সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর নিমিত্ত। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয়তম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, তাঁর পরিজন, সহচর, আল্লাহর সকল নবী-রাসূল ও প্রকৃত অনুসারীদের জন্য।
১৯৭৮ খৃস্টাব্দে আমেরিকার কলরাডো (Colorado) রাষ্ট্রের কলরাডো স্প্রীংস (Colorado springs) শহরে (north American conference on muslim evangelization): ‘মুসলিমদের খৃস্টান বানানো বিষয়ে উত্তর আমেরিকান সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মিশনারিগণ পরবর্তী অর্ধশতকের মধ্যে বাংলাদেশ-সহ এশিয়ার কয়েকটি মুসলিম দেশকে খৃস্টান-প্রধান দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা নেন। তারা প্রচার-পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদেরকে মুসলিম, ঈসায়ী তরীকার মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়া, ধর্মান্তরিতদের নামায-রোযা, ঈদ-মীলাদ বহাল রাখতে বলা.. ইত্যাদি। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সহস্রাধিক প্রচারক একনিষ্ঠভাবে কর্ম করে চলেছেন। ৫০ বৎসর আগে বাংলাদেশে কয়েক হাজার খৃস্টান ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিম খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়।
প্রত্যেকেরই অধিকার আছে নিজ ধর্ম প্রচার করার। কিন্তু অন্যদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা বা নিজের বিশ্বাস গোপন করে প্রতারণা করা আপত্তিকর। সকল সম্প্রদায়ের ন্যায় খৃস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ভাল মানুষ রয়েছেন, কুরআনে তাঁদের প্রশংসা করা হয়েছে (মায়িদা: ৮২)। কিন্তু খৃস্টধর্মের প্রাণপুরুষ সাধু পল মিথ্যার মাধ্যমে ধর্মপ্রচার পূণ্যকর্ম বলে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন: "For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory; why yet am I also judged as a sinner?" কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?” (রোমান ৩/৭)। এজন্য মিথ্যাচার অনেক প্রচারকের মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র ঈসায়ী প্রচারকগণ যা বলছেন তার মধ্যে রয়েছে: তাওরাত-ইঞ্জিল না পালন করে কোনো মুসলিম মুক্তি পাবে না। আমরা নাসারা-খৃস্টান নই; আমরা মুসলিম, আমরা ঈসায়ী মুসলিম। আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মান্য করি, কুরআন ও সকল ধর্মগ্রন্থ মান্য করি। শুধু ঈসায়ী তরীকা গ্রহণ করি। শুধু ভক্তির জন্য ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলি। আমরা বাইবেল মানি না; বরং কিতাবুল মোকাদ্দস মানি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আরবদের সতর্ক করতে এসেছিলেন, আর ঈসা মাসীহ বিশ্বের পাপীদের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। ঈসা মাসীহ যেহেতু আবার আসবেন; কাজেই তার উপর ঈমান এনে আগেই প্রস্তুতি নেওয়া ভাল। ঈসা মাসীহ জীবিত কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত; জীবিতের কাছেই যেতে হবে। ঈসা মাসীহ জীবিতকে মৃত করেছেন কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেন নি; কাজেই ঈসা মাসীহই বড়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ খুন করেছেন; কাজেই তিনি শান্তির দুত নন; ঈসা মাসীহ শান্তির দূত! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপী, কাজেই তিনি কিয়ামতে শাফা‘আত করতে পারবেন না; ঈসা মাসীহ নিষ্পাপ, তিনিই শাফা‘আত করবেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃদ্ধ বয়সে কিশোরী মেয়ে বিবাহ করেন, কাজেই তাঁর চরিত্র ভাল ছিল না। (নাঊযু বিল্লাহ!) .... এ জাতীয় আরো অনেক নোংরা কথা।
এ সকল কথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে এবং মুসলিমদের আহত করছে। বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও তথ্যভিত্তিক আলোচনায় রূপান্তরিত না করলে যে কোনো সময় হানাহানির রূপ নিতে পারে। কারণ, বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক করতে অক্ষম হলে মানুষ আবেগ তাড়িত হয়ে শক্তির আশ্রয় নিতে পারে। এজন্য এ পুস্তিকাটির রচনা। যেমন সমাজের আলিম, তালিবুল ইলম এবং সাধারণ যে কোনো মুসলিম কুরআন, হাদীস ও তাওরাত-ইঞ্জিল-এর আলোকে ঈসায়ী প্রচারকদের সাথে তথ্যভিত্তিক ও জ্ঞানবৃত্তিক আলোচনা করতে পারেন।
অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। আল্লাহ বলেন: “আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না।” (আন‘আম: ১০৮)। “তোমরা উত্তম ও সৌজন্যময় পন্থা ব্যতীত কিতাবীগণের (ইয়াহূদী-খৃস্টানগণের) সাথে বিতর্ক করো না, তবে তাদের সাথে করতে পার যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করে।” (আনকাবূত: ৪৬)। সারা বিশ্বে ঈসায়ী পোপ, পাদরি ও পণ্ডিতগণ ঘৃণ্য সিনেমা, কার্টুন, প্রচারণা ও বইপুস্তক লিখে এবং প্রচারকগণ মাঠে ময়দানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলে মুসলিমদের অনুভূতিকে আহত করছেন। কিন্তু কুরআনের নির্দেশে আমরা আমাদের মারাত্মকভাবে আহত অনুভূতিকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ এবং খৃস্টান পণ্ডিতদের বক্তব্যের আলোকেই প্রচারকদের বক্তব্য পর্যালোচনা করেছি।
খৃস্টানগণ এতদিন ঈশ্বর, ভাববাদী, যীশু খৃস্ট ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন। বর্তমানে আল্লাহ, নবী, ঈসা মাসীহ, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। আমি উভয় প্রকারের পরিভাষা ব্যবহার করেছি। বাংলা বাইবেলের কেরির অনুবাদই মূল ইংরেজির নিকটবর্তী, কিন্তু ভাষা দুর্বোধ্য। মুসলমানী অনুবাদগুলিতে মূলত মুসলিমদের ধর্মান্তর করার দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ফলে অনেক স্থানেই মূল অর্থ বিকৃত হয়েছে। এজন্য ইংরেজি বাইবেল সামনে রেখে মূলত কেরির বাংলা বাইবেল এবং প্রয়োজনে কিতাবুল মোকাদ্দস ও অন্যান্য বাংলা অনুবাদের সাহায্য গ্রহণ করেছি এবং প্রয়োজনে তুলনার জন্য ইংরেজি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি।
গ্রীক biblion, ল্যাটিন biblia ও ইংরেজি bible শব্দটির অর্থ গ্রন্থাবলি বা গ্রন্থমালা। মূল গ্রীক বাইবেল বা ক্যাথলিক বাইবেলের পুস্তকের সংখ্যা ৭৩টি। প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার: Martin Luther (১৫২৯ খৃ) ৭টি পূর্ণ বইকে জাল বলে বাতিল করেন। বাকি বইগুলি থেকেও অনেক অধ্যায় ও আয়াত জাল বলে বাতিল করেন। এজন্য প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বইয়ের সংখ্যা ৬৬টি। ক্যাথলিক বাইবেল বাংলায় ‘পবিত্র বাইবেল: জুবিলী বাইবেল’ নামে অনূদিত এবং বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী ১৯৯৯, ২০০৬ কর্তৃক প্রকাশিত। প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলটি ‘পবিত্র বাইবেল’ নামে প্রথম উইলিয়াম কেরি কর্তৃক অনূদিত ও বিভিন্ন সময়ে পরিমার্জিত ও বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি (বি. বি. এস.) কর্তৃক প্রকাশিত। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি সর্বশেষ বাইবেলকে ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামে প্রকাশ করেন। এতে বাইবেলের বইগুলির নামও পরিবর্তন করা হয়। এজন্য এখানে বাইবেলের বইগুলির নামের তালিকা এ পুস্তিকার শেষে দেওয়া হলো।
ত্রিত্ববাদী আকীদা, খৃস্টান প্রচারকদের সীমালঙ্ঘন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের বিকৃতি বুঝাতে তাদের অনেক কুফরী আকীদা বা বক্তব্য উদ্ধৃত করতে বাধ্য হয়েছি। লেখার সময় মুখে বারবার (নাউযূ বিল্লাহ) বললেও সর্বত্র লিখতে পরিনি। পাঠক এগুলি পাঠের সময় অবশ্যই বারংবার নাউযূ বিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ বলে হৃদয়কে পবিত্র করবেন।
বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গবেষণা সহজ হয়েছে। খৃস্টধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন নাম ও শব্দের ইংরেজি বানান অনেক সময় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করেছি, যেন আগ্রহী পাঠক এ সকল শব্দ ইংরেজিতে লিখে সার্চ করে খৃস্টান লেখকদের বক্তব্য থেকেই আমাদের উপস্থাপিত তথ্যের বিশুদ্ধতা ও এ বিষয়ক অন্যান্য তথ্য জানতে পারেন।
