بسم الله الرحمن الرحيم
সৃষ্টিজগতের প্রভু ও প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য সমস্ত প্রশংসা। তিনি আমাদেরকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তার তাওহীদ বাস্তবায়ন করার আদেশ করেছেন এবং তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদের মুখাপেক্ষী নন; বরং আমরাই তার মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾
‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা আয যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
তাওহীদ (একত্ব) এর দিকে আহবান করা এবং ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এর সাথে তার ইবাদত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলগণকে পাঠিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾
‘‘তোমার পূর্বে আমি যাকেই রসূল হিসাবে প্রেরণ করেছি, তাকে আদেশ প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত করো’’। (সূরা আল আম্বীয়া: ২৫)
وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له ولو كره المشركون، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله إلى الناس أجمعين، صلى الله عليه وعلى آله وأصحابه الذين هاجروا وجاهدوا وصبروا والذين آووا ونصروا وسلم تسليما كثيرًا إلى يوم الدين.
অতঃপর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তার কোনো শরীক নেই। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে থাকে।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রসূল। তিনি তাকে সমস্ত মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার উপর, তার পরিবারের উপর এবং তার ঐসব সাহাবীর উপর সালাত (দরুদ) ও সালাম বর্ষণ করুন, যারা তার সাথে হিজরত করেছে, জিহাদ করেছে এবং ধৈর্যধারণ করেছে। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা তার ঐসব আনসার সাথীর উপরও সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন, যারা তাকে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছে ও তাকে সাহায্য করেছে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অজস্র শান্তির ধারা বর্ষিত হোক। আমীন
অতঃপর, পরিশুদ্ধ আকীদার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা এবং তার দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কেননা এর উপরই আমলের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাদের অনুসারীগণ সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সে সঙ্গে তারা ঐসব বিষয় থেকেও সতর্ক করেছেন, যা মানুষের আকীদাকে নষ্ট করে অথবা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে।
কুরআনুল কারীমের আয়াতগুলোতে এ দিকটির প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াতে মানুষের আকীদা-বিশ্বাস সংশোধনের গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি।
মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেস-একনিষ্ঠ করার আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন তার জন্য মক্কা বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম কাবাঘরের মূর্তিগুলো ভাঙতে শুরু করলেন এবং সেটার নিশানা-চিহ্ন মুছে ফেলতে লাগলেন। সে সঙ্গে তিনি ইখলাসের সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার হুকুম করলেন। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরীক নেই।
এ উম্মতের আলেমগণ তাদের পরিশ্রমের বিরাট অংশ আকীদা সংশোধনের জন্য ব্যয় করেছেন, তারা এ উদ্দেশ্যেই জিহাদ করেছেন, উম্মতের লোকদেরকে ইহা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এর উপর অনেক বই-পুস্তক লিখেছেন। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আকীদা ও তাওহীদের কিতাবসমূহ ইসলামী পাঠাগারের বিরাট স্থান দখল করেছে। পাঠাগারের কিতাবগুলোর তালিকার সূচনাতেই রয়েছে আকীদার বইগুলোর নাম।
তাই এ বিরাট কাজে আমার সামান্য শ্রম ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করে কিতাবটি লেখার কাজে হাত দিলাম। কিতাবটি আমি পাঠকদের সামনে পেশ করছি। এতে আমি নতুন কিছু সংযোজন করিনি। নির্ভেজাল তাওহীদ ও সহীহ আকীদাকে ভালোভাবে বুঝার জন্য এ সংক্রান্ত কিছু ভুলভ্রান্তি পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। সে সঙ্গে বর্তমান সময়ের মানুষ সহীহ আকীদার ক্ষেত্রে যে ভুল-ভ্রান্তির চর্চা করছে এখানে সেদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, যাতে করে মানুষের কাছে এগুলোর হুকুম পরিষ্কার হয়ে যায় এবং যারা ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত রয়েছে, তাদের কাছে সেসব ভুল-ভ্রান্তি পরিষ্কার হয়। এতে সম্ভবত তারা সত্যের দিকে ফিরে আসবে এবং অন্যদেরকে এ দিকেই ফিরে আসার নছীহত করবে। আশা করা যায় যে, তারা সতর্ক হবে।
আমি এ কিতাবের বিষয়গুলো দীনের ইমাম ও মুসলিমদের আলেমগণের কিতাব থেকে সংগ্রহ করেছি। যেমন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তার ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম ইবনে কাছীর, শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব এবং তার ছাত্রদের মধ্য থেকে যারা তাওহীদ ও আকীদা সংশোধন-সংস্কারের দাওয়াতে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে আমি কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যা ফাতহুল মাজীদের উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছি। সুতরাং আমি দাবি করছি না যে, আমি এতে নতুন কিছু নিয়ে এসেছি। আমি কেবল কিছু জানা বিষয়কে পাঠকদের বোধশক্তির কাছাকাছি করেছি মাত্র। যখনই কোনো বিষয় বর্ণনা করেছি, তখন সুযোগ বুঝে সেগুলোকে বর্তমান সময়ের মানুষের বাস্তব অবস্থার সাথে মিলিয়ে দিয়েছি মাত্র।
এ কিতাবের মূল বিষয়গুলো সৌদি আরব থেকে প্রচারিত আল-কুরআনুল কারীম রেডিওর বিভিন্ন ইলমী মজলিসে প্রচার করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক না হলে বিষয়গুলো কিতাব আকারে প্রকাশ পেতো না। সে সঙ্গে কতিপয় দীনি ভাই আমার কাছে এগুলোকে একত্র করে সাজিয়ে-গুছিয়ে বই আকারে প্রকাশ করার প্রস্তাবও করেছেন। ইনশা-আল্লাহ এগুলো দ্বারা মানুষ দীর্ঘদিন উপকৃত হবে এবং এর কল্যাণ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে অবদানও রাখতে পারবো। বিশেষ করে যখন দীনের সঠিক দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা বিরাজ করছে, আকীদা সংশোধনের দাওয়াত না দিয়ে অনেক দাঈ যখন তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি বেশী গুরুত্ব প্রদান করছে এবং বলতে গেলে আকীদার বিষয়গুলো ছেড়েই দিয়েছে, তখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে এ বিষয়ে বই-পুস্তক লেখার গুরুত্ব আরো বেশী হয়ে দাড়িয়েছে।
বর্তমান সময়ে অনেক দাঈ লোকদেরকে বিভিন্ন সমাধিস্থল ও মাযারে শিরকে আকবার, বিদআত ও কুসংস্কারে ডুবে থাকতে দেখে এবং গোমরাহীর আহবানকারীদেরকে মূর্খ ও সাধারণ মানুষদের উপর জয়লাভ করতে দেখেও তা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ গোমরাহী ইমামগণ অজ্ঞ মানুষগুলোকে অলী-আওলীয়াদের কবর ও মাযারের দিকে টেনে নিচ্ছে। অলীদের কবরগুলোকে মানুষের জন্য উৎসবের স্থানে পরিণত করছে, তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও ধন-সম্পদ নিয়ে খেল-তামাশা করছে। এসব ভ- অন্যায়ভাবে অজ্ঞ লোকদের স্বঘোষিত নেতা হয়েছে এবং তারা আলেম ও আল্লাহর অলী হওয়ার দাবি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে।
আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে এমন অনেক দাঈ রয়েছে, যারা আকীদা সংশোধনের দিকে কোনো গুরুত্ব দেন না। তাদের কেউ কেউ বলে থাকেন, লোকদেরকে তাদের নিজ নিজ আকীদার উপর বহাল থাকতে দাও এবং তাদের কাজের প্রতিবাদ করতে যেয়ো না। লোকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করো এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করো না। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, لنجتمع على ما اتفقنا عليه وليعذر بعضنا بعضا فيما اختلفنا فيه অর্থাৎ যে বিষয়ে আমরা সকলেই একমত তার উপর ঐক্যবদ্ধ হবো এবং যাতে আমরা মতভেদ করেছি, তাতে আমরা পরস্পরকে ছাড় দিবো। তারা এ রকম অন্যান্য বাক্যও বলেছেন, যা আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের সুস্পষ্ট বিরোধী। উল্লেখ্য যে, এখানে তারা যে ঐক্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা দ্বারা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝিয়েছেন। আর যাতে উম্মত মতভেদ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন, তা দ্বারা তারা আকীদা ও তাওহীদকে বুঝিয়েছেন। তাদের কথা সম্পূর্ণ বাতিল।
আসল কথা হলো, আকীদার ক্ষেত্রে উম্মতের প্রথম যুগের আলেমগণ মোটেই মতভেদ করেননি এবং এক্ষেত্রে কোনো মতভেদ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক (কর্তৃত্বশীল ও বিদ্বান) তাদেরও। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’’। (সূরা আন নিসা: ৫৯)
আমাদের সকলের জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের দিকে ফিরে যাওয়া এবং তার বিরোধীতা বর্জন করা ব্যতীত মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তি অর্জন হওয়ার কোনো আশা নেই। বিশেষ করে আকীদার বিষয়ে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। কেননা এটিই তাদের দীনের মূল বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا﴾
‘‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জুকে মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
মদীনার ইমাম মালেক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বর্ণনা করেছেন। এটি একটি বিরাট কথা। মুসলিমদের উচিত কথাটি ভালোভাবে বুঝা এবং তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। তিনি বলেছেন,
لا يَصْلُحُ آخِرُ هذه الأمةِ إلا بما صَلَحَ به أوَّلُها
‘‘এ উম্মতের প্রথম যুগের লোকেরা যার মাধ্যমে সংশোধিত হয়েছে, তা ব্যতীত শেষ যুগের লোকদের সংশোধন হওয়া অসম্ভব।
আল্লাহ তা‘আলাই সঠিক পথের তাওফীক দাতা, তিনিই সঠিক পথের সন্ধান দাতা।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد و آله وصحبه
দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর।
ড. সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
