بسم الله الرحمن الرحيم
ভূমিকা
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে পৃথিবীতে স্থিতি দান করেছেন। তিনি তাদেরকে অসহায় ও লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেননি (মুমিনূন ২৩/১১৫)। বরং ‘প্রথম মানুষ’ আদমকে তাঁর বংশধরগণের হেদায়াতের জন্য ‘প্রথম নবী’ হিসাবে প্রেরণ করেন (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)। এভাবে আদম (আলাইহিস সালাম) হ’তে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত ৩১৫ জন রাসূল সহ এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গম্বর প্রেরিত হন।[1] বহু নবীর নিকটে আল্লাহ পাক ‘ছহীফা’ বা পুস্তিকা প্রদান করেন এবং প্রত্যেক রাসূলকে দেন পৃথক পৃথক শরী‘আত বা জীবন বিধান। তবে চার জন শ্রেষ্ঠ রাসূলের নিকটে আল্লাহ প্রধান চারটি ‘কিতাব’ প্রদান করেন। যথাক্রমে মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর উপরে ‘তাওরাত’, দাঊদ (আঃ)-এর উপরে ‘যবূর’, ঈসা (আঃ)-এর উপরে ‘ইনজীল’ এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর উপরে ‘কুরআন’। প্রথমোক্ত তিনজন ছিলেন বনু ইস্রাঈলের নবী এবং তাদের নিকটে প্রদত্ত তিনটি কিতাব নাযিল হয়েছিল একত্রিত আকারে। কিন্তু শেষনবী প্রেরিত হয়েছিলেন ‘বিশ্বনবী’ হিসাবে বনু ইসমাঈলে এবং শেষ কিতাব ‘কুরআন’ নাযিল হয়েছিল বিশ্বমানবের জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উপরে দীর্ঘ ২৩ বছরের বিস্তৃত সময় ধরে মানুষের বাস্তব চাহিদার প্রেক্ষিতে খন্ডাকারে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর আগমন ও শেষ কিতাব ‘কুরআন’ নাযিলের পর বিগত সকল নবুঅত ও সকল কিতাবের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। এখন বিশ্বমানবতার পথপ্রদর্শক গ্রন্থ হিসাবে (বাক্বারাহ ২/২, ১৮৫) কেবলমাত্র শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আনীত সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনই বাকী রয়েছে। নিঃসন্দেহে রাসূলের ছহীহ হাদীছ সমূহ আল্লাহর অহী (নাজম ৫৩/৩-৪) এবং কুরআনের বাস্তব ব্যাখ্যা (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯) ও জীবন মুকুর বৈ কিছুই নয়। যা মুমিন জীবনের চলার পথে ধ্রুবতারার ন্যায় সর্বদা পথ প্রদর্শন করে থাকে (হাশর ৫৯/৭)।
হাদীছে বর্ণিত উপরোক্ত বিরাট সংখ্যক নবীগণের মধ্যে পবিত্র কুরআনে মাত্র ২৫ জন নবীর নাম এসেছে। তন্মধ্যে একত্রে ১৭ জন নবীর নাম এসেছে সূরা আন‘আম ৮৩ হ’তে ৮৬ আয়াতে। বাকী নাম সমূহ এসেছে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে। কেবলমাত্র ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী সূরা ইউসুফে একত্রে বর্ণিত হয়েছে। বাকী নবীগণের কাহিনী কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসেছে। যেমন মূসা ও ফেরাঊনের ঘটনা কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলিকে একত্রিত করে কাহিনীর রূপ দেওয়া রীতিমত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আল্লাহ বলেন, وَرُسُلاً قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلاً لَّمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ. ‘আমরা আপনার পূর্বে এমন বহু রাসূল পাঠিয়েছি, যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনিয়েছি এবং এমন বহু রাসূল পাঠিয়েছি, যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনাইনি...’ (নিসা ৪/১৬৪, মুমিন ৪০/৭৮)।
আমরা বর্তমান আলোচনায় কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত ঘটনা ও বক্তব্য সমূহ একত্রিত করে কাহিনীর রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে বিশ্বস্ত তাফসীর, হাদীছ ও ইতিহাস গ্রন্থ সমূহ থেকেও সামান্য কিছু উদ্ধৃত করেছি। চেষ্টা করেছি নবীদের কাহিনীর নামে প্রচলিত কেচ্ছা-কাহিনী ও ইস্রাঈলী উপকথা সমূহ হ’তে বিরত থাকতে। সীমিত পরিসর ও সীমিত সাধ্যের কারণে অনাকাংখিত ত্রুটি সমূহ থেকে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে আগত সকল নবীই মূলতঃ চারটি বংশধারা থেকে এসেছেন। আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ، ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ. ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইব্রাহীম ও আলে ইমরানকে নির্বাচিত করেছেন। যারা একে অপরের বংশধর ছিল ...’ (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪)। এখানে আলে ইবরাহীম বলতে ইসমাঈল ও ইসহাক এবং আলে ইমরান বলতে মূসা ও তাঁর বংশধরগণকে বুঝানো হয়েছে। ইবরাহীম-পুত্র ইসহাক তনয় ইয়াকূব-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ (অর্থ ‘আল্লাহর দাস’)। তাঁর পুত্র ‘লাভী’ থেকে ইমরান-পুত্র মূসা, দাঊদ ও ঈসা পর্যন্ত সবাই বনু ইস্রাঈলের নবী ছিলেন (আনকাবূত ২৯/২৭)। ইবরাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এজন্য ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা বলা হয়। উল্লেখ্য যে, বিশ্বে মাত্র দু’জন নবীর একাধিক নাম ছিল। তন্মধ্যে ইয়াকূব (আঃ)-এর অপর নাম ‘ইস্রাঈল’ এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর অপর নাম ছিল ‘আহমাদ’ (ছফ ৬১/৬) এবং আরও কয়েকটি গুণবাচক নাম। আল্লাহ সকল নবীর উপরে শান্তি বর্ষণ করুন- আমীন!!
