ফাত্ওয়া নং - 92748
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
প্রথমত :
সম্মানিত ভাই, আপনি প্রশ্নটি করে বেশ ভাল করেছেন। কারণ আপনি রমযান মাসের প্রস্তুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন যখন সিয়ামের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বহু মানুষের ধ্যান ধারণা বিকৃত হয়েছে। তারা এই মাসকে খাদ্য, পানীয়, মিষ্টি-মন্ডা, রাত জাগা ও স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর মৌসুম বানিয়ে ফেলেছে। আর এ জন্য তারা রমযান মাসের বেশ আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে এই আশংকায় যে কিছু খাদ্য দ্রব্য কেনা বাদ পড়তে পারে বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই তারা খাদ্য দ্রব্য কিনে, হরেক রকম পানীয় প্রস্তুত করে এবং কী অনুষ্ঠান দেখবে আর কী দেখবে না তা জানতে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর গাইড খোঁজ খবর করে প্রস্তুতি নেয়।
আর এভাবে তারা রমযান মাসের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সত্যিকার অর্থেই অজ্ঞ থেকে গেল। তারা এ মাস থেকে ‘ইবাদাত ও তাক্ব্ওয়া সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে নিল এবং একে তাদের উদরপূর্তি ও চক্ষুবিলাসের সামগ্রীতে পরিণত করল।
দ্বিতীয়ত :
অপরদিকে অন্যরা রমযান মাসের সিয়ামের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে শা‘বান মাস থেকেই এর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, এমনকি তাদের কেউ কেউ এর আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
রমযান মাস উপলক্ষে প্রস্তুতি নেয়ার কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হল:
১. সত্যিকার তাওবাহ
আর এটি সবসময়ের জন্যই ওয়াজিব, তবে যেহেতু এক মহান মুবারাক (বরকতময়) মাসের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে তাই তার ও তার রবের মাঝে যে গুনাহগুলো আছে এবং তার ও মানুষের মাঝে যে অধিকারসমূহ রয়েছে সেগুলো থেকে দ্রুত তাওবাহ করার জন্য তার আরও বেশি তৎপর হওয়া উচিৎ; যাতে করে সে এই মুবারক (বরকতময়) মাসে পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করে আনুগত্য ও ‘ইবাদাতে মশগুল হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١ ﴾ [النور: ٣١]
“আর তোমরা সবাই, হে মু’মিনেরা, আল্লাহ্র কাছে তাওবাহ কর যাতে করে সফলকাম হতে পার।” [সূরা আন-নূর: ৩১]
আল-আগার ইব্ন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
وعَنْ الأَغَرَّ بن يسار رضي الله عنه عن النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ) رواه مسلم (2702)
“হে লোক সকল, আপনারা আল্লাহ্র কাছে তাওবাহ করুন কারণ, আমি দিনে তাঁর কাছে ১০০ বার তাওবাহ করি।” [মুসলিম (২৭০২)]
২. দো‘আ পাঠ
কোনো কোনো পূর্বসূরী (সাহাবীগণ, তাবি‘ঈনগণ .....) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা ৬ মাস ধরে আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করতেন যাতে তিনি তাঁদের রমযান মাস পাওয়ার তাওফীক্ব দেন, এরপর (রমযান শেষে) ৫ মাস ধরে এই দো‘আ করতেন যেন (রমযানের আ‘মালসমূহ) তাদের কাছ থেকে কবুল করা হয়।
তাই একজন মুসলিম তার রবের কাছে দো‘আ করবে যাতে তিনি তাকে রমযান মাস পাবার তাওফীক্ব দেন সর্বোত্তম দ্বীনি অবস্থা ও শারীরিক সুস্থতার মাঝে এবং তাঁর কাছে এই দো‘আ করবে যাতে তিনি তাকে তাঁর আনুগত্যে সাহায্য করেন এবং তাঁর কাছে এই দো‘আ করবে যাতে তিনি তার আমল কবুল করেন।
৩. এই মহান মাসের আসন্ন আগমনে আনন্দিত হওয়া
রমযান মাসের আগমন একজন মুসলিম বান্দার প্রতি আল্লাহ্র সুমহান নি‘আমাতগুলোর (অনুগ্রহসমূহের) একটি, কারণ রমযান কল্যাণময় একটি মওসুম। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এটি হল ক্বুর‘আনের মাস, আমাদের দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ, চূড়ান্ত সংগ্রামের মাস। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨ ﴾ [يونس: ٥٨]
“বলুন, আল্লাহ্র অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়, অতঃপর এর দ্বারা তারা আনন্দিত হোক; তা, তারা যা সঞ্চয় করে তা থেকে উত্তম।” [ইঊনুস : ৫৮]
৪. ওয়াজিব সিয়াম হতে নিজেকে দায়িত্ব মুক্ত করা
আবূ সালামাহ হতে বর্ণিত যে তিনি বলেছেন :
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ قَالَ : سَمِعْتُ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا تَقُولُ : »كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلا فِي شَعْبَانَ« . رواه البخاري (1849) ومسلم (1146)
“আবু সালামাহ বলেন, আমি ‘আয়েশাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে বলতে শুনেছি, “আমার উপর বিগত রমযানের সাওম বাকি থাকত যার কাযা আমি শা‘বান ছাড়া আদায় করতে পারতাম না।”
[বুখারী (১৮৪৯) ও মুসলিম (১১৪৬)]
হাফিজ ইব্নু হাজার-রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন :‘এ হাদীস দ্বারা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা কর্তৃক শা‘বান মাসে রমযানের সিয়াম পালনের চেষ্টা প্রমাণ করে যে, এক রমযান এর কাযা আরেক রমযান প্রবেশ করা পর্যন্ত দেরী করা জায়েয নয়।” [ফাতহুল বারী (৪/১৯১)]
৫. পর্যাপ্ত ‘ইল্ম (জ্ঞান) অর্জন করা, যাতে সিয়ামের হুকুম-বিধি-বিধান এবং রমযান মাসের মর্যাদা সম্পর্কে জানা যায়।
৬. রমযান মাসের ‘ইবাদাত থেকে একজন মুসলিমকে বিরত করতে পারে এমন কাজসমূহ দ্রুত সম্পন্ন করে ফেলা।
৭. পরিবারের সদস্যবর্গ যেমন-স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে বসে তাদেরকে সিয়ামের বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়া এবং ছোটদের সিয়াম পালনে উৎসাহিত করা।
৮. কিছু বই প্রস্তুত করা যা বাড়িতে বসে পড়া সম্ভব বা মাসজিদের ইমামকে উপহার দেয়া, যা তিনি রমযান মাসে লোকদের পড়ে শোনাবেন।
৯. রমযান মাসের প্রস্তুতিস্বরূপ শা‘বান মাস থেকেই সিয়াম পালন শুরু করা।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ لا يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ لا يَصُومُ، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ . رواه البخاري ( 1868 ) ومسلم ( 1156 )
‘আয়েশাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে সিয়াম পালন করতেন যে আমরা বলতাম তিনি আর সিয়াম ভঙ্গ করবেন না এবং এমনভাবে সিয়াম ভঙ্গ করতেন যে আমরা বলতাম, তিনি আর সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ছাড়া অন্য কোন মাসের গোটা অংশ সাওম পালন করতে দেখি নি এবং শা‘বান ছাড়া অন্য কোনো মাসে অধিক সিয়াম পালন করতে দেখি নি।” [বুখারী (১৮৬৮) ও মুসলিম (১১৫৬)]
عَنْ أُسَامَة بْن زَيْدٍ قَالَ : قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَرَكَ تَصُومُ شَهْرًا مِنْ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ ، قَالَ: (ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ) . رواه النسائي ( 2357 ) وحسَّنه الألباني في " صحيح النسائي "
‘উসামাহ ইব্ন যাইদ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে শা‘বান মাসের মত অন্য কোনো মাসে এত সাওম পালন করতে দেখিনি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এটি রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী একটি মাস, যখন মানুষ গাফিল হয় এবং এমন মাস যখন আমলসমূহ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে উঠানো হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে আমার আমল আমি সাওম পালন রত অবস্থায় উঠানো হবে।” [নাসা’ঈ (২৩৫৭) এবং আলবানী একে সহীহ আন-নাসায়ীতে একে হাসান বলেছেন।]
শা‘বান মাসের সাওম পালনের হিকমতের বর্ণনায় হাদীসে এসেছে যে এটি এমন মাস যখন আমলসমূহ উঠানো হয়। ‘আলিমগণের মাঝে কেউ কেউ অন্যান্য হিক্মাহসমূহ উল্লেখ করেছেন, আর তা হল শা‘বানের সাওম ফরয নামাযের পূর্বের সুন্নাহ্র মত যা ফরয আদায়ে মনকে প্রস্তুত করে ও উৎসাহ যোগায়। ঠিক একই বক্তব্য প্রযোজ্য রমযানের পূর্বে শা‘বানের সিয়ামের ক্ষেত্রে।
১০. কুরআন তিলাওয়াত:
সালামাহ ইব্ন কুহাইল বলেছেন : “শা‘বান মাসকে ক্বারীগণের মাস বলা হত।”
আম্র ইব্ন ক্বাইস, শা‘বান মাস শুরু হলে, তাঁর দোকান বন্ধ করে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর নিতেন।
আবূ বাক্র আল-বালাখী বলেছেন : “রাজাব মাস হল বীজ বপনের মাস, শা‘বান মাস হল ক্ষেতে সেচ প্রদানের মাস এবং রমযান মাস হল ফসল তোলার মাস।”
তিনি আরও বলেছেন : “রাজাব মাসের উদাহরণ হল বাতাসের ন্যায়, শা‘বান মাসের উদাহরণ মেঘের ন্যায়, রমযান মাসের উদাহরণ বৃষ্টির ন্যায় ; তাই যে রাজাব মাসে বীজ বপন করল না, শা‘বান মাসে সেচ প্রদান করল না, সে কীভাবে রমযান মাসে ফসল তুলতে চাইতে পারে?”
এখন রাজাব মাস গত হয়েছে, আর আপনি শা‘বান মাসে কি করবেন যদি রমযান মাস পেতে চান? এ হল এই বরকতময় মাসে আপনার নবী ও উম্মাতের পূর্বসূরীগণের অবস্থা। এ সমস্ত আমল ও মর্যাদাপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী হবে?