আল্লাহর মহান রাসূল ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে এবং রাহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে অশোভন নিন্দামূলক (blasphemous) অপপ্রচারের প্রতিরোধে এ সামান্য প্রচেষ্টাকে মহান আল্লাহ আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান, সকল পাঠক ও দীনের সকল প্রচারকের নাজাতের উপকরণ হিসেবে কবুল করুন। আমীন!
খৃস্টধর্মে মিথ্যার অনুপ্রবেশের বড় প্রমাণ ২৫শে ডিসেম্বরকে বড়দিন (ক্রিসমাস : Christmas) বা ঈসা মাসীহের জন্মদিন বলে বিশ্বাস, প্রচার ও উদযাপন করা। অথচ ঈসা মাসীহ ২৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছেন- কথাটি যেমন শতভাগ অসত্য, তেমনি এ দিবসটি পালন করা ঈসা মাসীহের শিক্ষা— এ কথাও শতভাগ অসত্য। এ দুটি মহা অসত্য-ই এখন “ঈসায়ী তরীকা”-য় পরিণত হয়েছে।
খৃস্টধর্মের সর্বোচ্চ গুরু পোপ বেনিডিক্ট ১৬ (Benedict XVI) স্বয়ং “Jesus of Nazareth: The Infance Narratives” নামে একটি পুস্তক রচনা করেছেন, যাতে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ২৫ শে ডিসেম্বর ঈসা মাসীহের জন্মদিন হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। পাঠক ইন্টারনেটে পোপের নাম বা বইটির নাম দিয়ে সার্চ করলেই বইটি পেয়ে যাবেন।
এ মিথ্যার সাথে সংযুক্ত হয়েছে “বিদ‘আত” বা উদ্ভাবন। ঈসা মাসীহের জন্ম যে দিনই হোক না কেন, দিনটি উদযাপন করার কোনোরূপ নির্দেশনা ইঞ্জিলে নেই। খৃস্টান গবেষকগণ একমত যে, যীশুর পরের ৩০০ বৎসর পর্যন্ত কোনো খৃস্টান কখনোই যীশুর জন্মদিন পালন করেন নি। ঈসা মাসীহ নিজে এবং পরবর্তী ৩০০ বৎসরের খৃস্টানরা যা পালন করলেন না সেটিকে “ঈসায়ী তরীকা” বা “খৃস্টধর্ম” নামে প্রতিষ্ঠা করা হলো। মাইক্রোসফট এনকার্টায় ক্রিসমাস আর্টিকেলের বক্তব্য:
Historiansareunsure exactly when Christians first began celebrating the Nativity of Christ. However, most scholars believe that Christmas originated in the 4th century as a Christian substitute for pagan celebrations of the winter solstice. “ঠিক কবে থেকে যীশুর জন্মদিন উদযাপনের জন্য খৃস্টানগণ ক্রিসমাস পালন শুরু করেন সে বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত নন। তবে অধিকাংশ গবেষক বিশ্বাস করেন যে, পৌত্তলিক শীতকালীন উত্তরায়ণ উৎসবের বিকল্প হিসেবে ৪র্থ শতকে ক্রিসমাস পালনের আয়োজন করা হয়।”
পাঠক যে কোনো ইনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে Origin of Christmas বা ক্রিসমাসের উৎপত্তি বিষয়ে পাঠ করলে দেখবেন যে, মূলত রোমান-গ্রীকদের দলে ভেড়ানোর জন্যই খৃস্টান ধর্মগুরুগণ এ উৎসবটির উদ্ভাবন করেন। গ্রীক-রোমান পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারীরা ডিসেম্বরের শেষে ফসলের দেবতা Saturn এবং আলোর দেবতা Mithra-এর পূজা উপলক্ষ্যে ব্যাপক উৎসব করত। পাদরিগণ পৌত্তলিকদেরকে ধর্মে ভিড়ানোর জন্য এ সময়ে ক্রিসমাস উৎসব চালু করেন। তারা বলতে চান, আমরাও তো তোমাদের মতই একই ধর্মের মানুষ এবং একই উৎসব করি। যেমন মুসলিমদেরকে তারা বলেন: ‘আমরাও মুসলিম, ঈসায়ী মুসলিম!
বড়দিনের আরেকটি জালিয়াতি “সান্তা ক্লজ” (Santa Claus)। সারা বিশ্বে খৃস্টানগণ বিশ্বাস ও প্রচার করেন যে, ক্রিসমাস-রাত্রিতে সান্তা ক্লজ প্রত্যেক খৃস্টান বাড়িতে যেয়ে ক্রিসমাসের দোয়া-উপহার রেখে আসেন। বিশেষত “ভাল” ছেলেমেয়েদের পায়ের মোজার মধ্যে উপহার রেখে আসেন! যুগযুগ ধরে এ মিথ্যাটি খৃস্টানগণ জেনেশুনেই বলেন। এ পুরো কাহিনীই বানোয়াট।
সম্মানিত পাঠক, ঈসায়ী প্রচারককে বলুন: যে মিথ্যা কথাটি ব্যবসা, সমাজ বা রাজনীতিতে বললে ফৌজদারি অপরাধ ও শাস্তি হতো, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর মিথ্যা আপনারা ধর্মের নামে বলছেন!! আপনি যে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ প্রচার করছেন সে গ্রন্থেও তো মিথ্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে: “তোমরা চুরি করিও না এবং আপন আপন স্বজাতীয়কে বঞ্চনা করিও না, ও মিথ্যা বলিও না।” (লেবীয় ১৯/১১)। আপনার ইঞ্জিলের শেষ বইয়েও বলা হয়েছে যে, মিথ্যার শাস্তি অনন্ত জাহান্নাম: “কিন্তু জ্বলন্ত আগুন ও গন্ধকের হ্রদের মধ্যে থাকাই হবে ভীতু, বেঈমান, ঘৃণার যোগ্য, খুনী, জেনাকারী, জাদুকর, মূর্তিপূজাকারী এবং সব মিথ্যাবাদীদের শেষ দশা। এটাই হল দ্বিতীয় মৃত্যু।” (প্রকাশিত বাক্য/কালাম ২১/৮)। আসুন না আমার সত্য বলি!