শাইখ ড. সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ আল-কাসীম অঞ্চলের বুরায়দাহ শহরের নিকটবর্তী শামাসীয়ার অধিবাসী। তিনি ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখ মোতাবেক ১ রজব ১৩৫৪ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থাকতেই তার পিতা মারা যান। অতঃপর তিনি ইয়াতীম অবস্থায় স্বীয় পরিবারে প্রতিপালিত হন। শহরের মসজিদের ইমামের নিকট তিনি কুরআনুল কারীম, কিরা‘আতের মূলনীতি এবং লেখা শিখেন।
শামাসিয়ায় ১৩৬৯ হিজরী সালে যখন সরকারী মাদরাসা চালু করা হয়, তখন তিনি সেখানে ভর্তি হন। অতঃপর বুরায়দা শহরস্থ ফয়সালীয়া ইবতেদায়ী মাদরাসায় ১৩৭১ হিজরী সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এ সময় তাকে ইবতেদায়ী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অতঃপর বুরায়দাতে ১৩৭৩ হিজরী সালে যখন ইসলামিক ইন্সটিটিউট খোলা হয়, তখন তিনি তাতে ভর্তি হন। ১৩৭৩ হিজরী সালে তিনি এখানে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি রিয়াদ শহরস্থ কুলদীয়া শারঈয়া বা শারঈয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৩৮১ হিজরী সালে শিক্ষা সমাপনী ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী ফিকাহর উপর এম,এ পাস করেন এবং একই বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্ম জীবন:
শারঈয়া কলেজ থেকে ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি রিয়াদস্থ ইসলামিক ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অতঃপর তাকে শারঈয়া কলেজের শিক্ষক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর তাকে ইসলামী আকীদা বিভাগের উচ্চতর শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অতঃপর তাকে বিচার বিষয়ক উচ্চতর ইন্সটিটিউটে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অতঃপর তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষে তাকে পুনরায় সেখানে শিক্ষক হিসাবে ফিরে আসেন। অতঃপর তাকে ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটির সদস্য নিয়োগ করা হয়। তিনি এখানো এই পদে বহাল রয়েছেন।
তিনি আরো যেসব সরকারী দায়িত্ব পালন করেন, তার মধ্যে هيئة كبار العلماء এর সদস্য, মক্কা মুকাররামায় অবস্থিত রাবেতার পরিচালনাধীন ইসলামী ফিকাহ একাডেমীর সদস্য, ইসলামী গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটির সদস্য, হজ্জ মৌসুমে দাঈদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্য এবং রিয়াদ শহরের মালায এলাকার আমীর মুতইব ইবনে আব্দুল আযীয আল-সউদ জামে মসজিদের ইমাম, খতীব ও শিক্ষক। তিনি সৌদি আরব রেডিওতে نور على الدرب নামক প্রোগ্রামে শ্রোতাদের প্রশ্নের নিয়মিত উত্তর প্রদান করেন।
এ ছাড়াও তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, গবেষণা, অধ্যায়ন, পুস্তিকা রচনা, ফতোয়া প্রদান করাসহ বিভিন্নভাবে ইলম চর্চা অব্যাহত রখেছেন। এগুলো একত্র করে কতিপয় পুস্তকও রচনা করা হয়েছে। তিনি মাস্টার্স ও ডক্টরেক ডিগ্রী অর্জনার্থী অনেক ছাত্রের গবেষণা কর্মে তত্বাবধায়ন করেছেন।
শাইখের উস্তাদবৃন্দ:
১) মান্যবর শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে সা’দী, ২) শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায, ৩) আব্দুল্লাহ ইবনে হুমায়েদ, ৪) শাইখ মুহাম্মাদ আল-আমীন শানকিতী, ৫) শাইখ আব্দুর রায্যাক আফীফী, ৬) শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুর রাহমান আস-সুকাইতী, ৬) শাইখ সালেহ ইবনে ইবরাহীম আল-বুলাইহী, ৭) শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সুবাইল, ৮) শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে সালেহ আলখুলাইফী, ৯) শাইখ ইবরাহীম ইবনে উবাইদ আল-আব্দ আল-মুহসিন, ১০) শাইখ হামুদ ইবনে উকালা আশ শুআইবী, ১১) শাইখ সালেহ আল-ইলদী আন্ নাসের। এ ছাড়াও আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ধার্মিক শাইখের কাছ থেকে হাদীছ, তাফসীর এবং আরবী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।
শাইখের ছাত্রগণ:
১) শাইখ ড. আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ আল-সাদহান, ২) শাইখ আলী ইবনে আব্দুর রাহমান আশ শিবিল, ৩) শাইখ সাগীর ইবনে ফালেহ আলসাগীর, ৪) শাইখ ইউসুফ ইবনে সা’দ আলজারীদ, ৫) শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামাদ আল-উসাইমী, ৬) শাইখ সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামাদ আলউসাইমী, ৭) মাসজিদুল হারামের ইমাম শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে সুদাইস, ৮) মসজিদে নববীর ইমাম শাইখ আব্দুল মুহসিন আল কাসিম, ৯) শাইখ সালেহ ইবনে ইবরাহীম আলুস-শাইখ, ১০) শাইখ আয্যাম মুহাম্মাদ আল শুআইর। এ ছাড়াও তার অনেক ছাত্র রয়েছে। তারা নিয়মিত তার মজলিসে এবং নিয়মিত দারসগুলোতে অংশ গ্রহণ করতেন।
শাইখের ইলমী খেদমত:
লেখালেখির কাজে রয়েছে শাইখের অনেক খেদমত। তার মধ্য থেকে নিম্নে কতিপয় গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো।
১) التحقيقات المرضية في المباحث الفرضية এটি ইলমে ফারায়েযের উপর রচিত শাইখের একটি কিতাব। এটি ছিল মাস্টার্স পর্বে তার গবেষণার বিষয়। বইটি এক খন্ডে ছাপানো হয়েছে।
২) أحكام الأطعمة في الشريعة الإسلامية ইসলামী শরী‘আতে খাদ্যদ্রব্যের বিধিবিধান।
৩) الإرشاد إلى صحيح الاعتقاد। আমরা এর বাংলা নাম দিয়েছি সহীহ আকীদার দিশারী। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
৪) شرح العقيدة الواسطية আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম ইমাম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার আল আকীদাতুল ওয়াসেত্বীয়ার ব্যাখ্যা ‘‘শারহুল আকীদা আল ওয়াসেত্বীয়া’’ এটি। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
৫) البيان فيما أخطأ فيه بعض الكتاب এটি একটি বড় মাপের কিতাব। এতে তিনি বিভিন্ন কিতাবের ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরেছেন।
৬) مجموع محاضرات في العقيدة والدعوة আকীদা ও দাওয়া বিষয়ে শাইখের বিভিন্ন লেকচার এখানে জমা করে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
৭) الخطب المنبرية في المناسبات العصرية যুগোপযোগী অনেক বিষয়কে একত্র করে জুমু‘আর খুৎবা হিসাবে লেখা হয়েছে। এটি দু’খ-- ছাপানো হয়েছে।
৮) ইসলামের সংস্কারক ইমামগণ
৯) বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তিকা
১০) বিদআত থেকে সাবধান। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
১১) مجموع فتاوى في العقيدة والفقه ফতোয়া ও আকীদা বিষয়ক সংকলন
১২) شرح كتاب التوحيد- للإمام محمد بن عبد الوهاب এটি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহিমাহুল্লাহর লিখিত কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যা।
১৩) الملخص الفقهي ফিকাহর উপর লিখিত শাইখের এটি একটি বিশাল কিতাব।
১৪) إتحاف أهل الإيمان بدروس شهر رمضان রমাদ্বান মাসের জন্য খাস করে অনেকগুলো দারস এখানে জমা করা হয়েছে।
১৫) হজ ও উমরাহকারীর জন্য যা করণীয়
১৬) কিতাবুত তাওহীদ। এটি সৌদি আরবের স্কুলসমূহে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
১৭) কিতাবুদ দাওয়া
১৮) রমাদ্বানুল মুবারকের মজলিস
১৯) عقيدة التوحيد আকীদাতুত তাওহীদ। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
২০) كشف الشبهات এর ব্যাখ্যা।
২১) যাদুল মুসতাকনি
২২) الملخص في شرح كتاب التوحيد এটি কিতাবুত্ তাওহীদের ব্যাখ্যা।
২৩) شرح مسائل الجاهلية এটি জাহেলী যুগের অনেক শিরক, কুফর এবং কুসংস্কারের প্রতিবাদে লিখিত হয়েছে। এটি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রহিমাহুল্লাহ এর লিখিত মাসাঈলিল জাহিলিয়াহ নামক পুস্তিকার ব্যাখ্যা ‘‘শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ’’। মাকতাবাতুস সুন্নাহ কর্তৃক বাংলায় অনুবাদ হয়েছে।
২৪) حكم الاحتفال بذكرى المولد النبوي নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিবস উপলক্ষে মীলাদ উদ্যাপন করা।
২৫) الإيمان بالملائكة وأثره في حياة الأمة ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান এবং মানব জীবনে তার প্রভাব।
২৬) مجمل عقيدة السلف الصالحসালাফদের আকীদার সংক্ষিপ্ত পরিচয়
২৭) حقيقة التصوف সুফীবাদের হাকীকত।
২৮) من مشكلات الشباب যুবকদের সমস্যা
২৯) وجوب التحاكم إلى ما أنزله الله আল্লাহর বিধান দিয়ে বিচার-ফায়ছালা করা আবশ্যক
৩০) من أصول عقيدة أهل السنة والجماعة আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকীদা
৩১) دور المرأة في تربية الأسرة পরিবার পরিচালনায় নারীর ভূমিকা
৩২) معنى لا إله إلا الله লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর ব্যাখ্যা
৩৩) شرح نواقض الإسلام ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা
৩৪) التوحيد في القران কুরআনুল কারীমে তাওহীদ
৩৫) سلسلة وصايا وتوجيهات للشباب ১-৪ যুবকদের জন্য কতিপয় উপদেশ ও নির্দেশনা সিরিজ ১-৪
শাইখের প্রশংসায় বিভিন্ন আলিমের মন্তব্য:
সৌদি আরবে যে সব বিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ আলিম এখনো জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে শাইখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, শাইখ ইবনে বায রহিমাহুল্লাহকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার পরে আমরা কার কাছে দীনের বিষয়াদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো? জবাবে ইবনে বায রহিমাহুল্লাহ বললেন, আপনারা সালেহ ফাওযান জিজ্ঞসা করবেন। এমনি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালিহ আল-উছাইমীন রহিমাহুল্লাহকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, আমরা আপনার পরে কাকে জিজ্ঞাসা করবো? তিনি জবাব দিলেন যে, আপনারা সালিহ ফাওযানকে জিজ্ঞাসা করবেন। কেননা তিনি একজন ফকীহ এবং ধার্মিক। শাইখ ইবনে গুদাইয়্যান প্রায়ই বলতেন, আপনারা দীনের ব্যাপারে শাইখ সালেহ ফাওযানকে জিজ্ঞাসা করবেন। আল্লাহ যেন তার আনুগত্যের উপর তার বয়স বৃদ্ধি করেন, তার শেষ পরিণাম যেন ভালো করেন এবং যেন হকের উপর তাকে টিকিয়ে রাখেন।
আমরা শাইখের জন্য দু‘আ করি, তিনি যেন তার হায়াতে বরকত দান করেন এবং দীনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তা যেন কবুল করেন। আল্লাহুম্মা আমীন।
সঠিক ইসলামী আকীদা দিয়েই আল্লাহ তা‘আলা রসূলগণকে পাঠিয়েছেন, কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন এবং সমস্ত জিন-ইনসানের উপর এটি কবুল করে নেয়াকে আবশ্যক করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾
‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোন রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা আয যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا﴾
‘‘তোমার রব এ ফায়ছালা দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া তোমরা অন্য কারো ইবাদত করো না। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ২৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন-নাহাল: ৩৬)
সমস্ত রসূলই এ সহীহ আকীদার দাওয়াত নিয়ে এসেছেন। সমস্ত আসমানী কিতাবই এ সহীহ আকীদার বিশদ বিবরণ দেয়ার জন্য নাযিল হয়েছে এবং এটাকে ভঙ্গকারী অথবা এটাকে ত্রুটিযুক্তকারী বিষয়গুলো স্পষ্ট করার জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক মানুষকেই তা গ্রহণ করার আদেশ করা হয়েছে।
সুতরাং আকীদার বিষয়টি যেহেতু এত মর্যাদাবান ও গুরুত্বপূর্ণ, তাই সর্বপ্রথম এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া, এ নিয়ে গবেষণা করা এবং এর জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। কেননা এ পরিশুদ্ধ আকীদার উপরই মানুষের ইহ-পরকালীন সৌভাগ্য নির্ভর করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
‘‘যে ব্যক্তি ‘তাগুতকে’[1] অস্বীকার করে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে ধারণ করে নেয় সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৬)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ সঠিক আকীদা থেকে হাত গুটিয়ে নিবে, সে এ বিষয়ে নিজস্ব খেয়াল-খুশী ও বাতিল ধারণার দিকে ধাবিত হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হবে সে তার সামনে বাতিল ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পাবে না।
সূরা হাজ্জের ৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ﴾
‘‘আল্লাহই সত্য; আর তার পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা বাতিল’’।
সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত লোকের পরিণাম জাহান্নামের দিকেই হবে। তা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান।
[1]. মোটকথা তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো ইসলাম পরিশুদ্ধ হবে না। কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর মর্মার্থ এটিই। সুতরাং لاإله এই কথার মাধ্যমে প্রত্যেক ঐ তাগুতকে অস্বীকার করা হয়েছে, আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত করা হয়। আর إلا الله কালেমার এ অংশের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর একত্ব সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’ (সূরা আন নাহাল: ৩৬) ।
সুতরাং আল্লাহর ইবাদতকে একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাগুতের ইবাদতকে অন্য একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং একজন মানুষ কেবল তখনই মুসলিম বলে গণ্য হবে, যখন সে আল্লাহর ইবাদত করবে এবং একই সাথে তাগুত থেকে দূরে থাকবে।
আর طاغوت শব্দের উৎপত্তি হয়েছে الطغيان থেকে। তাগুত বলা হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে, যে অন্যায় ও বিদ্রোহে সীমা লংঘন করে। আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
﴾ اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى ﴿
‘‘এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে। কেননা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে’’। (সূরা ত্বহা: ২৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ﴾
‘‘যে সময় পানির তুফান সীমাঅতিক্রম করলো তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে আরোহন করিয়েছিলাম’’। (সূরা আল হাক্কাহ: ১১) অর্থাৎ পানি যখন অত্যন্ত বেড়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴾ فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ ﴿
‘‘তাই সামূদ জাতিকে একটি সীমাহীন বিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে’’। (সূরা আলহাক্কাহ: ৫)
অর্থাৎ বিকট ও ভয়াবহ একটি চিৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তি বা বিষয় সীমা অতিক্রম করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। শয়তানকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণে এবং সীমালংঘন করার কারণে তাগুত বলা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে মাবুদের ইবাদত করা হয়, সে মাবুদ যদি উক্ত ইবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাকে তাগুত বলা হয়। যাদুকর এবং গণক উভয়ই তাগুত। এমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেক মাবুদই তাগুত।
মানুষ যা সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে দীন হিসাবে গ্রহণ করে তাই তার আকীদা। এ আকীদাটি যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রসূলগণের দীন এবং তার নাযিলকৃত কিতাবসমূহ অনুযায়ী হয়, তাহলে তা সহীহ আকীদা হিসাবে গণ্য হয়। তার মাধ্যমে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য লাভ করা যাবে।
আর এ আকীদা যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রসূলগণের আনীত আকীদার বিরোধী হয় এবং তার নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহের পরিপন্থী হয়, তাহলে তার অনুসারীরা আযাবের সম্মুখীন হবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে হতভাগ্য হবে।
কেউ পরিশুদ্ধ আকীদা গ্রহণ করলে দুনিয়াতে তার জান-মাল নিরাপদ থাকবে এবং অন্যায়ভাবে তার উপর আক্রমণ করা নিষিদ্ধ হবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ
‘‘আমাকে মানুষের সাথে জিহাদ করার আদেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত দিবে। যখন তারা এ কাজগুলো সম্পাদন করবে তখন তারা আমার হাত থেকে নিজেদের জান ও মাল নিরাপদ করে নিবে’’।[1]
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ
‘‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য বাতিল মাবুদের ইবাদতকে অস্বীকার করবে, তার জান-মাল মুসলিমদের নিকট সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এবং তার অন্তরে লুকায়িত বিষয়ের হিসাব আল্লাহর উপরই ন্যস্ত হবে’’।[2]
এ পরিশুদ্ধ আকীদাই কিয়ামতের দিন বান্দাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাবে। মুসলিম শরীফে জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ لَقِىَ اللَّهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ شيئا دَخَلَ النَّارِ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তার সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[3]
ইমাম বুখারী ও মুসলিম সাহাবী ইতবান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ
‘‘আল্লাহ তা‘আলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে’’।[4]
পরিশুদ্ধ আকীদার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেন। ইমাম তিরমিযী আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা হাদীছে কুদছীতে বলেছেন,
يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لاَ تُشْرِكُ بِى شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً
‘‘হে বনী আদম! তুমি যদি যমীন পরিপূর্ণ গুনাহ্ নিয়ে আমার কাছে আগমন করো এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করে মিলিত হও, তাহলে যমীন পরিপূর্ণ ক্ষমাসহ আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো।[5]
হাদীছের শব্দ قرابها অর্থ হলো ملؤها অর্থাৎ যমীন ভর্তি বা তার কাছাকাছি। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা পাওয়ার শর্ত হলো শিরকমুক্ত পরিশুদ্ধ আকীদা থাকা চাই। চাই শিরকের পরিমাণ বেশী হোক বা কম হোক, ছোট শিরক হোক বা বড় শিরক হোক। যার আকীদা শিরকমুক্ত হবে সেই মুক্ত ও পরিশুদ্ধ অন্তরের মালিক বলে গণ্য হবে। এ শ্রেণীর লোকের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ﴾
‘‘সেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না; কিন্তু যে পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’’। (সূরা শুআরা: ৮৮-৮৯)
আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ ইতবান ইবনে মালেকের হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, সেসব পরিশুদ্ধ তাওহীদের অধিকারীগণ ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, যারা তাদের তাওহীদের সাথে শিরক মিশ্রিত করেনি। আর যাদের অবস্থা শিরকমুক্ত হবে না, তারা ক্ষমাপ্রাপ্তও হবে না।
সুতরাং তাওহীদপন্থী যে লোক আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করা অবস্থায় যমীন ভর্তি গুনাহ নিয়ে সাক্ষাৎ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার সাথে যমীন ভর্তি ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাৎ করবেন। যার তাওহীদ ত্রুটিযুক্ত হবে, সে এ ফযীলত অর্জন করতে পারবে না। সুতরাং যে খাঁটি তাওহীদের সাথে শিরক মিশ্রিত হয় না, তার সাথে কোনো গুনাহ অবশিষ্ট থাকে না। কেননা পরিশুদ্ধ আকীদা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা, তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, তার ভয়, একমাত্র তার নিকট আশা-ভরসা ইত্যাদিকে আবশ্যক করে। আর এটি নিঃসন্দেহে গুনাহ মোচন হওয়ার কারণ। যদিও এটা যমীন ভর্তি হোক না কেন। সুতরাং শিরকের নাপাকী আসতেই পারে। কিন্তু তাকে দূর করার খুব শক্তিশালী মাধ্যম ও উপায় রয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের কথা এখানেই শেষ।
আকীদা বিশুদ্ধ থাকলে আমল কবুল হয় এবং আমল দ্বারা বান্দা উপকৃত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘যে পুরুষ বা নারীই সৎকাজ করবে, সে যদি মুমিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবন দান করবো এবং আখিরাতে তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে’’। (সূরা আন নাহাল: ৯৭)
আর যদি আকীদা পরিশুদ্ধ না হয়, তাহলে বিপরীত হবে। কেননা বাতিল আকীদা সমস্ত আমল বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾
‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যদি আল্লাহর সাথে শরীক করো, তবে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’। (সূরা আয যুমার: ৬৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘তারা যদি শিরক করতো, তাহলে তাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যেতো’’। (সূরা আনআম: ৮৮)
