুবকদল! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (বিবাহের অর্থাৎ স্ত্রীর ভরণপোষণ ও রতিক্রিয়ার) সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কারণ, বিবাহ চক্ষুকে দস্ত্তরমত সংযত করে এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করে। আর যে ব্যক্তি ঐ সামর্থ্য রাখে না, সে যেন রোযা রাখে। কারণ, তা যৌনক্ষুধা উপশমকারী।’’[15]
বলা বাহুল্য, যে যুবক বিবাহের খরচাদি বহন করতে সক্ষম নয়, সে যুবককে মহানবী এই নির্দেশ দিলেন যে, সে যেন তার কামক্ষুধা ও যৌন-উত্তেজনা প্রশমিত করতে রোযার সাহায্য নেয়। কারণ, রোযা উক্ত ক্ষুধা ও উত্তেজনা দমন ও নিবারণ করে। আর অনেকের অভিজ্ঞতা দ্বারা উক্ত নববী চিকিৎসা প্রমাণিত ও পরীক্ষিত যে, কামপীড়িত যুবকের জন্য যে কোনও সেব্য ঔষধ অপেক্ষা রোযাই হল উত্তম ও অব্যর্থ ঔষধ।
১৫। রোযা হল বেহেশ্তেগামী পথ। আবূ উমামাহ (রাঃ) জান্নাতে প্রবেশ করাবে এমন আমল প্রসঙ্গে যখন আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট নির্দেশ চাইলেন, তখন তিনি তাঁকে বললেন, ‘‘তুমি রোযা রাখ। কারণ, তার মত অন্য কোন আমল নেই।’’[16] তাছাড়া মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) রোযাদারকে বেহেশ্তে ‘রাইয়ান’ নামক এক বিশেষ দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সুসংবাদ দিয়েছেন।[17] আর ‘রাইয়ান’ (তৃষ্ণাহীন) দ্বার আমল অনুযায়ী রোযাদারের জন্য বড় উপযুক্ত। কারণ, রোযা রাখার ফলে দুনিয়াতে সে পিপাসায় কাতর হয়। তাই তারই বিনিময়ে পরকালে ‘‘সেই দ্বারে যে প্রবেশ করবে সে (বেহেশ্তী পানীয়) পান করবে। আর যে ব্যক্তি একবার তা পান করবে, সে ব্যক্তি আর কোন কালেও পিপাসিত হবে না।’’[18]
১৬। রোযা পালনের মাধ্যমে রোযাদার তার মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভ করে থাকে। যার জন্য তার উপবাস-জনিত মুখের দুর্গন্ধও আল্লাহর নিকট কস্ত্তরী অপেক্ষাও অধিক সুগন্ধময় হয়![19] অথচ খালি পেটে থাকা অবস্থায় মুখ থেকে বের হওয়া ঐ দুর্গন্ধ কোন মানুষ পছন্দ করে না; বরং ঘৃণাই করে থাকে। কিন্তু তা মহান স্রষ্টার নিকটে অতি পছন্দনীয়। কারণ, এ গন্ধ তাঁরই আনুগত্য ও সন্তুষ্টির পথে নির্গত হয়ে থাকে।
১৭। রোযাদার ব্যক্তির দুআ রোযা রাখা অবস্থায় কবুল হয়ে থাকে। প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘তিন প্রকার দুআ আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে থাকে; রোযাদারের দুআ, অত্যাচারিতের দুআ এবং মুসাফিরের দুআ।’’[20]
১৮। রোযা কিয়ামতের ভীষণ বিচার দিনে রোযাদারের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে; বলবে, ‘হে আমার প্রভু! আমি ওকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌনক্রিয়া থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ গ্রহণ করে নাও।’ অতঃপর মহান প্রভু তার সে সুপারিশ গ্রহণ করে নেবেন।[21]
১৯। রোযা রোযাদারের জন্য ইহ-পরকালের খুশী ও সুখের হেতু। যেমন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘রোযাদারের জন্য রয়েছে ২টি খুশী; প্রথম খুশী হল ইফতার করার সময় এবং দ্বিতীয় খুশী হল প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়।’’[22]
রোযাদারের ইফতার করার সময় যে খুশী, তা হল সেই সুখ ও তৃপ্তির একটি নমুনামাত্র; যা মুমিন ব্যক্তি নিজ প্রভুর আনুগত্য ও তাকওয়ার মাধ্যমে অর্জন করে থাকে। আর প্রকৃতপ্রস্তাবে এটাই হল আসল সুখ। এই সুখ ও তৃপ্তি দুইভাবে অনুভূত হয়ে থাকেঃ-
(ক) আল্লাহ তাআলা ঐ ইফতারের সময় রোযাদারের জন্য পানাহার বৈধ করে দিয়েছেন। আর নিঃসন্দেহে মানুষের প্রকৃতি এই যে, (বিশেষ করে খিদে থাকা অবস্থায়) খাবার দেখলে মন আনন্দে নেচে ওঠে। আর এ জন্যই তা বর্জন করা হল আল্লাহর ইবাদত।
(খ) সে মুহূর্তে রোযাদার তার একটি রোযা সম্পন্ন করে থাকে। সুতরাং আল্লাহর তওফীক অনুযায়ী সে সেদিনকার রোযা ও ইবাদত যে পালন ও পূর্ণ করতে পারল, তারই খুশী তার মনকে আন্দোলিত করে তোলে।[23]
পক্ষান্তরে সবচেয়ে বড় খুশী যা, তা রয়েছে পরকালে; যখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হবে যাঁর জন্য রোযাদার রোযা রেখে থাকে।
২০। রোযা হল পরহেযগার ও নেক লোকদের ট্রেনিং-ময়দান; যার মাঝে আল্লাহর দেওয়া পৃথিবীর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার উপর নিজেদের কর্তব্যের বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, রোযা দেহ-মনের জন্য একটি বড় রহমত। রোযার মাঝেই হৃদয় ও সকল চিন্তা-ভাবনা আল্লাহ তাআলার সাথে যুক্ত থাকে। সকল মনোবল তাঁর ভালোবাসা, আনুগত্য ও তাঁর পথে জিহাদের কাজে বর্ধিত ও সংবদ্ধ হয়ে থাকে। যার পশ্চাতে উদ্দেশ্য থাকে এই যে, আল্লাহর বাণীই সমুন্নত হোক এবং কাফেরদের বাণী হোক অবনত; সে কাফের যেমনই হোক, তার যে নাম বা উপাধি হোক অথবা যে প্রতীকই হোক।[24]
২১। রোযা হল কচি-কাঁচা শিশুর মনের মাটিতে ‘আমানতদারী’র বীজ রোপণ করার এক বাস্তবভিত্তিক ইতিবাচক ও কার্যকর প্রক্রিয়া। শিশু-কিশোরকে রোযা রাখতে অভ্যাসী করার সময় যখন তাকে পানাহার করতে নিষেধ করা হয় এবং খাবার ও পানি হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও সে শুধু এই বিশ্বাসে তা খেতে পারে না যে, এ নিষেধ হল আল্লাহর এবং তিনি তাকে দেখছেন। অথচ এ ব্যাপারে কেবল তার মন ও বিবেক ছাড়া অন্য কেউ পর্যবেক্ষক নেই। সুতরাং কাঁচা মনে আমানতদারী বদ্ধমূল করতে এই অনুভূতি অপেক্ষা অধিক প্রতিক্রিয়াশীল আর অন্য কি হতে পারে?
