লগইন করুন
এক: একটি বা দু’টি হাদীস কোনো ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করা দ্বারা কোনো মতেই একথা সাব্যস্ত করা যায় না যে, বর্ণনাকারী ঐ ব্যক্তির ছাত্র ছিলেন। যেমন ইমাম আহমাদ ও অন্য সুন্নীরা ‘মুহাম্মদ ইবন ফুযাইল ইবন গাযওয়ান আদ্দব্বীর কাছ থেকে কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। বরঞ্চ হাদীস শাস্ত্রে একটি পরিভাষা আছে ‘অনুজের কাছ থেকে অগ্রজের বর্ণনা’ আরেকটি পরিভাষা আছে ‘ছাত্রের কাছ থেকে শিক্ষকের বর্ণনা’।[1]
তদ্রূপ কারো কাছ থেকে কোনো একটা হাদীস বর্ণনা করার মানে এ নয় যে, সে ব্যক্তি বর্ণনাকারীর চেয়ে বেশী ইলম রাখেন। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অনেক রাবীর বোধশক্তি তার শ্রোতার চেয়ে কম। আবার অনেক রাবীর আদৌ বোধশক্তি নেই।’[2]
তবে এখানে একটু ইঙ্গিত দিয়ে রাখি যে, এ ক্ষেত্রে বারো-ইমামী ইমামিয়া শিয়ারা একটা চতুরামি করে। তাহলো, যে কোনো মুহাদ্দিসের ব্যাপারে শিয়া বলা হলেই তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, সে লোক তাদের দলে- রাফেযী বা কট্টরপন্থী শিয়া।[3] প্রকৃতপক্ষে সুন্নী মাযহাবের আলেমরা ‘বারো -ইমামের অনুসারী’ শিয়াদের কাছ থেকে একটা হাদীসও বর্ণনা করে নি। তবে মুফাদ্দিলা[4] শিয়াদের কাছ থেকে তাদের কিছু রেওয়ায়েত আছে।
দুই: এক ব্যক্তি থেকে সামান্য কিছু হাদীস বর্ণনা করা আর তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার ইলমের উপর নির্ভর করা- এ দুয়ের মাঝে অনেক ফারাক। অথচ এ পন্থায় বার-ইমামের অনুসারী এসব শিয়ারা বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়। এ জন্য জাফর সাদেক রাহিমাহুল্লাহর কাছ থেকে সুন্নী চার ইমাম যে সামান্য কটি হাদীস বর্ণনা করেছেন সে ব্যাপারে বলতে গিয়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, “এই চারজন ইমাম জাফর সাদেকের কাছ থেকে ফিকহের কোনো নীতিমালা গ্রহণ করেন নি। তবে তারা তার কাছে থেকে কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন যেমনিভাবে অন্যদের কাছ থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর অন্যদের কাছ থেকে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন তার সংখ্যা জাফর সাদেক থেকে বর্ণনাকৃত হাদীসের দ্বিগুণ, চতুর্গুণ”[5]
আমরা একথাও বলতে পারি যে, আহলুস সুন্নার ইমামরা আবু আব্দুল্লাহ্ জাফর সাদেকের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করাটা আশ্চর্য্যের কিছু নয়। কারণ এতো সুন্নীর কাছ থেকে সুন্নীদের হাদীস বর্ণনা। শিয়ারা যদি দাবী করে যে, জাফর সাদেক তাদের দলের,- বরঞ্চ চতুর্থ খলিফা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর ব্যাপারেও তারা এ রকম দাবী করে- শুধু দাবী করলেই তো তারা তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবেন না। বরং এ দুই ব্যক্তি শিয়াদের (মতাদর্শ) থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। শিয়ারা ‘কাফী’ নামক কিতাবে বা তাদের অন্যান্য কিতাবে এ দুজনের নামে এবং আহলে বাইতের অন্যান্যদের নামে যেসব বানোয়াট বর্ণনা উল্লেখ করেছে সেগুলো দ্বারা বাস্তবতাকে পরিবর্তন করা যাবে না।
তিন: অনুরূপভাবে এ দিক থেকেও তাদের এ দাবীর অসারতা প্রমাণিত হয় যে, এ চারজন ইমাম এবং তাদের ছাত্ররা কখনোই দাবী করেননি যে, তারা বারো-ইমামী বিশ্বাসী শিয়া এবং তারা এ মতবাদকে মেনেও নেননি। তাহলে এ কথা কতটুকু যুক্তিযুক্ত যে, তারা হাদীস ও ফিকহের যাবতীয় ইলম বারো-ইমামী মতবাদে বিশ্বাসী শিয়াদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন? পাত্রের ভেতরে যদি ঘোল থাকে তাহলে ঘোল বের হবে, আর দুধ থাকলে দুধ বের হওয়াই স্বাভাবিক।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এটা জানা কথা যে, মুসলিমদের নামকরা আলেমদের মধ্যে কেউ রাফেযী ছিলেন না। বরং রাফেযীদের মূর্খতা ও বিভ্রান্তির ব্যাপারে তারা সকলে একমত।…তারা সবসময় রাফেযীদের অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতার এমন সব উদাহরণ পেশ করে থাকেন যা থেকে জানা যায় যে, তাদের বিশ্বাস হল ‘রাফেযীরা অজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বেশী পথভ্রষ্ট এবং উম্মতে মুসলিমার নানা ফেরকার মধ্যে হেদায়েত থেকে সবচেয়ে বেশী দূরে।”[6]
ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, “আল্লাহ্ তাআলা জানেন যে, অসংখ্য আলেম ও বিভিন্ন মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমার প্রচুর পড়াশুনা থাকা সত্ত্বেও আমি এমন একজন আলেমও পাইনি যার সামান্যতম খ্যাতি আছে অথচ তিনি ইমামিয়া মতবাদের প্রতি অনুরক্ত। এ কথা বলাতো দূরে থাক্ যে, তাদের কেউ গোপনে এই মতবাদ বিশ্বাস করতেন।”[7]
সুন্নী আলেম আব্দুল কাহের আল বাগদাদী বলেন, “আল্লাহ্র প্রশংসা, তাঁর অনুগ্রহে ‘ফিকহের কোনো ইমাম’ অথবা ‘হাদীসের কোনো ইমাম’ খারেজী, রাফেযী… অথবা অন্যকোন বাতিল ফেরকার দলভুক্ত ছিলেন না।”[8]
এ কারণে আজ পর্যন্ত চার মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে কিছু মুতাযিলা, সুফী বা মুরজিয়া পাওয়া যায় বটে, কিন্তু মাযহাবের ফিকহের উপর বা উসুলের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন অথবা সংকলন করেছেন এমন ব্যক্তিবর্গদের মধ্যে কেউ রাফেযী হানাফী, রাফেযী মালেকী, রাফেযী শাফেয়ী বা রাফেযী হাম্বলী ছিলেন বলে আমরা শুনি নি। যেহেতু রাফেযী মতবাদের সাথে ইলমের কোনো সম্পর্ক নাই এবং তা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। আর দুই বিপরীত মেরু কখনো এক হতে পারে না।চার: এটা কিভাবে যুক্তিযুক্ত হতে পারে যে, চার মাযহাবের ইমামরা বারো ইমামী শিয়াদের ইলমের উপর নির্ভর করেছেন- অথচ শত্রুমিত্র, আপন-পর সকলে একবাক্যে এ সকল ইমামদের অগাধ ইলম, নির্ভুল বোধশক্তি, সত্যবাদিতা ও নিখুঁত বিশ্লেষণ শক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছে। বিপরীত দিকে উম্মাহ্র বেশীরভাগ অংশ ইমামিয়াদের অজ্ঞতা ও মিথ্যাবাদিতার উপর সাক্ষ্য দিয়েছে, বিশেষতঃ বর্ণনার ক্ষেত্রে। ইবনে তাইমিয়া বলেন, “বুদ্ধিমান সকল মুসলিম একমত যে, কাবাকে কিবলা মান্যকারীদের মধ্যে তাদের ফেরকার চেয়ে মূর্খ, পথভ্রষ্ট, মিথ্যাবাদী, বিদআতী এবং খারাপ কাজে অগ্রবর্তী আর কোনো ফেরকা নাই।”[9] তিনি ইমামিয়াদের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে এ কথা বলেন।[10]
[2] হাদীসটি ইমাম তিরমিযি তার জামে’ গ্রন্থে (নং ২৬৫৬) উল্লেখ করে বলেছেন: হাসান হাদীস। এছাড়া আবু দাউদ তার সুনান গ্রন্থে (নং ৩৬৬০), ইবনে মাজাহ্ তার সুনান গ্রন্থে (নং ২৩০) এবং ইবনে হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে (নং ৬৭) যায়েদ ইবন সাবেতের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
[3] মুহাম্মদ আলু কাশেফ আল গাত্তাহ্ তার ‘আসলুশ শিয়া’ গ্রন্থে (৭৫-১০৬) এবং আমীর কাযউনী তার ‘আশ শিয়া ফি আকায়িদিহিম’ গ্রন্থে (পৃ:১৭) অনেক সাহাবী ও তাবেয়ীকে কট্টরপন্থী শিয়া হিসেবে সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছে এবং তাদেরকে বর্তমান রাফেজীদের পূর্বপুরুষ বলে দাবী করেছে।
[4] মুফাদ্দিলা শিয়া তাদেরকে বলা হয় যারা আবু বকর ও উমরের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উপর আলীকে রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অগ্রগন্য মনে করত। কিন্তু তারা আবু বকর ও উমরে রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার নেতৃত্ব, তাদের দীনদারীর প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ছিল এবং এ দুজনকে তারা মহব্বতও করত। পক্ষান্তরে ‘বার-ইমামের অনুসারী’ শিয়াদের বিশ্বাস হল আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কাফের। যেহেতু তাদের বিশ্বাস হল- রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরবর্তীতে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খলিফা হবেন এই মর্মে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে। সুতরাং যারা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর আগে খিলাফতের দায়িত্ব নিল তারা জোরপূর্বক তা নিয়ে গেল।
[5] মিনহাজুস সুন্নাহ্ (৭/৫৩৩)।
[6] প্রাগুক্ত (৪/১৩০-১৩১)।
[7] প্রাগুক্ত (৪/১৩১)।
[8] আল ফারকু বায়নাল ফিরাক (পৃ: ৩০৮)।
[9] মিনহাজুস সুন্নাহ্ আননাবাওয়িয়্যাহ্ (২/৬০৭) এবং (৭/৪১৬)।
[10] যুক্তি ও দলীল দেয়ার ক্ষেত্রে ইমামিয়াদের মূর্খতা জানতে হলে দেখুন: মিনহাজুস সুন্নাহ্ আননাবাওয়িয়্যাহ্ (৪/৬৩, ৬৪, ৬৫)।