শিরকপূর্ণ বাতিল আকীদার কারণে বানদার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায় ও সে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা হতে বঞ্চিত হয়। এর কারণে মানুষ আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হবে এবং চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ﴾
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শিরক করার গুনাহ মাফ করবেন না। শিরক ছাড়া অন্যান্য যেসব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দিবেন’’। (সূরা আন নিসা: ৪৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ﴾
নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। বস্ত্তত যালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। (সূরা আল মায়েদা: ৭২)
বাতিল আকীদা পোষণকারীর জান ও মালের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ﴾
‘‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ফিতনা (শিরক) অবসান না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত’’। (সুরা আল আনফাল: ৩৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوْا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾
‘‘অতঃপর মুশরিকদের হত্যা করো। যেখানেই তাদেরকে পাও, তাদেরকে বন্দী এবং অবরোধ করো। আর প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাকো। কিন্তু যদি তারা তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের রাস্তা ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। (সূরা আত তাওবা: ৫)
অপরপক্ষে মানুষের অন্তর, সামাজিক আচার-আচরণ ও জীবন-যাপনে পরিশুদ্ধ আকীদার বিরাট প্রভাব রয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় দু’দল লোক মসজিদ নির্মাণ করেছিল। একদল লোক সৎ নিয়ত ও আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সহীহ আকীদা পোষণ করে মসজিদ নির্মাণ করেছিল। অন্য একটি দল অসৎ উদ্দেশ্যে এবং বাতিল আকীদার উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে ঐ মসজিদে সালাত আদায় করার আদেশ করলেন, যা তাকওয়া এবং পরিশুদ্ধ ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর যে মসজিদ কুফুরী করার জন্য এবং অসৎ উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে, তাতে তিনি তার নবীকে সালাতের জন্য দাঁড়াতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا الْحُسْنَى وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ لَا تَقُمْ فِيهِ أَبَدًا لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيهِ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ فَمَنْ أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَى تَقْوَى مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٍ خَيْرٌ أَمْ مَنْ أَسَّسَ بُنْيَانَهُ عَلَى شَفَا جُرُفٍ هَارٍ فَانْهَارَ بِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘যারা সত্যের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যে, কুফুরী করার জন্য, মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য গোপন ঘাটি বানাবার উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে যে ইতিপূর্বে আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তারা অবশ্যই কসম খেয়ে বলবে, ভালো ছাড়া আর কোনো ইচ্ছাই আমাদের ছিল না। কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা একেবারেই মিথ্যাবাদী। তুমি কখনো সেখানে দাঁড়াবে না, তবে যে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে তাকওয়ার উপর প্রথম দিন থেকেই, সেটিই তোমার দাঁড়াবার যোগ্য স্থান। সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতা অর্জন করাকে ভালোবাসে। আর আল্লাহ পবিত্র লোকদের ভালবাসেন। তুমি কি মনে করো, যে ব্যক্তি আল্লাহ ভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপর নিজের ইমারতের ভীত্তি স্থাপন করলো সে ভাল, না যে ব্যক্তি তার ইমারতের ভিত উঠালো পতনমুখী একটি গর্তের কিনারায়, অতঃপর তা তাকে নিয়ে সোজা জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়লো? এ ধরণের যালেমদেরকে আল্লাহ কখনো সোজা পথ দেখান না’’। (সূরা আত তাওবা: ১০৭-১০৯)
[1] . বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
[2] . মুসলিম, অধ্যায়: লা-ইলাহা পাঠ না করা পর্যন্ত লোকদের সাথে জিহাদ করার আদেশ।
[3]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: যে ব্যক্তি শিরক করে মৃত্যু বরণ করল, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
[4] . বুখারী, অধ্যায়: বাড়িঘরে সালাতের স্থান নির্ধারণ করা, মুসলিম, অধ্যায়: জামা‘আতের সাথে সালাত পড়া হতে বিরত থাকার অনুমতি।
[5] . তিরমিযী, অধ্যায়: গুনাহ্ করার পর বান্দার জন্য আল্লাহর ক্ষমা। ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলায়ে সহীহা, হা/১২৭।
প্রিয় ভাইগণ! আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এবং আপনাদেরকে ইসলামের সঠিক আকীদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের তাওফীক দান করুন। কেননা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইসলামের সহীহ আকীদা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। সহীহ আকীদার অর্থ এবং তার ভিত্তি সম্পর্কে জানা আবশ্যক। সে সঙ্গে সহীহ আকীদা পরিপন্থী এবং যা এটাকে ভঙ্গ ও বাতিল করে দেয় সে সম্পর্কেও জানা আবশ্যক। বড় এবং ছোট উভয় প্রকার শিরকই সহীহ আকীদাকে ভঙ্গ কিংবা ত্রুটিপূর্ণ করে দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন,
﴿فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ﴾
‘‘তুমি জেনে নাও যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। অতঃপর তোমার গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করো’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)
ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ তার সহীহ গ্রন্থে তাওহীদের জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে যে অধ্যায় রচনা করেছেন, তা হলো باب العلم قبل القول والعمل অর্থাৎ কথা ও কাজের আগে জ্ঞান থাকা জরুরী। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনুল মুনীর বলেছেন, ইমাম বুখারীর উদ্দেশ্য হলো কথা ও আচরণের বিশুদ্ধতার জন্য জ্ঞান থাকা জরুরী। সুতরাং জ্ঞান ছাড়া কথা ও আচরণের কোনো মূল্য নেই। তাই তাওহীদের জ্ঞানকে কথা ও কাজের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। তাওহীদের জ্ঞানই নিয়তকে পরিশুদ্ধ করে। আর নিয়ত মানুষের আমলকে বিশুদ্ধতা দান করে।
এ কারণেই আলেমগণ আকীদার হুকুম-আহকাম শিক্ষা করা এবং এটাকে শিক্ষা দেয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তারা সকল প্রকার ইলম অর্জনের উপর সহীহ আকীদার ইলম অর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে তারা নির্দিষ্টভাবে অনেক কিতাব রচনা করেছেন। এতে তারা বিস্তারিতভাবে আকীদার মাসায়েল এবং তা গ্রহণ করার আবশ্যকতা বর্ণনা করেছেন। সে সঙ্গে তারা সহীহ আকীদা ভঙ্গকারী বা এটাকে ত্রুটিযুক্তকারী শিরক, বিদআত এবং কুসংস্কারগুলোও বর্ণনা করেছেন। এটিই হচ্ছে لاإله إلا الله -এর ব্যাখ্যা। এটি শুধু মুখের উচ্চারণের নাম নয়। বরং এর অর্থ, মর্মার্থ, তাৎপর্য ও দাবি রয়েছে। এগুলো জানা এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সে অনুপাতে আমল করা আবশ্যক। এ আকীদাকে ভঙ্গকারী এবং ত্রুটিযুক্তকারী অনেক বিষয় রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ব্যতীত কারো কাছে এটা পরিষ্কার হয় না।
এ জন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরের পাঠ্যসূচীতে আকীদার বিষয়কে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা আবশ্যক এবং প্রত্যেক দিনের ক্লাশরুটিনে আকীদার ক্লাশের সংখ্যা যথেষ্ট থাকা চাই। যোগ্য শিক্ষকগণ এটা পাঠ দান করবে। আকীদার বিষয়ে কাউকে পাশ বা ফেল করানোর সময় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ পাঠ্যসূচী ও শিক্ষাক্রম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠ্যসূচী তৈরী করার সময় আকীদার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হয় না। এতে মুসলিমদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আকীদা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তারা শিরক, বিদআত এবং কুসংস্কারকে বৈধ মনে করে এটাকেই আকীদা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। কেননা তারা লোকদেরকে এর উপর দেখতে পাবে। এগুলো যে ভুল ও বাতিল, তারা তা বুঝতে পারবে না।
এ জন্যই আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
يوشك أن تنقض عرى الإسلام عروة عروة إذا نشأ في الإسلام من لا يعرف الجاهلية
‘‘অচিরেই ইসলামের বন্ধন (হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান) একটি একটি করে খুলে ফেলা হবে। বিশেষ করে যখন ইসলামের মধ্যে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা কুফর ও শিরক সম্পর্কে অজ্ঞ হবে।
এ জন্যই মুসলিম ছাত্রদের জন্য পাঠ্যসূচী হিসাবে এমন সহীহ-শুদ্ধ কিতাব নির্বাচন করা আবশ্যক, যা সালাফে সালেহীন ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মানহাজের উপর লিখিত হয়েছে এবং আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো মুসলিম ছাত্রদের পাঠ্যসূচী হিসাবে নির্ধারণ করা হবে। সে সঙ্গে সালাফে সালেহীনদের মানহাজের পরিপন্থী কিতাবগুলো পাঠ্যসূচী থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া উচিত। যেমন আশায়েরা, মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং সালাফদের মানহাজ থেকে বিচ্যুত অন্যান্য গোমরাহ ফির্কার কিতাবগুলো যেন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত না করা হয়।
মুসলিম সমাজের সরকারী-বেসরকারী নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহীহ আকীদার পাঠদানের সাথে সাথে মসজিদগুলোতেও ইলমী দারসের (বিদ্যা পাঠদান) ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এসব দারসে সালাফী আকীদার পাঠদান করাকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা চাই। এখানে মূল কিতাব এবং এটার ব্যাখ্যা পড়ানো হবে। যাতে করে ছাত্র এবং উপস্থিত সাধারণ লোকেরা উপকৃত হতে পারে। সে সঙ্গে আকীদা সম্পর্কিত বড় বড় কিতাবগুলো সংক্ষিপ্ত করে লিখে সাধারণ লোকদের সামনে এটার ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ করাও জরুরী। এর মাধ্যমে সহীহ ইসলামী আকীদার প্রচার ও প্রসার ঘটবে। ইনশা-আল্লাহ। এর পাশাপাশি রেডিও এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে যেসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, তার প্রতিও গুরুত্বারোপ করা জরুরী। প্রচার মাধ্যমগুলোতে এমন কিছু নিয়মিত প্রোগ্রামসূচী থাকা চাই, যাতে ইসলামী আকীদার মাস‘আলাগুলো প্রচার করা হবে।