বাংলাদেশে খৃস্টান প্রচারকগণ “ইঞ্জিল শরীফ” নামের একটি পুস্তক প্রচার করেন। ইঞ্জিল শব্দটির ইংরেজি ইভানজেল (evangel)। শব্দটি প্রাচীন গ্রীক (euaggelion/euaggelos) থেকে গৃহীত। এর অর্থ সুসংবাদ। ইংরেজিতে একে গসপেল (gospel)-ও বলা হয়। খৃস্টান বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ “নতুন নিয়ম” (the New Testament)-এর মধ্যে মোট ২৭টি পুস্তক বিদ্যমান। এগুলির মধ্যে মাত্র ৪টি পুস্তককে খৃস্টানগণ “ইঞ্জিল” বলে দাবি করেছেন। এছাড়া বাকি ২৩টি পুস্তককে বিগত ২ হাজার বৎসরে কোনো একজন খৃস্টানও ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেন নি। মুসলিমদের সরল বিশ্বাসকে পুজি করে তাদেরকে ধর্মান্তর করার জন্য খৃস্টান প্রচারকগণ ২৭ গ্রন্থের এ পুস্তককে “ইঞ্জিল শরীফ” বলে চালাচ্ছেন। জেনে শুনেই তাঁরা এ মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(১) ইংরেজী ভাষায় এ গ্রন্থটির নাম (the New Testament)। আরবী ভাষায় এটির নাম (العهد الجديد), যার অর্থ নতুন নিয়ম বা নতুন সন্ধি। বিশ্বের কোনো ভাষাতেই খৃস্টানগণ এটির নাম ‘ইঞ্জিল’ বলে দাবি করেন নি। শুধু সরল মুসলিমদের প্রতারণা করার জন্য বর্তমানে কোনো কোনো মুসলিম দেশে এ বইটিকে “ইঞ্জিল” বলে চালাচ্ছেন তাঁরা। আগ্রহী পাঠক একটু কষ্ট করে যে কোনো ইংরেজি অভিধানে বা ইন্টারনেটে evangel লিখে সার্চ করলেই বিষয়টি জানতে পারবেন।
(২) ২৭টি বইয়ের মধ্যে মাত্র চারটি বইকে খৃস্টানগণ ইঞ্জিল বলে দাবি করেছেন। মূল গ্রীক বা ইংরেজি বাইবেলে এগুলির নাম নিম্নরূপ:
(১) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Matthew/ The Gospel According To St. Matthew: সাধু মথির মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
(২) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Mark/ The Gospel According To St. Mark: সাধু মার্কের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
(১) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. Luke/ The Gospel According To St. Luke: সাধু লূকের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
(১) The Holy Gospel of Jesus Christ According to St. John/ The Gospel According To St. John: সাধু যোহনের মতানুসারে ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল
পাঠক, নাম থেকেই সহজেই বুঝতে পারছেন যে, এ চারটি পুস্তকও মূলত ইঞ্জিল নয়, বিভিন্ন মানুষের মতে এগুলি ইঞ্জিল বলে কথিত। ঈসা (আঃ) একটি ইঞ্জিল প্রচার করেছিলেন বলে সকলেই জানত। তবে কারো কাছেই এর কোনো কপি ছিল না। তাঁর তিরোধানের কয়েকশত বৎসর পরে অনেক মানুষ ‘ইঞ্জিল’ লিখে প্রচার করেন যে, এটি ঈসা (আঃ) এর ইঞ্জিল। এজন্য এগুলির এরূপ নামকরণ করা হয়: ‘অমুকের মতানুসারে এটি ইঞ্জিল’, সঠিক ইঞ্জিল কোনটি তা কেউ জানেন না।
আমরা দেখলাম যে, “ইঞ্জিল শরীফ” নামের পুস্তকটি কখনোই ইঞ্জিল নয়। ২৭টির মধ্যে মাত্র চারটি পুস্তক “মতানুসারে ইঞ্জিল” বলে দাবি করেছেন খৃস্টানগণ।
এ সকল ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ সাথে ‘ঈসা মাসীহের ইঞ্জিলের’ মুল পার্থক্য ঈসা (আঃ)-এর উপর নাযিলকৃত মূল ইঞ্জিলটি ছিল আল্লাহর কালাম। আর প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’ চারটির মধ্যে আল্লাহর কোনো কালাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এগুলির মধ্যে ঈসা মাসীহের বক্তব্যও কম। এগুলি মূলত তাঁর জীবনীগ্রন্থ। এগুলির মধ্যে ঈসা মাসীহ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের গালগল্প সংকলন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এরূপ প্রায় অর্ধশত “মতানুসারে ইঞ্জিল” তৃতীয় শতকের খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এগুলির মধ্য থেকে সাধু পলের অনুসারী ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ কোনোরূপ সুস্পষ্ট সনদ, ভিত্তি বা যুক্তি ছাড়া, শুধু নিজেদের পছন্দের উপর নির্ভর করে এ চারটিকে বাছাই করেন।
খৃস্টান পণ্ডিতদের লেখা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature-এর বক্তব্য: As far as the New Testament is concerned, there could be no Bible without a church that created it; yet conversely, having been nurtured by the content of the writings themselves, the church selected the canon. ... Indeed, until c. AD 150, Christians could produce writings either anonymously or pseudonymously—i.e., using the name of some acknowledged important biblical or apostolic figure. The practice was not believed to be either a trick or fraud. ...
“নতুন নিয়মের বিষয়টি হলো যদি চার্চ (ধর্মগুরুদের মণ্ডলী) বাইবেল তৈরি না করত তাহলে কোনো বাইবেলই থাকতো না। অপরদিকে লিখনিগুলির বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে চার্চই বাইবেলের বইগুলি বাছাই করেছে। ... প্রকৃত বিষয় হলো, ১৫০ খৃস্টাব্দের দিকে যে কোনো খৃস্টান নাম প্রকাশ না করে, অথবা কোনো প্রসিদ্ধ বাইবেলীয় ব্যক্তিত্ব বা যীশুর শিষ্যদের নামে বই লিখতে পারত। এরূপ কর্মকে ছলচাতুরি বা প্রতারণা বলে গণ্য করা হতো না! ...”