তৃতীয়ত :
রমযান মাসে একজন মুসলিমের কী করা উচিৎ সে আমলসমূহ সম্পর্কে জানতে দেখুন (26869) ও (12468) নং প্রশ্নের উত্তর।
আল্লাহই তাওফীক্বদাতা।
ফাত্ওয়া নং - 13480
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
রমযান...এটি ‘আরাবী’ বার মাসগুলোর একটি, আর এটি দ্বীন ইসলামে একটি সম্মানিত মাস। এটি অন্যান্য মাস থেকে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ও ফযিলতসমূহ-এর কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন :
১. আল্লাহ তা‘আলা সাওমকে (রোযাকে) ইসলামের আরকানের মধ্যে চতুর্থ রুকন হিসেবে স্থান দিয়েছেন, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“রমযান মাস যে মাসে আল-ক্বুরআন নাযিল করা হয়েছে, মানুষের জন্য হিদায়াতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন; সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাস পায় সে যেন সাওম পালন করে।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫]
আর সহীহ বুখারী (৮) ও সহীহ মুসলিম (১৬)-এ ইবনু ‘উমার এর হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«بني الإسلام على خمس شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبد الله ورسوله وإقام الصلاة وإيتاء الزكاة، وصوم رمضان وحج البيت»
“ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত – (১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ (উপাস্য) নেই, এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল; (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা; (৩) যাকাত প্রদান করা; (৪) রমযান মাসে সাওম পালন করা এবং (৫) বাইতের (কা‘বাহ-এর) উদ্দেশ্যে হাজ্জ করা”।
২. আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে আল-কুরআন নাযিল করেছেন, যেমনটি আল্লাহ্ তা‘আলা পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করেছেন:
﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“রমযান মাস যে মাসে তিনি আল-কুরআন নাযিল করেছেন, তা মানবজাতির জন্য হিদায়াতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন।” [আল-বাকারাহ : ১৮৫]
তিনি - সুবহানাহূ ওয়া তা‘আলা- আরও বলেছেন :
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ ﴾ [القدر: ١]
“নিশ্চয়ই আমি একে (আল-কুরআন) লাইলাতুল ক্বাদ্রে নাযিল করেছি।” [আল-ক্বাদ্র : ১]
৩. আল্লাহ এ মাসে লাইলাতুল ক্বাদ্র রেখেছেন যে মাস হাজার মাস থেকে উত্তম যেমনটি আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ﴾ [القدر: ١، ٥]
“১. নিশ্চয়ই আমি একে লাইলাতুল ক্বাদরে (আল-কুরআন )নাযিল করেছি।
২. এবং আপনি কি জানেন লাইলাতুল ক্বাদ্র কি?
৩. লাইলাতুল ক্বাদ্র হাজার মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম।
৪. এতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ (জিবরীল-আলাইহিস সালাম-) তাঁদের রব্বের অনুমতিক্রমে অবতরণ করেন সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে।
৫. শান্তিময় (বা নিরাপত্তাপূর্ণ) সেই রাত, ফাজরের সূচনা পর্যন্ত।” [আল-ক্বাদর : ১-৫]
তিনি আরও বলেছেন :
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ ﴾ [الدخان: ٣]
“নিশ্চয়ই আমি একে (আল-কুরআন) এক মুবারাক (বরকতময়) রাতে নাযিল করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।” [আদ-দুখান:৩]
আল্লাহ তা‘আলা রমযান মাসকে লাইলাতুল ক্বাদ্র দিয়ে সম্মানিত করেছেন, আর এই মুবারাক (বরকতময়) রাতে মর্যাদার বর্ণনায় সূরাতুল ক্বাদ্র নাযিল করেছেন।
আর এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে অনেক হাদীস। তন্মধ্যে:
আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ , تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ , وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ , وَتُغَلُّ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ , لِلَّهِ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ,مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ» رواه النسائي ( 2106 ) وأحمد (8769) صححه الألباني في صحيح الترغيب ( 999 ) .
“তোমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে রমযান, এক মুবারাক (বরকতময়) মাস। এ মাসে সিয়াম পালন করা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর ফরয করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, এ মাসে অবাধ্য শয়তানদের শেকলবদ্ধ করা হয়, আর এ মাসে রয়েছে আল্লাহর এক রাত যা হাজার মাস থেকে উত্তম, যে এ রাত থেকে বঞ্চিত হল, সে প্রকৃত পক্ষেই বঞ্চিত হল।”
[বর্ণনা করেছেন আন-নাসা’ঈ (২১০৬), আহমাদ (৮৭৬৯) এবং আল-আলবানী একে ‘সাহীহুত তা্রগীব’ গ্রন্থে সহীহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন (৯৯৯)]
আবূ হুরাইরাহ-রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর হাদীস থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেছেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ» رواه البخاري (1910) ومسلم ( 760 )
“যে ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল ক্বাদ্র (ক্বাদরের রাত্রিতে) ক্বিয়াম করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” [এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (১৯১০) ও মুসলিম (৭৬০)]
৪. আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় সিয়াম পালন ও ক্বিয়াম করাকে গুনাহ মাফের কারণ করেছেন, যেমনটি দুই সহীহ গ্রন্থ আল-বুখারী (২০১৪) ও মুসলিম (৭৬০) - এ বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরাইরাহ-রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীস থেকে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه»
“যে রমযান মাসে ঈমান সহকারে ও সাওয়াবের আশায় সাওম পালন করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”
অনুরূপভাবে বুখারী (২০০৮) ও মুসলিম (১৭৪)-এ তাঁর (আবূ হুরাইরাহ-রাদিয়াল্লাহু আনহু-) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন :
«من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه»
“যে রমযান মাসে ঈমান সহকারে ও সাওয়াবের (প্রতিদানের) আশায় ক্বিয়াম করবে তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”
মুসলিমদের মাঝে রমযানের রাতে ক্বিয়াম করা সুন্নাহ হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘ (ঐকমত্য) রয়েছে। ইমাম আন-নাওয়াউয়ী উল্লেখ করেছেন :
“রমযানে ক্বিয়াম করার অর্থ হল তারাউয়ীহের (তারাবীহের) সালাত আদায় করা অর্থাৎ তারাউয়ীহের (তারাবীহের) সালাত আদায়ের মাধ্যমে ক্বিয়াম করার উদ্দেশ্য সাধিত হয়।”
৫. আল্লাহতা‘আলা এই মাসে জান্নাতসমূহের দরজাসমূহ খুলে দেন, এ মাসে জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেন এবং শাইত্বান (শয়তান)দের শেকলবদ্ধ করেন। যেমনটি প্রমাণিত হয়েছে দুই সহীহ গ্রন্থ আল-বুখারী (১৮৯৮) ও মুসলিম (১০৭৯)-এ আবূ হুরাইরাহ এর হাদীস হতে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة , وغلقت أبواب النار , وصُفِّدت الشياطين»
“যখন রমযান আবির্ভূত হয় তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শেকলবদ্ধ করা হয়।”
৬. এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে (তাঁর বান্দাদের) মুক্ত করেন। ইমাম আহমাদ (৫/২৫৬) আবূ উমামাহ -এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«لله عند كل فطر عتقاء»
“আল্লাহর রয়েছে প্রতি ফিত্বরে (ইফত্বারের সময় জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দারা।”
আল-মুনযিরী বলেছেন এর ইসনাদে কোনো সমস্যা নেই। আর আল-আলবানী এটিকে ‘সাহীহুত তারগীব’ (৯৮৭) - এ সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অনুরূপ আল-বাযযার (কাশফ ৯৬২) আবূ সা’ঈদের হাদীস থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন :
«إن لله تبارك وتعالى عتقاء في كل يوم وليلة _ يعني في رمضان _ وإن لكل مسلم في كل يوم وليلة دعوة مستجابة»
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার রয়েছে (রমযান মাসে) প্রতি দিনে ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাগণ আর নিশ্চয়ই একজন মুসলিমের রয়েছে প্রতি দিনে ও রাতে কবুল যোগ্য দো‘আ।”
৭. রমযান মাসে সাওম পালন করা পূর্ববর্তী রমযান থেকে কৃত গুনাহসমূহের কাফফারাহ লাভের কারণ যদি বড় গুনাহসমূহ (কাবীরাহ গুনাহসমূহ) থেকে বিরত থাকা হয়, যেমনটি প্রমাণিত হয়েছে ‘সহীহ মুসলিম (২৩৩)-এ যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«الصلوات الخمس , والجمعة إلى الجمعة , ورمضان إلى رمضان , مكفرات ما بينهن إذا اجتنبت الكبائر»
“পাঁচ ওয়াক্বতের পাঁচবার সালাত, এক জুমু‘আহ থেকে অপর জুমু‘আহ, এক রমযান থেকে অপর রমযান এর মাঝে কৃত গুনাহসমূহের কাফফারাহ করে যদি বড় গুনাহসমূহ (কাবীরাহ গুনাহ সমূহ) থেকে বিরত থাকা হয়।”
৮. এই মাসে সাওম পালন করা দশ মাসে সিয়াম পালন করার সমতুল্য যা ‘সহীহ মুসলিম’ (১১৬৪)-এ প্রমাণিত আবূ আইয়ূব আল-আনসারীর হাদীস থেকে নির্দেশনা পাওয়া যায় যে তিনি বলেছেন :
«من صام رمضان , ثم أتبعه ستا من شوال كان كصيام الدهر»
“যে রমযান মাসে সিয়াম পালন করল, এর পর শাউওয়ালের ছয়দিন সাওম পালন করল, তবে তা সারা জীবন সাওম রাখার সমতূল্য”।
আর ইমাম আহমাদ (২১৯০৬) বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«من صام رمضان فشهر بعشرة أشهر ، وصيام ستة أيام بعد الفطر فذلك تمام السنة»
“যে রমযান মাসে সাওম পালন করল, তা দশ মাসের (সাওম পালনের) সমতূল্য আর ‘ঈদুল ফিত্বরের পর (শাউওয়ালের মাসের) ছয় দিন সাওম পালন করা গোটা বছরের (সাওম পালনের) সমতূল্য।”[1]
৯. এই মাসে যে ইমামের সাথে, ইমাম সালাত শেষ করে চলে যাওয়া পর্যন্ত ক্বিয়াম করে, সে সারা রাত ক্বিয়াম করেছে বলে হিসাব করা হবে যা ইমাম আবূ দাঊদ (১৩৭০) ও অন্য সূত্রে আবূ যার -রাদিয়াল্লাহু আনহু- এর হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ - সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- বলেছেন :
«إنه من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة»
“যে ইমাম চলে যাওয়া পর্যন্ত তাঁর (ইমামের) সাথে ক্বিয়াম করল, সে সারা রাত ক্বিয়াম করেছে বলে ধরে নেয়া হবে।”
আল-আলবানী ‘সালাতুত-তারাউয়ীহ’ বইতে (পৃঃ১৫) একে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন।
১০. এই মাসে ‘উমরাহ করা হাজ্জ করার সমতুল্য। ইমাম বুখারী (১৭৮২) ও মুসলিম (১২৫৬) ইবন ‘আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের এক মহিলাকে প্রশ্ন করলেন:
«ما منعك أن تحجي معنا ؟ " قالت : لم يكن لنا إلا ناضحان , فحج أبو ولدها وابنها على ناضح , وترك لنا ناضحا ننضح عليه , قال : " فإذا جاء رمضان فاعتمري , فإن عمرة فيه تعدل حجة»
“কিসে আপনাকে আমাদের সাথে হাজ্জ করতে বাঁধা দিল?” তিনি (আনসারী মহিলা) বললেন: আমাদের শুধু পানি বহনকারী দুটি উটই ছিল। তাঁর স্বামী ও পুত্র একটি পানি বহনকারী উটে করে হাজ্জে গিয়েছেন। আর আমাদের পানি বহনের জন্য একটি পানি বহনকারী উট রেখে গেছেন।” তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন: “তাহলে রমযান এলে আপনি ‘উমরাহ করেন কারণ, এ মাসে ‘উমরাহ করা হাজ্জ করার সমতুল্য।”
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে: “আমার সাথে হাজ্জ করার সমতুল্য।”