শাসক ও নের্তৃবৃন্দের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক ব্যক্তিরই আকীদার উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা আবশ্যক। তাদের উচিত আকীদার কিতাবগুলো অধ্যয়ন করা। সালাফদের মানহাজের উপর যেসব কিতাব লেখা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা রাখা আবশ্যক। একই সঙ্গে সালাফদের মানহাজের পরিপন্থী যেসব কিতাব লেখা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও সচেতন থাকা জরুরী। এতে করেই জ্ঞানে পরিপক্ক একজন মুসলিম তার দীনকে ভালোভাবে জানতে পারবে এবং আহলে সুন্নাতের আকীদার মধ্যে বাতিলপন্থীরা যেসব সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চায়, তার উপযুক্ত জবাব প্রদান করতে সক্ষম হবে।
হে মুসলিম! আপনি যখন কুরআনুল করীমের মধ্যে গভীর দৃষ্টি দিবেন, তখন দেখতে পাবেন যে, কুরআনের অনেক আয়াত ও সূরা আকীদার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছে। আপনি দেখবেন মক্কী সূরাগুলোকে সঠিক আকীদা বর্ণনার জন্যই খাস করা হয়েছে এবং এর উপর যেসব সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে সেগুলোর পরিস্কার জবাব রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ সূরা ফাতিহার কথাই বলা যেতে পারে।
আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ এ মক্কী সূরাটির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বলেন, জেনে রাখা আবশ্যক যে, এ সূরাটি সুমহান উদ্দেশ্যগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে এবং পরিপূর্ণ আকারে এটাকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছে। তাতে আমাদের একমাত্র মাবুদ মহান আল্লাহর পরিচয়কে তার তিনটি নামের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলীর অর্থ বিদ্যমান এবং এর উপরই বাকিসব নাম ও গুণাবলীর ভিত্তি। এগুলো হচ্ছে الله, الرب এবং الرحمن। সূরাটির মূল বিষয় হলো আল্লাহ তা‘আলার উলুহীয়াত, রবুবীয়াত এবং তার সুবিশাল রহমত সম্পর্কে। إياك نعبد -এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার একচ্ছত্র উলুহীয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। إياك نستعين -এর মাধ্যমে তার রুবুবীয়াত সাব্যস্ত হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে সীরাতুল মুস্তাকীমের হিদায়াত চাওয়ার সম্পর্ক হচ্ছে তার রহমত ছিফাতের সাথে। কারণ তিনি তার বান্দার প্রতি দয়াশীল বলেই তাদেরকে সীরাতুল মুস্তাকীমের পথ দেখান।
আর الحمد বা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা তিনটি বিষয়কে শামিল করে। তিনি তার উলুহীয়াত, রবুবীয়াত এবং রহমত এ তিনটি কারণেই প্রশংসিত। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্বের কারণেই তার প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনা করা আবশ্যক। সূরা ফাতিহায় পুনরুত্থান এবং বান্দাদের ভালো-মন্দ আমলের বিনিময় দেয়ার বিষয়টিও সাব্যস্ত হয়েছে। সেদিন আল্লাহ তা‘আলা একাই সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে ফায়ছালা করবেন এবং তার ফায়ছালা হবে পরিপূর্ণ ইনসাফ ভিত্তিক। সূরা ফাতিহার আয়াত: ﴾ ﴿مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ উপরোক্ত সব বিষয়কে সাব্যস্ত করেছে। এ সূরাটি নবীদের নবুওয়াতকেও একাধিকভাবে সাব্যস্ত করেছে।
অতঃপর ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ নবী-রসূলদের নবুওয়াত ও রিসালাত সম্পর্কে এমন দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, যা অত্যন্ত উপকারী। সূরা ফাতিহা ও মক্কী সূরা সমূহের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে আলোচনা করার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, শুধু এ সূরাতেই নয়; বরং পুরো কুরআন নাযিল হয়েছে তাওহীদ, এটার হক ও এটা কবুলকারীদের পুরস্কারের ব্যাপারে এবং শিরক ও এটাকে প্রত্যাখ্যানকারী মুশরিকদের শাস্তির ব্যাপারে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ﴾ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿ এর মধ্যে তাওহীদ রয়েছে ﴾ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ﴿ এর মধ্যে তাওহীদ রয়েছে এবং ﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ﴾ -এর মধ্যেও তাওহীদ রয়েছে,اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ﴾ ﴿ এর মধ্যেও রয়েছে তাওহীদ। সে সঙ্গে তাওহীদপন্থী হওয়ার কারণে যারা আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কৃত হয়েছেন এখানে তাদের পথের হিদায়াতও চাওয়া হয়েছে।
﴿غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ﴾ এর মধ্যেও রয়েছে তাওহীদ। অর্থাৎ যারা তাওহীদকে প্রত্যাখ্যান করা এবং এটা থেকে দূরে থাকার কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে, এখানে তাদের আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের পথে পরিচালিত না করার প্রার্থনা করা হয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, কুরআনের অধিকাংশ সূরাতেই দু’প্রকার তাওহীদের বিশদ বিবরণ এসেছে। কুরআনে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তা, তার অতি সুন্দর নামাবলী ও সুমহান গুণাবলী সম্পর্কে সংবাদ। এটি হচ্ছে التوحيد العلمي الخبري (আল্লাহ তা‘আলার পরিচিত ও খবর সংক্রান্ত তাওহীদ)। আর রয়েছে তাতে তাওহীদের সাথে একমাত্র তার ইবাদতের দিকে আহবান। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও তার কোনো শরীক নেই। সেই সঙ্গে তাতে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যান্য বস্ত্তর ইবাদত প্রত্যাখ্যান করার আহবান। আর এটি হচ্ছে তাওহীদুল উলুহীয়াহ। আর এটিকে التوحيد الإرادي والطلبي (কামনা-বাসনা সংক্রান্ত তাওহীদ) বলা হয়।
অথবা কুরআনের মধ্যে রয়েছে আদেশ, নিষেধ ও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা আবশ্যক হওয়ার বিষয়াদি। আর এটি হচ্ছে তাওহীদের হক এবং এটার পরিপূরক। অথবা তাতে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাওহীদ পন্থীদেরকে সম্মানিত করা ও দুনিয়াতে তাদেরকে পুরস্কৃত করা এবং আখিরাতে তাদেরকে যা দিয়ে সম্মানিত করবেন এটার খবরাদি।
অথবা তাতে রয়েছে মুশরিক ও দুনিয়াতে তাদের উপর যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নেমেছিল এবং আখিরাতে তাদের জন্য যে বিরাট শাস্তি অপেক্ষা করছে তার বিবরণ। আর এটি হলো তাওহীদ থেকে বিচ্যুত লোকদের পুরস্কারের খবরাদি। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের বক্তব্য এখানেই শেষ।
পরিশুদ্ধ আকীদা পোষণ করার প্রতি এত গুরুত্ব দেয়ার পরও যারা কুরআন পড়ে তাদের অধিকাংশই সঠিকভাবে আকীদা বুঝে না। এর ফলে তারা হকের সাথে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটায় এবং আকীদার ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়। তারা বাপ-দাদাদেরকে যে আকীদার উপর পায়, তার অনুসরণ করার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। চিন্তা-গবেষণার সাথে কুরআন না পড়াও তাদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। মূলতঃ আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই এবং তার সাহায্য ব্যতীত সঠিক আকীদার উপর টিকে থাকারও কোনো শক্তি নেই।
আল্লাহ তা‘আলা যে মুসলিমকে সহীহ আকীদার নিয়ামত প্রদান করেন ও এটাকে আঁকড়ে ধরার তাওফীক দিয়ে সম্মানিত করেন, তার উপর আবশ্যক হয় যে, সসে শিরক ও জাহেলীয়াতের অন্ধকার থেকে বের করে আনার জন্য এবং তাওহীদ ও সহীহ আকীদার আলোর দিকে আসার জন্য মানুষকে দাওয়াত দিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
‘‘যে ব্যক্তি ‘তাগুতকে’ অস্বীকার করে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের বন্ধু। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফুরী করে তাদের বন্ধু হচ্ছে তাগুত। তারা তাদের আলো থেকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যায়। এরা আগুনের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৬-২৫৭)
সমস্ত রসূল আকীদা পরিশুদ্ধ করার দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমেই তাদের দাওয়াতের সূচনা করেছেন। এর আগে তারা অন্য কিছু দিয়ে শুরু করেননি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (আন নাহল: ৩৬)
প্রত্যেক রসূলই প্রথম যখন তার জাতির লোকদেরকে দাওয়াত দিতেন, তখন তিনি বলতেন,
﴿ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ﴾
‘‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই’’। (সূরা হুদ: ৫০)
নূহ আলাইহিস সালাম, হুদ আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহিস সালাম, শুআইব আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সমস্ত রসূল আলাইহিমুস সালামও অনুরূপ করতেন।
সুতরাং যারা এ আকীদার জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং এর উপর আমল করার তাওফীক পাবে, তারা যেন এটিকে নিজের মধ্যে সীমিত না রাখে। বরং তারা হিকমত ও উত্তম নছীহতের মাধ্যমে লোকদেরকে এ দিকে দাওয়াত দিবে। এ আকীদার দিকে দাওয়াত দেয়াকেই মূল কাজ মনে করবে এবং এখান থেকে যাত্রা শুরু করবে।
সুতরাং তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পূর্বে ফরয বা ওয়াজিব কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করা কিংবা হারাম কোনো জিনিস বর্জন করার দিকে দাওয়াত দিবে না। এতে করেই সহীহ আকীদা প্রতিষ্ঠিত হবে। কেননা আকীদা হলো ইসলামের মূল ভিত্তি এবং সমস্ত আমলকে পরিশুদ্ধকারী। আকীদা ঠিক হওয়া ব্যতীত কোনো আমলই সহীহ হয় না, কবুল হয় না এবং আমলের ছাওয়াবও দেয়া হয় না। আর এ সহজ কথাটি সকলেরই জানা আছে যে, ভিত্তি প্রস্তর ব্যতীত কোনো ঘর প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং এটা ঠিকও থাকে না।
এ জন্যই রসূলগণ সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধনের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলাম প্রচারের জন্য সাহাবীদেরকে পাঠাতেন তখন সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধন করার দাওয়াত দেয়ার আহবান জানানোর উপদেশ দিতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি বললেন,
