বারো ইমামের অনুসারী শিয়াদের দৃষ্টিতে চার ইমাম (আবু হানিফা, মালেক, শাফে‘ঈ ও আহমাদ) প্রথম পরিচ্ছেদ: চার ইমামের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ইসলামহাউজ.কম
হিজরতের দেশের ইমাম মালেক ইবন আনাস রাহিমাহুল্লাহ* [৯৩-১৭৯ হিঃ]

বংশ পরিচয়: তিনি হচ্ছেন হিজরতের দেশ মদীনার ইমাম, আবু আব্দুল্লাহ্‌ মালেক ইবন আনাস ইবন মালেক ইবন আবু আমের ইবন আমর ইবন হারেছ ইবন গায়মান ইবন জুছাইল ইবন আমর ইবন আলহারেছ আলআছবাহী।

শৈশবকাল: ইমাম মালেক আলেম-পরিবারে বড় হয়েছেন। তার দাদা মালেক ইবন আবু আমের বয়োজ্যোষ্ঠ তাবেয়ী ছিলেন এবং তাবেয়ীদের মাঝে বড় আলেম ছিলেন। উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর শাসনামলে ‘মুসহাফ’ (কুরআন) লেখার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি ও রাষ্ট্রীয় কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ কাজের জন্য সে যুগের যে সব উল্লেখযোগ্য লোকদেরকে ডাকা হয় ইমাম মালেকের দাদা ‘মালেক’ও তাদের একজন ছিলেন।

ইমাম মালিকের ভাই ‘নদর’ তৎকালীন আলেমদের সান্নিধ্যে থেকে ইলম শিখতেন। এমনকি ইমাম মালেক যখন ইলমী মজলিসগুলোতে হাজির হওয়া শুরু করেন তখন লোকেরা মালেককে ‘নদরের ভাই’ বলে চিনত। এরপর ইমাম মালেকের ইলমী খ্যাতি যখন আলেমদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে তখন নদরকে ‘ইমাম মালেকের ভাই’ বলা হত।

যে অঞ্চলে ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ বড় হয়েছেন সার্বিকভাবে সে অঞ্চল ছিল ইলমের জন্য উপযুক্ত, মেধার বিকাশের জন্য উর্বর। যেহেতু তা হচ্ছে মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র মদীনা, শরীয়ত নাযিলের পূণ্যভূমি, আলো বিচ্ছুরণের উৎস, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম কেন্দ্রস্থল। প্রথম উমাইয়া শাসনামলে এটি ছিল আলেমদের বিচরণভূমি। এমনকি ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কূফাতে থাকাকালে যখন কোনো মাসয়ালায় ফতোয়া দিতেন এবং মদীনায় এসে এর বিপরীত কোনো মত অবগত হতেন তখন তিনি বাহন থেকে নামার আগে ফতোয়া জিজ্ঞেসকারী ব্যক্তিকে সঠিক মতটি জানিয়ে আসতেন।

এমন একটি মনোরম ইলমী পরিবেশে ইমাম মালেক বড় হয়েছিলেন। শৈশবেই তিনি কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। তারপর হাদীস মুখস্থ করায় মশগুল হন। এরপর আলেমদের মজলিসে যাওয়া-আসা শুরু করেন।

ইলম অর্জন ও তাঁর ইলমী মর্যাদা: ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন ইলম তলবে পরিশ্রমী। পরিপূর্ণ উদ্যম, ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ইলম অর্জনে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আলেমরা তাদের ঘর থেকে মসজিদে বের হওয়ার সময়ের প্রতীক্ষায় বসে থাকতেন তিনি। ইমাম মালেক নিজের ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেন, “তিনি ‘ইবনে হুরমুযের’ কাছে সাত বছর কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি অন্য কারো কাছে যান নি।” সাত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হুরমুযের সান্নিধ্যে থাকতেন। ইবনে হুরমুয তাঁর মাঝে শুভ লক্ষণ দেখতে পেয়ে তাঁর ব্যাপারে উত্তম ভবিষ্যতের আশাবাদী ছিলেন। একদিন হুরমুয তাঁর দাসীকে বললেন, ‘দেখ তো দরজায় কে? দাসী মালেক ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। এসে বলল, সেখানে ঐ গৌরবর্ণের ফর্সা লোকটি। হুরমুয বললেন, তাকে ডেকে আন; সে মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আলেম।’