কি ভয়ঙ্কর কথা! ১০০/১৫০ বৎসর পরে যে কোনো খৃস্টান সম্পূর্ণ মিথ্যাভাবে একটি বই লিখে প্রচার করছে, এটি লূক লিখিত ইঞ্জিল, এটি পিতর লিখিত ইঞ্জিল... এভাবে যীশুর শিষ্যদের বা সাধুদের নামে যে যা পারছে লিখে প্রচার করছে। এরূপ কর্মকে উক্ত ধার্মিক লেখক বা সমাজের অন্য কোনো ধার্মিক খৃস্টান কেউই অন্যায় বা পাপ বলে গণ্য করছেন না! এগুলি সমাজে এভাবে ইঞ্জিল নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার আরো ১৫০ বৎসর পর এরূপ ধার্মিক খৃস্টানগণ “যীশুর শিষ্যদের নামে ১৫০ বৎসর পরে অজ্ঞাত ধার্মিক মানুষদের লেখা” অর্ধশত ইঞ্জিল থেকে শুধু বিষয়বস্তুর দিকে তাকিয়ে, বিষয়বস্তুগুলি নিজেদের পছন্দমত কিনা তা দেখে, ৪টি ইঞ্জিল বেছে নিয়ে “নতুন নিয়ম”-এর অন্তর্ভুক্ত করলেন।
মাইক্রোসফট এনকার্টায় Bible আর্টিকেলের বক্তব্য: The27books of theNew Testament are only a fraction of the literary production of the Christian communities in their first three centuries. ... As many as 50 Gospels were in circulation during this time. “খৃস্টান সম্প্রদায়গুলি প্রথম তিন শতকে যে সকল ধর্মগ্রন্থ লিখেছিল তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি হলো নতুন নিয়মের ২৭টি বই। তখন ৫০টির মত ইঞ্জিল তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।”
আমরা জানলাম যে, প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল চারটি’ ২য় শতকের কতিপয় খৃস্টানের পরনামে (pseudonymously) লেখা বই। এগুলির মধ্যে বৈপরিত্যের শেষ নেই। এ চারটির মধ্যে প্রথম তিনটিকে খৃস্টান পণ্ডিত ও ধর্মগুরুগণ Synoptic Gospels বা ‘একমতীয় ইঞ্জিল’ বলে আখ্যায়িত করেন। চতুর্থ যোহন বা ইউহোন্নার মতানুসারে ইঞ্জিলটিকে ব্যতিক্রম বলে গণ্য করেন। প্রথম তিনটির সাথে চতুর্থটির বৈপরীত্য আরো বেশি। খৃস্টান গবেষকগণ প্রায় সকলেই একমত যে, মথি, মার্ক ও লূকের সুসমাচারের উৎস মূল একটি সংক্ষিপ্ত ‘ইঞ্জিল’। হারিয়ে যাওয়া এই মূল ইঞ্জিলটিকে খৃস্টান গবেষকগণ ‘কিউ’ (Q) বলে অভিহিত করেন। জার্মান Quelle শব্দের অর্থ source বা উৎস। যেহেতু এতে শুধু যীশুর বচন সংকলন করা হয়েছিল এজন্য গবেষকগণ একে Logia বলে অভিহিত করেন। (The New Encyclopedia Britannica, 15th Ed, V-10, Jesus Christ, p 146) চতুর্থ ‘মতানুসারে ইঞ্জিলের’ উৎস, ভিত্তি, প্রেক্ষাপট ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খৃস্টান গবেষকদের মত ও ভিন্নমত জানতে যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়াতে “বাইবেল” বিষয়ক প্রবন্ধ অধ্যয়ন করতে পারেন।
ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল এবং এ সকল ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-এর মধ্যে অন্যতম পার্থক্য ঈসা মাসীহের ইঞ্জিল ছিল (Hebrew-Aramaic) হিব্রু-আরামিক ভাষায়। কিন্তু প্রচলিত ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-গুলি গ্রীক ভাষায় লেখা। সাধু পলের অনুসারীরা যীশুর পরে ১০০ বৎসরের মধ্যেই তাঁর আসল হিব্রু ইঞ্জিল গুম করে দেন।
খৃস্টান প্রচারকগণ “বাংলা”-য় ‘ইঞ্জিল শরীফ’ প্রচার করেন। আপনি তাকে বলুন: আপনার হাতের ইঞ্জিলটি তো বাংলায় লেখা! ঈসা মাসীহ কি বাঙালী ছিলেন? তা না হলে তিনি কোন্ ভাষায় কথা বলতেন? খৃস্টান প্রচারক স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ঈসা মাসীহ হিব্রু-আরামিক ভাষায় কথা বলতেন। আপনি তাকে বলুন: হিব্রু ইঞ্জিল কোথায়? যীশুর তিরোধানের পর থেকে ৫০০ বৎসরের মধ্যে লেখা একটি হিব্রু ইঞ্জিল যদি আপনি দেখাতে পারেন তবে আপনার ইঞ্জিল সত্য বলে মেনে নেব।
তারা বলেন, ইঞ্জিল গ্রীক ভাষায় লেখা হয়েছিল। কী উদ্ভট কথা! যীশু, তাঁর শিষ্যগণ এবং ফিলিস্তিনের মানুষের মাতৃভাষা এবং ধর্মীয় ভাষা ছিল হিব্রু। তবে সে সময়ে গ্রীকরা ফিলিস্তিন দখল করেছিল। ইয়াহূদীগণ বিজাতীয় ভাষা ঘৃণা করতেন এবং করেন। যীশু কি তাঁর নিজের ও জনগণের মাতৃভাষা ও ধর্মীয়ভাষা বাদ দিয়ে দখলদারদের অপরিচিত ও ঘৃণিত ভাষায় ইঞ্জিল প্রচার করতেন? যীশুর শিষ্যরা কি তাদের মাতৃভাষা ও ধর্মীয়ভাষা বাদ দিয়ে দখলদারদের ভাষায় ইঞ্জিল লিখবেন? কেউ যদি বলে রবীন্দ্র বা নজরুল সাহিত্য ইংরেজিতে রচিত তবে তাকে আপনি কী বলবেন?