إِنَّكَ تَأْتِى قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فليكن أول ما تدعو إليه شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وفي رواية إلى أن يوحدوا الله فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِى كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ فِى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ
‘‘তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছো যারা আহলে কিতাব। সর্বপ্রথম যে জিনিসের দিকে তুমি তাদেরকে আহবান জানাবে তা হচ্ছে, ‘‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ’’এর সাক্ষ্য দান করা’’। অন্য বর্ণনায় আছে, তুমি তাদেরকে এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানাবে। এ বিষয়ে তারা যদি তোমার আনুগত্য করে তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। এ ব্যাপারে তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয় তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা বিত্তশালীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদেরকে দেয়া হবে। তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে তাহলে তাদের উৎকৃষ্ট মালের ব্যাপারে তুমি খুব সাবধান থাকবে। আর মাযলুমের বদ দু‘আকে পরিহার করে চলবে। কেননা মাযলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তা‘আলার মাঝখানে কোনো পর্দা নেই’’।[1]
এ হাদীছ শরীফ, কুরআনুল কারীমে আলোচিত রসূলদের দাওয়াত এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী নিয়ে গবেষণা করেই কেবল আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার সঠিক মানহাজ গ্রহণ করা যায়। আর এ আকীদা পরিশুদ্ধ করার জন্যই সর্বপ্রথম মানুষকে দাওয়াত দিবে। আর এটা এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা এবং তিনি ব্যতীত অন্যের ইবাদত বর্জন করার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরীক নেই। এটিই হচ্ছে কালেমায়ে তাইয়্যেবা লা-ই লাহা ইল্লাল্লাহ-এর সঠিক অর্থ।
নবুওত পাওয়ার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাতে ১৩ বছর অবস্থান করে এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা এবং মূর্তির ইবাদত বর্জন করার মাধ্যমে মানুষের আকীদা সংশোধনের দাওয়াত দিয়েছেন। সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ ও জিহাদের আদেশ এবং সুদ, যেনা-ব্যভিচার, মদ্যপান এবং জুয়া খেলাসহ অন্যান্য হারাম কাজ বর্জনের নির্দেশ দেয়ার আগে তিনি কেবল আকীদা সংশোধনের দাওয়াত দিতেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ নীতি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সমসাময়িক ঐসব দলের দাওয়াতের মানহাজ ভ্রান্ত হওয়ার প্রমাণ করে, যারা দীনের দাওয়াত দেয়ার দাবি করে ঠিকই; কিন্তু তারা আকীদা সংশোধনের প্রতি দাওয়াত দেয়ার তেমন কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। তারা কেবল চরিত্র ও আচার-আচরণ ঠিক করাসহ অধিকতর কম গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় বিষয়ের উপর জোর দেয়। অথচ এসব জামা‘আতের লোকেরা কতিপয় ইসলামী দেশে কবরের উপর নির্মিত মাযার ও সমাধির নিকট অনেক মানুষকে বড় শির্কে লিপ্ত দেখে। কিন্তু তার কোনো প্রতিবাদ করে না এবং তা থেকে নিষেধও করে না। ভাষণ-বক্তৃতা এবং লেখালেখির মাধ্যমে খুব কম সংখ্যক লোক আকীদা সংক্রান্ত এসব ভুল-ভ্রান্তির প্রতিবাদ করে থাকে। এসব জামা‘আতের লোকদের কাতারে এমন লোক রয়েছে, যারা শিরক ও সুফীবাদের চর্চা করে। তারা অন্যদেরকে নিষেধ করে না এবং সতর্কও করে না। অথচ সুস্পষ্ট কুফুরীতে লিপ্ত কাফের ও নাস্তিকদেরকে দাওয়াত দেয়ার আগে নিজের দলের লোকদেরকে দাওয়াত দেয়া ও সংশোধন করা উত্তম। কেননা নাস্তিক ও বিধর্মীরা তো সুস্পষ্টরূপেই তাদের কুফুরীর ঘোষণা দিয়েছে এবং স্বীকার করে নিয়েছে যে, তারা রসূলদের আনীত দীনের বিরোধীতায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু কবর পূজারী ও বিভ্রান্ত উপরোক্ত সুফীরা ধারণা করে যে, তারা মুসলিম। তারা আরো ধারণা করে, তারা যার উপর রয়েছে এটাই প্রকৃত ইসলাম। সুতরাং তারা নিজেরা ধোঁকার মধ্যে রয়েছে এবং অন্যদেরকেও ধোঁকা দিচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সর্বপ্রথম নিকটবর্তী কাফেরদেরকে দাওয়াত দেয়ার আদেশ করেছেন। তিনি বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ﴾
হে ঈমানদারগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ করো। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রাখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন’’। (সূরা আত তাওবা: ১২৩)
সুতরাং মুসলিমদের কাতারকে বহিরাগত আকীদা থেকে পরিষ্কার না করা হলে দুশমনদের মোকাবেলায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
বর্ণনা করা হয় যে, জনৈক কবরপূজারী এক লোককে মূর্তিপূজা করতে দেখে প্রতিবাদ করল। মূর্তিপূজক কবর পূজারীকে বলল, তুমি এমন এক সৃষ্টির ইবাদত করছো, যা তোমার সামনে উপস্থিত নয়। আর আমি এমন এক সৃষ্টির পূজা করছি, যা আমার সামনে উপস্থিত রয়েছে এবং সে আমার দিকে ঝুকে রয়েছে। বলো তো আমাদের উভয়ের মধ্যে কার কাজটি উত্তম? এভাবেই মূর্তিপূজক কবরপূজারীকে বিতর্কে হারিয়ে দিল। যদিও তারা উভয়ই পথভ্রষ্ট মুশরিক। তারা এমন বস্ত্তর ইবাদত করে, যে কারো ক্ষতি কিংবা উপকার সাধন করার ক্ষমতা রাখে না। তবে গোমরাহীর দিক থেকে কবরপূজারী মূর্তিপূজকের চেয়ে বেশী অন্ধকারের মধ্যে ডুবে রয়েছে এবং অসম্ভব বস্ত্ত প্রার্থনায় সে তার মূর্তিপূজক সাথীর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং দাওয়াতের ক্ষেত্রে অন্যান্য জিনিসের চেয়ে আকীদা সংশোধনের দিকে বেশী জোর দেয়া আবশ্যক। প্রথমে মুসলিমগণ নিজেরা ভালোভাবে আকীদা পাঠ করবে এবং বুঝবে। অতঃপর অন্যদেরকে এটা শিক্ষা দেয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। যারা আকীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছে অথবা এটা বুঝতে ভুল করেছে, তাদেরকে সহীহ আকীদার দিকে আহবান করবে।
আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে বলেন,
﴿قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
‘‘বলো! এটিই আমার পথ। পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানেই। আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফ: ১০৮)
ইমাম ইবনে জারীর এ আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার নবী মুহাম্মাদকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! তুমি বলো, আমি যে দাওয়াত দিচ্ছি, যে পথের উপর অটল থেকে আল্লাহর তাওহীদের ঘোষণা দিচ্ছি এবং বাতিল মাবুদ ও মূর্তিপূজা বর্জন করে ইখলাসের সাথে তার ইবাদতের দিকে আহবান জানাচ্ছি, তার আনুগত্য করাকেই যথেষ্ট মনে করছি এবং তার বিরোধীতা বর্জন করছি, এটাই আমার তরীকা ও দাওয়াত। আমি আল্লাহর দিকে আহবান করছি। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই। আমি জেনে-বুঝে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেই এদিকে আহবান করছি। আমার অনুসারী সাহাবীগণও সজ্ঞানে আমাকে বিশ্বাস করে এদিকেই দাওয়াত দিচ্ছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেছেন, হে নবী! তুমি বলো, আমি আল্লাহ তা‘আলার রাজত্বে তার কোনো অংশীদার কিংবা তার সাম্রাজ্যে তিনি ব্যতীত অন্য কোনো মাবুদ থাকা হতে তার পবিত্রতা ও মহত্ত্বের ঘোষণা করছি। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শিরক করে, তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই এবং তারাও আমার দলভুক্ত নয়। ইমাম ইবনে জারীরের কথা এখানেই শেষ।
উপরোক্ত মর্যাদাবান আয়াতটি ইসলামে সহীহ আকীদা জানা এবং তার দিকে দাওয়াত প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ এ বিষয়ে তার অনুসরণ করেছেন এবং উপরোক্ত দু’টি বিশেষণেই বিশেষিত হয়েছেন। তারা সহীহ আকীদা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানী ছিলেন এবং সেদিকেই তারা দাওয়াত দিতেন।
সুতরাং যারা সহীহ আকীদা শিখবে না, এর প্রতি গুরুত্ব দিবে না এবং এদিকে দাওয়াত দিবে না, তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত অনুসারী নয়। যদিও সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে নিজেকে সম্বন্ধ করে এবং তার অনুসারী হওয়ার দাবি করে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর ব্যাখ্যায় বলেন,
﴿ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ﴾
‘‘হে নবী! হিকমত এবং উত্তম উপদেশ সহকারে তোমার রবের পথে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে’’
আল্লাহ তা‘আলা এখানে দাওয়াতের বিভিন্ন স্তর বর্ণনা করেছেন এবং মানুষের অবস্থা অনুপাতে এটাকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। কেননা মানুষ যদি হকের সন্ধানী হয় এবং হক জানার পর অন্যকে এটার দিকে আহবানকারী হবে বলে আশা করা যায়, এমন ব্যক্তিকে হিকমতের সাথে দাওয়াত দিতে হবে, তার জন্য নছীহত পেশ এবং তার সাথে বিতর্ক করার দরকার নেই। আর যদি কোনো লোক সত্যের বিরুদ্ধাচরণকারী হয় এবং তার ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, সে সত্য জানতে পারলে এটা দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং মেনে নিবে তাহলে এমন ব্যক্তিকে উৎসাহ দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে নছীহত করার প্রয়োজন রয়েছে।
আর যদি কোনো লোক অহঙ্কারী ও হকের বিরোধী হয়, তাহলে তার সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করতে হবে। সে যদি বিরোধীতা বর্জন করে এবং হকের দিকে ফিরে আসে তাহলে ভালো। অন্যথায় সম্ভব হলে তার সাথে তর্ক-বিতর্ক বাদ দিয়ে অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।[2] ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে দাওয়াতের মানহাজ সুস্পষ্ট হলো এবং এ বিষয়ে মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কেও জানা গেল। সে সঙ্গে দাওয়াতের দাবিদার কিছু দলের মানহাজ ভুল বলেও প্রমাণিত হলো। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সহীহ সুন্নাতে দাওয়াতের বিশুদ্ধ মানহাজ বর্ণনা করেছেন, তারা তার বিরোধীতা করে যাচ্ছে।
[1]. সহীহ বুখারী, হা/১৩৯৫, সহীহ মুসলিম, হা/১৯, ইবনে মাজাহ, হা/১৭৮৩, আবূ দাউদ, হা/১৫৮৪।