কাহিনী বর্ণনার উদ্দেশ্য:
প্রশ্ন হ’তে পারে, পবিত্র কুরআনে বিগত নবীগণের ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি সমূহের কাহিনী বর্ণনার উদ্দেশ্য কি? এর জবাব আল্লাহ দিয়েছেন, وَكُلاًّ نَّقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنبَاء الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ وَجَاءَكَ فِيْ هَذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَّذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِيْنَ- ‘আমরা পয়গম্বরদের এসব কাহিনী আপনার কাছে বর্ণনা করি, যদ্বারা আমরা আপনার অন্তরকে সুদৃঢ় করি। আর এর মধ্যে এসেছে আপনার নিকটে সত্য, উপদেশ ও স্মরণীয় বস্ত্ত সমূহ বিশ্বাসীদের জন্য’ (হূদ ১১/১২০)। অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য হ’ল, যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নবুঅতের গুরু দায়িত্ব বহন করার জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্ত্তত হয়ে যান এবং তাঁর উম্মত এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
কুরআনে বর্ণিত ২৫ জন নবীর নাম:
আদম, নূহ, ইদরীস, হূদ, ছালেহ, ইবরাহীম, লূত্ব, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শু‘আয়েব, মূসা, হারূণ, ইউনুস, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, আল-ইয়াসা‘, যুল-কিফ্ল, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা (আঃ) ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)। (ইবনু কাছীর, তাফসীর নিসা ২৬৪) এঁদের মধ্যে ইবরাহীম-পূর্ব সকল নবী আদম ও নূহের বংশধর এবং ইবরাহীম-পরবর্তী সকল নবী ও রাসূল ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর। উল্লেখ্য যে, সূরা তওবা ৩০ আয়াতে ওযায়ের-এর নাম, এলেও তিনি নবী ছিলেন না। বরং একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি ছিলেন। কুরতুবী বলেন, অত্যাচারী খৃষ্টান রাজা বুখতানছরের ভয়ে যখন ফিলিস্তীনের ইহুদীরা সবাই তওরাত মাটিতে পুঁতে ফেলে এবং তওরাত ভুলে যায়, তখন ওযায়ের তওরাত মুখস্ত করে সবাইকে শুনান। তাতে অনেকে এটাকে অলৌকিকভাবে তাকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা আল্লাহর বেটা বলতে থাকে। ইবনু কাছীর ও সুদ্দী প্রমুখের বরাতে কাছাকাছি একইরূপ বর্ণনা করেছেন। আমরা এক্ষণে পরপর তাঁদের জীবনী ও তা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ।
হযরত হূদ (আঃ) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ‘আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ-এর পরে কওমে ‘আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। হূদ (আঃ) ছিলেন এদেরই বংশধর। ‘আদ ও ছামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্র সামের বংশধর এবং নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত।[1] ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
‘আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হ’তে শুরু করে হাযারামাউত ও ইয়ামন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল।[2] তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদের প্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্রবুদ্ধির কারণে এসব নে‘মতই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল। তারা শক্তি মদমত্ত হয়ে ‘আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে’ (ফুছসালাত/হামীম সাজদাহ ১৫) বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল। তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে নূহ (আঃ)-এর আমলে ফেলে আসা মূর্তিপূজার শিরক-এর পুনরায় প্রচলন ঘটালো। মাত্র কয়েক পুরুষ আগে ঘটে যাওয়া নূহের সর্বগ্রাসী প্লাবনের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। ফলে আল্লাহ পাক তাদের হেদায়াতের জন্য তাদেরই মধ্য হ’তে হূদ (আঃ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করলেন। উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে।
হযরত হূদ (আঃ) ও কওমে ‘আদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৭টি সূরায় ৭৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[3]
[2]. কুরতুবী, আ‘রাফ ৬৫।
[3]. যথাক্রমে: (১) আ‘রাফ ৭/৬৫-৭২, (২) তওবা ৯/৭০, (৩) হূদ ১১/৫০-৬০, ৮৯, (৪) ইবরাহীম ১৪/৯, (৫) হজ্জ ২২/৪২, (৬) ফুরক্বান ২৫/৩৮, ৩৯, (৭) শো‘আরা ২৬/১২৩-১৪০, (৮) আনকাবূত ২৯/৩৮, (৯) ছোয়াদ ৩৮/১২, (১০) গাফের/মুমিন ৪০/৩১, (১১) ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ ৪১/১৩-১৬, (১২) আহক্বাফ ৪৬/২১-২৬, (১৩) ক্বাফ ৫০/১৩, (১৪) যারিয়াত ৫১/৪১, ৪২, (১৫) ক্বামার ৫৪/১৮-২২, (১৬) হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৪-৮, (১৭) ফাজ্র ৮৯/৬-৮। সর্বমোট ৭৩।
সূরা আ‘রাফ ৬৫-৭২ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُوْداً قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ أَفَلاَ تَتَّقُوْنَ؟ قَالَ الْمَلأُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِيْ سَفَاهَةٍ وِإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ الْكَاذِبِيْنَ، قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِيْ سَفَاهَةٌ وَلَكِنِّيْ رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِيْنَ، أُبَلِّغُكُمْ رِسَالاتِ رَبِّيْ وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِيْنٌ، أَوَعَجِبْتُمْ أَنْ جَاءَكُمْ ذِكْرٌ مِّن رَّبِّكُمْ عَلَى رَجُلٍ مِّنْكُمْ لِيُنْذِرَكُمْ وَاذْكُرُوْا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِن بَعْدِ قَوْمِ نُوْحٍ وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً فَاذْكُرُوْا آلآءَ اللهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ، قَالُوْا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ، قَالَ قَدْ وَقَعَ عَلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ رِجْسٌ وَغَضَبٌ أَتُجَادِلُوْنَنِيْ فِيْ أَسْمَاءٍ سَمَّيْتُمُوْهَا أَنتُمْ وَآبَآؤكُم مَّا نَزَّلَ الله ُبِهَا مِنْ سُلْطَانٍ فَانتَظِرُوْا إِنِّيْ مَعَكُم مِّنَ الْمُنْتَظِرِيْنَ، فَأَنجَيْنَاهُ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا وَمَا كَانُوْا مُؤْمِنِيْنَ- (الأعراف ৬৫-৭২)-