১১. এ মাসে ই‘তিকাফ করা সুন্নাহ। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিয়মিতভাবে করতেন যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ‘আয়েশাহ্ -রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা-থেকে –
«أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ تَعَالَى , ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ»
“আল্লাহ তাঁকে (রাসূলুল্লাহকে) ক্বাবদ্ব (কবজ, মৃত্যু দান) না দেওয়া পর্যন্ত রমযানের শেষ দশ দিনে ই‘তিকাফ করতেন। তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন।” [বুখারী (১৯২২) ও মুসলিম (১১৭২)]
১২. রমযান মাসে কুরআন অধ্যয়ন ও তা বেশি বেশি তিলাওয়াত করা খুবই তাকীদের (তাগিদের) সাথে করণীয় এক মুস্তাহাব্ব (পছন্দনীয়) কাজ। আর কুরআন অধ্যয়ন হল একজন অপরজনকে কুরআন পড়ে শোনাবে এবং অপরজনও তাকে তা পড়ে শোনাবে। আর তা মুস্তাহাব্ব হওয়ার দালীলঃ
أَنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يَلْقَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ " رواه البخاري ( 6 ) ومسلم ( 2308 )
“জিবরীল রমযান মাসে প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কুরআন অধ্যয়ন করতেন।” [বুখারী (৬) ও মুসলিম (২৩০৮)]
কুরআন ক্বিরা‘আত সাধারণভাবে মুস্তাহাব্ব, তবে রমযানে বেশি তাকীদযোগ্য।
১৩. রমযানে সাওম পালনকারীকে ইফত্বার করানো মুস্তাহাব্ব যার দলীল যাইদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী হতে বর্ণিত হাদীস যাতে তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ , غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا»
“যে কোন সাওম পালনকারীকে ইফত্বার করায়, তার (যে ইফত্বার করালো) তাঁর (সাওম পালনকারীর) সমান সাওয়াব হবে, অথচ সেই সাওম পালনকারীর সাওয়াব কোন অংশে কমে না”।
[আত-তিরমিযী(৮০৭), ইবনু মাজাহ (১৭৪৬) এবং আল-আলবানী ‘সহীহ আত তিরমিযী’(৬৪৭) তে একে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন]
দেখুন প্রশ্ন নং (12598)
এবং আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
১. এক দল, তারা যে দেশে বাস করে সে দেশের চাঁদ দেখে সাওম রাখে।
২. এক দল, যারা সউদি আরবে সিয়াম শুরু হলে সাওম পালন করে।
৩. এক দল, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিম ছাত্র ইউনিয়নের খবর (নতুন চাঁদ দেখার) পৌঁছলে সাওম রাখে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করে। তারা (সেই মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন) দেশের কোন স্থানে চাঁদ দেখলে বিভিন্ন সেন্টারসমূহে তা দেখার খবর পৌঁছে দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিমরা একই দিনে সাওম পালন করে যদিও এই শহরগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। এক্ষেত্রে সিয়াম পালন, চাঁদ দেখা ও এ সংক্রান্ত খবরের ব্যাপারে কারা বেশি অনুসরণ যোগ্য? আমাদের এ ব্যাপারে দয়া করে ফাত্ওয়া দিন, আল্লাহ আপনাদেরকে পুরস্কৃত করুন, সাওয়াব দিন।
ফাত্ওয়া নং -1248
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
প্রথমত : নতুন চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল থাকার ব্যাপারটি ইন্দ্রিয় ও ‘আক্বল (বুদ্ধি) দ্বারা অবধারিতভাবে জানা বিষয়গুলোর একটি। যে ব্যাপারে ‘আলিমগণের কেউ দ্বিমত পোষণ করেন নি। তবে মুসলিমদের ‘আলিমগণের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনাযোগ্য কিনা তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
দ্বিতীয়ত : ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল এবং তা বিবেচনাযোগ্য না হওয়ার মাসআলাটি তাত্ত্বিক মাসআলাগুলোর একটি, যাতে ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে। জ্ঞান ও দ্বীনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞজনদের মাঝে এ ব্যাপারে ইখতিলাফ (দ্বিমত) আছে। আর এটি এমন একটি গ্রহণযোগ্য মতভেদ যে ব্যাপারে সঠিক মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) দুইবার সাওয়াব পাবেন-ইজতিহাদ করার সাওয়াব ও সঠিক মত প্রদান করার সাওয়াব এবং ভুল মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) শুধু ইজতিহাদ করার সাওয়াব পাবেন।
এই মাসআলাটিতে ‘আলিমগণ দুটি মত প্রদান করেছেন :
-তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেছেন।
-আবার তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেননি।
তবে উভয়পক্ষই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল দিয়েছেন, এমনকি একই পাঠ থেকে দলীল দিয়েছেন। কারণ তা দুটি মতের সপক্ষেই দলীল হিসেবে পেশ করা যায়। আর তা আল্লাহ্র-তা‘আলার বাণী :
﴿ ۞يَسَۡٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡأَهِلَّةِۖ قُلۡ هِيَ مَوَٰقِيتُ لِلنَّاسِ وَٱلۡحَجِّ﴾ [البقرة: ١٨٩]
“তাঁরা আপনাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, তা মানুষের সময়সীমা (নির্ধারণ) ও হাজ্জ এর জন্য।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৯]
এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :
«صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته» الحديث
“তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম শুরু কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ কর।” [বুখারী(১৯০৯) ও মুসলিম (১০৮১)]
আর এ ভিন্ন মতভেদের কারণ হল পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে ভিন্নতা হওয়া এবং এ ব্যাপারে দলীল দেয়ার ক্ষেত্রে উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা।
তৃতীয়ত : চাঁদ দেখা সংক্রান্ত কমিটি নতুন চাঁদ হিসাবের সাহায্যে নিশ্চিত হবার ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত দলীলসমূহ গবেষণা করে দেখেছেন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে ‘আলিমগণের বক্তব্য যাচাই করেছেন। এরপর তাঁরা ইজমা‘ (ঐকমত্য) ক্রমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব দ্বারা শারী‘আত সংক্রান্ত মাসআলাসমূহের ক্ষেত্রে নতুন চাঁদ দেখা নিশ্চিত করার ব্যাপারটি বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর দলীল হিসেবে তাঁরা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী :
«صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته» الحديث
“তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম শুরু কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ কর।” [বুখারী(১৯০৯) ও মুসলিম (১০৮১)]
এবং তাঁর (রাসূলুল্লাহ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :
«لا تصوموا حتى تروه ولا تفطروا حتى تروه» الحديث
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সাওম রেখো না ও তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সাওম শেষ করো না।” [মালিক (৬৩৫)] ও এর অর্থে অন্যান্য দলীল সমূহও রয়েছে।
গবেষণা ও ফাত্ওয়া ইস্যুকারী স্থায়ী কমিটি এ মত পোষণ করে যে, মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন (অথবা এ ধরণের অন্য কোনো সংস্থা যারা ইসলামী কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করে) অমুসলিম সরকার শাসিত দেশসমূহে সেখানে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য নতুন চাঁদ দেখা নিশ্চিত করার ব্যাপারে মুসলিম সরকারের স্থলাভিষিক্ত হবে।
আর পূর্বে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, এই ইউনিয়নের দুটো মতের যে কোনো একটি মত- ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করা বা না করা- এর যে কোনো একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার আছে। এরপর তারা সেই মতকে সে দেশের সমস্ত মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করবে। আর সে মুসলিমদের সেই মতকে যা তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে তা মেনে নেয়া বাধ্যতামূলক; ঐক্যের স্বার্থে, সিয়াম শুরুর জন্য এবং মতভেদ ও বিভ্রান্তি এড়িয়ে চলার জন্য।
এ সমস্ত দেশে যারা বাস করে তাদের উচিৎ নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে তৎপর হওয়া, তাদের মাঝে এক বা একাধিক বিশ্বস্ত ব্যক্তি যদি তা (নতুন চাঁদ) দেখে তবে তারা সাওম পালন করবে এবং সেই ইউনিয়নকে খবর দিবে যাতে তারা সবার উপর এটি প্রয়োগ করতে পারে। এটি হল মাস শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে।
আর তা (মাস) শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে শাউওয়ালের নতুন চাঁদ দেখা বা রমযানের ত্রিশ দিন পূর্ণ করার ব্যাপারে দুইজন ‘আদল ব্যক্তির শাহাদাহ (সাক্ষ্য) অবশ্য প্রয়োজন। এর দলীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :
«صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غم عليكم فأكملوا العدة ثلاثين يوماً»
“তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম পালন কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ করো বা ঈদুল ফিতর আদায় কর। আর যদি নতুন চাঁদ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে দেখা না যায় তবে (মাসকে) ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।” আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ফাতাওয়া আল-লাজ্নাহ আদ-দা’ইমাহ (১০/১০৯)
ফাত্ওয়া নং - 45545
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য ।
যদি কোনো ব্যক্তি এক দেশে রমযান শুরু করার পর অন্য দেশে যায় যেখানে ‘ঈদুল ফিত্বর এক দিন দেরিতে আসে তাহলে সে সিয়াম পালন চালিয়ে যাবে যতদিন না দ্বিতীয় দেশের লোকেরা সিয়াম পালন শেষ করে।
শাইখ ইবনু বায-রাহিমাহুল্লাহ- এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল-
আমি পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে এসেছি যেখানে হিজরি মাস সউদি আরব এর চেয়ে একদিন দেরিতে শুরু হয়। রমযান মাসে আমি আমার দেশে যাব। আমি যদি সউদি আরবে সিয়াম পালন শুরু করি এবং আমার দেশে গিয়ে শেষ করি তাহলে আমার ৩১ দিন সাওম পালন করা হবে। আমাদের সিয়ামের ব্যাপারে হুকুম কি? আমি কতদিন সাওম পালন করব?
তিনি উত্তরে বলেন-
“আপনি যদি সউদি আরব বা অন্য কোন দেশে সিয়াম পালন শুরু করেন কিন্তু নিজের দেশে গিয়ে বাকিটা পালন করেন তাহলে আপনাদের দেশের লোকদের সাথেই সিয়াম ভঙ্গ করবেন যদিও বা তা ৩০ দিনের বেশি হয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«الصوم يوم تصومون ، والفطر يوم تفطرون»
“সাওম হল সেদিন যেদিন তোমরা (সকলে ) সাওম পালন কর, আর ‘ঈদুল ফিত্বর হল সেদিন যেদিন তোমরা (সকলে ) সাওম ভঙ্গ কর[1]।”
কিন্তু আপনি যদি তা করতে গিয়ে ২৯ দিনের কম সাওম পালন করেন, তাহলে আপনাকে পরে এক দিন সাওম এর ক্বাদ্বা (কাযা) আদায় করে নিতে হবে; কারণ রমযান মাস ২৯ দিনের কম হতে পারে না।’
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইবনি বায, (১৫/১৫৫)]
শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-‘উসাইমীন-রাহিমাহুল্লাহ-এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল-
এক মুসলিম দেশ থেকে যদি আরেক দেশে যাওয়া হয় যেখানে লোকজন প্রথম দেশের চেয়ে এক দিন দেরিতে রমযান আরম্ভ করেছে, তবে সিয়াম পালনের বিধান কি হবে যখন দ্বিতীয় দেশের লোকজনকে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে ৩০ দিনের বেশি সিয়াম পালন করতে হয়? এবং এর বিপরীত ক্ষেত্রে কী হবে?