[2]. যেমন তার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
প্রিয় মুসলিম ভাই! আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ও আপনাকে ইসলামী আকীদা জানা, মেনে চলা এবং এটার দিকে দাওয়াত দেয়ার তাওফীক দিন। আপনি জেনে রাখুন যে, নাজাতপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট ইসলামী আকীদার মূলনীতিগুলো হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান, আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান এবং তাক্বদীরের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতি ঈমান আনয়ন করা।
আকীদার এ মূলনীতিগুলোর পক্ষে কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর আলেমগণ এগুলো আকীদা ও ঈমানের মূলনীতি হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾
‘‘তোমরা তোমাদের মুখম-ল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে প্রত্যাবর্তিত করার মধ্যে কোন ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা আল বাকারা: ১৭৭)
তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টি করেছি নির্দিষ্ট পরিমাপে’’। (সূরা কামার: ৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ﴾
‘‘রসূলের উপর তার রবের পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি তিনি ঈমান এনেছেন এবং ঈমানদারগণ। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে: আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করি না’’। (সূরা আল বাকারা: ২৮৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَن يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ, তার ফেরেশতাবর্গ, তার কিতাবসমূহ, তার রসূলগণ ও পরকালের প্রতি কুফুরী করলো সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহুদূর চলে গেলো’’। (সূরা আন নিসা: ১৩৬)
সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেছেন,
أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ
‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেশতাদের উপর (৩) তার কিতাবসমূহের উপর (৪) তার নবী-রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাক্বদীরের ভালো-মন্দের উপর’’।[1]
আকীদার এ বিরাট মূলনীতিগুলোকে ঈমানের রুকন বলেও নামকরণ করা হয়। সমস্ত নবী-রসূল এবং সমস্ত আসমানী শরী‘আত এগুলো ঈমানের রুকন ও আকীদার মূলনীতি হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। আসমানী কিতাবসমূহ এ মূলনীতিগুলোসহ নাযিল হয়েছে। ঈমানের গ-- থেকে বের হয়ে যারা কাফেরে পরিণত হয়েছে, তারা ব্যতীত অন্য কেউ এগুলোকে অথবা এগুলো থেকে কোনো কিছু অস্বীকার করতে পারে না। যেমন-
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُّهِينًا وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ أُولَٰئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا﴾
‘‘যারা আল্লাহ ও তার রসূলদের সাথে কুফুরী করে, আল্লাহ ও তার রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কারো প্রতি ঈমান আনয়ন করি ও কারো প্রতি কুফুরী করি। আর তারা কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়, তারা সবাই আসলে কট্টর কাফের। আর এহেন কাফেরদের জন্য আমি অবমাননাকর শাস্তি তৈরী করে রেখেছি। বিপরীত পক্ষে যারা আল্লাহ ও তার রসূলদেরকে মেনে নেয় এবং তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না, তাদেরকে আমি অবশ্যই পুরস্কার দান করবো। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়’’। (সূরা আন নিসা: ১৫০-১৫২)
এ হলো আকীদার বিরাট মূলনীতিগুলো এবং ঈমানের সুদৃঢ় ও মজবুত রুকনগুলোর বিশদ ব্যাখ্যা বিরণ প্রদান করা দরকার। আমরা এ কিতাবে যথাসাধ্য এ মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা করবো ইনশা-আল্লাহ।
[1]. সহীহ মুসলিম, হা/৮, সহীহ বুখারী, হা/৫০, ইবনে মাজাহ, হা/৬৩, আবূ দাউদ, হা/৪৬৯৫।
আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়ন করাই হচ্ছে আকীদার প্রধান মূলনীতি। الإيمان بالله বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হলো অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, তিনিই প্রত্যেক জিনিসের একমাত্র রব ও মালিক। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। সমগ্র সৃষ্টিজগতের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। সে সঙ্গে আরো বিশ্বাস করা যে, তিনিই একমাত্র বান্দার ইবাদতের হকদার, এতে তার কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া আর যত মাবুদ রয়েছে, তা সবই বাতিল। এগুলোর ইবাদতও বাতিল।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা লুকমানের ৩০ নং আয়াতে বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ﴾
‘‘এসব কিছু এ কারণে যে, আল্লাহই সত্য এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্যান্য যেসব জিনিসকে তারা ডাকে তা সবই মিথ্যা, আর আল্লাহই সুউচ্চ ও সুমহান’’।
আরো বিশ্বাস করা যে, তিনি সিফাতে কামালিয়া তথা উত্তম ও পূর্ণতার গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত এবং প্রত্যেক দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত।
আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান বলতে তিন প্রকার তাওহীদকেই বুঝায়। তাওহীদুর রুবুবীয়্যা, তাওহীদুল উলুহীয়া এবং তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত। এতে রয়েছে কয়েকটি অনুচ্ছেদ।
তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা একই সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা। সব কিছুর ব্যবস্থাপক, পরিচালক, জীবন দাতা, মৃত্যু দাতা। তিনিই রিযিক দানকারী এবং প্রবল শক্তিধর। এ প্রকার তাওহীদকে মেনে নেয়ার প্রবণতা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যেই স্থাপন করে দেয়া হয়েছে। মানব জাতির কেউ এ বিষয়ে তেমন কোনো মতভেদ করেনি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ﴾
‘‘তুমি যদি এদের জিজ্ঞাসা করো, কে এদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, আল্লাহ। তাহলে কোথা থেকে এরা প্রতারিত হচ্ছে? (সূরা যুখরুফ: ৮৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ﴾
‘‘তুমি যদি এসব লোকদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা এগুলো সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা যুখরুফ: ৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلْ مَن رَّبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ سَيَقُولُونَ الله﴾
‘‘তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহ’’। (সূরা মুমিনুন: ৮৬-৮৭)
এ রকম আয়াত কুরআনে অনেক রয়েছে। কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াত স্বীকার করতো। তারা বিশ্বাস করতো আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, রিযিক দাতা, জীবন দাতা এবং মৃত্যু দাতা। মানব জাতির সামান্য লোকই কেবল তাওহীদুর রুবুবীয়াত এবং প্রভুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।
কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রভু ও স্রষ্টাকে অস্বীকার করলেও গোপনে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে। অহংকার করার কারণেই কেবল তারা প্রকাশ্যে প্রভুকে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাআউন সম্পর্কে বলেন যে, সে বলেছিল,
﴿يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي ﴾
‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোনে প্রভু আছে বলে জানি না’’। (সূরা কাসাস: ৩৮)
আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালামের কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তা‘আলা মূসার উক্তি উল্লেখ করে বলেন,
﴿قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ﴾
‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০২)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
﴿وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا﴾
‘‘তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে অহংকারের সাথে নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের মনমগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে’’। (সূরা নামাল: ১৪)
তারা সত্য অস্বীকারের ক্ষেত্রে কোনো দলীল-প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। কেবল অহংকার করেই তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ﴾
‘‘এরা বলে, জীবন বলতে তো শুধু আমাদের দুনিয়ার এ জীবনই। আমাদের জীবন ও মৃত্যু এখানেই এবং কালের বিবর্তন ছাড়া আর কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে এদের কোনো জ্ঞান নেই। এরা শুধু ধারণার উপর নির্ভর করে এসব কথা বলে’’। (সূরা জাছিয়া: ২৪)
সুতরাং তাদের কাছে এমন কেনো জ্ঞান ছিল না, যা তাদেরকে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার পথ দেখিয়েছে: বরং আসমানী শরী‘আত, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং সৃষ্টিগত স্বভাব সবই স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার ও সাব্যস্ত করেছে।
এ সৃষ্টিজগত এবং তাতে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা সবই আল্লাহ তা‘আলার একত্ব এবং তার প্রভুত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ। কেননা সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা থাকা আবশ্যক। সৃষ্টিজগতে যা কিছু প্রবর্তিত হচ্ছে, তার জন্য প্রবর্তক থাকা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ﴾
‘‘তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না’’। (সূরা তুর: ৩৫-৩৬)
কবি বলেছেন, وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ... تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِد প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তার নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি একক। তারা কি কোনো কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? এ প্রশ্নটির জবাব দেয়া আবশ্যক। তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নাস্তিকরা এলোমেলো জবাব দিয়েছে। তারা কখনো বলেছে, প্রকৃতির নিয়মেই এ সৃষ্টিজগত সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তকে প্রকৃতি বলা হয়। এ বিশাল সৃষ্টিজগতের সবকিছু তাদের নিকট প্রকৃতি। এ নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে!!