বিশ্রামের সময়ও যদি ইলম তলবের কোনো সুযোগ থাকত মালেক রাহিমাহুল্লাহ সে সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। মালেক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “একবার ঈদের দিনে আমি ভাবলাম আজ ‘ইবনে শিহাব’ নিরিবিলি থাকবেন। এই ভেবে আমি ঈদগাহ থেকে সোজা তার বাসার দরজায় গিয়ে বসে থাকলাম। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম তিনি তাঁর দাসীকে বলছেন, দেখ তো দরজায় কে? দাসী বলল, ঐ তো সে মালেক নামের ফর্সা লোকটি। তিনি বললেন, তাকে ঘরে আসতে দাও। আমি ঘরে ঢুকলাম। আমাকে বললেন, তুমি বাসায় যাওনি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, কিছু খেয়েছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, কিছু খাবে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে কি চাও? আমি বললাম, আমাকে কি হাদীস শুনাবেন? তিনি বললেন, ঠিক আছে বস। আমি আমার হাদীসের নোট বই বের করলাম। তখন তিনি আমাকে চল্লিশটি হাদীস শুনালেন। আমি বললাম, আরো শুনান। তিনি বললেন, এটাই যথেষ্ট। তিনি বললেন, যদি তুমি এই হাদীসগুলো (মুখস্থ) শুনাতে পার তাহলে তুমি ‘হাদীসের হাফেয’। আমি বললাম, আমি শুনাতে পারব। তিনি তখন আমার হাত থেকে খাতাগুলো নিয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, শুনাও দেখি। আমি তাকে শুনালাম। এরপর আমাকে খাতাগুলো দিয়ে বললেন, “উঠে যাও। তুমি ইলমের ভাণ্ডার।”

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ আবদুল্লাহ ইবনে উমরের আযাদকৃত দাস নাফে’র কাছ থেকেও প্রচুর ইলম শিখতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে ইমাম মালেক বলেন, “ঠিক দ্বিপ্রহরে আমি তার কাছে আসতাম। সূর্যের উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য কোনো গাছের ছায়া পেতাম না। তাঁর বের হওয়ার প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম। যখন তিনি বের হতেন তখন কিছু সময় আমি অপেক্ষা করতাম, যেন আমি তাকে দেখতে পাইনি। একটু পর গিয়ে সালাম দিয়ে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম। এমনকি তিনি পুনরায় ঘরে ঢুকার আগ পর্যন্ত আমি বলতে থাকতাম ‘ইবনে উমর’ অমুক বিষয়ে কি বলতেন, অমুক মাসয়ালায় কি বলতেন। আর তিনি আমাকে উত্তর দিতেই থাকতেন।

এভাবে ইলম অর্জনের পথে জানমালের সর্বোচ্চ কুরবানী দিতে তিনি সামান্যতম কার্পণ্য করেন নি। তাঁর ছাত্র ‘ইবনে কাসেম’ তাঁর ব্যাপারে বলেন, ইলমের পথে ত্যাগ করতে করতে ইমাম মালেক ফতুর হয়ে পড়েছিলেন। তার ঘরের ছাদ ভেঙ্গে পড়েছিল। তখন তিনি ছাদের কাঠগুলো খুলে বিক্রি করে দেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বৈষয়িক সমৃদ্ধি পেয়েছেন।