যার ফলে শৈশব থেকেই শিশু আমানতদারীর মত এক নৈতিকতাপূর্ণ কর্মে অভ্যাসী হয়ে গড়ে ওঠে এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও তার যথার্থ হিফাযত করতে ও তার মনে তা আজীবন বহাল রাখতে কোন প্রকার কষ্টবোধ করে না।[25]
২২। রোযা মানুষের হৃদয়কে নরম করে, আল্লাহ-প্রেমী করে এবং সর্বদা তাঁর যিক্র ও শুক্র করতে অভ্যাসী করে।
২৩। রোযা মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশ ও প্রবাহ-পথ রুদ্ধ করে। এর ফলে তার দেহ-মনে শয়তানের আধিপত্য কমে যায়। পক্ষান্তরে যখনই মানুষ নিজ প্রবৃত্তির লাগাম ছেড়ে দেয়, তখনই শয়তান তা লুফে নিয়ে তাকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে পরিচালিত করতে থাকে।[26]
২৪। রোযা হল আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের শুক্রিয়া আদায় করার অন্যতম মাধ্যম। কারণ, রোযা হল পানাহার ও যৌনমিলন থেকে বিরত থাকার নাম। আর মানুষের উপর আল্লাহর যে সকল বড় বড় নেয়ামত রয়েছে তার মধ্যে পানাহার ও যৌনমিলন হল অন্যতম। সুতরাং মানুষ এ নেয়ামতের কদর তখনই বুঝবে, যখন সে এ নেয়ামত থেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বঞ্চিত থাকবে। কারণ, হারিয়ে না গেলে কোন নেয়ামতের কদর বুঝা যায় না। আর যখনই উক্ত নেয়ামতের কদর সে বুঝবে, তখনই তার অবশিষ্ট অধিকার আদায়ের জন্য শুক্রিয়া জ্ঞাপন করবে। পক্ষান্তরে নেয়ামতের শুক্র আদায় করা ফরয; শরীয়তে এবং বিবেক মতেও। রোযার আয়াতে মহান আল্লাহ ঐ কথার প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেন,
(ولعلَّكُمْ تَشْكُرُوْن)
অর্থাৎ, যাতে তোমরা শুক্র আদায় কর। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
রোযাদার যখন ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করে, তখন সে সেই গরীব-নিঃসবদের কষ্টের কথাও উপলব্ধি করে; যারা ক্ষুধার সময় পেটে এক মুঠো অন্নও যোগাড় করতে সমর্থ নয়। এর ফলে ঐ উপলব্ধি তাকে তাদের জন্য দান-খয়রাত করে সহানুভূতি প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ, নিজের দেখা বিষয় শোনা বিষয়ের মত নয়। নিজের দেখা ও পরীক্ষা করা বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতীতি জন্মে অধিক। যেমন একজন ঘোড়সওয়ার লোক পথ চলার কষ্ট ততক্ষণ অনুভব করতে সক্ষম নয়; যতক্ষণ না সে নিজে পায়ে হেঁটে পথ চলে দেখেছে।[27]
২৫। রোযার মাধ্যমে রোযাদার ক্ষুধা-জনিত দুর্বলতার ফলে সে আল্লাহর কতটা মুখাপেক্ষী তা আন্দাজ করতে পারে। আর যে ব্যক্তি নিজের মাঝে নিজের দুর্বলতা চিনতে পারে, সে ব্যক্তির মিথ্যা অহংকার দূরীভূত হয়ে যায়। পরন্তু আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি রহম করেন, যে নিজের কদর নিজে জেনেছে।[28]
২৬। রোযাতে রোযাদার ফিরিশ্তামন্ডলীর অনুরূপ কর্মে শামিল হতে পারে; যে ফিরিশ্তামন্ডলী আল্লাহর কোন প্রকার অবাধ্যাচরণ করেন না। তাঁরা তাই করেন, যা করতে তাঁদের প্রতিপালক তাঁদেরকে আদেশ করেন। দিবারাত্র তাসবীহ পাঠ করতে থাকেন এবং কোন প্রকার ক্লান্তিবোধ করেন না। যাঁরা খান না এবং পানও করেন না।[29]
২৭। রোযা রোযাদারের ঈমান বৃদ্ধি করে। এই রোযাতে মানুষ অধিকাধিক নামায পড়ে, কুরআন তেলাঅত ও যিক্র করে, দান-খয়রাত করে, দুআ ও ইস্তিগফার তথা তওবা করে, ওয়ায-নসীহত শোনে। রোযা তাকে মন্দ কাজ করতে বাধা দেয়। বলা বাহুল্য, এ সবে পাপ বন্ধ থাকে এবং ঈমান বর্ধিত হয়।[30]
২৮। রোযার মাসে রোযাদারের দ্বীনী জ্ঞান বর্ধিত হয়ে থাকে। কারণ, রমাযান হল ইবাদতের মাস, আল্লাহর আয়াত নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ও গবেষণা করার মাস। কুরআন মাজীদ তেলাঅত করা ও শোনার মাস।[31]
২৯। এ মাসে দ্বীনের আহবায়কদের জন্য রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। এ মাসে অধিকাংশ মুসলিম জনসাধারণ মসজিদের দিকে ধাবিত হয়। এদের মধ্যে কেউ বা তার জীবনে প্রথমবার প্রবেশ করে, কেউ বা অনেক দিন হল মসজিদ ত্যাগ করেছিল। এ সময় তাদের হৃদয় এক প্রকার দুর্লভ নম্রতা ও তরঙ্গায়িত ভক্তিতে গদ্গদ্ করে।
সুতরাং এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মন-গলানো উপদেশমালা এবং উপযুক্ত ওয়ায ও দর্স প্রয়োগ করে তাদের ঈমান বাড়াতে সাহায্য করা উচিৎ। আর এ কাজে অবশ্যই সৎ ও আল্লাহভীতির কাজে সহায়তা হয়ে থাকে।[32]
পরন্তু রমাযানের রোযা বছরান্তে একবার ফরযরূপে এসে থাকে। যা হজ্জের মত জীবনে একবার নয়। যাতে প্রত্যেক বছর ঈমানী দর্সের পুনরাবৃত্তি হয় এবং রোপিত ঈমানী বৃক্ষ সহসায় বেড়ে ওঠে।
৩০। রোযার মাধ্যমে মুসলিমদের সামাজিক উপকারিতা সাধন হয়ে থাকে। রোযা হল মুসলিম জাতির ঐক্যের নিদর্শন, সারা উম্মাহর মাঝে সংহতির প্রতীক, গরীব-ধনীর মাঝে সাম্য ও সম্প্রীতির চিহÁ। এতে আম-খাস, আতরাফ-আশরাফ, আমীর-ফকীরের ভেদাভেদ চূর্ণ হয়ে যায়। সকলের মনে একটাই বোধ জাগে যে, মুসলিম জাতি হল এক জাতি। সকলে একই সময়ে পানাহার করে, একই সময়ে রোযা রাখে। একই জামাআতে মসজিদে তারাবীহর নামায পড়ে। যেন সকলের হৃদয় এক, মাস এক, কর্মও এক, যাদেরকে তাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তারা হল একটি দেহের মত।
৩১। রোযার উপবাস সবাস্থ্যের জন্য বড় উপকারী। রোযাতে তুলনামূলকভাবে কম খাওয়া হয় এবং নির্দিষ্ট সময় ধরে পাকস্থলীকে বিরতি দেওয়া হয়। এর ফলে শরীরের মেদ, ক্লেদ ও আর্দ্রতা ইত্যাদি দূরীভূত হয়ে যায়।[33] আর একথা বিদিত ও স্বীকৃত যে, শরীরের মধ্যে পেট হল রোগের বাসা এবং ব্যবস্থাপিত ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্য আহার করা হল শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা। বলা বাহুল্য, এ কথা বহু চিকিৎসকই স্বীকার করেছেন যে, রোযাতে রয়েছে বহু দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি থেকে নিরাপত্তা, বিশেষ করে যক্ষ্মা, ক্যানসার ইত্যাদি।
