বান্দার উপর সর্বপ্রথম ওয়াজিব হচ্ছে, তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তাদের থেকে যে বিষয়ের অঙ্গীকার নিয়েছেন, যে বিষয় দিয়ে রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। এ বিষয়টির জন্যই আল্লাহ্ তাআলা দুনিয়া-আখেরাত, জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়ের জন্যেই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে, দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে, আমলনামা প্রদান করা হবে। এ বিষয়টির কারণেই কেউ সৌভাগ্যবান হবে আবার কেউ হবে হতভাগা। এ অনুযায়ী কিয়ামতের দিন নূর বন্টিত হবে। সে দিন আল্লাহ যাকে নূর দান করবেন না, তার কোন নূর থাকবে না।
আল্লাহ তা’আলা মানুষ ও জিন জাতিকে পৃথিবীতে তাঁর একত্ববাদ ও এবাদত প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ তাআ’লা বলেনঃ
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لاَعِبِينَ * مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ
‘‘আমি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবতী সবকিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি আকাশ ও পৃথিবী যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বুঝে না’’। (সূরা আদ্ দুখানঃ ৩৮-৩৯) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَاطِلاً ذَلِكَ ظَنُّ الَّذِينَ كَفَرُوا
‘‘আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে তা অযথা সৃষ্টি করি নি। এটা কাফেরদের ধারণা মাত্র’’। (সূরা সোয়াদাঃ ২৭) আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
وَخَلَقَ اللَّهُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِالْحَقِّ وَلِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُونَ
‘‘আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তার উপার্জনের ফল পায়। তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না’’। (সূরা জাসিয়াঃ ২২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإِنسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ
‘‘আর আমি জিন এবং মানবকে কেবল আমার এবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)
আব্দ দ্বারা যদি অধিনস্ত উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আসমান-যমীনের সকল জ্ঞানবান ও জ্ঞানহীন, তাজা-শুকনা, চলমান-স্থির, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কাফের-মুমিন, সৎ-অসৎ সব কিছুই উদ্দেশ্য। সবই আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহ কর্তৃক প্রতিপালিত, তাঁর অধিনস্ত, তাঁর পরিচালনাধীন। প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট একটি গন্তব্যস্থল রয়েছে। সেখানে গিয়ে তার যাত্রা শেষ হবে। প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট একটি সময়ের উদ্দেশ্যে চলমান। তার জন্যে নির্ধারিত সীমা ছেড়ে একটি সরিষার দানা পরিমাণ স্থানও অতিক্রম করতে পারবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
‘‘আর এটি হল মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর নির্ধারণ’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৩৮)
আর আব্দ দ্বারা যদি এবাদতকারী, অনুগত ও প্রিয় উদ্দেশ্য হয় তাহলে আব্দ অর্থ হবে আল্লাহর সম্মানিত মুমিন ব্যক্তিগণ। তারা হবেন আল্লাহর পরহেজগার বন্ধু। তাদের কোন ভয় নেই। আর তারা চিন্তিতও হবে না।
আল্লাহ তা’আলা বান্দার যেসমস্ত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালবাসেন ও পছন্দ করেন এবং যে সমস্ত বিষয় আল্লাহর ভালবাসা ও পছন্দের বিপরীত ও পরিপন্থী, তা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার নামই এবাদত।
আমলের মধ্যে যখন দু’টি বস্ত্ত পরিপূর্ণ অবস্থায় পাওয়া যাবে তখন তা এবাদতে পরিণত হবে। (১) আল্লাহকে পরিপূর্ণরূপে ভালবাসা এবং (২) আল্লাহর সামনে পরিপূর্ণভাবে বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
‘‘আর যারা ঈমানদার, তারা আল্লাহ্কে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ هُمْ مِنْ خَشْيَةِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ
‘‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ তাদের পালনকর্তার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকে’’। (সূরা মুমিনূনঃ ৫৭) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ
إِنَّهُمْ كَانُوا يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ
‘‘তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ৯০)
বান্দা কর্তৃক আল্লাহকে ভালবাসার প্রমাণ হল, সে আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে ভালবাসবে এবং আল্লাহ যা অপছন্দ করেন, সে তা অপছন্দ করবে। আল্লাহর আদেশ মেনে চলবে এবং তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহর বন্ধুদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে এবং আল্লাহর শত্রুদেরকে শত্রু মনে করবে। এ জন্যই আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে ঘৃণা করা ঈমানের সবচেয়ে মজবুত হাতল।
আল্লাহ যা পছন্দ করেন ও ভালবাসেন, তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন আদেশের মাধ্যমে এবং যা অপছন্দ করেন তা জানিয়ে দিয়েছেন নিষেধের মাধ্যমে। সুতরাং রাসূল প্রেরণ এবং আসমানী কিতাব নাযিলের মাধ্যমে বান্দাগণ আল্লাহর পছন্দনীয় আমলসমূহ জানতে পেরেছে। এর মাধ্যমেই তাদের নিকট আল্লাহর অকাট্য দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাঁর পরিপূর্ণ হিকমত প্রকাশিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
رُسُلاً مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلاَ يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ
‘‘সুসংবাদদাতা এবং ভীতি প্রদর্শনকারী রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি। যাতে রাসূলগণকে প্রেরণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন সুযোগ না থাকে’’। (সূরা নিসাঃ ১৬৫) আল্লাহ তাআ’লা আরো বলেনঃ
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
‘‘বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী ও দয়ালু’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)
এবাদতের শর্ত হচ্ছে তিনটি।
(১) ‘সিদকুল আযীমাহ’ তথা এবাদত করার সুদৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা। আর এটি হচ্ছে এবাদতের অস্তিত্বের শর্ত।
(২) নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া।
(৩) আল্লাহ তাআলা যে শরীয়ত (দ্বীন) অনুযায়ী এবাদত করতে বলেছেন, এবাদতটি সেই শরীয়ত অনুযায়ী হওয়া। শেষ দু’টি হচ্ছে এবাদত কবুল হওয়ার শর্ত।
তা হচ্ছে এবাদত করতে গিয়ে সম্পূর্ণরূপে অলসতা পরিহার করা এবং কথা ও কাজে পরিপূর্ণ মিল থাকা। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ * كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لاَ تَفْعَلُونَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা কর না তা বল কেন? তোমরা যা কর না তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষ জনক’’। (সূরা আস্ সাফঃ ২-৩)
নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে বান্দা তার প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য সকল কথা ও কাজের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمَا أُمِرُوا إلاَّ لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
‘‘তাদেরকে এ ছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে’’। (সূরা আল-বাইয়্যিনাহঃ ৫) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ
وَمَا لأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى* إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الأَعْلَى
‘‘এবং তাঁর উপর কারও এমন কোন অনুগ্রহ নেই, যার বিনিময় প্রদান করা হচ্ছে; বরং তার মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই’’। (সূরা আল-লাইলঃ ১৯-২০) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لاَ نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلاَ شُكُورًا
‘‘তারা বলেঃ আমরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই তোমাদেরকে আহার প্রদান করি। তোমাদের পক্ষ হতে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না’’। (সূরা আল-ইনসানঃ ৯) আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ
‘‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমি তার জন্য সেই ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে, আমি তাকে এর কিছু দিয়ে দেই। আর পরকালে তার কোন অংশ থাকবে না’’। (সূরা শু'রাঃ ২০) এ মর্মে আরো আয়াত রয়েছে।