অনুবাদঃ আর ‘আদ সম্প্রদায়ের নিকটে (আমরা প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই হূদকে। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। অতঃপর তোমরা কি আল্লাহভীরু হবে না? (আ‘রাফ ৭/৬৫)। ‘তার সম্প্রদায়ের কাফের নেতারা বলল, আমরা তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি’ (৬৬)। ‘হূদ বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই। বরং আমি বিশ্বপালকের প্রেরিত একজন রাসূল মাত্র’ (৬৭)। ‘আমি তোমাদের নিকটে প্রতিপালকের পয়গাম সমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের হিতাকাংখী ও বিশ্বস্ত’ (৬৮)। ‘তোমরা কি আশ্চর্য বোধ করছ যে, তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে তোমাদের থেকেই একজনের নিকটে অহী (যিকর) এসেছে, যাতে সে তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে? তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে কওমে নূহের পরে নেতৃত্বে অভিষিক্ত করলেন ও তোমাদেরকে বিশালবপু করে সৃষ্টি করলেন। অতএব তোমরা আল্লাহর নে‘মত সমূহ স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (৬৯)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে কেবল এজন্য এসেছ যে, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি, আর আমাদের বাপ-দাদারা যাদের পূজা করত, তাদেরকে পরিত্যাগ করি? তাহ’লে নিয়ে এস আমাদের কাছে (সেই আযাব), যার দুঃসংবাদ তুমি আমাদের শুনাচ্ছ, যদি তুমি সত্যবাদী হও’ (৭০)। ‘হূদ বলল, তোমাদের উপরে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে শাস্তি ও ক্রোধ অবধারিত হয়ে গেছে। তোমরা কেন আমার সাথে ঐসব নাম সম্পর্কে বিতর্ক করছ, যেগুলোর নামকরণ তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা করেছ? ঐসব উপাস্যদের সম্পর্কে আল্লাহ কোন প্রমাণ (সুলতান) নাযিল করেননি। অতএব অপেক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি’ (৭১)। ‘অনন্তর আমরা তাকে ও তার সাথীদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে রক্ষা করলাম এবং যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করেছিল, তাদের মূলোৎপাটন করে দিলাম। বস্ত্ততঃ তারা বিশ্বাসী ছিল না’ (আ‘রাফ ৭/৬৫-৭২)।
অতঃপর সূরা হূদ ৫০-৬০ আয়াতে আল্লাহ উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেন নিম্নরূপেঃ
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنْ أَنتُمْ إِلاَّ مُفْتَرُوْنَ، يَا قَوْمِ لاَ أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ أَجْرِيَ إِلاَّ عَلَى الَّذِيْ فَطَرَنِيْ أَفَلاَ تَعْقِلُوْنَ؟ وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوْبُوْا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَى قُوَّتِكُمْ وَلاَ تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِيْنَ، قَالُوْا يَا هُوْدُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَّمَا نَحْنُ بِتَارِكِيْ آلِهَتِنَا عَنْ قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِيْنَ، إِن نَّقُوْلُ إِلاَّ اعْتَرَاكَ بَعْضُ آلِهَتِنَا بِسُوْءٍ قَالَ إِنِّيْ أُشْهِدُ اللّهَ وَاشْهَدُوْا أَنِّيْ بَرِيْءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ، مِنْ دُوْنِهِ فَكِيْدُونِيْ جَمِيْعًا ثُمَّ لاَ تُنْظِرُوْنِ، إِنِّيْ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ رَبِّيْ وَرَبِّكُم مَّا مِنْ دَآبَّةٍ إِلاَّ هُوَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّيْ عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ، فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقَدْ أَبْلَغْتُكُم مَّا أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَيْكُمْ وَيَسْتَخْلِفُ رَبِّيْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلاَ تَضُرُّوْنَهُ شَيْئًا إِنَّ رَبِّيْ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيْظٌ، وَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا هُوْدًا وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَنَجَّيْنَاهُم مِّنْ عَذَابٍ غَلِيْظٍ، وَتِلْكَ عَادٌ جَحَدُوْا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَعَصَوْا رُسُلَهُ وَاتَّبَعُوْا أَمْرَ كُلِّ جَبَّارٍ عَنِيْدٍ، وَأُتْبِعُوْا فِيْ هَذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ أَلآ إِنَّ عَادًا كَفَرُوْا رَبَّهُمْ أَلآ بُعْدًا لِّعَادٍ قَوْمِ هُوْدٍ- (هود ৫০-৬০)-
অনুবাদঃ আর ‘আদ জাতির প্রতি (আমরা) তাদের ভাই হূদকে (প্রেরণ করেছিলাম)। সে তাদেরকে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন মা‘বূদ নেই। বস্ত্ততঃ তোমরা সবাই এ ব্যাপারে মিথ্যারোপ করছ’ (হূদ ১১/৫০)। ‘হে আমার জাতি! (আমার এ দাওয়াতের জন্য) আমি তোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না। আমার পারিতোষিক তাঁরই কাছে রয়েছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা কি বুঝ না’? (৫১)। ‘হে আমার কওম! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাও। তিনি আসমান থেকে তোমাদের উপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন। তোমরা অপরাধীদের ন্যায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (৫২)। ‘তারা বলল, হে হূদ! তুমি আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নিয়ে আসনি, আর আমরাও তোমার কথা মত আমাদের উপাস্যদের বর্জন করতে পারি না। বস্ত্ততঃ আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসী নই’ (৫৩)। ‘বরং আমরা তো একথাই বলতে চাই যে, আমাদের কোন উপাস্য-দেবতা (তোমার অবিশ্বাসের ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে) তোমার উপরে অশুভ আছর করেছেন। হূদ বলল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি, আর তোমরাও সাক্ষী থাক যে, তাদের থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত, যাদেরকে তোমরা শরীক করে থাক’ (৫৪) ‘তাঁকে ছাড়া। অতঃপর তোমরা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট করার প্রয়াস চালাও এবং আমাকে কোনরূপ অবকাশ দিয়ো না’ (৫৫)। ‘আমি আল্লাহর উপরে ভরসা করেছি। যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই, যা তাঁর আয়ত্তাধীন নয়। আমার পালনকর্তা সরল পথে আছেন’ (অর্থাৎ সরল পথের পথিকগণের সাথে আছেন)’ (৫৬)। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে (জেনে রেখ যে,) আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি যা নিয়ে আমি তোমাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছি। আমার প্রভু অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, তখন তোমরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা প্রতিটি বস্ত্তর হেফাযতকারী’ (৫৭)। ‘অতঃপর যখন আমাদের আদেশ (গযব) উপস্থিত হ’ল, তখন আমরা নিজ অনুগ্রহে হূদ ও তার সাথী ঈমানদারগণকে মুক্ত করি এবং তাদেরকে এক কঠিন আযাব থেকে রক্ষা করি’ (৫৮)। ‘এরা ছিল ‘আদ জাতি। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহকে (নিদর্শন সমূহকে) অস্বীকার করেছিল ও তাদের নিকটে প্রেরিত রাসূলগণের অবাধ্যতা করেছিল এবং তারা উদ্ধত ও হঠকারী ব্যক্তিদের আদেশ পালন করেছিল’ (৫৯)। ‘এ দুনিয়ায় তাদের পিছে পিছে অভিসম্পাৎ রয়েছে এবং রয়েছে ক্বিয়ামতের দিনেও। জেনে রেখ ‘আদ জাতি তাদের পালনকর্তার সাথে কুফরী করেছে। জেনে রেখ হূদের কওম ‘আদ জাতির জন্য অভিসম্পাৎ’ (হূদ ১১/৫০-৬০)।
হূদ (আঃ) তাঁর জাতিকে তাদের বিলাসোপকরণ ও অন্যায় আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং এতদসত্ত্বেও তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ সমূহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যেমন সূরা শো‘আরায় ১২৮-১৩৯ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,
أَتَبْنُوْنَ بِكُلِّ رِيْعٍ آيَةً تَعْبَثُوْنَ، وَتَتَّخِذُوْنَ مَصَانِعَ لَعَلَّكُمْ تَخْلُدُوْنَ، وَإِذَا بَطَشْتُمْ بَطَشْتُمْ جَبَّارِيْنَ، فَاتَّقُوا اللهَ وَأَطِيْعُوْنِ، وَاتَّقُوا الَّذِيْ أَمَدَّكُمْ بِمَا تَعْلَمُوْنَ، أَمَدَّكُمْ بِأَنْعَامٍ وَّبَنِيْنَ، وَجَنَّاتٍ وَّعُيُوْنٍ، إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ، قَالُوْا سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَوَعَظْتَ أَمْ لَمْ تَكُن مِّنَ الْوَاعِظِيْنَ، إِنْ هَذَا إِلاَّ خُلُقُ الْأَوَّلِيْنَ، وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِيْنَ، فَكَذَّبُوْهُ فَأَهْلَكْنَاهُمْ إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَةً وَّمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِيْنَ- (الشعراء ১২৮-১৩৯)-
অনুবাদঃ ‘তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে অযথা নিদর্শন নির্মাণ করছ (২৬/১২৮)? (যেমন সুউচ্চ টাওয়ার, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি)। ‘এবং তোমরা বড় বড় প্রাসাদ সমূহ নির্মাণ করছ, যেন তোমরা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে’ (১২৯)? (যেমন ধনী ব্যক্তিরা দেশে ও বিদেশে বিনা প্রয়োজনে বড় বড় বাড়ী করে থাকে)। ‘এছাড়া যখন তোমরা কাউকে আঘাত হানো, তখন নিষ্ঠুর-যালেমদের মত আঘাত হেনে থাক (১৩০)’ (বিভিন্ন দেশে পুলিশী নির্যাতনের বিষয়টি স্মরণযোগ্য)। ‘অতএব তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর (১৩১)’। ‘তোমরা ভয় কর সেই মহান সত্তাকে, যিনি তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন ঐসব বস্ত্ত দ্বারা যা তোমরা জানো’ (১৩২)। ‘তিনি তোমাদের সাহায্য করেছেন গবাদি পশু ও সন্তানাদি দ্বারা (১৩৩)’ ‘এবং উদ্যান ও ঝরণা সমূহ দ্বারা (১৩৪)’। (অতঃপর হূদ (আঃ) কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়ে বললেন,) ‘আমি তোমাদের জন্য মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করছি’ (১৩৫)। জবাবে কওমের নেতারা বলল, ‘তুমি উপদেশ দাও বা না দাও সবই আমাদের জন্য সমান’ (১৩৬)। ‘তোমার এসব কথাবার্তা পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-অভ্যাস বৈ কিছু নয়’ (১৩৭)। ‘আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হব না’ (১৩৮)। (আল্লাহ বলেন,) ‘অতঃপর (এভাবে) তারা তাদের নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। ফলে আমরাও তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। এর মধ্যে (শিক্ষণীয়) নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (শো‘আরা ২৬/১২৮-১৩৯)।
সূরা হা-মীম সাজদার ১৪-১৬ আয়াতে ‘আদ জাতির অলীক দাবী, অযথা দম্ভ ও তাদের উপরে আপতিত শাস্তির বর্ণনা সমূহ এসেছে এভাবে,
... قَالُوْا لَوْ شَآءَ رَبُّنَا لَأَنْزَلَ مَلآئِكَةً فَإِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُوْنَ، فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوْا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوْا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللهَ الَّذِيْ خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَكَانُوْا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُوْنَ، فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيْحًا صَرْصَرًا فِيْ أَيَّامٍ نَّحِسَاتٍ لِّنُذِيْقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَى وَهُمْ لاَ يُنْصَرُوْنَ- (حم السجدة ১৪-১৬)-
‘...তারা (‘আদ ও ছামূদের লোকেরা) বলেছিল, আমাদের প্রভু ইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা পাঠাতেন। অতএব আমরা তোমাদের আনীত বিষয় অমান্য করলাম’ (৪১/১৪)। ‘অতঃপর ‘আদ-এর লোকেরা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করল এবং বলল, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিধর কে আছে? তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্ত্ততঃ তারা আমাদের নিদর্শন সমূহ অস্বীকার করত’ (১৫)। ‘অতঃপর আমরা তাদের উপরে প্রেরণ করলাম ঝঞ্ঝাবায়ু বেশ কয়েকটি অশুভ দিনে, যাতে তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনার কিছু আযাব আস্বাদন করানো যায়। আর পরকালের আযাব তো আরও লাঞ্ছনাকর। যেদিন তারা কোনরূপ সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (ফুছসালাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৪-১৬)।
সূরা আহক্বাফ ২১-২৬ আয়াতে উক্ত আযাবের ধরন বর্ণিত হয়েছে এভাবে, যেমন আল্লাহ বলেন,