রোযায় রয়েছে শরীরের ওজন বৃদ্ধি, হ্যাপাটাইটিস, জন্ডিস, প্লীহা, যকৃৎ, বদহজম, প্রভৃতি রোগের চিকিৎসা।
রোযা ফরয হয়েছে সুস্থ মানুষের উপর। যাতে আক্রমণের পূর্বেই ঐ সকল বা আরো অজানা বহু রোগের হাত থেকে বাঁচার উপায় পাওয়া যায়। তাছাড়া বহু গবেষণা এ কথা প্রমাণ করেছে যে, পানাহার থেকে বিরত থাকা একটি প্রকৃতিগত ব্যাপার; যা মহান সৃষ্টিকর্তা নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সময় ব্যাপী জীবজগতের জন্য অনিবার্য করেছেন। আর তা শুধু এই জন্য যে, যাতে করে প্রাণীজগৎ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়, বাঁচার জন্য শক্তি পায় এবং নিজ নিজ বংশবিস্তারে যথানিয়মে সক্রিয় থাকতে পারে।
জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গের উপবাস করার কথা অনেকের অজানা নয়। কোন কোন জন্তু লম্বা সময় ধরে প্রায় কয়েক মাস যাবৎ উপবাস করে। কোন কোন জন্তু কয়েক দিন ধরে উপবাস করে। বরং উদ্ভিদজগৎও উপবাস পালন করে থাকে। যার ফলে নতুন, সুন্দর ও লকলকে পাতা বের হয়ে আসে এবং শান্ত শীতে নিদ্রার পর ফুল-ফলে সুশোভিত হয়ে শক্তিশালী ও সজীবরূপে শুরু হয় বৃক্ষ-তরুলতার আনন্দময় বসন্তকাল।
ডাঃ সলোমন মানব-দেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন, ‘ইঞ্জিন রক্ষাকল্পে মধ্যে মধ্যে ডকে নিয়া চুল্লি হইতে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত করা যেমনটা আবশ্যক - উপবাস দ্বারা মধ্যে মধ্যে পাকস্থলী হইতে অজীর্ণ খাদ্যটি নিষ্কাশিত করাও তেমনটা দরকার।’[34]
৩২। রোযা মানুষের চিন্তাশক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি করে। কারণ, পেট খালি থাকলে চিন্তা-গবেষণা নির্মল হয় এবং মন-মগজের কর্ম সুন্দর হয়।
পক্ষান্তরে যারা ধারণা করে যে, রোযা মানুষের খরচ বাড়ায় এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় এই রোযার মাসে, তাদের ধারণা সঠিক নয়। কেননা, খাবারের নানান ভ্যারাইটিজ তৈরী করা এবং প্রয়োজনের তুলনায় বেশী খাবার প্রস্ত্তত করা, রমাযানের জন্য বিশেষ বিশেষ ধরন ও বরনের খাদ্যপণ্যের বিপণন ঘটানোতে ইসলামের অনুমোদন নেই। বরং তা হল অপচয়। আর অপচয় ইসলামে নিষিদ্ধ; রমাযানে এবং অন্য মাসেও।
বলাই বাহুল্য যে, রোযাতে রয়েছে মঙ্গলই মঙ্গল। ব্যক্তি ও সমাজের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সেই মঙ্গল অনস্বীকার্য। আর মহান আল্লাহর এই বাণীর মধ্যে সেই মঙ্গলের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি বলেন,
(وَأَنْ تَصُوْمُوْا خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
অর্থাৎ, তোমাদের রোযা রাখাটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা উপলব্ধি কর। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৪)
[2] (ফাইযঃ ২২৪পৃঃ)
[3] (সাওমু রামাযান ৪০পৃঃ)
[4] (সাওমু রামাযান ৪০পৃঃ)
[5] (ইতহাফ ৪২পৃঃ)
[6] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৫০৩)
[7] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ১০পৃঃ)
[8] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ১০পৃঃ)
[9] (ইতহাফ ৪১পৃঃ)
[10] (বুখারী ১৭৯৬, মুসলিম ১৪৪নং)
[11] (বুখারী ৩৮, মুসলিম ৭৬০নং)
[12] (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম ২৩৩নং, তিরমিযী)
[13] (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮৬৭নং)
[14] (বুখারী ২৬৮৫, মুসলিম ১১৫৩নং)
[15] (বুখারী ৪৭৭৯, মুসলিম ১৪০০, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৮০নং)
[16] (নাসাঈ ২২২১নং)
[17] (বুখারী ১৭৯৭, মুসলিম ১১৫২নং)
[18] (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৫১৮৪নং)
[19] (বুখারী ১৮০৫, মুসলিম ১১৫১নং)
[20] (বাইহাকী শুআবুল ঈমান, ইবনে আসাকের, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৭৯৭নং)
[21] (আহমাদ, মুসনাদ ২/১৭৪, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/৫৫৪)
[22] (বুখারী ১০৮৫, মুসলিম ১১৫১নং)
[23] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ১৭পৃঃ)
[24] (ফাইযঃ ১০৭পৃঃ)
[25] (সাওমু রামাযান ৩৯পৃঃ)
[26] (ফাইযঃ ১০৮পৃঃ)
[27] (ফাইযঃ ১৪পৃঃ, সাবঊনা মাসআলাহ ফিস্-সিয়াম ৪নং)
[28] (ইতহাফ ৪৫পৃঃ)
[29] (ঐ ৪৫পৃঃ)
[30] (ঐ ৪৫পৃঃ)
[31] (সাওমু রামাযান ৪১পৃঃ)
[32] (সাওমু রামাযান ৪১পৃঃ)
[33] (ফসূলঃ ৮পৃঃ)
[34] (বাংলা মিশকাত ৪/২৬৩)
রোযা হল দুই প্রকার; ফরয (বাধ্যতামূলক) ও নফল (অতিরিক্ত)। ফরয রোযা আবার ৩ প্রকার; রমাযানের রোযা, কাফ্ফারার রোযা এবং নযর মানা রোযা।
এক্ষণে রমাযানের রোযা সংক্রান্ত বিভিন্ন মাসায়েল আলোচনা করব।
রমাযানের রোযা আল্লাহর কিতাব, তাঁর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ইজমা’ (সর্বসম্মতি) মতে চিরকালের জন্য ফরয।
কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- أَيَّاماً مَعْدُودَاتٍ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের উপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা পরহেযগার হতে পার। তা নির্ধারিত কয়েক দিন--।’’(কুরআনুল কারীম ২/১৮৩-১৮৪)
তিনি আরো বলেন,
﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾
‘‘রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে।’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
হাদীসে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘ইসলামের ভিত্তি হল ৫টি কর্ম; আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্যিকারে উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর রসূল (দূত) -এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া, নামায কায়েম করা, যাকাৎ প্রদান করা, রমাযানের রোযা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে কা’বাগৃহের হজ্জ করা।’’[1]
তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার উপর আল্লাহ কি কি রোযা ফরয করেছেন তা আমাকে বলে দিন।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘রমাযান মাসের রোযা।’’ লোকটি বলল, ‘এ ছাড়া অন্য কিছু কি আমার কর্তব্য আছে?’ তিনি বললেন, ‘‘না, তবে যদি তুমি নফল রোযা রাখ, তাহলে ভিন্ন কথা।’’[2]
আর মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, রমাযানের রোযা ফরয। তা ইসলামের অন্যতম রুকন, খুঁটি বা ভিত্তি। এ ফরয হওয়ার কথা সহজ উপায়ে সকলের জানা। সুতরাং যে কেউ তা অস্বীকার করবে সে মুরতাদ্দ্ কাফের। তাকে তওবা করার জন্য আহবান করা হবে। তাতে সে তওবা করলে এবং রোযা ফরয বলে মেনে নিলে উত্তম। নচেৎ, (সরকার) তাকে কাফের অবস্থায় হত্যা করবে।[3]
[2] (বুখারী, ১৮৯১, মুসলিম)
[3] (ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৮৩, ফুসূল ৪-৫পৃঃ)
রমাযান শব্দটি ‘রম্য’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। এর মানে হল কঠিন গরম, জ্বালিয়ে দেওয়া। চান্দ্র মাসগুলোর যখন প্রাচীন নাম বাদ দিয়ে আরবী ভাষায় নতুন নাম দেওয়া হয়, তখন রমাযান মাসটি পরে কঠিন গরমের সময়। আর তাকেই ভিত্তি করে তার ‘রামাযান’ নামকরণ করা হয়। অবশ্য রমাযান মাসের রোযা ফরয হওয়ার পর তার নাম সার্থক হয়। যেহেতু উক্ত মাসে ক্ষুৎপিপাসায় রোযাদারের পেট জ্বলে থাকে।
রমাযানের মাসের একাধিক এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যান্য মাসে নেই। যেমনঃ-
১। এই মাসের নাম কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্য কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
পক্ষান্তরে অন্য মাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
২। এই মাস আসার সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবাগণকে সুসংবাদ দিতেন।
৩। রমাযান হল বর্কতময় পবিত্র মাস। এ মাসে বর্কত অবতীর্ণ হয়।
৪। মহান আল্লাহ এই মাসের রোযা ফরয করেছেন।
৫। এই মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করা হয় এবং একটা দ্বারও বন্ধ থাকে না।
৬। এই মাসে রহমতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়।[1]
৭। এই মাসে জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করা হয় এবং একটা দ্বারও খোলা থাকে না।
উল্লেখ্য যে, বেহেশ্তের সকল দরজা খুলে দেওয়ার কারণ হল, যাতে করে আমলকারী তা শুনে আমলে আগ্রহ ও উৎসাহ পায় এবং তাতে প্রবেশ করার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। আর দোযখের সকল দরজা বন্ধ করার কারণ হল, যাতে আমলকারী এই মাসে পাপে লিপ্ত না হয় এবং তাতে প্রবেশ না করে বসে। এর অর্থ এই নয় যে, যে ব্যক্তি রমাযান মাসে মারা যাবে সে বিনা হিসাবে সোজা বেহেশ্তে যাবে।[2]
৮। উচ্ছৃঙ্খল শয়তান দলকে এই মাসে বন্দী করে রাখা হয়।[3] অর্থাৎ, তাদেরকে শিকল ও বেড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রাখা হয়। ফলে তারা রমাযানে সেই পাপাচরণ ঘটাতে সক্ষম হয় না, যতটা অন্য মাসে সক্ষম হয়। এ জন্য দেখা যায় যে, অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে শয়তানের কুমন্ত্রণা, চক্রান্ত এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ কম ঘটে থাকে। বরং শয়তান রমাযান মাসকে ভয় করে, যেমন ভয় করে আযান ও ইকামতকে এবং তার শব্দ শুনে পাদতে পাদতে পলায়ন করে।
কিন্তু আমরা এ মাসেও যে পাপাচরণ ও শয়তানী কর্মকান্ড ঘটতে দেখে থাকি তা উক্ত কথার বিরোধী নয়। কারণ, পাপ কেবল শয়তানই ঘটায় না। বরং মন্দপ্রবণ মানুষের মনও এমনিতেই পাপ করে থাকে। যে মন শয়তানের কুমন্ত্রণা সত্বর গ্রহণ করে থাকে এবং শয়তানের তাসীর কম বা বন্ধ হয়ে গেলেও সেই মন নিজেই পাপ সৃষ্টি করে। এটি হল মানুষের ‘নাফ্সে আম্মারাহ।’ যে নাফ্স বা মন শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সেই পাপাচরণ ঘটিয়ে থাকে। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।[4]
৯। রমাযান মাসে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।[5]
১০। এই মাসে দুআ কবুল হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘(রমাযান মাসের) প্রত্যেক রাতে ও দিনে প্রত্যেক মুসলিমের দুআ কবুল করা হয়।’’[6]
১১। এই মাসে রয়েছে এমন একটি রাত্রি, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এই রাতের মঙ্গল থেকে বঞ্চিত হয়, সে আসলে সকল মঙ্গল থেকে বঞ্চিত। আর একান্ত বঞ্চিত ব্যক্তি ছাড়া সে মঙ্গল থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না।[7]
১২। এই মাসের প্রত্যেক রাত্রে একজন আহবানকারী (ফিরিশ্তা) আহবান করে বলেন, ‘ওহে কল্যাণকামী! তুমি অগ্রসর হও। আর ওহে মন্দকামী! তুমি ক্ষান্ত হও।’
১৩। এই মাসের প্রত্যেক রাত্রে মহান আল্লাহ দোযখ থেকে মুসলিম মুক্ত করে থাকেন।[8]