যখন ইমাম মালেকের চিন্তা পরিপক্কতা পেল এবং তার ব্যক্তিত্ব পূর্ণতা লাভ করল তখন তিনি মসজিদে নববীতে পাঠদান ও ফতোয়া দেওয়ার ব্রতে মশগুল হন। তার ওস্তাদদের কাছ থেকে তার ইলমী যোগ্যতার সত্যায়ন ও স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি উক্ত ব্রতে মশগুল হন। তিনি বলেন, “হাদীসের পাঠদান ও ফতোয়া দেওয়ার জন্য আমি যোগ্য - আমার সত্তরজন ওস্তাদ এই সাক্ষ্য দেওয়ার পর আমি পাঠদান ও ফতোয়া দেওয়া শুরু করি। যারা এই সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে ইমাম যুহরী ও রাবীয়া’র মত ব্যক্তিবর্গও ছিলেন।” তিনি এই কথাটি সবসময় বলতেন, “যে ব্যক্তি নিজের জন্য এমন কোনো পদ দাবী করে, যে পদের জন্য মানুষ তাকে যোগ্য মনে করে না সে ব্যক্তির মধ্যে কোনো কল্যাণ নাই ।”

তাঁকে যদি কোনো মাসয়ালা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হত, যা তার অজানা, তিনি সাফ বলে দিতেন, “আমি জানি না।” তিনি তাঁর ওস্তাদ হুরমুয থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি হুরমুয থেকে বর্ণনা করে বলেন, “আমি হুরমুযকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: আলেমের উচিত তাঁর শিষ্যদেরকে “আমি জানি না” এ কথা বলা শিক্ষা দিয়ে যাওয়া। যেন এই বাক্যটি তাদের হাতে একটি হাতিয়ার হিসেবে থাকে। যখন তাদের কেউ কোনো প্রশ্ন শুনে কি উত্তর দিবে ভেবে না পায় তখন সে যেন বলে, “আমি জানি না”

ইমাম মালেক আলেম সমাজের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাঁর ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা বলেন, “কোন প্রশ্নের তড়িৎ জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং সমালোচনামূলক আলোচনায় আমি ইমাম মালেকের তুল্য কাউকে দেখিনি।”

আবু ইউসুফ তাঁর ইলমী মর্যাদার সত্যায়ন করতে গিয়ে বলেন: “তিন ব্যক্তির চেয়ে অধিক ইলমধারী আমি আর কাউকে দেখিনি। তারা হচ্ছেন- মালেক, ইবনে আবি লাইলা, আবু হানীফা।” শেষ দুজন ছিলেন আবু ইউসুফের ওস্তাদ, তাই মালেককে তিনি তাঁদের পর্যায়ে স্থান দেন।

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ ব্যাপারে তাঁর ছাত্র ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “তাবেয়ীদের পর ইমাম মালেক ছিলেন মাখলুকাতের উপর আল্লাহ্‌ তা‘আলার সাক্ষী। মালেক হচ্ছেন আমার ওস্তাদ, আমি তাঁর কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করেছি। তিনি আমার শিক্ষক। আমার উপর অন্য কারো চেয়ে মালেকের অবদান অনেক বেশী। তাঁকে আমি আমার মাঝে ও আল্লাহ্‌র মাঝে হুজ্জত মনে করি।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “মালেক হচ্ছেন শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একজন। তিনি হাদীসের ক্ষেত্রেও ইমাম, ফিকহের ক্ষেত্রেও ইমাম। মালেকের তুল্য আর কে আছে? যিনি পরিপূর্ণ বোধ ও আদবের সাথে পূর্ববর্তীদের আদর্শের অনুসারী ছিলেন।”

হাদীসে এসেছে- “ইলমের সন্ধানে মানুষ দেশ-দেশান্তরে সফর করবে। কিন্তু তারা মদীনার আলেমের চেয়ে অধিক ইলমধারী আর কাউকে পাবে না।”[1] তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের মতে এই হাদীসটিতে ইমাম মালেককে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