বস্তুত এ সকল বেনামী ইঞ্জিলের লেখকগণ অ-ইয়াহূদী রোমান ছিলেন। তাঁরা হিব্রু ভাষা জানতেন না। যীশু হিব্রু ভাষায় ইস্রায়েল বংশের মানুষদের মধ্যে ইঞ্জিল প্রচার করেন। তিনি অ-হিব্রু বা অ-ইয়াহূদীদের কাছে ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেন। সাধু পল দাবি করেন যে, যীশু তাকে পয়গম্বর বানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের খৃস্টানগণ তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তিনি দাবি করেন যে, যীশু তাঁকে অ-ইস্রায়েলীয়দের জন্য পয়গম্বর বানিয়েছেন। এভাবে তিনি গ্রীকভাষী মানুষদের মধ্যে তার বানোয়াট ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তিনি বারংবার বলেন, তাঁর নিজের ইঞ্জিল ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিল, অর্থাৎ যীশুর ইঞ্জিল যদি কেউ প্রচার করে তবে সে অভিশপ্ত (গালাতীয় ১/৬, ৮-৯; ২-করিন্থীয় ১১/৪)। এভাবে ক্রমান্বয়ে তাঁর অনুসারী ত্রিত্ববাদী খৃস্টানগণ (Pauline Christaians) প্রাধান্য লাভ করে এবং একত্ববাদী হিব্রু খৃস্টানগণ (Judeo Christaians) কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সাধু পলের অনুসারী গ্রীক-ভাষী খৃস্টানগণ যীশু খৃস্টের ১০০/১৫০ বৎসর পরে “পবিত্র সাধুদের নামে” নিজেদের মনগড়া ইঞ্জিল লিখতে থাকেন। তাঁরা সমাজে ঈসা মাসীহের নামে প্রচলিত সত্য, মিথ্যা ও নিজের মনগড়া কথা লিখে ‘অমুকের লেখা ইঞ্জিল’ নামে প্রচার করেন।
খৃস্টান প্রচারকগণ দাবি করেন, পবিত্র আত্মা বা পাক রুহের তত্ত্বাবধানে ‘ইঞ্জিল’ লেখা হয়। এটিও ভিত্তিহীন দাবি ছাড়া কিছুই নয়। নতুন নিয়মে যীশু খৃস্টের শিষ্যদের পত্রে আমরা দেখি যে, তারা পবিত্র আত্মার মাধ্যমে কিছু জানতে পারলে তা উল্লেখ করতেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফগুলির কোথাও লেখা নেই যে, এগুলি পবিত্র আত্মার মাধ্যমে লেখা। বরং লূক তার ইঞ্জিলের শুরুতে খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, অনেকেই বিশ্বাসের ভিত্তিতে অনেক ইঞ্জিল লিখেছেন এবং তিনিও শোনা কথার উপর ভিত্তি করে সঠিক কথাগুলি লেখার চেষ্টা করেছেন। (লূক ১/১-৪)।
সর্বোপরি ইঞ্জিলগুলির মধ্যে এত বৈপরীত্য রয়েছে যে, পাক রূহ তো দূরের কথা কোনো নাপাক মানুষও এরূপ পরস্পর বিরোধী কথা লিখতে পারে না। পাঠক যদি প্রচলিত চারটি “মতানুসারে ইঞ্জিল” তুলনা করে অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখবেন যে, চারটি ইঞ্জিলেই যীশু খৃস্টের জীবনের একই ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘটনা চার ইঞ্জিলে পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি ডকুমেন্ট বা দলিলের মধ্যে যদি সুস্পষ্ট স্ববিরোধী বা সর্বজনবিদিত সত্যের বিপরীত কিছু তথ্য থাকে, তবে অন্য কোনো বিচার ছাড়াই বিচারক তাকে জাল বলে গণ্য করেন। কিতাবুল মোকাদ্দস-এর মধ্যে বিদ্যমান এরূপ কিছু তথ্য দেখুন:
আমরা জানি যে, তাওরাত মূসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ। অথচ প্রচলিত তাওরাতের দ্বিতীয় বিবরণের ৩৪ অধ্যায়ে মূসা (আঃ)-এর মৃত্যু, দাফন, কবর. তার উম্মাতের ত্রিশ দিন শোক পালন এবং যুগের আবর্তনের মূসার কবরটি হারিয়ে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। আর ইঞ্জিলের বিষয় তো আরো অদ্ভূত। আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-এর উপর ইঞ্জিল নাযিল করেন। ঈসা মাসীহ জীবদ্দশায় ইঞ্জিল প্রচার করেছেন (মথি ৪/২৩, ৯/৩৫, ১১/১৫; মার্ক ১/১৪, ১৫, ৮/৩৫; মার্ক ১০/২৯; লূক ৯/৬)। কিন্তু প্রচলিত ইঞ্জিলগুলির সবগুলিতেই ঈসা মাসীহের মৃত্যু, কবর, কবর থেকে বের হওয়া... ইত্যাদি বিবরণ বিদ্যমান। পাঠক কি মনে করেন, আল্লাহ মূসার (আঃ) কিতাবে তার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি এবং ঈসার (আঃ) কিতাবে তার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলির বিবরণ নাযিল করেছিলেন?
(ক) ৩, ৫ ও ১০-এর বিভ্রাট
বনী ইস্রায়েলের মূল পিতা ইসরায়েল (ইয়াকুব আ)-এর ১২ পুত্রের একপুত্র বিন্যামীন (বিন্ইয়ামীন)। তাঁর পুত্রগণের বিষয়ে সাংঘর্ষিক বর্ণনা লক্ষ্য করুন:
১-বংশাবলি ৭/৬: “বিন্যামীনের সন্তান- বেলা, বেখর ও যিদীয়েল, তিন জন।”
পক্ষান্তরে ১-বংশাবলি ৮/১: “বিন্যামীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বেলা, দ্বিতীয় অস্বেল, তৃতীয় অহর্হ, চতুর্থ নোহা ও পঞ্চম রাফা।”
কিন্তু আদিপুস্তক ৪৬/২১: “বিন্যামীনের পুত্র বেলা, বেখর, অস্বেল, গেরা, নামন, এহী, রোশ, মুপ্পীম, হুপ্পীম ও অর্দ।”
বিন্যামিনের সন্তান সংখ্যা প্রথম বক্তব্যে তিনজন এবং দ্বিতীয় বক্তব্যে পাঁচজন। তাদের নামের বর্ণনাও পরস্পর বিরোধী, শুধু বেলার নামটি উভয় শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকিদের নাম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর তৃতীয় শ্লোকে বিন্যামীনের সন্তান সংখ্যা দশজন। নামগুলিও আলাদা। তৃতীয় শ্লোকের নামগুলির সাথে প্রথম শ্লোকের সাথে দুজনের নামের এবং দ্বিতীয় শ্লোকের দুজনের নামের মিল আছে। আর তিনটি শ্লোকের মিল আছে একমাত্র “বেলা” নামটি উল্লেখের ক্ষেত্রে।
(খ) মাত্র তিন লক্ষের হেরফের!