তিনি উত্তরে বলেন :
“যদি কেউ এক মুসলিম দেশ থেকে আরেক মুসলিম দেশে ভ্রমণ করে এবং সেই দেশে রমযান দেরিতে শুরু হয়, তবে তিনি ওই দেশের লোকরা সিয়াম ভঙ্গ না করা পর্যন্ত সিয়াম পালন করে যাবেন কারণ সাওম হল সেদিন যেদিন লোকেরা (সকলে) সিয়াম পালন করে, আর ‘ঈদুল ফিত্বর হল সেদিন যেদিন লোকেরা (সকলে) ইফত্বার করে অর্থাৎ ঈদুল ফিতর পালন করে, আর ‘ঈদুল ’আদ্বহা (আযহা) হল সেদিন যেদিন লোকেরা পশু যবেহ করে।
সে এই কাজ করবে যদিও বা এজন্য তাকে এক বা এর বেশি দিন সিয়াম পালন করতে হয়।
এটি সেই পরিস্থিতির অনুরূপ যখন সে এমন দেশে যায় যেখানে সূর্যাস্ত দেরীতে হয়, তবে সে সূর্যাস্ত না হওয়া পর্যন্ত সাওম পালন করবে যদিও বা এর ফলে দুই বা তিন বা ততোধিক ঘণ্টা স্বাভাবিক দিন (চব্বিশ ঘণ্টা) থেকে বেড়ে যায়।
একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে যদি সে এমন কোনো দেশে যায় যেখানে নতুন চাঁদ এখনও দেখা যায় নি, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাওম শুরু করতে বা ইফত্বার করতে নিষেধ করেছেন যতক্ষণ না আমরা তা দেখি। তিনি বলেছেন :
«صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته»
“তোমরা তা (নতুন চাঁদ) দেখে সাওম শুরু কর এবং তা (নতুন চাঁদ) দেখে ইফত্বার তথা সাওম সমাপ্ত কর।”
আর বিপরীত অবস্থার ক্ষেত্রে, যখন একজন ব্যক্তি এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায় যেখানে রমযান মাস প্রথম দেশের তুলনায় আগে শুরু হয়েছে, তবে তিনি তাদের সাথেই সাওম ভঙ্গ করবেন এবং যে কয়দিনের সাওম বাদ পড়েছে সেগুলো পরে ক্বাদ্বা’ (কাযা) করে নিবেন। যদি একদিন বাদ পড়ে, তবে একদিনের ক্বাদ্বা’ (কাযা) করবেন, যদি দুই দিন বাদ পড়ে, তবে দুই দিনের; তিনি ২৮ দিন পর সাওম ভঙ্গ করলে, তাহলে দুই দিনের কাযা করবেন; যদি উভয় দেশেই মাস ৩০ দিনে শেষ হয়, আর এক দিনের ক্বাদ্বা’ (কাযা) করবেন যদি উভয় দেশে বা যে কোন একটি দেশে ২৯ দিনে মাস শেষ হয়।”
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইবনি ‘উসাইমীন (১৯/ প্রশ্ন নং ২৪)]
শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ আল-উসাইমীনের কাছে আরও জানতে চাওয়া হয়েছিল-
কেউ হয়ত বলবে যে, কেন আপনি বলছেন যে প্রথম ক্ষেত্রে ৩০ দিনের বেশি সাওম পালন করতে হবে এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সাওমে র ক্বাদ্বা’ (কাযা) পালন করতে হবে?
তিনি উত্তরে বলেন-
“দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সাওমের ক্বাদ্বা’ (কাযা) সাওম পালন করতে হবে কারণ মাস ২৯ দিনের কম হতে পারে না আর সে প্রথম ক্ষেত্রে ৩০ দিনের বেশি সাওম পালন করবে; কারণ তখনও নতুন চাঁদ দেখা যায় নি।
প্রথম ক্ষেত্রে আমরা তাকে বলব সাওম ভঙ্গ কর, যদিও তোমার ২৯ দিন পূর্ণ হয়নি; কারণ নতুন চাঁদ দেখা গিয়েছে আর নতুন চাঁদ দেখা যাওয়ার পর সাওম ভঙ্গ করা বাধ্যতামূলক, শাউওয়াল মাসের প্রথম দিন সাওম পালন করা নিষিদ্ধ। আর কেউ যদি ২৯ দিনের কম সাওম পালন করে থাকে, তাহলে তাকে ২৯ দিন পূরণ করতে হবে। এটি দ্বিতীয় অবস্থা হতে ভিন্ন; কারণ যে দেশে আসা হয়েছে সেখানে তখন রমযান চলছে, নতুন চাঁদ দেখা যায় নি। যেখানে এখনও রমযান চলছে সেখানে কিভাবে সাওম ভঙ্গ করা যেতে পারে? তাই আপনাকে সাওম পালন চালিয়ে যেতে হবে। আর যদি তাতে মাস বেড়ে যায়, তাহলে তা দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার মত।”
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইবনি ‘উসাইমীন (১৯/ প্রশ্ন নং ২৫)]
আরও দেখুন, (38101) নং প্রশ্নের উত্তর।
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
যে ব্যক্তির মধ্যে ৫টি শর্ত পাওয়া যায় তার উপর সাওম পালন করা ওয়াজিব :
প্রথমত : যদি সে মুসলিম হয়
দ্বিতীয়ত : যদি সে মুকাল্লাফ (যার উপর শারী‘আতের বিধি-বিধান প্রযোজ্য) হয়
তৃতীয়ত : যদি সে সাওম পালন করতে সক্ষম হয়
চতুর্থত : যদি সে অবস্থানকারী (মুকিম) হয়
পঞ্চমত : যদি সাওম পালনে বাধাদানকারী বিষয়সমূহ তার মধ্যে না পাওয়া যায়
এই পাঁচটি শর্ত যে ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় তার উপর সাওম পালন করা ওয়াজিব।
(প্রথম শর্ত: মুসলিম হওয়া)
প্রথম শর্তের মাধ্যমে একজন কাফির ব্যক্তি এর আওতা বহির্ভূত হয়; একজন কাফিরের জন্য সাওম বাধ্যতামূলক নয়, আর সে তা পালন করলেও শুদ্ধ হবে না। আর যদি সে ইসলাম কবুল করে, তাহলে তাকে সেই দিনগুলোর কাযা করতে আদেশ করা হবে না।
আর এর দলীল হল আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
﴿ وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡهُمۡ نَفَقَٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ وَلَا يَأۡتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمۡ كُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمۡ كَٰرِهُونَ ٥٤ ﴾ [التوبة: ٥٤]
“আর তাদের দানসমূহ কবুল হতে এটিই বাঁধা দিয়েছিল যে তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (মুহাম্মাদ) এর সাথে কুফরী করেছিল এবং তারা শুধু অলসতা বশতই সালাতে উপস্থিত হত আর তারা শুধু বাধ্য হয়েই অনিচ্ছাকৃতভাবে দান করত।” [আত-তাওবাহ : ৫৪]
আর যদি দান-সাদকাহ যার উপকার বহুমুখী, তা তাদের কুফরের কারণে কবুল হয় না, তাহলে বিশেষ ‘ইবাদাতসমূহ (যার উপকার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ) সেগুলো আরও বেশি কবুল না হওয়ার যোগ্য।
আর সে যদি ইসলাম কবুল করে তবে তার কাযা না আদায় করার দলীল হল তাঁর-তা‘আলার বাণী :
﴿قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ وَإِن يَعُودُواْ فَقَدۡ مَضَتۡ سُنَّتُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٣٨ ﴾ [الانفال: ٣٨]
“আপনি তাদেরকে বলুন যারা অবিশ্বাস করেছে যদি তারা বিরত থাকে, তবে তাদের পূর্বে যা গত হয়েছে তা ক্ষমা করে দেয়া হবে।” [আল-আনফাল: ৩৮]
আর এটি তাওয়াতুর (প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, ধারাবাহিক) সূত্রে রাসূল থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি তাকে ছুটে যাওয়া ওয়াজিবসমূহের কাযা করতে আদেশ করতেন না।
আর একজন কাফির যদি ইসলাম কবুল না করে তবে কি সে সিয়াম ত্যাগ করার জন্য আখিরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে?
উত্তর : হ্যাঁ, সে (সেই কাফির) তা (সাওম পালন) ত্যাগ করার জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত হবে, আর সে সমস্ত ওয়াজিবসমূহ ত্যাগ করার জন্যও শাস্তিপ্রাপ্ত হবে কারণ, আল্লাহর প্রতি অনুগত শারী‘আতের বিধান পালনকারী, একজন মুসলিম যদি শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, তবে একজন অহংকারী (কাফির) শাস্তি পাওয়ার আরও বেশি যোগ্য। একজন কাফির যদি আল্লাহর অনুগ্রহসমূহ যেমন-খাবার, পানীয় ও পোশাক ইত্যাদি উপভোগ করার জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, তবে হারাম কাজ করা ও ওয়াজিবসমূহ ত্যাগ করার জন্য শাস্তি পাওয়ার আরও বেশি যোগ্য; আর এটি হল ক্বিয়াস।
আর কুরআন থেকে (এর) দলীল হল, আল্লাহ তা‘আলা ডানপাশে অবস্থানকারীদের সম্পর্কে বলেছেন যে তারা অপরাধীদেরকে (কাফিরদের) বলবেন :
﴿ مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣ وَلَمۡ نَكُ نُطۡعِمُ ٱلۡمِسۡكِينَ ٤٤ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ ٱلۡخَآئِضِينَ ٤٥ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤٦ ﴾ [المدثر: ٤٢، ٤٦]
“কিসে তোমাদেরকে সাক্বারে (একটি জাহান্নামের নাম) প্রবেশ করিয়েছে? তারা বলবে : আমরা সালাত আদায়কারী ছিলাম না, আর আমরা মিসকীনদের খাবার খাওয়াতাম না, আর আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম, আর আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম।” [আল-মুদাসসির : ৪২- ৪৬] সুতরাং এ চারটি বিষয়ই তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করিয়েছে।
(১) “আমরা সালাত আদায়কারী ছিলাম না”, সালাত ;
(২) “আমরা মিসকীনদের খাবার খাওয়াতাম না”, যাকাত;
(৩) “আর আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম”, যেমন, আল্লাহর আয়াত সমূহকে বিদ্রূপ ইত্যাদি করা;
(৪) “আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম”।
(দুই.)