১৪। রমাযান মাস হল সবর ও ধৈর্যের মাস। যেহেতু রোযা ছাড়া অন্য ইবাদতে সেইরূপ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় না। মুসলিম এই মাসে পূর্ণ ৩০ বা ২৯টি দিনই পানাহার, স্ত্রী-মিলন এবং অন্যান্য রোযাবিরোধী সকল কর্ম থেকে ধৈর্যের সাথে বিরত থাকে। তাই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এই মাসকে ‘ধৈর্যের মাস’ বলে অভিহিত করেছেন।[9] আর তিনি বলেছেন, ‘‘ধৈর্যের (রমাযান) মাসে রোযা আর প্রত্যেক মাসের তিনটি রোযা অন্তরের বিদ্বেষ ও খট্কা দূর করে দেয়।’’[10]
১৫। রমাযান হল কুরআনের মাস। কুরআন পঠন-পাঠন ও তেলাঅতের মাস। প্রশংসার অধিকারী বিজ্ঞানময় আল্লাহর তরফ থেকে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস। এই মাসে কুরআন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে দুনিয়ার আসমানের প্রতি অবতীর্ণ হয়, অথবা কুরআন অবতীর্ণ হতে শুরু হয় এই পবিত্র মাসে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾
‘‘রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে।’’
(কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
আর কেবল কুরআনই নয়; বরং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থসমূহও অবতীর্ণ হয়েছে এই বর্কতময় মাসেই। ‘‘ইবরাহীমের সহীফাসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে রমাযান মাসের প্রথম রাতে, তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের সপ্তম রাতে, ইঞ্জীল অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ১৪তম রাতে, যাবূর অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ১৯শের রাতে এবং কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে রমাযানের ২৫শের রাতে।’’[11]
১৬। রমাযান মাসে বিস্ময়কর বড় বড় বিজয় দানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ইসলামকে সাহায্য করেছেন, মুসলিমদেরকে মর্যাদা দিয়েছেন। এই মাসেই বদর যুদ্ধে বদর প্রান্তরে মুসলিমদের আধ্যাত্মিক শক্তিমত্তা, ঈমানী ভিত্তির সুদৃঢ়তা এবং প্রতীতির অবিচলতা প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলা এই দিনে তাঁদেরকে সাহায্য করেন এবং শত্রুর উপর বিজয়ী করেন।
অষ্টম হিজরীর রমাযান মাসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁদেরকে সাহায্য করেন। যার পর মুসলিমরা স্থিতিশীলতা পেলেন এবং ইসলাম পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করল।[12]
১৭। রমাযান মাসে কোন কোন আমলের বহুগুণ সওয়াব লাভ হয়। এ মাসে উমরাহ আদায় আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে হজ্জ করার সমান।[13]
পক্ষান্তরে এ মাসের রোযা রাখার সওয়াব প্রসঙ্গে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন,
(ক) ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান ও বিÇবাসের সাথে এবং সওয়াবের আশা রেখে রমাযানের রোযা রাখবে তারও পূর্বেকার পাপরাশি মাফ হয়ে যাবে।’’[14]
(খ) ‘‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমআহ হতে অপর জুমআহ পর্যন্ত ও এক রমাযান অপর রমাযান পর্যন্ত উভয়ের মধ্যবর্তীকালের সংঘটিত পাপরাশিকে মোচন করে দেয়; যদি কাবীরা গোনাহ থেকে দূরে থাকা হয় তবে।’’[15]
(গ) এক ব্যক্তি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে হাজির হয়ে আরজ করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার অভিমত কি? যদি আমি সাক্ষ্য দিই যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রসূল, পাঁচ-ওয়াক্ত নামায পড়ি, যাকাত আদায় করি এবং রমাযানের রোযা পালন করি, তাহলে আমি কাদের দলভুক্ত হব?’ উত্তরে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘তুমি সিদ্দীক ও শহীদগণের দলভুক্ত হবে।’’[16]
[2] (ফাসিঃ ২২পৃঃ)
[3] (বুখারী ১৮০, মুসলিম ১০৭৯নং)
[4] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ২১পৃঃ)
[5] (বুখারী ১৮৯৯, আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৮৬৮নং)
[6] (বাযযার, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৮৮নং)
[7] (সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩৩৩, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৫১৯নং)
[8] (আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩১২, ৫/৪১১, নাসাঈ, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩৩১নং)
[9] (সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮০৩নং)
[10] (বায্যার, ত্বাবারানী, মু’জাম, ইবনে হিববান, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৩৮০৪নং)
[11] (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ১৪৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৫৭৫নং)
[12] (সাওমু রামাযান ৮-১৩পৃঃ)
[13] (বুখারী ১৮৬৩, মুসলিম ১২৫৬, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, সুনান)
[14] (বুখারী ৩৮, ১৯০৮, মুসলিম ৭৬০, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
[15] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫৯, ৪০০, ৪১৪, মুসলিম ২৩৩নং)
[16] (বায্যার, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, ইবনে হিববান, সহীহ, সহীহ তারগীব, আলবানী ৯৮৯নং)
যে ব্যক্তি বিনা ওজরে রমাযানের রোযা ত্যাগ করে সে ব্যক্তির দুটি কারণ হতে পারে; হয় সে তা ফরয বলে অস্বীকার করছে এবং তাকে একটি ইবাদত বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।) আর না হয় সে আলসেমি করে তা রাখছে না।