দায়ূদের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি যোয়াব লোকসংখ্যা গণনা করেন। এ বিষয়ে শমূয়েলের দ্বিতীয় পুস্তকের ২৪ অধ্যায়ের ৯ম শ্লোকটি নিম্নরূপ: “পরে যোয়াব গণিত লোকেদের সংখ্যা রাজার কাছে দিলেন; ইস্রায়েলে খড়্গ-ধারী আট লক্ষ বলবান লোক ছিল; আর যিহূদার পাঁচ লক্ষ লোক ছিল।”
অপর দিকে বংশাবলি প্রথম খন্ডের ২১ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোক নিম্নরূপ: “আর যোয়াব গণিত লোকদের সংখ্যা দায়ূদের কাছে দিলেন। সমস্ত ইস্রায়েলের এগার লক্ষ খড়্গধারী লোক, ও যিহূদার চারি লক্ষ সত্তর সহস্র খড়্গধারী লোক ছিল।”
প্রথম বর্ণনায় ইস্রায়েলের যোদ্ধাসংখ্যা ৮ লক্ষ এবং যিহূদার ৫ লক্ষ। আর দ্বিতীয় বর্ণনামতে ১১ লক্ষ ও ৪ লক্ষ ৭০ হাজার। উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরীত্যের পরিমাণ দেখুন! ইস্রায়েলের জনসংখ্যা বর্ণনায় মাত্র ৩ লক্ষের কমবেশি এবং যিহূদার জনসংখ্যার বর্ণনায় ত্রিশ হাজারের কমবেশি। পবিত্র আত্মার কারসাজি?!
(গ) ভুলটি কার? যীশুর? পবিত্র আত্মার? না বেনামি লেখকের?
মার্ক লিখেছেন ২/২৫-২৬: “তিনি (যীশু) তাহাদিগকে (ইয়াহূদী ফরীশীগণকে) কহিলেন, দায়ূদ ও তাঁহার সঙ্গীরা খাদ্যের অভাবে ক্ষুধিত হইলে তিনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহা কি তোমরা কখনো পাঠ কর নাই? তিনি ত অবিয়াথর মহাযাজকের সময়ে ঈশ্বরের গৃহে প্রবেশ করিয়া, যে দর্শন-রুটী যাজকবর্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও ভোজন করা বিধেয় নয়, তাহাই ভোজন করিয়াছিলেন, এবং সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন।”
১ শমূয়েল ২১ ও ২২ অধ্যায় থেকে প্রমাণিত যে, এ কথাটি ভুল। কারণ ‘দর্শন-রুটী’ ভোজন করার সময় দায়ূদ ‘একা’ ছিলেন, তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। কাজেই ‘ও তাঁহার সঙ্গীরা’ এবং ‘সঙ্গিগণকেও দিয়াছিলেন’ দুটি কথাই ভুল। এছাড়া এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মহাযাজকের নাম ছিল ‘অহীমেলক’। ‘অবিয়াথর’ এ সময়ে যাজক ছিলেন না। অর্থাৎ যীশু অথবা পবিত্র আত্মা কিতাবুল মোকাদ্দস জানতেন না!
অন্যত্র ঈসা মাসীহ বলেছেন: “আর স্বর্গে কেহ উঠে নাই; কেবল যিনি স্বর্গ হইতে নামিয়াছেন, সেই মনুষ্যপুত্র, যিনি স্বর্গে থাকেন।” (যোহন ৩/১৩) তাওরাতের ভাষ্যে এ কথাটি ভুল। কারণ হনোক (Enoch: ইদরীস) এবং এলিয় (Eli'jah: আল-ইয়াসা’) উভয়ে স্বর্গে গমন করেছেন (আদিপুস্তক ৫/২৩-২৪; ২ রাজাবলি ২/১-১১।) অর্থাৎ যীশু বা ইঞ্জিল লেখক পবিত্র(!) আত্মা ‘আল্লাহর কালাম’ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন।
যীশুর পিতামাতা তাঁকে নিয়ে মিসর থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে নাসরৎ নামক শহরে বসবাস করতে থাকেন। এ বিষয়ে মথি বলেন: “এবং নাসরৎ নামক নগরে গিয়া বসতি করিলেন; যেন ভাববাদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন।” (মথি ২/২৩) ইঞ্জিলের এ কথাটি অসত্য; কোনো ভাববাদীর কোনো পুস্তকেই এ কথা নেই। কিন্তু পবিত্র আত্মা তা জানতেন না!
ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা ৩০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে যীশুকে ইয়াহূদীদের কাছে ধরিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে মথি বলেন ২৭/৯: “তখন যিরমিয় ভাববাদী দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হইল, ‘আর তাহারা সেই ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রা লইল।” কথাটি অসত্য। এ বাক্যটি বা এ অর্থে কোনো বাক্য যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তকের কোথাও নেই।
যীশুর বংশাবলি-পত্রে লূক লিখেছেন (৩/২৭): “ইনি যোহানার পুত্র, ইনি রীষার পুত্র, ইনি সরুববাবিলের পুত্র, ইনি শল্টীয়েলের পুত্র ইনি নেরির পুত্র”।
পুরাতন নিয়ম থেকে প্রমাণিত যে এখানে তিনটি অসত্য তথ্য রয়েছে: প্রথমত: “রীষা সরুববাবিলের পুত্র” কথাটি অসত্য। মথি লিখেছেন (১/১২-১৩) “সরুববাবিলের পুত্র অবীহূদ।” লূক ও মথি দুজনের কথাই অসত্য। কারণ ১ বংশাবলি ৩/১৯-এ রয়েছে যে, সরুববাবিলের ৫টি পুত্র ছিল, তাদের মধ্যে (রীষা) বা (অবীহূদ) নামে কোনো পুত্র ছিল না। দ্বিতীয়ত: সরুববাবিল শল্টীয়েলের পুত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন পদায়ের পুত্র। হ্যাঁ, তিনি শল্টীয়েলের ভাতিজা ছিলেন। (১ বংশাবলি ৩/১৭-১৮) তৃতীয়ত: শল্টীয়েলের পিতার নাম নেরি ছিল না। তার পিতার নাম ছিল যিকনিয় (যিহোয়াখীন)। (১ বংশাবলি ৩/১৭ ও মথি ১/১২)
(ঘ) যীশুর পিতার দুজন পিতা!
আমরা দেখেছি যে, প্রচলিত ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম নয়। এর মধ্যে আল্লাহর কোনো বাণী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর মূল বিষয় যীশু খৃস্ট। অথচ যীশু খৃস্টের পরিচয়েও ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য! এক ব্যক্তির দুজন পিতা!!
মথি এবং লূক উভয়ে যীশুর বংশ তালিকা প্রদান করেছেন (মথি: ১/১-১৬ ও লূক: ৩/২৩-৩৮)। যদি কেউ উভয় তালিকার তুলনা করেন তাহলে উভয়ের মধ্যে অনেক বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা দেখতে পাবেন, যেগুলির মধ্যে রয়েছে:
- যীশুর দাদার নাম: মথি বলেন: যাকোব কিন্তু লূক বলেন: এলি। দু পিতার একপুত্র!
- মথি থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র শলোমনের বংশধর। লূক থেকে জানা যায় যে, যীশু দায়ূদের পুত্র নাথন-এর বংশধর।
- মথির ভাষ্যে দায়ূদ থেকে ব্যবিলনের নির্বাসন পর্যন্ত যীশুর পূর্বপুরুষগণ সকলেই সুপ্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। লূকের বর্ণনায় দায়ূদ ও নাথন বাদে যীশুর পুর্বপুরুষগণের মধ্যে কেউই রাজা বা কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন না।
- মথির বিবরণ অনুযায়ী দায়ূদ থেকে যীশু পর্যন্ত উভয়ের মাঝে ২৬ প্রজন্ম। আর লূকের বর্ণনা অনুযায়ী উভয়ের মাঝে ৪১ প্রজন্ম।
- মথি বলেন (১/১৭): “এভাবে ইব্রাহিম থেকে দাউদ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ; ব্যাবিলনে বন্দী হবার পর থেকে মসীহ্ পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ।”
এখানে দুটি সুনিশ্চিত ও প্রমাণিত অসত্য তথ্য বিদ্যমান:
প্রথমত, এখানে বলা হলো: যীশুর বংশতালিকা তিন অংশে বিভক্ত, প্রত্যেক অংশে ১৪ পুরুষ, তাহলে মোট ৪২ পুরুষ। এ কথাটি সুস্পষ্ট ভুল। মথির ১/১-১৭-র বংশ তালিকায় যীশু থেকে আবরাহাম পর্যন্ত ৪২ পুরুষ নয়, বরং ৪১ পুরুষের উল্লেখ রয়েছে। যে কোনো পাঠক গণনা করলেই তা জানতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, মথির বক্তব্য: “দাউদ থেকে ব্যাবিলনে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত চৌদ্দ পুরুষ”- মারাত্মক ভুল। ১ বংশাবলির ১ম অধ্যায় থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এ পর্যায়ে ১৮ পুরুষ ছিল, ১৪ পুরুষ নয়। আরো লক্ষণীয় যে, বংশাবলি ও মথি- বাইবেলের দু স্থানেই স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তির জনক। মথি তালিকার বিভিন্ন স্থান থেকে চার পুরুষ ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও লিখেছেন যে, পূর্ববতী ব্যক্তি পরের ব্যক্তির সরাসরি জনক। তিনি এতেও ক্ষান্ত হন নি। উপরন্তু এদের মাঝে যে আর কেউ ছিল না নিশ্চিত করতে এ পর্যায়ে সর্বমোট ১৪ পুরুষ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
এজন্য প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ কার্ডিনাল জন হেনরী নিউম্যান (১৮০১-১৮৯০) আফসোস করে বলেন, “খৃস্টধর্মে একথা বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনে এক হয় বা তিন ও এক একই সংখ্যা। কিন্তু এখন একথাও বিশ্বাস করা জরুরী হয়ে গেল যে, ১৪ এবং ১৮ একই সংখ্যা; কারণ পবিত্র গ্রন্থে কোনো ভুল থাকার সম্ভাবনা নেই!”
আমরা তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি, ৪১ ও ৪২ একই সংখ্যা!