وَاذْكُرْ أَخَا عَادٍ إِذْ أَنذَرَ قَوْمَهُ بِالْأَحْقَافِ وَقَدْ خَلَتْ النُّذُرُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ أَلاَّ تَعْبُدُوْا إِلاَّ اللَّهَ إِنِّيْ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ، قَالُوْا أَجِئْتَنَا لِتَأْفِكَنَا عَنْ آلِهَتِنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ، قَالَ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِندَ اللَّهِ وَأُبَلِّغُكُم مَّا أُرْسِلْتُ بِهِ وَلَكِنِّيْ أَرَاكُمْ قَوْماً تَجْهَلُوْنَ، فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضاً مُّسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوْا هَذَا عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ رِيْحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيْمٌ، تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا فَأَصْبَحُوْا لاَ يُرَى إِلاَّ مَسَاكِنُهُمْ كَذَلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِيْنَ، وَلَقَدْ مَكَّنَّاهُمْ فِيْمَا إِن مَّكَّنَّاكُمْ فِيْهِ وَجَعَلْنَا لَهُمْ سَمْعاً وَّأَبْصَاراً وَّأَفْئِدَةً فَمَا أَغْنَى عَنْهُمْ سَمْعُهُمْ وَلاَ أَبْصَارُهُمْ وَلاَ أَفْئِدَتُهُم مِّنْ شَيْءٍ إِذْ كَانُوْا يَجْحَدُونَ بِآيَاتِ اللهِ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوْا بِهِ يَسْتَهْزِءُوْنَ- (الأحقاف ২১-২৬)-
‘আর তুমি ‘আদ-এর ভাই (হূদ)-এর কথা বর্ণনা কর, যখন সে তার কওমকে বালুকাময় উঁচু উপত্যকায় সতর্ক করে বলেছিল, অথচ তার পূর্বে ও পরে অনেক সতর্ককারী গত হয়েছিল, (এই মর্মে যে,) তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ইবাদত কর না। আমি তোমাদের জন্য এক মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করছি’ (আহক্বাফ ৪৬/২১)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্য সমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখতে আগমন করেছ? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তবে আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি?’ (২২)। হূদ বলল, এ জ্ঞান তো স্রেফ আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি যে বিষয় নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকি। কিন্তু আমি দেখছি তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়’ (২৩)। অতঃপর তারা যখন শাস্তিকে মেঘরূপে তাদের উপত্যকা সমূহের অভিমুখী দেখল, তখন বলল, এতো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। (হূদ বললেন) বরং এটা সেই বস্ত্ত, যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু, যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’ (২৪)। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবকিছুকে ধ্বংস করে দেবে। অতঃপর ভোর বেলায় তারা এমন অবস্থা প্রাপ্ত হ’ল যে, শূন্য বাস্ত্তভিটাগুলি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হ’ল না। আমরা অপরাধী সম্প্রদায়কে এমনি করেই শাস্তি দিয়ে থাকি’ (২৫)। ‘আমরা তাদেরকে এমন সব বিষয়ে ক্ষমতা দিয়েছিলাম, যেসব বিষয়ে তোমাদের ক্ষমতা দেইনি। আমরা তাদের দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়। কিন্তু সেসব কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় তাদের কোন কাজে আসল না, যখন তারা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করল এবং সেই শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করল, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত’ (আহক্বাফ ৪৬/২১-২৬)।
উক্ত বিষয়ে সূরা হা-ক্বক্বাহ ৭-৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ حُسُوْمًا فَتَرَى الْقَوْمَ فِيْهَا صَرْعَى كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ- فَهَلْ تَرَى لَهُم مِّن بَاقِيَة؟- (الحاقة ৭-৮)-
‘তাদের উপরে প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু প্রবাহিত হয়েছিল সাত রাত্রি ও আট দিবস ব্যাপী অবিরতভাবে। (হে মুহাম্মাদ!) তুমি দেখলে দেখতে পেতে যে, তারা অসার খর্জুর কান্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে রয়েছে’ (৭)। ‘তুমি (এখন) তাদের কোন অস্তিত্ব দেখতে পাও কি’? (হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৭-৮)।
সূরা ফাজ্র ৬-৮ আয়াতে ‘আদ বংশের শৌর্য-বীর্য সম্বন্ধে আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে শুনিয়ে বলেন,
اَلَمْ تَرَكَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ، اِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ، الَّتِىْ لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِى الْبِلاَدِ-
‘আপনি কি জানেন না আপনার প্রভু কিরূপ আচরণ করেছিলেন ‘আদে ইরম (প্রথম ‘আদ) গোত্রের সাথে’? (ফজর ৬) ‘যারা ছিল উঁচু স্তম্ভসমূহের মালিক (৭)। ‘এবং যাদের সমান কাউকে জনপদ সমূহে সৃষ্টি করা হয়নি’ (ফাজ্র ৮৯/৬-৮)।
কওমে নূহের প্রতি হযরত নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম এবং কওমে ‘আদ-এর প্রতি হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম প্রায় একই। হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারকথাগুলি সূরা হূদ-এর ৫০, ৫১ ও ৫২ আয়াতে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, যা এক কথায় বলা যায়- তাওহীদ, তাবলীগ ও ইস্তেগফার। প্রথমে তিনি নিজ কওমকে তাদের কল্পিত উপাস্যদের ছেড়ে একক উপাস্য আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি ইবাদতের আহবান জানান, যাকে বলা হয় ‘তাওহীদে ইবাদত’। অতঃপর তিনি জনজীবনকে শিরকের আবিলতা ও নানাবিধ কুসংস্কারের পংকিলতা হ’তে মুক্ত করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাদের নিকট আল্লাহর বিধানসমূহ পৌঁছে দিতে থাকেন। তাঁর এই দাওয়াত ও তাবলীগ ছিল নিরন্তর ও অবিরত ধারায় এবং যাবতীয় বস্ত্তগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অতঃপর তিনি জনগণকে নিজেদের কুফরী, শেরেকী ও অন্যান্য কবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে তওবা করার ও আল্লাহর নিকটে একান্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানান।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে সকল নবীই দাওয়াত দিয়েছেন। মূলতঃ উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি। মানুষ যখনই নিজেদের কল্পিত দেব-দেবী ও মূর্তি-প্রতিমাসহ বিভিন্ন উপাস্যের নিকটে মাথা নত করবে ও তাদেরকেই মুক্তির অসীলা কিংবা সরাসরি মুক্তিদাতা ভাববে, তখনই তার শ্রেষ্ঠত্ব ভূলুণ্ঠিত হবে। নিকৃষ্ট সৃষ্টি সাপ ও তুলসী গাছ পর্যন্ত তার পূজা পাবে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও তার সেবা বাদ দিয়ে সে নির্জীব মূর্তির সেবায় লিপ্ত হবে। একজন ক্ষুধার্ত ভাইকে বা একটি অসহায় প্রাণীকে খাদ্য না দিয়ে সে নিজেদের হাতে গড়া অক্ষম-অনড় মূর্তিকে দুধ-কলার নৈবেদ্য পেশ করবে ও পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করবে। এমনকি কল্পিত দেবতাকে খুশী করার জন্য সে নরবলি বা সতীদাহ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। পক্ষান্তরে যখনই একজন মানুষ সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ্কে তার সৃষ্টিকর্তা, রূযীদাতা, বিপদহন্তা, বিধানদাতা, জীবন ও মরণদাতা হিসাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, তখনই সে অন্য সকল সৃষ্টির প্রতি মিথ্যা আনুগত্য হ’তে মুক্তি পাবে। আল্লাহর গোলামীর অধীনে নিজেকে স্বাধীন ও সৃষ্টির সেরা হিসাবে ভাবতে শুরু করবে। তার সেবার জন্য সৃষ্ট জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষের সবকিছুর উপরে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সে উদ্বুদ্ধ হবে। তার জ্ঞান ও উপলব্ধি যত বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টজীবের প্রতি তার দায়িত্ববোধ তত উচ্চকিত হবে।
দ্বিতীয়তঃ বস্ত্তগত কোন স্বার্থ ছাড়াই মানুষ যখন কাউকে সৎ পথের দাওয়াত দেয়, তখন তা অন্যের মনে প্রভাব বিস্তার করে। ঐ দাওয়াত যদি তার হৃদয় উৎসারিত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত সত্যের পথের দাওয়াত হয়, তাহ’লে তা অন্যের হৃদয়ে রেখাপাত করে। সংশোধন মূলক দাওয়াত প্রথমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা অবশেষে কল্যাণময় ফলাফল নিয়ে আসে। নবীগণের দাওয়াতে স্ব স্ব যুগের ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হ’লেও দুনিয়া চিরদিন নবীগণকেই সম্মান করেছে, ঐসব দুষ্টমতি ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের নয়।
তৃতীয়তঃ মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তখন তার দুনিয়াবী জীবনে যেমন কল্যাণ প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি তার পরকালীন জীবন সুখময় হয় এবং সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। হূদ (আঃ) স্বীয় জাতিকে বিশেষভাবে বলেছিলেন, ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তাহ’লে তিনি আসমান থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন’ (হূদ ১১/৫২)। এখানে ‘শক্তি’ বলতে দৈহিক বল, জনবল ও ধনবল সবই বুঝানো হয়েছে। তওবা ও ইস্তেগফারের ফলে এসবই লাভ করা সম্ভব, এটাই অত্র আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত হূদ (আঃ) স্বীয় কওমে ‘আদকে শিরক পরিত্যাগ করে সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং যুলুম ও অত্যাচার পরিহার করে ন্যায় ও সুবিচারের পথে চলার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী শক্তির অহংকারে মদমত্ত হয়ে তারা নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলল, তোমার ঘোষিত আযাব কিংবা তোমার কোন মু‘জেযা না দেখে কেবল তোমার মুখের কথায় আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্য দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না। বরং আমরা সন্দেহ করছি যে, আমাদের দেবতাদের নিন্দাবাদ করার কারণে তাদের অভিশাপে তোমাকে ভূতে ধরেছে ও মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে তুমি উন্মাদের মত কথাবার্তা বলছ। তাদের এসব কথার উত্তরে হযরত হূদ (আঃ) পয়গম্বর সূলভ নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দেন যে, তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তবে তোমরা সাক্ষী থাক যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমাদের ঐসব অলীক উপাস্যদের আমি মানি না। তোমরা ও তোমাদের দেবতারা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা কর। তাতে আমার কিছুই হবে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তিনিই আমার পালনকর্তা। তাঁর উপরেই আমি ভরসা রাখি। যারা সরল পথে চলে, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন।
অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত জাতির বিরুদ্ধে একাকী এমন নির্ভীক ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করেনি। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাঁর একটি মু‘জেযা বিশেষ। এর দ্বারা তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, তাদের কল্পিত দেব-দেবীদের কোন ক্ষমতা নেই। অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে যে সত্য পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক দিয়েছেন, সে সত্য আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই থাক এবং হঠকারিতার উপরে যিদ করতে থাক, তাহ’লে জেনে রেখ এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে তোমাদের উপরে আল্লাহর সেই কঠিন শাস্তি নেমে আসবে, যার আবেদন তোমরা আমার নিকটে বারবার করেছ। অতএব তোমরা সাবধান হও। এখনো তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এসো।
কিন্তু হতভাগার দল হযরত হূদ (আঃ)-এর কোন কথায় কর্ণপাত করল না। তারা বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে বলে উঠলো, ‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। ফলে তাদের উপরে এলাহী গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বলেন, কওমে ‘আদ-এর অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গযব হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘ দেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, তোমরা কোনটি পসন্দ করো? লোকেরা কালো মেঘ কামনা করল। তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, هَذَا عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’। জবাবে তাদের নবী হূদ (আঃ) বললেন,
بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ رِيْحٌ فِيْهَا عَذَابٌ اَلِيْمٌ، تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِرَبِّهَا... (الأحقاف ২৪-২৫)-