দ্বিতীয় শর্ত : যদি সে মুকাল্লাফ (শারী‘আতসম্মতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত) হয়, আর মুকাল্লাফ হল বালিগ, ‘আক্বিল (বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন) হওয়া। কারণ, ছোট শিশু ও পাগলের উপর কোনো তাকলীফ (শারী‘আতের বিধি-বিধান) প্রযোজ্য হয় না।
আর বুলূগ (বালিগ হওয়া) তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি পাওয়া গেলে সাব্যস্ত হয়। (প্রশ্ন নং (20475) -এ পাবেন)
আর ‘আক্বিলের বিপরীত হল পাগল, অর্থাৎ যে ‘আক্বল (বুদ্ধি-বিবেক) হারিয়েছে এমন পাগল, আর তাই তার ‘আক্বল-বুদ্ধি যে কোন দিক থেকে হারিয়ে ফেলুক না কেন সে মুকাল্লাফ নয়, তার উপর দ্বীনের ওয়াজিব দায়িত্বসমূহ যেমন-সালাত, সিয়াম, ইত্ব‘আম (মিসকীনকে খাওয়ানো) ইত্যাদির কোনো ওয়াজিব দায়িত্বই প্রযোজ্য হয় না, অর্থাৎ তার উপর কোন কিছুই ওয়াজিব হয় না।
(তিন.)
তৃতীয় শর্ত সক্ষম অর্থাৎ যে সিয়াম পালনে সক্ষম। আর যে অক্ষম তার উপর সিয়াম পালন ওয়াজিব নয়, আর এর দলীল আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
﴿وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“আর যে অসুস্থ অথবা ভ্রমণে আছে সে সেই সংখ্যায় অন্য দিনগুলোতে এর ক্বাদ্বা (কাযা) করবে।” [আল-বাকারাহ: ১৮৫]
আর অক্ষমতা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত : অস্থায়ী ও স্থায়ী ।
(১.) আর অস্থায়ী অক্ষমতা উল্লেখিত হয়েছে পূর্বের আয়াতটিতে যেমন-এমন রোগী যার সুস্থতার আশা করা যায় এবং মুসাফির; এ সমস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাওম পালন না করা জায়েয। এরপর তাদের ছুটে যাওয়া সাওম কাযা করা ওয়াজিব।
(২.) আর স্থায়ী অক্ষমতা যেমন-এমন রোগী যার সুস্থতা আশা করা যায় না এবং এমন বৃদ্ধ লোক যিনি সিয়াম পালনে অক্ষম, আর তা উল্লেখিত হয়েছে তাঁর-আল্লাহ তা‘আলার বাণীতে :
﴿وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ﴾ [البقرة: ١٨٤]
“আর যারা সাওম পালনে অক্ষম তারা ফিদয়াহ দিবে (অর্থাৎ মিসকীন খাওয়াবে)।” [আল-বাকারাহ : ১৮৪]
এই আয়াতটিকে ইবনু ‘আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) তাফসীর করে বলেছেন-
“বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যাদের অনেক বয়স হয়েছে তারা যদি সাওম পালনে সক্ষম না হয়, তবে তারা প্রতিদিনের বদলে একজন মিসকীনকে খাওয়াবে।”
(চার.)
চতুর্থ শর্ত : সে যেন মুকীম বা অবস্থানকারী হয়। সুতরাং সে যদি মুসাফির হয় তবে তার উপর সাওম পালন করা ওয়াজিব নয়। এর দলীল হল তাঁর-আল্লাহ তা‘আলা-বাণী :
﴿وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
“আর যে অসুস্থ অথবা ভ্রমণে আছে সে সেই সংখ্যায় অন্য দিনগুলোতে এর কাযা করবে।” [আল-বাকারাহ : ১৮৫]
আর ‘আলিমগণ এ ব্যাপারে ইজমা‘ (ঐকমত্য) প্রকাশ করেছেন যে, একজন মুসাফিরের জন্য সাওম ভঙ্গ করা জায়েয (বৈধ)। আর একজন মুসাফিরের জন্য উত্তম হল তার জন্য যেটা বেশি সহজ তা করা। যদি সাওম পালন করায় তার ক্ষতি হয় তবে তার (মুসাফিরের) জন্য সাওম পালন করা হারাম। এর দলীল হল তাঁর-তা‘আলা বাণী:
﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا ٢٩ ﴾ [النساء: ٢٩]
“তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি দয়াময়।” [আন-নিসা : ২৯]
এই আয়াতটি থেকে এই নির্দেশনা পাওয়া যায় যে,
যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা তার জন্য নিষিদ্ধ। (দেখুন প্রশ্ন নং- (20165)।)
যদি আপনি বলেন সেই ক্ষতির পরিমাণ কতটুকু যা সিয়াম পালনকে হারাম করে?
তবে তার উত্তর হল :
এমন ক্ষতি যা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা সম্ভব অথবা কারো দেয়া তথ্যের মাধ্যমে জানা সম্ভব।
(১.) আর ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা একজন রোগী নিজেই অনুভব করবে যে সাওম পালন করার কারণে তার ক্ষতি হচ্ছে ও তা তার পীড়ার কারণ হচ্ছে যার কারণে সুস্থতা দেরীতে হয় এ ধরণের কিছু।
(২.) আর তথ্যের মাধ্যমে এই ক্ষতি সম্পর্কে জানার অর্থ হল, একজন বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ডাক্তার তাকে (রোগীকে) এ তথ্য দিবে যে সাওম পালন করা তার জন্য ক্ষতিকর।
(পাঁচ.)
পঞ্চম শর্ত : যদি সাওম পালনে বাধাদানকারী বিষয়সমূহ না পাওয়া যায়। আর এটি বিশেষভাবে নারীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং হায়েয হয়েছে ও নিফাস হয়েছে এতদুভয়ের উপর সাওম পালন বাধ্যতামূলক নয়। এর দলীল হল নবীর স্বীকৃতিমূলক বাণী:
«أليس إذا حاضت لم تصل و لم تصم»
“একজন নারীর মাসিক ঋতুস্রাব হলে সে কি সালাত ও সাওম ত্যাগ করে না?” [আল- বুখারী : ২৯৮]
সুতরাং ‘আলিমগণের ইজমা’ তথা সর্বসম্মত মত অনুসারে তার উপর সাওম পালন ওয়াজিব হয় না আর তা পালন করলে শুদ্ধও হয় না। তবে তার উপর এই দিনগুলো কাযা করা ইজমা’ সর্বসম্মতিক্রমে বাধ্যতামূলক। [আশ-শারহুল-মুমতি‘ (৬/৩৩০)]
আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
ফাত্ওয়া নং -38023
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তা‘আলা সর্বোচ্চ হিকমাহ’র আলোকে শারী‘আতে সাওম পালনের বিধান রেখেছেন।
তিনি সাওম পালনকারীকে এমন মধ্যম পন্থায় সাওম পালন করতে বলেছেন; যাতে সে সিয়াম পালনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় আবার এমন কিছুও গ্রহণ না করে যা সিয়ামের বিপরীত।
তাই সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ দু ধরণের :
(এক.) কিছু সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যা শরীর থেকে নির্গত হয় এমন ধরণের যেমন-যৌন মিলন, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা, মাসিক ঋতুস্রাব, শিঙ্গা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যা শরীর থেকে বের হয় ও তা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে সিয়াম বিনষ্টকারী বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন; যাতে করে সাওম পালনের দুর্বলতা এসব বস্তু নির্গত হওয়ার কারণে সৃষ্ট দুর্বলতার সাথে যোগ হওয়ার ফলশ্রুতিতে একজন সাওম পালনকারী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; ফলে সাওম তার স্বাভাবিক মধ্যম পন্থার সীমারেখা অতিক্রম করে।
(দুই.) কিছু সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যা (শরীরে) প্রবেশ করে এমন ধরণের যেমন-খাওয়া, পান করা ইত্যাদি। একজন সাওম পালনকারী যদি কিছু খায় বা পান করে, তবে সিয়াম পালনের মাধ্যমে উদ্দিষ্ট হিকমাহ অর্জিত হয় না। [মাজমূ‘উল ফাত্ওয়া (২৫/২৪৮)]
আর আল্লাহ তা‘আলা মূল সিয়াম বিনষ্টকারী বিষয়সমূহকে একসাথে উল্লেখ করেছেন তাঁর এই বাণীতে :
﴿فَٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ﴾ [البقرة: ١٨٧]
“সুতরাং এখন (রমযানের রাতে) তোমরা তাদের (তোমাদের স্ত্রীদের) সাথে মিলন কর, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন তার খোঁজ কর, আর খাও ও পান কর যতক্ষণ পর্যন্ত না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অতঃপর রাত (যার প্রারম্ভ সূর্য) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর।” [আল-বাকারাহ: ১৮৭]
আল্লাহ তা‘আলা এই সম্মানিত আয়াতে মূল সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ উল্লেখ করেছেন। আর তা হল-(১) খাওয়া (২) পান করা ও (৩) যৌন মিলন।
আর সিয়াম বিনষ্টকারী যাবতীয় বিষয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাহতে ব্যাখ্যা করেছেন।
সিয়াম বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ সাতটি, আর তা হল :
১. যৌন মিলন
২. ইসতিমনা’ (নিজস্ব ক্রিয়া/হস্তমৈথুন)
৩. খাওয়া ও পান করা
৪. যা খাওয়া ও পান করার অর্থে পড়ে
৫. হিজামাহ বা শিঙ্গা ইত্যাদির মাধ্যমে রক্ত বের করা
৬. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা
৭. একজন নারীর (শরীর) থেকে হায়েয (মাসিক) ও নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত) –এর রক্ত বের হওয়া।
(এক.) সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের প্রথমটি হল : যৌন মিলন
এটি সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের মাঝে সবচেয়ে মারাত্মক ও সবচেয়ে গুনাহের যোগ্য।
যে রমযান মাসে দিনের বেলা ইচ্ছাকৃতভাবে যৌন মিলন করে, যাতে করে দুই (পুরুষ ও নারীর) খিতান (খাতনা করা স্থানসমূহ) একত্রিত হয় এবং দুই গুপ্তাঙ্গের যে কোন একটির হাইমেন লুপ্ত হয় (পড়ে যায়), তবে সে তার সাওম নষ্ট করল, বীর্যপাত ঘটাক বা নাই ঘটাক, এক্ষেত্রে
(১) তার তাওবাহ করতে হবে
(২) সেদিনের বাকি অংশ ( সাওম রেখে) পূর্ণ করতে হবে
(৩) সেদিনের সাওম কাযা করতে হবে
(৪) বড় কাফফারাহ আদায় করতে হবে।
এর প্রমাণ হচ্ছে, আবূ হুরাইরাহ -রাদিয়াল্লাহু আনহু- থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন :
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ : هَلَكْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ: وَمَا أَهْلَكَكَ ؟ قَالَ : وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِي فِي رَمَضَانَ . قَالَ : هَلْ تَجِدُ مَا تُعْتِقُ رَقَبَةً ؟ قَالَ : لا . قَالَ : فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ ؟ قَالَ : لا . قَالَ : فَهَلْ تَجِدُ مَا تُطْعِمُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ؟ قَالَ : لا .. . الحديث رواه البخاري (1936) ومسلم (1111)
“এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, ‘আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছি হে রাসূলুল্লাহ! তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন, ‘আর কিসে আপনাকে ধ্বংস করল? সে ব্যক্তি বললেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর সাথে রমযানে (দিনের বেলা যৌন) মিলন করেছি।’ তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন, ‘আপনি কি একজন দাস মুক্ত করতে পারেন?’ তিনি (সে ব্যক্তি) বললেন, ‘না’। তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন, ‘তবে কি আপনি একাধারে দুই মাস সাওম পালন করতে পারেন?’ তিনি (সে ব্যক্তি) বললেন, ‘না’। তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন, ‘তবে কি আপনার কিছু আছে যা দিয়ে ষাটজন মিসকীন খাওয়াতে পারেন?’ তিনি (সে ব্যক্তি) বললেন, ‘না’।........ [বুখারী (১৯৩৬) ও মুসলিম (১১১১)]
যৌন মিলন ছাড়া অন্য কোনো সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়ের ক্ষেত্রে কাফফারাহ ওয়াজিব হয় না।
(দুই.) সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের দ্বিতীয়টি হল-নিজস্ব ক্রিয়া বা হস্তমৈথুন। আর তা হল হাত বা ইত্যাদি দিয়ে বীর্য বের করা। হস্তমৈথুন যে সিয়াম ভঙ্গকারী তার দলীল হচ্ছে, হাদীসে কুদসীতে সাওম পালনকারী সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
«يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي» رواه البخاري (1894) ومسلم (1151) .