তারা কখনো বলেছে, উদ্ভিদ, জীব ও জড় বস্ত্তর বিভিন্ন স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের নামই প্রকৃতি। যেমন গরম হওয়া, ঠান্ডা হওয়া, আদ্র হওয়া, শুস্ক হওয়া, মসৃণ হওয়া, মোটা হওয়া, নড়াচড়া করা, স্থির হওয়া, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া, প্রজনন, বংশ বিস্তার করা ইত্যাদি সব কিছু প্রাকৃতিক নিয়মে হয়। তাদের মতে বস্ত্তসমূহের স্বভাব এবং বিভিন্ন অবস্থায় সেটা রূপান্তরিত হওয়ার যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখে তাকেই প্রকৃতি বলা হয়। তাদের মতে এ স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যগুলোই সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছে।
উভয় দিক থেকেই তাদের কথা বাতিল। যদি বলা হয় উদ্ভিদ, জীব ও জড় পদার্থগুলোর নামই প্রকৃতি এবং প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে, তাহলে তাদের কথা অনুযায়ী প্রকৃতি একই সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়। এতে আবশ্যক হয় যে, পৃথিবী নিজেই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে, আকাশও নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে কথা একই...। এটি অসম্ভব।
এভাবে প্রকৃতির নিয়মে এক বস্ত্তর সত্তা থেকে সমজাতীয় আরেক বস্ত্তর সত্তা সৃষ্টি হওয়া যদি অসম্ভব হয়, তাহলে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সৃষ্টি হওয়া আরো বেশী কঠিন। অর্থাৎ কেননা কোনো বস্ত্ত নিজেই যদি নিজেকে সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বস্ত্তর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বস্ত্তকে সৃষ্টি করা আরো বেশী অসম্ভব। কেননা موصوف বা বিশেষিত সত্তার সাথে যুক্ত না হয়ে صفة বা স্বভাব ও বিশেষণ অস্তিত্বশীল হয় না। সুতরাং ছিফাত কিভাবে মাউসুফকে সৃষ্টি করতে পারে!! অথচ ছিফাত নিজেই মাউসুফের প্রতি মুখাপেক্ষী। সুতরাং যখন দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে মাউসুফ সৃষ্টি হয়েছে, তখন এ বিশ্বাস করা আবশ্যক যে ছিফাতও সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি কথা বুঝা দরকার যে, প্রকৃতির কোনো অনুভুতি নেই। এটি একটি যন্ত্রের মত। সুতরাং তা থেকে কিভাবে এত বিশাল বিশাল ও সুনিপুন-অভিনব কাজ-কর্ম তৈরী হতে পারে, যা সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং যা পরস্পর মিলে একটি সুশৃঙ্খল বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে।
নাস্তিকদের কেউ কেউ বলে থাকে, এ সৃষ্টিজগত আকস্মিকভাবে তৈরী হয়। অর্থাৎ আকস্মিকভাবে অনেকগুলো অণু-পরমাণু ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্ত একসাথে মিলিত হয়ে প্রাণ তৈরী হয়। এতে কোনো স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনা ও কলা-কৌশলের প্রয়োজন হয় না। এটি একটি বাতিল কথা। বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাব এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। কেননা আপনি যখন এ সুশৃঙ্খল সৃষ্টিজগতের মহাশূন্য, ভূপৃষ্ঠ এবং মহাকাশে সুক্ষ্ম, বিস্ময়কর ও সুবিন্যস্তভাবে চলাচলকারী সৃষ্টিসমূহের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবেন, তখন আপনার কাছে সুস্পষ্ট হয় যাবে যে, প্রজ্ঞাবান এক স্রষ্টা ব্যতীত এসব তৈরী হওয়া মোটেই সম্ভব নয়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, তুমি স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নাস্তিককে জিজ্ঞাসা করো, ঐ মেশিনের ব্যাপারে তোমার ধারণা কী, যা একটি নদীতে রাখা হয়েছে। তার যন্ত্রাংশগুলো মজবুত, সেগুলো মজবুতভাবে লাগানো হয়েছে এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেগুলো তৈরী করা হয়েছে। দর্শক মেশিনের ভিতরে যেমন কোনো দোষ ধরতে পারে না তেমনি তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কোনো ত্রুটি খুঁজে পায় না। আর এ মেশিনটি দিয়ে বিরাট একটি বাগানে পানি দেয়া হচ্ছে। বাগানে রয়েছে প্রত্যেক প্রকার ফলফলাদির গাছপালা। মেশিনটি বাগানের গাছপালা ও ফল-ফসলের চাহিদা মোতাবেক পানি সরবরাহ করছে। ঐদিকে বাগানকে ঠিক-ঠাক রাখার জন্য তাতে একজন পরিচর্যাকারী রয়েছে। সে ভালোভাবে বাগানের যত্ন নেয়, খোঁজ-খবর রাখে এবং বাগানের সার্বিক কাজ-কর্ম সম্পন্ন করে। বাগানের কোনো কিছুই ত্রুটিযুক্ত রাখে না। অতঃপর লোকটি বাগানের ফল-ফসল উঠিয়ে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে তাদের মধ্যে ভাগ-বন্টন করে দেয়। প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকেই প্রয়োজন মোতাবেক দান করে। সর্বদা সে এ রকমই করতে থাকে। তুমি কি মনে করো কোনো কারিগর ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই বাগান এবং তার সবকিছু আকস্মিকভাবে হয়ে গেছে?
বাগানে পানি দেয়ার মেশিনটি এমনিতেই হয়ে গেছে? বাগান ও তার ভিতরকার পরিবেশ হঠাৎ করেই তৈরী হয়েছে?
কোনো কর্তা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ছাড়াই এসব কিছু আকস্মিকভাবেই হয়ে গেছে?
তোমার যদি বিবেক-বুদ্ধি থাকে, তাহলে এসবের ব্যাপারে তোমার বিবেক কী বলে তা খেয়াল করো। তোমার বিবেক কী জবাব দেয় তা ভালোভাবে বুঝো এবং কী দিক নির্দেশনা দেয় তা অনুধাবন করো। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি এ যে, তিনি এমন কিছু অন্তর সৃষ্টি করেছেন, যা সম্পূর্ণ অন্ধ, তাতে কোনো আলো নেই। যার কারণে সে উজ্জ্বল ঝকঝকে নিদর্শনগুলো কেবল ঐসব চতুষ্পদ জন্তুর মতোই দেখতে পায় যাদের চক্ষু আছে ঠিকই; কিন্তু তাতে কোনো আলো নেই। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ।
সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাসভাবে সম্পন্ন করাকে توحيد الألوهية বলা হয়। উলুহীয়াত অর্থ ইবাদত। الإله অর্থ মাবুদ। এ জন্যই এ প্রকার তাওহীদকে توحيد العبادة বলেও নামকরণ করা হয়।
العبادة শব্দের আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, বশীভুত হওয়া, পদদলিত হওয়া ইত্যাদি। যখন কোনো রাস্তার উপর দিয়ে পদচারণ করা হয়, তখন তাকে طريق معبد বলা হয়। অর্থাৎ পদদলিত ও বশীভুত রাস্তা। আলেমগণ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বাক্য ব্যবহার করেছেন। তবে তার মূল অর্থে সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
একদল আলেমের মতে প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও বিবেক-বুদ্ধির দাবি ছাড়াই যা বাস্তবায়ন করার জন্য শরী‘আতের পক্ষ হতে আদেশ করা হয়েছে, তাই ইবাদত। আরেক দল আলেমের মতে পরিপূর্ণ বিনয় মিশ্রিত পরিপূর্ণ ভালোবাসাকে ইবাদত বলা হয়।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার যেসব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই ইবাদত।
ইবাদতের এ সংজ্ঞাটিই সর্বাধিক সূক্ষ্ম ও অধিকতর ব্যাপক। কেননা দীনের সবকিছুই ইবাদতের মধ্যে গণ্য। যারা বিনয় মিশ্রিত ভয়কে ইবাদত বলে নামকরণ করেছেন, তাদের কথা হলো পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে পরিপূর্ণ ভালোবাসা প্রিয়পাত্রের আনুগত্য করা ও তার সামনে নত হওয়ার দাবি জানায়। বান্দাকে কেবল ভালোবাসা ও বিনয়ই প্রিয়পাত্রের জন্য নত করে। সুতরাং বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসা ও তার সামনে নত হওয়া অনুপাতেই বান্দার আনুগত্য হয়ে থাকে। বান্দার তরফ থেকে তার রবের প্রতি ভালোবাসা এবং তার রবের সামনে বিনয়ী ও নত হওয়া একমাত্র তারই ইবাদতের দাবি জানায়। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই।
ইসলামী শরী‘আতে যেসব ইবাদতের আদেশ এসেছে, তাতে একই সঙ্গে বিনয়-নম্রতা ও ভালোবাসা থাকা আবশ্যক। এতে তিনটি রুকন থাকা জরুরী। ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্খা এবং ভয়-ভীতি। ইবাদতের মধ্যে এসব বিষয় একসাথে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। যে ব্যক্তির মধ্যে এগুলো থেকে শুধু একটি পাওয়া যাবে, সে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী নয়। অন্তরে শুধু ভালোবাসা নিয়ে ইবাদত করা সুফীদের তরীকা, শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ইবাদত করা মুরজিয়াদের তরীকা, আর শুধু ভয় নিয়ে ইবাদত করা খারেজীদের তরীকা।
বিনয়হীন ভালোবাসা ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো জিনিসকে ভালোবাসে ঠিকই; কিন্তু তার সামনে নত হয় না, সে তার ইবাদতকারী হিসাবে গণ্য নয়। যেমন কোনো মানুষ তার সন্তান ও বন্ধুবান্ধবকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা ইবাদত নয়। এমনি ভালোবাসাবিহীন নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। যেমন রাজা-বাদশা কিংবা যালেম ও সন্ত্রাসীর ক্ষতি থেকে বাচার জন্য মানুষ তাদের সামনে নত হয়। এ নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের ক্ষেত্রে এ দু’টি বিষয়ের একটি অন্যটি থেকে আলাদা হলে ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না। বরং বান্দার নিকট আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক প্রিয় হওয়া আবশ্যক। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সামনে বান্দা সর্বাধিক বিনয়ী হওয়া ও নতি স্বীকার করা আবশ্যক।
সুতরাং বান্দার ইবাদত আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুব প্রিয় এবং এটা তার সন্তুষ্টি পাওয়ার মাধ্যম। ইবাদতের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মাখলুক সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾
‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন.
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন নাহল: ৩৬)