সুতরাং যদি সে রোযা ফরয বলে অস্বীকার করে ও বলে যে, রোযা শরীয়তে ফরয নয়, তাহলে সে কাফের ও মুরতাদ্দ্; যেমন এ কথা পূর্বে বলা হয়েছে। কারণ, সে দ্বীনের সর্ববাদিসম্মত এমন একটি ব্যাপারকে অস্বীকার করে যা আম-খাস সকলের পক্ষে জানা সহজ এবং যা ইসলামের একটি রুকন।
আর তার এই মুরতাদ্দ্ হওয়ার ফলে একজন মুরতাদ্দের মাল ও পরিবারের ব্যাপারে যা বিধান আছে তা কার্যকর হবে। সরকারের কাছে সে হত্যাযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। তার গোসল-কাফন ও জানাযা হবে না এবং মুসলিমদের গোরস্থানে তাকে দাফন করাও যাবে না। অবশ্য যদি কেউ নওমুসলিম হওয়ার ফলে অথবা ইসলামী পরিবেশ ও উলামা থেকে দূরে থাকার ফলে এ ধরনের কথা বলে থাকে, তাহলে তার কথা ভিন্ন।
পক্ষান্তরে যদি কেউ আলসেমি করে রোযা না রাখে, তাহলে ভয়ানক কঠিন শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে।
আবূ উমামাহ বাহেলী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন যে, ‘‘একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম; এমন সময় (স্বপ্নে) আমার নিকট দুই ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমার উভয় বাহুর ঊর্ধ্বাংশে ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ের নিকট উপস্থিত করলেন এবং বললেন, ‘আপনি এই পাহাড়ে চড়ুন।’ আমি বললাম, ‘এ পাহাড়ে চড়তে আমি অক্ষম।’ তাঁরা বললেন, ‘আমরা আপনার জন্য চড়া সহজ করে দেব।’ সুতরাং আমি চড়ে গেলাম। অবশেষে যখন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন বেশ কিছু চিৎকার-ধ্বনি শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘এ চিৎকার-ধ্বনি কাদের?’ তাঁরা বললেন, ‘এ হল জাহান্নামবাসীদের চীৎকার-ধ্বনি।’ পুনরায় তাঁরা আমাকে নিয়ে চলতে লাগলেন। হঠাৎ দেখলাম একদল লোক তাদের পায়ের গোড়ালির উপর মোটা শিরায় (বাঁধা অবস্থায়) লটকানো আছে, তাদের কশগুলো কেটে ও ছিঁড়ে আছে এবং কশ বেয়ে রক্তও ঝরছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমি বললাম, ‘ওরা কারা?’ তাঁরা বললেন, ‘ওরা হল তারা; যারা সময় হওয়ার পূর্বে-পূর্বেই ইফতার করে নিত---।’’[1]
‘ওরা হল তারা; যারা সময় হওয়ার পূর্বে-পূর্বেই ইফতার করে নিত---।’ রোযা রাখার পরেও তাদের যদি ঐ অবস্থা হয়, তাহলে যারা পূর্ণ দিন মূলেই রোযা রাখে না, তাদের অবস্থা এবং যারা পূর্ণ মাসই রোযা রাখে না, তাদের অবস্থা যে কত করুণ, কত সঙ্গিন তা অনুমেয়!
মুস্তাফা মুহাম্মাদ আম্মারাহ তাঁর তারগীবের টীকায়[2] বলেন, ‘উক্ত হাদীসের ভাবার্থ এই যে, মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে রোযা ভঙ্গকারীদের আযাব সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করেছেন। তিনি দেখেছেন, তাদের সেই দুরবস্থা; তাদের আকার-আকৃতি ছিল বড় মর্মান্তিক ও নিকৃষ্ট। কঠিন যন্ত্রণায় তারা কুকুর ও নেকড়ের মত চিৎকার করছে। তারা সাহায্য প্রার্থনা করছে অথচ কোন সাহায্যকারী নেই। তাদের পায়ের শেষ প্রান্তে (গোড়ালির উপর মোটা শিরায়) জাহান্নামের আঁকুশি দিয়ে কসাইখানার যবাই করা ছাগলের মত তাদেরকে নিম্নমুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর তাদের কশ বেয়ে মুখভর্তি রক্ত ঝরছে! আশা করি নাফরমান বেরোযাদার মুসলিম সম্প্রদায় এই আযাবের কথা জেনে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং তাঁর সেই আযাবকে ভয় করে যথানিয়মে রোযা পালন করবে।’
ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেন, ‘মুমিনদের নিকটে এ কথা স্থির-সিদ্ধান্ত যে, যে ব্যক্তি কোন রোগ ও ওজর না থাকা সত্ত্বেও রমাযানের রোযা ত্যাগ করে, সে ব্যক্তি একজন ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী থেকেও নিকৃষ্ট। বরং মুসলিমরা তার ইসলামে সন্দেহ পোষণ করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন নাস্তিক ও নৈতিক শৈথিল্যপূর্ণ মানুষ।[3]
[2] (২/১০৯)
[3] (মাজমূ’ ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৫/২২৫, আল-কাবায়ের, যাহাবী ৪৯পৃঃ, ফিকহুস সুন্নাহ ১/৩৮৪, ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান, আব্দুল্লাহ ত্বাইয়ার ২০-২১পৃঃ, তাওজীহাতুন অফাওয়াএদ লিসসা-য়েমীনা অসসায়েমাত ৭৪পৃঃ)
রমাযান মাস প্রবেশ হওয়া প্রমাণ হবে দুয়ের মধ্যে একভাবেঃ-
১। রমাযানের চাঁদ দেখে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন,
(فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ)
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে গণনায় ৩০ পুরা করে নাও।’’[1]
তিনি আরো বলেন, ‘‘তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর। কিন্তু যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে শা’বানের গুনতি ৩০ পূর্ণ করে নাও।’’
বলা বাহুল্য, হাদীসে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে যে, রমাযানের রোযা ফরয হওয়া তথা তা শুরু করার ব্যাপারটা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। আর এর মানেই হল, চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখা নিষিদ্ধ।
সাক্ষ্য দ্বারা মাস প্রমাণঃ
মহান আল্লাহ বলেন,
(يَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الأَهِلَّةِ، قُلْ هِيَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ)
অর্থাৎ, ওরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, তা হল মানুষ ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক। (কুরআনুল কারীম ২/১৮৯)