“যে তার খাবার, পানীয় ও কামনা বাসনা আমার জন্য ত্যাগ করে” [বুখারী (১৮৯৪) ও মুসলিম (১১৫১)]
আর বীর্য নির্গত করা কামনা বাসনার মাঝে পড়ে যা একজন সাওম পালনকারীকে পরিত্যাগ করতে হবে।
যে রমযান মাসের দিনের বেলা হস্তমৈথুন করে, তার উপর ওয়াজিব হল
(১) আল্লাহর কাছে তাওবা করা,
(২) দিনের বাকি অংশ সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা এবং
(৩) সেদিনের সাওমের কাযা করা।
যদি সে হস্তমৈথুন শুরু করে থেমে যায় এবং বীর্যপাত না ঘটায়, তবে তাকে তাওবাহ করতে হবে, আর তার সাওম শুদ্ধ হবে, বীর্যপাত না ঘটানোর জন্য তাকে সাওম কাযা করতে হবে না। একজন সাওম পালনকারী কামভাব উদ্রেককারী সকল বিষয় থেকে দূরে থাকা উচিৎ এবং খারাপ চিন্তা-ভাবনা রোধ করা উচিৎ।
আর মাযী এর ক্ষেত্রে শক্তিশালী মতটি হল এতে সাওম ভঙ্গ হয় না।
(তিন.) সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের তৃতীয়টি হল খাওয়া ও পান করা, আর তা হল মুখের মাধ্যমে খাদ্য ও পানীয় পাকস্থলীতে পৌঁছানো। একইভাবে যদি নাক দিয়ে পাকস্থলীতে কোনো কিছু প্রবেশ করানো হয় তবে তা খাওয়া ও পান করারই সমতূল্য।
তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«وَبَالِغْ فِي الاسْتِنْشَاقِ إِلا أَنْ تَكُونَ صَائِمًا » رواه الترمذي (788) . وصححه الألباني في صحيح الترمذي ( 631 )
“ওযুর সময় নাকে পানি গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করাও যদি না তুমি সাওম পালনকারী হও।” [তিরমিযী (৭৮৮) আলবানী ‘সহীহ আত-তিরমিযী’(৬৩১) গ্রন্থে একে সহীহ বলেছেন]
যদি নাকের মাধ্যমে পানি পাকস্থলীতে প্রবেশ করা সাওমের উপর প্রভাব না ফেলত, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকে ওযুর সময় গভীরভাবে পানি প্রবেশ করাতে নিষেধ করতেন না।
(চার.) সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের চতুর্থটি হল, যা খাওয়া ও পান করার অর্থে পড়ে। আর এর মাঝে দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত :
ক) সাওম পালনকারীর শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রবেশ করানো, যেমন, সে যদি রক্তপাতের শিকার হয় তবে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রবিষ্ট করা হলে তার সাওম ভেঙ্গে যাবে; কারণ খাদ্য ও পানীয়ের দ্বারা খাবার গ্রহণেল সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে রক্ত তৈরী হওয়া।
খ) খাদ্য ও পানীয়ের স্থলাভিষিক্ত হয় এমন খাবার জাতীয় ইনজেকশন; কারণ তা খাদ্য ও পানীয়ের অন্তর্ভুক্ত।
[আশ-শাইখ ইবনু ‘উসাইমীনের ‘মাজালিস শাহর রমযান’ এ (পৃ. ৭০) ]
তবে যেসব ইনজেকশন যা খাদ্য ও পানীয়ের বদলে ব্যবহৃত হয় না, তবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যেমন –পেনসিলিন, ইনসুলিন ইত্যাদি অথবা শরীরকে তৎপর করার জন্য বা ভ্যাকসিনের জন্য পেশীর মাধ্যমে যে ইনজেকশন দেওয়া হয়, তা সিয়ামের ক্ষতি করে না। [ফাত্ওয়া মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম (৪/১৮৯)]
তবে বেশি সাবধানতা হল এসব রাতের বেলা হওয়া।
আর কিডনী ডায়ালাইসিস, যার জন্য তা পরিষ্কার করতে রক্ত বের করে তা কেমিক্যাল পদার্থ, পুষ্টি দানকারী উপাদান যেমন – চিনি, লবণ ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে আবারো তাতে (কিডনীতে) প্রবেশ করানো হয়, তা সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় বলে গণ্য হবে।
[ফাত্ওয়া আল-লাজ্নাহ আদ-দা’ইমাহ (১০/১৯)]
(পাঁচ.) সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহের পঞ্চমটি হল- শিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করা।
এর দলীল হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :
«أَفْطَرَ الْحَاجِمُ وَالْمَحْجُومُ» رواه أبو داود (2367) وصححه الألباني في صحيح أبي داود (2047)
“হাজিম বা শিঙ্গা প্রদানকারী (যে রক্ত বের করে) এবং মাহজূম বা শিঙ্গা গ্রহণকারী (যার রক্ত বের করা হয়) উভয়ই সাওম ভঙ্গ করল।” [আবূ দাঊদ (২৩৬৭) এবং আল-আলবানী ‘সহীহ আবী দাঊদ’ এ (২০৪৭) একে সহীহ বলেছেন]
আর রক্ত দান করা, হিজামাহ বা শিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করার অর্থে পড়ে; কারণ তা শিঙ্গার মতই শরীরের উপর প্রভাব ফেলে।
আর তাই একজন সাওম পালনকারীর রক্ত দান করা জায়েয নয়; যদি না একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে, একান্ত প্রয়োজন হলে তার জন্য রক্ত দান করা জায়েয। এক্ষেত্রে রক্ত দানকারীর সাওম ভঙ্গ হয় এবং তাকে সে দিনের কাযা করতে হবে।
[ইবনু ‘উসাইমীনের ‘মাজালিস শাহর রমযান’ (পৃঃ৭১)]
আর যার রক্তপাত হয়েছে, তার সিয়াম শুদ্ধ হবে কারণ সে তা ইচ্ছাকৃতভাবে করে নি। [ফাত্ওয়া আল-লাজ্নাহ আদ-দায়েমাহ (১০/২৬৪)]
আর দাঁত তোলা বা ক্ষতস্থান ড্রেসিং বা রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদির জন্য রক্ত বের হলে তা সাওম ভঙ্গ করে না; কারণ তা হিজামাহ বা শিঙ্গা লাগানো নয়, এর অর্থেও পড়ে না। কারণ তা হিজামাহ বা শিঙ্গা লাগানোর ন্যায় শরীরের উপর প্রভাব ফেলে না।
(ছয়.) ষষ্ঠ সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা। এর দলীল হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :
«مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ ، وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ». رواه الترمذي (720) صححه الألباني في صحيح الترمذي (577)
“যার অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি আসে, তাকে কাযা করতে হবে না; আর যে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে, সে যাতে কাযা করে।”
[আত-তিরমিযী (৭২০) এবং আল-আলবানী ‘সহীহ আত তিরমিযী’-(৫৭৭) তে একে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন ]
আর ইবনুল মুনযির বলেছেন :
“‘আলিমগণের মাঝে এ ব্যাপারে ইজমা‘ (ঐকমত্য) রয়েছে যে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা সাওম বাতিল করে।” [আল-মুগনী (৪/৩৬৮)]
সুতরাং যে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বা পেট চেপে বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোন দুর্গন্ধ শুঁকে বা বমি আসে এমন কিছুর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করল, তাকে কাযা করতে হবে।
যদি তার পাকস্থলী ফেঁপে বমি আসে তবে তার বমি রোধ করা বাধ্যতামূলক নয় কারণ তা তার ক্ষতির কারণ হবে।
[ ইবন ‘উসাইমীনের ‘মাজালিস শাহর রমযান’ (পৃঃ৭১)]
(সাত.) সপ্তম সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় হল: হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) ও নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত) –এর রক্ত বের হওয়া। এর দলীল হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী :
«أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ» . رواه البخاري (304)
“একজন নারীর হায়েয (মাসিক) হলে সে কি সালাত ও সাওম ত্যাগ করে না?” [বুখারী (৩০৪)]
তাই যখনই কোনো নারী হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) বা নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত) –এর রক্ত দেখে, তখনই তার সাওম ফাসিদ (বিনষ্ট) হয়ে যায়, তা সূর্যাস্তের এক মুহূর্ত আগেও হোক না কেন।
যদি কোনো নারী হায়েযের (মাসিক ঋতুস্রাব) রক্ত চলাচল অনুভব করে আর তা সূর্যাস্ত পর্যন্ত বের না হয়, তবে তার সাওম শুদ্ধ হবে এবং তার সেদিনের জন্য যথেষ্ট হবে।
একজন হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব ওয়ালী) বা নুফাসা (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত ওয়ালী) নারীর যদি রাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয় ও সে সিয়াম পালনের নিয়্যাত করে এবং তার গোসল করার আগেই সূর্য উদিত হয়, তবে সকল ‘আলেম’ এর মতেই তার সে সাওম শুদ্ধ হবে। [আল-ফাতহ (৪/১৪৮)]
একজন হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব ওয়ালী) নারীর জন্য উত্তম হল তার স্বভাবজাত প্রকৃতির উপর থাকা, আল্লাহ তার জন্য যা লিখে রেখেছেন তার উপর সন্তুষ্ট থাকা, রক্ত বন্ধ করে এমন কিছু গ্রহণ না করা এবং হায়েয তথা হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) এর সময় সাওম ভঙ্গ করা ও পরে তা কাযা করার যে বিধান আল্লাহ তার জন্য প্রদান করেছেন, তা গ্রহণ করা। এমনই ছিলেন উম্মুল মুমিনীনগণ, পরবর্তী সাহাবী ও তাবি‘ঈগণের নারীরা।
[ফাত্ওয়া আল-লাজ্নাহ আদ-দা’ইমাহ (১০/১৫১)]
এছাড়া উল্লেখযোগ্য যে চিকিৎসাবিজ্ঞানে রক্তপাত রোধকারী উপাদান সমূহের বহুমুখী ক্ষতি প্রমাণিত হয়েছে এবং অসংখ্য নারী এর ফলশ্রুতিতে অনিয়মিত হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) হওয়া জনিত বিপদের শিকার হয়েছে। তবে কোনো নারী যদি তা করে ও এমন কিছু গ্রহণ করে যা তার রক্তপাত বন্ধ করে এবং পবিত্র অবস্থায় সাওম পালন করে, তবে তার সেদিনের সাওম যথেষ্ট (শুদ্ধ) হবে।
এগুলো হল সাওম ফাসিদকারী (বিনষ্টকারী) বিষয়সমূহ। এগুলোর কারণে - হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) ও নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত) ব্যতীত - একজন সাওম পালনকারীর সাওম ভঙ্গ হয় না যদি না তার মাঝে তিনটি শর্ত পাওয়া যায় :
(১) সে যদি এ ব্যাপারে জেনে থাকে অর্থাৎ অজ্ঞ না হয়।
(২) তার যদি এ ব্যাপারে স্মরণ থাকে অর্থাৎ ভুলে না যায়।
(৩) সে যদি এ ব্যাপার ইচ্ছাকৃতভাবে করে অর্থাৎ বাধ্য হয়ে না করে।
আর আমাদের আরও জানা উচিৎ কিছু বিষয় যা সাওম ভঙ্গ করে না:
১। এনেমাস, চোখের ড্রপ, কানের ড্রপ, দাঁত তোলা, ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা এসব সাওম ভঙ্গ করে না। [মাজমূ ফাত্ওয়া শাইখুল-ইসলাম (২৫/২৩৩), (২৫/২৪৫)]
২।এজমা (শ্বাসকষ্ট) চিকিৎসায় যে ঔষধ জাতীয় ট্যাবলেট বা এ জাতীয় বস্তু জিভের নিচে রাখা হয় তা সাওম ভঙ্গ করে না; যদি না গিলে ফেলা হয়।
৩। ভ্যাজাইনাতে সাপোসিটরী, লোশন, দুরবিক্ষণ যন্ত্র, ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য যে আঙ্গুল প্রবেশ করানো হয়, তা সাওম ভঙ্গ করে না।
৪। মাতৃগর্ভে স্পেকুলাম ইত্যাদি প্রবেশ করানো বা আই.ইউ.ডি (I.U.D) সাওম ভঙ্গ করে না।
৫।পুরুষ ও নারীর ইউরিনারী ট্র্যাক্টে যে ক্যাথেটার, স্কোপ বা অপাকিউ ডাই প্রবেশ করানো হয়, এক্স-রে এর জন্য এবং ব্লাডার ধৌতকরণে যে ঔষধ বা মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়, তা সাওম ভঙ্গ করে না।
৬। দাঁত ফিলিং, উঠানো, পরিষ্কার করা বা মিসওয়াক, টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা সাওম ভঙ্গ করে না যদি না গলায় পৌঁছে এমন কিছু গিলে ফেলা হয়।
৭। কুলি করা, গরগরা করা, চিকিৎসার্থে মুখ দিয়ে স্প্রে গ্রহণ সাওম ভঙ্গ করে না, যদি না গলায় পৌঁছে এমন কিছু গিলে ফেলা হয়।
৮। অক্সিজেন বা এনেসথেসিয়ার জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সাওম ভঙ্গ করে না যদি না রোগীকে পুষ্টি দানকারী তরল দেয়া হয়।
৯। ক্রিম, মলম বা চিকিৎসার্থে চামড়ায় ব্যবহৃত প্লাস্টার যাতে ওষুধ বা কেমিক্যাল পদার্থ থাকে ইত্যাদির কোন কিছু শরীরের চামড়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হলে, তা সাওম ভঙ্গ করে না।
১০। শিরায়, হার্টের কোনো অংশে বা অন্য কোনো অঙ্গে চিকিৎসার্থে ডায়গোনোস্টিক ছবি নেওয়ার জন্য ক্যাথেটার (চিকন টিউব) প্রবেশ করানো হলে, তা সাওম ভঙ্গ করে না।
১১। পেটের প্রাচীর দিয়ে ইনটেসটাইন পরীক্ষার বা সার্জিকাল অপারেশন পরিচালনার জন্য স্কোপ প্রবেশ করানো হলে তা সাওম ভঙ্গ করে না।
১২। লিভারের বা অন্য কোনো অঙ্গের বায়োপসি করা যদি কোনো রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত তরলের সাথে না হয় তবে তা সাওম ভঙ্গ করে না।
১৩। এন্ডোসকপি করা হলে এর সাথে যদি কোন রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত তরল প্রবেশ করানো না হয় তবে তা সাওম ভঙ্গ করে না।
১৪। ব্রেইন বা স্পাইনাল কার্ড এ কোনো ইন্সট্রুমেন্ট বা ওষুধ জাতীয় পদার্থ প্রবেশ করানো হয় তবে তা সাওম ভঙ্গ করে না।
দেখুন, আশ-শাইখ ইবনু ‘উসাইমীনের ‘মাজালিস শাহর রমযান’ ও এই ওয়েবসাইটের (www.islam-qa.com) বই পত্র বিভাগের ‘সিয়াম সংক্রান্ত ৭০টি মাস‘আলাহ ’ শিরোনামের বুকলেটটি।
এবং আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ফাত্ওয়া নং - 26863
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
রমযান মাসের সাওমের নিয়্যাত রাতে ফজরের আগে করাটা ওয়াজিব। আর ঐদিন নিয়্যাত ছাড়া দিনের বেলা সাওম রাখাটা শুদ্ধ হবে না। কেউ যদি পূর্বাহ্নে এসে জানতে পারে যে আজকে রমযান তাহলে সে রোযার নিয়্যাত করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং পরবর্তীতে তাকে কাযা করতে হবে, কারণ, ইবনু ‘উমার, হাফসাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«من لم يجمع الصيام قبل الفجر فلا صيام له»
“যে ফাজ্রের আগে সিয়ামের নিয়্যাত বাঁধে না, তার কোনো সিয়াম নেই।” [ইমাম আহমাদ , আস-সুনানের সংকলকগণ, ইবনু খুযাইমাহ এবং ইবনু হিব্বান বর্ণনা করেছেন; এবং শেষের দুজন এই হাদীসটিকে সহীহ এবং মারফূ‘ বলে সাব্যস্ত করেছেন।]
এটি ফরয রোযার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নাফল রোযার ক্ষেত্রে দিনের বেলায় নিয়্যাত করার অনুমতি আছে। যদি আপনি ফাজরের পরে খাওয়া বা পান করা বা যৌন মিলন থেকে বিরত থাকেন। কারণ, ‘‘আয়েশাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর নিকট পূর্বাহ্নে এসে বললেন,
«هل عندكم شيء؟»
“তোমাদের কাছে কিছু (খাবার)আছে কি?” ‘‘আয়েশাহ্ বললেন, “না।” তিনি বললেন :
« إني إذاً صائم» خرجه مسلم في صحيحه
“তাহলে আমি সাওম (রোযা) রাখলাম।” [এটি মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে তে বর্ণনা করেছেন]
আর আল্লাহই তাওফীক্ব দাতা। আর আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সাহাবীগণের উপর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন।
গবেষণা ও ফাত্ওয়া ইস্যুকারী আল-লাজ্নাহ আদ-দায়েমাহ (১০/২৪৪)
ফাত্ওয়া নং - 5595
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ জন্য।
প্রথমত : যখন কোনো নারীর মাসিক হয় তখন তা থেকে তার পবিত্রতার চিহ্ন হল রক্ত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া তা কম বা বেশি সময়ের জন্য হোক না কেন। ফক্বীহগণের অনেকের মতে, মাসিকের সর্বনিম্ন সময় এক দিন এক রাত এবং সর্বোচ্চ সময় ১৫ দিন।
তবে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ-রাহিমাহুল্লাহ- এর মতে, মাসিকের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সময়ের কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। বরং যতক্ষণ তার মধ্যে মাসিকের (রক্তের) বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান থাকবে তখনই সেটা হায়েয (মাসিক) হিসেবে গণ্য হবে। তিনি বলেছেন :
“হায়েয (মাসিক), আল্লাহ এর সাথে কুরআন ও সুন্নাহ এ অনেক রকম বিধি-বিধান (বিধি বিধান) সম্পৃক্ত করেছেন, আর এর কোনো সর্বনিম্ন বা সর্বোচ্চ নির্দিষ্ট করে দেন নি, দুই হায়েযের মাঝখানে পবিত্রতার সময়টিও নির্ধারণ করে দেন নি। কারণ, এতে করে মানুষের জন্য শরী‘আতের বিধান পালন করা কষ্টকর হয়ে পড়ে ... ”
এরপর তিনি বলেছেন : “আর ‘আলেমগণের মাঝে অনেকে এর (মাসিকের )সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সময় নির্ধারণ করেছেন। এরপর সেই নির্ধারিত সময়ের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আবার তাঁদের মধ্যে অনেকে সর্বোচ্চ সময় নির্ধারণ করলেও সর্বনিম্ন সময় নির্ধারণ করেন নি। তবে এখানে তৃতীয় মতটি বেশি সঠিক, আর তা হল: এর (মাসিকের) সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সময়ের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই।” [মাজমূ‘উল ফাত্ওয়া (১৯/২৩৭ )]
দ্বিতীয়ত : এছাড়া আরও এক ধরণের রক্ত আছে যাকে ইসতিহাযা বলে, যা হায়েযের রক্ত থেকে আলাদা। এর বিধি-বিধান হায়েযের বিধি-বিধান থেকে আলাদা। আর এই রক্তকে হায়েযের রক্ত থেকে নিচের কয়েকটি গুণাবলী দ্বারা পৃথক করা যায়:
রং - হায়েযের রক্ত কালচে আর ইসতিহাযার রক্ত লাল।
ঘনত্ব - হায়েযের রক্ত ঘন, গাঢ় আর ইসতিহাযার রক্ত পাতলা।
ঘ্রাণ - হায়েযের রক্ত দুর্গন্ধযুক্ত আর ইসতিহাযার রক্ত দুর্গন্ধযুক্ত নয়; কারণ এটি শিরার স্বাভাবিক রক্ত।
জমাটবদ্ধতা - হায়েযের রক্ত বের হওয়ার পর জমাট বাঁধে না কিন্তু ইসতিহাযা’র রক্ত জমাট বাঁধে, কারণ তা শিরার রক্ত।
হায়েযের কারণে সালাত নিষিদ্ধ হয় আর ইসতিহাযার কারণে সালাত নিষিদ্ধ হয় না বরং সে নারী পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং প্রতি সালাতের জন্য ওযু করবে যদি পরবর্তী ওয়াক্বতের সালাত পর্যন্ত রক্ত পড়া অব্যাহত থাকে, এমনকি সালাত আদায়ের সময়েও যদি এ রক্ত পড়তে থাকে তবে তাতে সালাতের কোনো সমস্যা হবে না।
মূলনীতিটি হল, নির্গত হওয়া রক্ত হায়েযের (মাসিকের) রক্ত হিসেবেই ধর্তব্য হবে; যদি না তা প্রবাহমান হয় এবং গোটা মাস জুড়ে অব্যাহত থাকে, (তখন তা ইস্তেহাযার রক্ত বিবেচিত হবে) এ হচ্ছে শাইখুল ইসলামের মত। অথবা হায়েযের (মাসিকের) সর্বোচ্চ সময়সীমা ১৫ দিনের বেশি অতিক্রান্ত হলে তবে অধিকাংশ ‘আলেমের মতে তা ইস্তিহাযা-এর রক্ত বলে বিবেচিত হবে।
তৃতীয়ত : একজন নারী তার পবিত্রতা দুটো চিহ্নের যে কোনো একটির মাধ্যমে জানতে পারে:
(১) শ্বেতস্রাব (আল-ক্বাসসাতুল বাইদ্বা’) : আর তা হল একধরনের সাদা তরল পদার্থ যা জরায়ু থেকে বের হয়, এটি পবিত্রতার একটি চিহ্ন।
(২) পূর্ণ শুষ্কতা: যদি কোনো নারীর এই শ্বেতস্রাব না আসে, সেক্ষেত্রে সে রক্ত বের হওয়ার স্থানে সাদা তুলো প্রবেশ করাবে, তা যদি পরিষ্কার অবস্থায় বের হয় তবে সে জানবে যে সে পবিত্র হয়ে গেছে, এরপর সে গোসল করে সালাত আদায় করবে।
আর যদি সে তুলো লাল, হলুদ ও খয়েরী রঙ এর বের হয় তাহলে সে সালাত আদায় করবে না।
আর মহিলা সাহাবীগণ, ‘‘আয়েশাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর কাছে পাত্রে করে তুলো পাঠাতেন যাতে হলদে রঙ (এর স্রাব) থাকতো। তিনি ‘আয়েশাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন : “আপনারা শ্বেতস্রাব না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করবেন না।”
[এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী মু‘আল্লাক্ব হিসেবে, (কিতাব আল-হায়েয, বাব ইক্ববাল আল-মাহীদ্ব ওয়া ইদবারিহ) ও মালিক (১৩০)]
তবে যদি এই হলদে বা খয়েরী রঙ এর স্রাব সে নারীর পবিত্রতার দিনগুলোতে (শ্বেতস্রাব বের হওয়ার পর) আসে, তা ধর্তব্য হবে না এবং সে নারী তার সালাত ত্যাগ করবে না, গোসলও করবে না [তবে তা পরিষ্কার করে ওযু করবে] কারণ তা গোসল ওয়াজিব করে না, আর তা থেকে অপবিত্রও হয় না।
এর দলীল হল উম্মু ‘আত্বিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস :
كنا لا نعد الصفرة والكدرة بعد الطهر شيئاً . رواه أبو داود (307) ، ورواه البخاري ( 320 ) ولم يذكر " بعد الطهر " .