কঠিন পরীক্ষা: আব্বাসী যুগে খলিফা মনসুরের সময় ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তৎকালীন সময়ে মদীনার গর্ভনর ছিল খলিফা মনসুরের চাচাতো ভাই। সে ইমাম মালেকের গায়ে হাত তোলে। কারণ পরশ্রীকাতর কিছু ব্যক্তি ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহর বিরুদ্ধে একটা অপপ্রচার রটিয়ে দেয়। তারা বলে, “ইমাম মালেক ফতোয়া দিচ্ছেন যে, ‘চাপের মুখে যে ব্যক্তি কোনো স্বীকৃতি দেয় তার কাছ থেকে কসম তলব করা যাবে না।’ এ কথার অর্থ হচ্ছে- আপনারা জোরপূর্বক যাদের কাছ থেকে বায়‘আত (শাসক হিসেবে স্বীকৃতি) গ্রহণ করেছেন ইমাম মালেক তাঁর এ ফতোয়ার মাধ্যমে সে বায়‘আতকে ভঙ্গের কথা বলছে।” তখন গভর্নরের নির্দেশে তাঁকে ধরে আনা হয় এবং সত্তরটি বেত্রাঘাত করা হয়। যার ফলে তিনি কাতর হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন।

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহর প্রতি মুসলিমদের অন্তরে ছিল অগাধ সম্মান। তাই এ ঘটনার পর পুরো মদীনার অলি-গলি থরথর করে কেঁপে উঠে। মানুষ তীব্র প্রতিবাদে ও বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। তখন খলিফা হেজাযবাসীদের অভ্যুত্থানের ভয়ে ইমাম মালেককে ইরাকে ডেকে পাঠান। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। অবশেষে খলিফা হজ্জের সময় মিনাতে তার সাথে দেখা করার কথা বলে পাঠান। যখন ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ খলিফার সাক্ষাতে প্রবেশ করেন তখন মনসুর তার আসন থেকে নীচে নেমে বসেন এবং মালেককে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে একবারে তার কাছে নিয়ে বসান। এরপর তাঁকে প্রহার করা ও কষ্ট দেওয়ার কারণে দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আবু আব্দুল্লাহ্‌ (মালেকের উপনাম), সেই আল্লাহ্‌র শপথ যিনি ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নাই- এই নির্দেশ আমি দেইনি। এমনকি ঘটনাটা ঘটার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না এবং জানার পর আমি তা মেনে নিতে পারিনি। আবু আব্দুল্লাহ্, আপনি যতদিন হেজাযে আছেন ততদিন হেজাযবাসী কল্যাণে থাকবে। আমি মনে করি আল্লাহ্‌র শাস্তি থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য আপনিই তাদের সহায়। আল্লাহ্‌ তা‘আলা আপনার মাধ্যমে তাদেরকে বড় এক বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। আমি ফরমান জারি করেছি গভর্নর জাফরকে যেন মদীনা থেকে খাটে করে আনা হয় এবং একটি সংকীর্ণ স্থানে বন্দী করে রেখে চরম অপমান করা হয়। সে আপনার সাথে যতটুকু বেয়াদবি করেছে আমি তাকে এর চেয়েও বেশী শাস্তি দিব।

ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ বললেন, “হে আমীরুল মুমেনীন! আল্লাহ্‌ তাকে মাফ করুন এবং তার সম্মান বৃদ্ধি করুন। আল্লাহ্‌র রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুটুম হওয়ার কারণে এবং আপনার সাথে তার আত্মীয়তা থাকার কারণে আমি তাকে মাফ করে দিলাম।”

তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলী: সাহাবীদের যুগের মুজতাহিদ আলেমগণ তাদের ফতোয়া লিপিবদ্ধ করতে বাধা দিতেন। যেন ইসলামের মূলনীতির উপর লিপিবদ্ধ বই একটিই থাকে- ‘কুরআন’। এরপর আলেমরা সুন্নাহ্‌ সংকলন করা এবং ফতোয়া ও ফিকহ লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু তখনও এই জ্ঞানগুলো গ্রন্থের রূপ লাভ করেনি, বরং অনেকটা ব্যক্তিগত নোটবুকের আকারে ছিল। ইমাম মালেকের “মুয়াত্তা”- ই ইসলামী জ্ঞানের প্রাচীনতম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।

তিনি এ বইয়ের মধ্যে সহীহ হাদীস, সাহাবী ও তাবেয়ীদের বাণী, তাদের ফতোয়া এবং তাঁর নিজস্ব মতামত উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থের সংকলন সমাপ্ত করতে তাঁর চল্লিশ বছর সময় লেগেছে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, তিনি এ গ্রন্থটি সংকলন করতে কতটুকু পরিশ্রম করেছেন। এই কিতাবের সুনাম কুড়ানোর জন্য এইটুকু যথেষ্ট যে, ইমাম শাফেয়ী এই গ্রন্থের ব্যাপারে বলেন, “পৃথিবীর বুকে ‘মুয়াত্তার’ চেয়ে বিশুদ্ধ কোনো ইলমী কিতাব নেই।” ইমাম নাসায়ী বলেন, “আমার দৃষ্টিতে তাবেয়ীদের পর ইমাম মালেকের চেয়ে উত্তম, উৎকৃষ্ট, নির্ভরযোগ্য এবং হাদীসের ব্যাপারে বিশ্বস্ত আর কোনো ব্যক্তি নেই। দুর্বল রাবীদের কাছ থেকে তার বর্ণনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।”তাঁর অসুস্থতা ও মৃত্যু: ইমাম মালেক বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হন। যার ফলে তার দরসের মজলিস (শিক্ষা মজলিস) মসজিদে নববী থেকে তাঁর ঘরে স্থানান্তরিত করেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি ইলম তলব, হাদীস গ্রহণ, পাঠদান ও ফতোয়া দেওয়ার মহানব্রতে রত থাকেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে তিনি দীর্ঘ ২২দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার পর ১৪ই রবিউল আউয়াল ১৭৯ হিজরীতে মারা যান। তিনি তাঁর রোগের ব্যাপারে এবং মসজিদে নববী থেকে তার দরস সরিয়ে নেয়ার কারণ সম্পর্কে তার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কাউকে কিছু জানাননি। মৃত্যুর দিন তার দর্শনার্থীদেরকে বলেন, “হয়ত এটা আমার শেষ দিন। তাই আপনাদেরকে আমার বহুমূত্র রোগের কথা জানালাম। আমি অজু ছাড়া মসজিদে নববীতে আসাটা অপছন্দ করতাম এবং আমি আমার রোগের কথা জানানোটাও অপছন্দ করেছিলাম। বরং আমার রব্বের কাছেই অভিযোগ করতাম। আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইমাম মালেকের প্রতি রহম করুন। তার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। তার ব্যাপারে ইবনে উয়ায়না যা বলেছেন বাস্তবে তিনি তাই ছিলেন। তিনি বলেছেন, “মালেক হচ্ছে এ উম্মতের প্রদীপ।”

>
* ইমাম মুহাম্মদ আবু যুহরার “মালেক হায়াতুহু ওয়া আসরুহু: আ-রাউহু ওয়া ফিক্‌হুহু” এবং ড. আহমাদ ত্বহা রাইয়্যানের “মালামিহ মিন হায়াতি মালেক ইবন আনাস” শীর্ষক গ্রন্থদ্বয়ের সহযোগিতা নিয়ে এই জীবনীটি সাজানো হয়েছে।


[1] আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে তিরমিযী তার জামে’ গ্রন্থে (নং ২৬৮০) হাদীসটি সংকলন করেছেন।