মহান আল্লাহ চাঁদকে মানুষের জন্য সময়-নির্দেশক হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা মানুষ নিজেদের ইবাদত ও পার্থিব জীবনের সময় ও তারীখ নির্ধারণ করতে পারে। সুতরাং বান্দার প্রতি তাঁর খাস রহমত এই যে, তিনি ফরয রোযা শুরু হওয়ার বিষয়টা একটি এমন স্পষ্ট জিনিস ও প্রকট চিহ্নের উপর নির্ভরশীল করেছেন, যা সকল মানুষই জানে।
অবশ্য রোযা ওয়াজেব হওয়ার জন্য এ শর্ত নয় যে, প্রত্যেক মুসলিমকেই চাঁদ দেখতে হবে। বরং কিছু সংখ্যক লোক দেখলে, বরং - সঠিক মতে- একজন দেখলেই; যদি সে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি হয়, তাহলে তার দেখা মতে সকলের জন্য রোযা রাখা জরুরী হয়ে যাবে। অবশ্য তাদের সকলের চন্দ্রের উদয়-স্থল এক হয় তবে।[2]
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, একদা লোকেরা নতুন চাঁদ দেখতে জমায়েত হল। আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে খবর দিলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। তিনি আমার এ খবরে রোযা রাখলেন এবং লোকেদেরকে রোযা রাখতে আদেশ করলেন।[3]
২। রমাযান প্রবেশ হওয়ার কথা প্রমাণ করার দ্বিতীয় উপায় হল, (চাঁদ দেখা না গেলে) শা’বান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করে নেওয়া। (অবশ্য এর জন্য শর্ত হল শা’বান মাসের শুরুর হিসাব রাখা।) এ ব্যাপারে পূর্বে উল্লেখিত দুটি হাদীস আমাদেরকে পথনির্দেশ করে। যাতে বলা হয়েছে, ‘‘যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে শা’বানের গুনতি ৩০ পূর্ণ করে নাও।’’
জ্যোতিষ-গণনার উপর নির্ভর করা যাবে নাঃ
উপর্যুক্ত দুটি উপায় ছাড়া অন্য উপায়ে মাস প্রবেশ হওয়ার কথা প্রমাণ করা যাবে না। সুতরাং জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকা মতে রমাযান মাস ধরে নিয়ে রোযা ফরয হবে না। বলা বাহুল্য, যদি জ্যোতিষীদের হিসাব মতে আজকের রাত রমাযানের প্রথম তারীখ হয়, কিন্তু সন্ধ্যায় কেউই চাঁদ না দেখে থাকে, তাহলে রোযা রাখা যাবে না। যেহেতু শরীয়ত রোযা রাখার বিধানকে একটি বাহ্যিকভাবে উপলব্ধ জিনিসের উপর নির্ভরশীল করে দিয়েছে। আর তা হল চাঁদ দেখা।[4] তা ছাড়া পঞ্জিকার হিসাব নির্ভুল নয়। এক এলাকায় সচল হলেও অন্য এলাকায় অচল। অতএব তার উপর ভরসা করে চোখ বুজে রোযা রাখা বৈধ নয়।
পঞ্জিকার হিসাবের উপর নির্ভর করার কথা শরীয়ত ও বিবেকে স্বীকৃত নয়। কেননা, মুসলিম উম্মাহ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নবুঅত কাল থেকে নিয়ে আজও পর্যন্ত চাঁদ দেখার উপরই নির্ভর করে; হিসাবের উপর ভরসা না করে, কেবল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর অনুসরণে রোযা রেখে আসছে। যে সম্মানিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আমরা হলাম নিরক্ষর জাতি। আমরা লিখাপড়া জানি না এবং হিসাবও জানি না। মাস কখনো এই রকম হয়, কখনো এই রকম হয়। অর্থাৎ, কখনো ২৯ দিনে হয় এবং কখনো ৩০ দিনে।’’[5]
হাফেয ইবনে হাজার উক্ত হাদীসের টীকায় বলেন, এখানে ‘হিসাব’ বলতে ‘জ্যোতিষী হিসাব’কে বুঝানো হয়েছে। আর তখন এ হিসাব খুবই কম সংখ্যক লোক ছাড়া কেউই জানত না। তাই রোযা রাখা এবং অন্যান্য ব্যাপার চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছে। যাতে এ বিষয়ে লোকেরা অসুবিধা তথা জ্যেতিষী গণনার কষ্ট থেকে রেহাই পায়।
পরবর্তীকালে কিছু লোক এ হিসাব শিখলেও রোযা রাখা-না রাখার বিষয়টা এইভাবেই চলতে থাকল। বরং হাদীসের প্রকাশ্য উক্তি মূলতঃ হিসাবের উপর নির্ভর না করতেই ইঙ্গিত করে। আর এ কথা আরো স্পষ্ট করে দেয় পূর্বোক্ত হাদীস। যাতে বলা হয়েছে, ‘‘যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে শা’বানের গুনতি ৩০ পূর্ণ করে নাও।’’ এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, যদি আকাশে মেঘ থাকে, তাহলে জ্যোতিষীদেরকে জিজ্ঞাসা করে নাও।’’
এই বিধানের পশ্চাতে যুক্তি এই যে, আকাশ অপরিষ্কার থাকার সময় সংখ্যা পূরণ করে নিলে তাতে সকল আজ্ঞাপ্রাপ্ত মুসলিম সমান হয়ে যাবে এবং এর ফলে তাদের মধ্যে কোন প্রকার মতভেদ ও ঝগড়া অবশিষ্ট থাকবে না।[6]
চাঁদ দেখার জন্য দুরবীন ব্যবহারঃ
চাঁদ দেখার জন্য দূরের জিনিস কাছের করে দেখার যন্ত্র দূরবীন ব্যবহার করা দোষাবহ নয়। অবশ্য দূরবীন ব্যবহার করা বা চাঁদ দেখার জন্য তা ক্রয় করা ওয়াজেব নয়। কারণ, বাহ্যিকভাবে সুন্নাহ এ কথাই নির্দেশ করে যে, এর জন্য স্বাভাবিক দর্শনের উপর নির্ভর হবে, অস্বাভাবিক কোন দর্শনের উপর নয়। তবুও যদি কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ঐ যন্ত্রের মাধ্যমে চাঁদ দেখে থাকে, তাহলে তার ঐ দেখার উপর আমল করা যাবে। বহু পূর্ব যুগেও লোকেরা ২৯শে শা’বান বা ২৯শে রমাযান উঁচু উঁচু মিনারে চড়ে ঐ শ্রেণীর যন্ত্রের মাধ্যমে চাঁদ দেখত। যাই বা হোক, যে কোন মাধ্যম ও উপায়ে, যে কোন প্রকারে চাঁদ দেখা গেলে সেই দেখার উপর আমল করা জরুরী হবে। কেননা, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী এ ব্যাপারে সাধারণ। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর।’’[7]
উদয়স্থলের বিভিন্নতাঃ
অভিজ্ঞদের ঐক্যমতে চাঁদের উদয়স্থল ভিন্ন ভিন্ন এবং উদয়কালও অনুরূপ। আর এই ভিন্ন উদয়কালের ফলেই কোথাও চাঁদ দেখা যায়, কোথাও যায় না। সুতরাং উদয়-স্থল ভিন্ন হলে প্রত্যেক এলাকার জন্য পৃথক দর্শন জরুরী। পক্ষান্তরে উদয়স্থল বা উদয়কাল একই হলে একই এলাকাভুক্ত লোকেদের জন্য ২/১ জনের দর্শন অনুযায়ী আমল করা ওয়াজেব হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে রোযা রাখে।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