‘বরং এটা সেই বস্ত্ত যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে...’।[4] ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে। সাত রাত্রি ও আট দিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘর সব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয় (ক্বামার ৫৪/২০; হাক্বক্বাহ ৬৯/৬-৮) এবং এভাবেই শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিশালবপু ‘আদ জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, এছাড়াও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী অভিসম্পাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে (হূদ ১১/৬০)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মেঘ বা ঝড় দেখতেন, তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং বলতেন হে আয়েশা! এই মেঘ ও তার মধ্যকার ঝঞ্ঝাবায়ু দিয়েই একটি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। যারা মেঘ দেখে খুশী হয়ে বলেছিল, ‘এটি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে’।[5] রাসূলের এই ভয়ের তাৎপর্য ছিল এই যে, কিছু লোকের অন্যায়ের কারণে সকলের উপর এই ব্যাপক গযব নেমে আসতে পারে। যেমন ওহোদ যুদ্ধের দিন কয়েকজনের ভুলের কারণে সকলের উপর বিপদ নেমে আসে। যেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
وَاتَّقُوْا فِتْنَةً لاَّتُصِيْبَنَّ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوْآ أَنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ- (الأنفال ২৫)-
‘আর তোমরা ঐসব ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষভাবে কেবল তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (আনফাল ৮/২৫)।
উল্লেখ্য যে, গযব নাযিলের প্রাক্কালেই আল্লাহ স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের উক্ত এলাকা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন ও তাঁরা উক্ত আযাব থেকে রক্ষা পান (হূদ ১১/৫৮)। অতঃপর তিনি মক্কায় চলে যান ও সেখানেই ওফাত পান।[6] তবে ইবনু কাছীর হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, হূদ (আঃ) ইয়ামনেই কবরস্থ হয়েছেন।[7] আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৫১৩ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘ঝঞ্ঝা-বায়ু’ অনুচ্ছেদ।
[6]. তাফসীর কুরতুবী, আ‘রাফ ৬৫।
[7]. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৬৫।
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত ছালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন ‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত ইসহাক্ব-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ(ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। যাঁর অনুসারীগণ ‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত।
বাবেল হ’তে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীন) হিজরত করেন। সেখান থেকে বিবি সারা-র বংশজাত নবীগণের মাধ্যমে আশপাশে সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করে। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাঈলের মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও তার আশপাশ এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার হয় এবং অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে। এভাবে ইবরাহীমের দুই স্ত্রীর বংশজাত নবীগণ বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা মুবারক পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর ন্যায় ছিল। যা তিনি মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে উম্মতকে খবর দেন।[1]
আল্লাহ বলেন, وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِدْرِيْسَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَّبِيًّا، وَرَفَعْنَاهُ مَكَاناً عَلِيّاً- ‘তুমি এই কিতাবে ইদরীসের কথা আলোচনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও নবী’। ‘আমরা তাকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছিলাম’ (মারিয়াম ১৯/৫৬-৫৭)।
ইদরীস (আঃ)-এর পরিচয়: তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত নবী। তাঁর নামে বহু উপকথা তাফসীরের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে। যে কারণে জনসাধারণ্যে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। হযরত ইদরীস (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর পূর্বের নবী ছিলেন, না পরের নবী ছিলেন এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ছাহাবীর মতে তিনি নূহ (আঃ)-এর পরের নবী ছিলেন।[1]
সূরা মারিয়ামে হযরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, হারূণ, মূসা, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা ইবনে মারিয়াম ও ইদরীস (আঃ)-এর আলোচনা শেষে আল্লাহ বলেন,
أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ الله ُعَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ مِن ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِن ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَن خَرُّوْا سُجَّداً وَبُكِيّاً-
‘এঁরাই হ’লেন সেই সকল নবী, যাদেরকে নবীগণের মধ্য হ’তে আল্লাহ বিশেষভাবে অনুগৃহীত করেছেন। এঁরা আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমরা নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশধর এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈল (ইয়াকূব)-এর বংশধর এবং যাদেরকে আমরা (ইসলামের) সুপথ প্রদর্শন করেছি ও (ঈমানের জন্য) মনোনীত করেছি তাদের বংশধর। তাদের কাছে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াত সমূহ পাঠ করা হ’ত, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত ও ক্রন্দন করত’ (মারিয়াম ১৯/৫৮)। অত্র আয়াতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ইদরীস (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর পরের নবী ছিলেন। তবে নূহ ও ইদরীস হযরত আদম (আঃ)-এর নিকটবর্তী নবী ছিলেন, যেমন ইবরাহীম (আঃ) হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকটবর্তী এবং ইসমাঈল, ইসহাক্ব ও ইয়াকূব হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকটবর্তী নবী ছিলেন।[2] নূহ পরবর্তী সকল মানুষ হ’লেন নূহের বংশধর।[3]