“আমরা পবিত্রতার পর হলদে বা খয়েরী স্রাবকে কোনো কিছু হিসেবে (হায়েয হিসেবে) গণ্য করতাম না।”
[এটি বর্ণনা করেছেন আবু দাঊদ (৩০৭), আর বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (৩২০) তবে “পবিত্রতার পর’’ কথাটি উল্লেখ করেন নি]
‘কুদ্রাহ’ বা খয়েরী স্রাব ময়লা পানির ন্যায়। ‘কোন কিছু হিসেবে (হায়েয হিসেবে) গণ্য করতাম না’ অর্থাৎ হায়েয হিসেবে গণ্য করতাম না তবে এতে ওযু করা ওয়াজিব হয়।
তবে যদি খয়েরী বা হলুদ স্রাব হায়েযের সাথে বের হয় তবে তা হায়েযের মধ্যে বলে গণ্য হবে।
চতুর্থত : যদি কোনো নারী মনে করে যে সে পবিত্র হয়েছে এবং এরপর রক্ত ফিরে আসে এবং সেই রক্ত হায়েযের বৈশিষ্ট্য বহন করে তবে তা হায়েয (মাসিক)। যদি না গোটা মাস জুড়ে অব্যাহত থাকে।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
ফাত্ওয়া নং - 106452
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
“তার রোযাটি হয়নি এবং তাকে তার কাযা করতে হবে, কারণ, মূল নীতিটি হচ্ছে তার মাসিক চলছিল, তার পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে রোযা শুরু করার অর্থ হল সন্দেহের সাথে ‘ইবাদাত শুরু করা। আর নিশ্চিত হয়ে কোন ‘ইবাদাত শুরু করা হল সেই ‘ইবাদাত শুদ্ধ হওয়ার একটি শর্ত, এই কারণেই তার রোযাটি হয়নি।” উদ্ধৃতির সমাপ্তি।
ফাদ্বীলাতুশ শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ‘উসাইমীন।
[‘মাজমূ‘ ফাত্ওয়া ইবন ‘উসাইমীন’, ফাত্ওয়া আস-সিয়াম (১০৭,১০৮)]
ফাত্ওয়া নং - 66062
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
একজন হায়েয ওয়ালী বা ঋতুবতী নারীর মাসিক শেষ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার আগে হায়েয থেকে গোসল করা, সালাত আদায় করা ও সিয়াম পালন করায় তাড়াহুড়ো করা জায়েয (বৈধ) নয়।
আর একজন নারী তার হায়েয (মাসিক) শেষ হওয়ার ব্যাপারটি জানতে পারে সাদা স্রাব বের হওয়ার মাধ্যমে যা তাদের (নারী সমাজে) পরিচিত, আর তা হল, আল-ক্বাস্বস্বাতুল বাইদ্বা’ (শ্বেতস্রাব)। আর নারীদের কেউ কেউ তার পবিত্রতা রক্তের পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জানতে পারে।
সুতরাং একজন নারীর উচিৎ পবিত্রতার ব্যাপারে (পুরোপুরি) নিশ্চিত না হয়ে গোসল করবে না করা।
ইমাম আল-বুখারী ‘ইক্ববাল আল-মাহীদ্ব ওয়া ইদবারিহ’ অধ্যায়ে বলেছেন: ‘আর মহিলা সাহাবীগণ ‘আয়েশাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে পাত্রে করে তুলো পাঠাতেন যাতে হলদে রঙ থাকতো। তিনি বলতেন : ‘আপনারা শ্বেতস্রাব না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করবেন না।’ তিনি এর দ্বারা হায়েয থেকে পবিত্র হওয়া বোঝাতেন। যায়িদ ইবনু সাবিতের কন্যার কাছে এই বর্ণনা পৌঁছেছে যে নারীরা গভীর রাতে আলোকবাতির সাহায্যে পবিত্রতা এসেছে কিনা তা দেখতেন। তিনি ‘নারীরা এরূপ করত না’ বলে তাঁদের সমালোচনা করেন।” সমাপ্ত
হাফিয ইবনু হাজার –রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন:
‘আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, হায়েযের শুরু বোঝা যায় তা হওয়ার সময় রক্ত পড়ার মাধ্যমে এবং তারা তা শেষ হওয়ার ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
কেউ বলেছেন, তা জানা যায় শুষ্কতার মাধ্যমে; আর তা হল সেখানে কোন কিছু প্রবেশ করালে তা যদি শুষ্ক অবস্থায় বের হয়।
আবার কেউ বলেন তা জানা যাবে শ্বেতস্রাব এর মাধ্যমে। আর এই মতটি লেখক- অর্থাৎ ইমাম আল-বুখারী প্রাধান্য দিয়েছেন।”
আর এতে আছে, শ্বেতস্রাব হায়েয শেষ হওয়ার চিহ্ন। আর এ দ্বারা পবিত্রতা শুরু হয়েছে তা বোঝা যায়। আর তিনি তাঁদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন যাদের মতে এটি (পবিত্রতা) শুষ্কতার মাধ্যমে বোঝা যায়; কারণ, হায়েযের মাঝেও (ভেতরে প্রবেশ করানো) তুলো শুষ্ক অবস্থায় বের হতে পারে, সে ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে হায়েয শেষ হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না, যা শ্বেতস্রাব এর বিপরীত। আর তা এক ধরণের সাদা তরল যা জরায়ু হায়েযের শেষে বের করে দেয়।
ইমাম মালিক বলেছেন:
“আমি নারীদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি, এটি তাদের মধ্যে পরিচিত একটি ব্যাপার যা তারা পবিত্রতার সময় দেখা যায়।” সমাপ্ত। [ফাত্হুল-বারী, (১/৪২০)]
শাইখ ইবনু ‘উসাইমীন- রাহিমাহুল্লাহ তা‘আলা-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল হায়েয ওয়ালী (ঋতুবতী নারী) যদি ফাজরের আগে পবিত্র হয় ও পরে গোসল করে তবে তার হুকুম কি?
তিনি এর উত্তরে বলেন :
“তার সাওম সঠিক হয়েছে যদি সে ফাজর উদিত হওয়ার (অর্থাৎ ফাজরের সময় শুরু হওয়ার) আগে পবিত্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। মূলনীতিটি হল, একজন নারীকে সে যে পবিত্র হয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে কারণ, নারীদের কেউ কেউ মনে করে যে সে পবিত্র হয়েছে, কিন্তু আসলে সে পবিত্র হয় নি। এ কারণে মহিলা সাহাবীগণ ‘আয়েশাহ্ -রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর কাছে তুলো নিয়ে আসতেন এবং পবিত্রতার চিহ্ন এসেছে কিনা তা জানতে তাঁকে তা দেখাতেন, তিনি (‘আয়েশাহ্) তাঁদেরকে বলতেন :
“আপনারা শ্বেতস্রাব না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করবেন না।”
তাই একজন নারীর উচিৎ ধীরস্থির ভাবে নিশ্চিত হওয়া যে সে পবিত্র হয়েছে কি না। সে পবিত্র হলে সাওম পালনের নিয়্যাত করবে যদিও বা সে ফাজর উদিত হওয়ার (অর্থাৎ ফাজরের সময় শুরু হওয়া) পরে গোসল করে, তবে তার উচিৎ সালাতের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া এবং সময় মত ফাজরের সালাত পড়ার জন্য তাড়াতাড়ি গোসল করে নেওয়া…”
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইবন ‘উসাইমীন (১৭/প্রশ্ন নং-৫৩)]
আর প্রশ্নকারিণী এমন সময়ে গোসল করেছেন যখন তিনি হায়েয শেষ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হন নি, আর তিনি হায়েয থেকে তাঁর পবিত্রতার ব্যাপারে দেরীতে জানতে পেরেছেন, আর তা ছিল যা তার বক্তব্য অনুসারে সূর্য অস্ত যাওয়ার পরে।
সে কারণে প্রশ্নকারিণী যা করেছেন তা সঠিক হয় নি এবং তার সে দিনের সাওম শুদ্ধ হয় নি। তাই তাকে সেই দিনের কাযা করতে হবে।
আমরা আল্লাহর কাছে তাঁর (প্রশ্নকারিনীর জন্য) উপকারী জ্ঞান ও ভালো কাজের তাওফীক্ব চাই।
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।