আর যাদের উদয়স্থল ওদের মত নয়, তাদের জন্য বলা যাবে না যে, ওরা চাঁদ দেখেছে; না প্রকৃতপক্ষে, আর না-ই আপাতদৃষ্টে। অথচ মহান আল্লাহ তাদের জন্য রোযা ফরয করেছেন, যারা চাঁদ দেখেছে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর।’’ এই আজ্ঞায় রোযা রাখার আদেশকে চাঁদ দেখার শর্ত-সাপেক্ষ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি এমন জায়গায় বাস করে, যে জায়গার উদয়স্থল যে চাঁদ দেখেছে তার উদয়স্থলের অনুরূপ নয়, সে ব্যক্তি (যেহেতু তার নিজের এলাকায় কেউ চাঁদ দেখেনি সেহেতু) আসলে চাঁদ দেখেনি; না প্রকৃতপক্ষে, আর না-ই আপাতদৃষ্টে।
পরন্তু মাসিক সময়কাল প্রাত্যহিক সময়কালের মতই। সুতরাং যেমন প্রত্যেক দেশ প্রাত্যহিক সেহরীর ও ইফতারের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন সময় ব্যবহার করে থাকে, ঠিক তেমনিই মাসিক রোযা শুরু ও শেষ হওয়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন হওয়া জরুরী। আর এ কথা বিদিত যে, মুসলিমদের ঐক্যমতে দৈনিক সময়ের স্বতন্ত্র প্রভাব আছে। তাই যারা প্রাচ্যে বাস করে তারা তাদের আগে সেহরী খাওয়া বন্ধ করবে; যারা প্রতীচ্যে বাস করে। অনুরূপ প্রাচ্যের লোক প্রতীচ্যের লোকদের পূর্বে ইফতার করবে।
সুতরাং যখন দৈনিক সময়ে সূর্যের উদয়াস্ত কালের ভিন্নতা মেনে নিতে বাধ্য, তখন তারই সম্পূর্ণ অনুরূপ মাসের ব্যাপারেও চন্দ্রের উদয়কালের ভিন্নতাকে মেনে নিতে আমরা বাধ্য।
আর এ কথা বলা কারো জন্য যুক্তি সঙ্গত হবে না যে, যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন,
(وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ)
‘‘আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না (রাতের) কালো অন্ধকার থেকে ফজরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে।’’(কুরআনুল কারীম ২/১৮৭)
এবং মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘রাত যখন এদিক (পূর্ব গগণ) থেকে আগত হবে, দিন যখন এদিক (পশ্চিম গগণ) থেকে বিদায় নেবে এবং সূর্য যখন অস্ত যাবে, তখন রোযাদার ইফতার করবে।’’[8]
আর এ কথা কেউ বলতে পারে না যে, উক্ত নির্দেশ সারা বিশ্বের সকল দেশের মুসলিমদের জন্য ব্যাপক।
কুরাইব বলেন, একদা উম্মুল ফায্ল বিন্তুল হারেষ আমাকে শাম দেশে মুআবিয়ার নিকট পাঠালেন। আমি শাম (সিরিয়া) পৌঁছে তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করলাম। অতঃপর আমার শামে থাকা কালেই রমাযান শুরু হল। (বৃহস্পতিবার দিবাগত) জুমআর রাত্রে চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষ দিকে মদ্বীনায় এলাম। আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) আমাকে চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘আমরা জুমআর রাত্রে দেখেছি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি নিজে দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ। আর লোকেরাও দেখে রোযা রেখেছে এবং মুআবিয়াও রোযা রেখেছেন।’ ইবনে আববাস (রাঃ) বললেন, ‘কিন্তু আমরা তো (শুক্রবার দিবাগত) শনিবার রাত্রে চাঁদ দেখেছি। অতএব আমরা ৩০ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অথবা নতুন চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখতে থাকব।’ আমি বললাম, ‘মুআবিয়ার দর্শন ও তাঁর রোযার খবর কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়?’ তিনি বললেন, ‘না। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে এ রকমই আদেশ দিয়েছেন।’[9]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) এই কথাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন যে, যে দেশের লোক চাঁদ দেখেছে তাদের এবং তাদের সামনের (পশ্চিম) দেশের লোকেদের জন্য রোযা রাখা ওয়াজেব। আর এ কথা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, যখনই কোন দেশে চাঁদ দেখা যাবে, তখনই তার পরবর্তী (পশ্চিমী) দেশে চাঁদ অবশ্য অবশ্যই দেখা যাবে। কেননা, সে দেশের সূর্য দেরীতে অস্ত যায়। এইভাবে যত দেরীতে সূর্য ডুববে, চাঁদ সূর্য থেকে তত দূর হবে এবং তত উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বাহরাইনে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে তার পশ্চাতের দেশ নজ্দ (রিয়ায), হিজায (মক্কা-মদ্বীনা), মিসর ও মরক্কোতেও রোযা ওয়াজেব হবে। পক্ষান্তরে তার পূর্ব দিকের দেশ হিন্দ্, সিন্দ্ ও মা অরাআন নাহার (ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের) লোকদের জন্য রোযা রাখা ওয়াজেব হবে না।[10]
তদনুরূপই বাংলাদেশে চাঁদ হয়েছে বলে পাকা খবর পাওয়া গেলে পশ্চিমবাংলার লোকেদের জন্য রোযা রাখা ওয়াজেব হবে; যদিও মেঘের কারণে সেখানে (পশ্চিম বাংলায়) চাঁদ না দেখা যায়।
[2] (ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান ২৮পৃঃ)
[3] (আবূ দাঊদ ২৩৪২, দারেমী, সুনান ২/৪, ইবনে হিববান, সহীহ ৮৭১নং, হাকেম, মুস্তাদ্রাক ১/৪২৩, দারাকুত্বনী, সুনান, বাইহাকী ৪/২১২, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৪/১৬)
[4] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩১৪)
[5] (বুখারীঃ ১৯১৩নং)
[6] (ফাতহুল বারী ৪/১৫১)
[7] (সুআলান ফিস্-সিয়ামঃ ৩১পৃঃ)
[8] (বুখারী ১৯৪১, মুসলিম ১১০০, ১১০১, আবূ দাঊদ ২৩৫১, ২৩৫২, তিরমিযী, দারেমী, সুনান)
[9] (মুসলিম ১০৭৮ নং)
[10] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩২১-৩২২, ইবনে উসাইমীন, ফাসিঃ মুসনিদ ১৫পৃঃ, ইবনে জিবরীন, ফাসিঃ জিরাইসী ১০পৃঃ)