উল্লেখ্য যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, কা‘ব আল-আহবার, সুদ্দী প্রমুখের বরাতে হযরত ইদরীস (আঃ)-এর জান্নাত দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ফেরেশতার মাধ্যমে সশরীরে আসমানে উত্থান ও ৪র্থ আসমানে মালাকুল মউত কর্তৃক তাঁর জান কবয করা, অতঃপর সেখানেই অবস্থান করা ইত্যাদি বিষয়ে যেসব বর্ণনা তাফসীরের কিতাব সমূহে দেখতে পাওয়া যায়, তার সবই ভিত্তিহীন ইস্রাঈলিয়াত মাত্র।[4]
উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুরআনে হযরত ইদরীস (আঃ) সম্পর্কে সূরা মারিয়াম ৫৬, ৫৭ এবং সূরা আম্বিয়া ৮৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
কুরতুবী বলেন, ইদরীস (আঃ)-এর নাম ‘আখনূখ’ ছিল এবং তিনি হযরত নূহ (আঃ)-এর পরদাদা ছিলেন বলে বংশবিশারদগণ যে কথা বলেছেন, তা ধারণা মাত্র। এমনিভাবে অন্যান্য নবীদের যে দীর্ঘ বংশধারা সাধারণতঃ বর্ণনা করা হয়ে থাকে, সে সবের কোন সঠিক ভিত্তি নেই। এসবের প্রকৃত ইল্ম কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটে রয়েছে। ইদরীস (আঃ)-কে ৩০টি ছহীফা প্রদান করা হয়েছিল বলে হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) থেকে ইবনু হিববানে (নং ৩৬১) যে বর্ণনা এসেছে, তার সনদ যঈফ।[5]
কুরতুবী বলেন, তিনি যে নূহের পূর্বেকার নবী ছিলেন না, তার বড় প্রমাণ হ’ল এই যে, মি‘রাজে যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ১ম আসমানে আদম (আঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি রাসূলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেন, مرحبا بالابن الصالح والنبى الصالح ‘নেককার সন্তান ও নেককার নবীর জন্য সাদর সম্ভাষণ’। অতঃপর ৪র্থ আসমানে হযরত ইদরীস (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি রাসূলকে বলেন, مرحبا بالاخ الصالح والنبى الصالح ‘নেককার ভাই ও নেককার নবীর জন্য সাদর সম্ভাষণ’।[6] ক্বাযী আয়ায বলেন, যদি ইদরীস (আঃ) নূহ (আঃ)-এর পূর্বেকার নবী হ’তেন, তাহ’লে তিনি শেষনবী (ছাঃ)-কে ‘নেককার ভাই’ না বলে ‘নেককার সন্তান’ বলে সম্ভাষণ জানাতেন। যেমন আদম, নূহ ও ইবরাহীম বলেছিলেন। তিনি বলেন, নূহ ছিলেন সকল মানুষের প্রতি প্রেরিত প্রথম রাসূল। যেমন শেষনবী ছিলেন সকল মানুষের প্রতি প্রেরিত শেষ রাসূল। আর ইদরীস (আঃ) ছিলেন স্বীয় কওমের প্রতি প্রেরিত নবী। যেমন ছিলেন হূদ, ছালেহ প্রমুখ নবী’।[7] উল্লেখ্য যে, এখানে আদম, নূহ ও ইবরাহীমকে ‘পিতা’ হিসাবে খাছ করার কারণ এই যে, আদম হ’লেন মানবজাতির আদি পিতা। নূহ হ’লেন মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা এবং ইবরাহীম হ’লেন তাঁর পরবর্তী সকল নবীর পিতা ‘আবুল আম্বিয়া’।
বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইদরীস (আঃ) হ’লেন প্রথম মানব, যাঁকে মু‘জেযা হিসাবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অংকবিজ্ঞান দান করা হয়েছিল। তিনিই সর্বপ্রথম মানব, যিনি আল্লাহর ইলহাম মতে কলমের সাহায্যে লিখন পদ্ধতি ও বস্ত্র সেলাই শিল্পের সূচনা করেন। তাঁর পূর্বে মানুষ সাধারণতঃ পোশাক হিসাবে জীবজন্তুর চামড়া ব্যবহার করত। ওযন ও পরিমাপের পদ্ধতি তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন এবং লোহা দ্বারা অস্ত্র-শস্ত্র তৈরীর পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার ব্যবহার তাঁর আমল থেকেই শুরু হয়। তিনি অস্ত্র নির্মাণ করে ক্বাবীল গোত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ করেন।[8]
[1]. তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন পৃঃ ৪৫২।
[2]. কুরতুবী, মারিয়াম ৫৮-এর ব্যাখ্যা।
[3]. কুরতুবী, আ‘রাফ ৫৯-এর ব্যাখ্যা; ইবনু কাছীর, ঐ।
[4]. কুরতুবী, মারিয়াম ৫৭ আয়াতের টীকা।
[5]. কুরতুবী, মারিয়াম ৫৬ আয়াতের টীকা দ্রষ্টব্য।
[6]. কুরতুবী, সূরা আ‘রাফ ৫৯-এর ব্যাখ্যা; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৬২ ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।
[7]. কুরতুবী, সূরা আ‘রাফ ৫৯-এর ব্যাখ্যা।
[8]. কুরতুবী, মারিয়াম ৫৬; তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন পৃঃ ৮৩৮।
১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ :
(ক) তারা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহের অবমূল্যায়ন করেছিল। যার ফলে তারা আল্লাহর আনুগত্য হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং শয়তানের আনুগত্য বরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছিল (খ) আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী ভেবেছিল (গ) আল্লাহর গযব থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন কল্পিত উপাস্যের অসীলা পূজা শুরু করেছিল (ঘ) তারা আল্লাহর নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল (ঙ) তারা আল্লাহর গযব থেকে নির্ভীক হয়ে গিয়েছিল। যদিও তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত।
২. বস্তগত কারণসমূহ : প্রধানত: তিনটি :
(ক) তারা অযথা উঁচু স্থান সমূহে সুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শন সমূহ নির্মাণ করত। যা স্রেফ অপচয় ব্যতীত কিছুই ছিল না (শো‘আরা ১২৮)।
(খ) তারা অহেতুক মযবূত প্রাসাদ রাজি তৈরী করত এবং ভাবত যেন তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে (ঐ, ১২৯)।
(গ) তারা দুর্বলদের উপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানতো এবং মানুষের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো (ঐ, ১৩০)।
উপরোক্ত বিষয়গুলির মধ্যে বর্তমান যুগের অত্যাচারী সমাজনেতা ও যালেম সরকার সমূহ এবং সভ্যতাগর্বী মানুষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ নিহিত রয়েছে। যেমন:
(১) অহি-র বিধানকে অস্বীকার করা এবং অন্যায়ের উপর যিদ ও অহংকার প্রদর্শন করাই হ’ল পৃথিবীতে আল্লাহর গযব নাযিলের প্রধান কারণ।
(২) আল্লাহ প্রেরিত গযবের ধরন বিভিন্ন রূপ হ’তে পারে। কিন্তু সেই গযবকে ঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের থাকে না।
(৩) বিলাসী, অপচয়কারী ও অত্যাচারী নেতাদের কারণেই জাতি আল্লাহর গযবের শিকার হয়ে থাকে।
(৪) আল্লাহর গযব যাদের উপর আপতিত হয়, তারা সকল যুগে নিন্দিত হয় এবং কখনোই তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
(৫) আল্লাহর বিধান লংঘনকারী ব্যক্তি বা সম্প্রদায় চূড়ান্ত বিচারে দুনিয়াতেই আল্লাহর গযবের শিকার হয়। উপরন্তু আখেরাতের আযাব তো থাকেই এবং তা হয় আরো কঠোর (ক্বলম ৬৮/৩৩)।