কবর যিয়ারত ও কবরবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন অন্যের কাছে দো‘আ চাওয়ার বিধান, সে ব্যক্তি জীবিত হোক কিংবা মৃত ইসলামহাউজ.কম
অন্যের কাছে দো‘আ চাওয়ার বিধান, সে ব্যক্তি জীবিত হোক কিংবা মৃত - ৩

আর এর মাধ্যমেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলীর জীবদ্দশায় চাওয়া ও তার মৃত্যুর পর ও তার অনুপস্থিতিতে তার কাছে কোনো কিছু চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য সুষ্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা তার জীবদ্দশায় কেউ তার ইবাদত করতে পারবে না। তাই যখন নবীগণ ও ওলীগণ জীবিত থাকেন তখন তারা তাদের উপস্থিতিতে কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করতে ছাড় দিতেন না; বরং তারা তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করতেন এবং এর জন্য তাদের শাস্তি দিতেন। আর এ কারণে মসীহ আলাইহিস সালাম বলেন,

﴿مَا قُلۡتُ لَهُمۡ إِلَّا مَآ أَمَرۡتَنِي بِهِۦٓ أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمۡۚ وَكُنتُ عَلَيۡهِمۡ شَهِيدٗا مَّا دُمۡتُ فِيهِمۡۖ فَلَمَّا تَوَفَّيۡتَنِي كُنتَ أَنتَ ٱلرَّقِيبَ عَلَيۡهِمۡۚ وَأَنتَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ شَهِيدٌ ١١٧﴾ [المائ‍دة: ١١٧]

“আপনি আমাকে যে আদেশ করেছেন তা ছাড়া তাদেরকে আমি কিছুই বলি নি। তা এই যে, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদাত কর এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের কাজকর্মের সাক্ষী, কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের কাজকর্মের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনিই সব বিষয়ে সাক্ষী”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ১১৭]

আর কোনো এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, ‘আল্লাহ ও আপনি চাইলে’, তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«أجعلتني لله ندا قل ما شاء الله وحده»

“তুমি কি আমাকে আল্লাহর সাথে অংশীদার বানিয়েছো? বল, একমাত্র আল্লাহ যা চেয়েছেন।”[1]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

«لا تقولوا ما شاء الله وشاء محمد ولكن قولوا ما شاء الله ثم شاء محمد»

“তোমরা বলবে না, আল্লাহ ও মুহাম্মদ যা চেয়েছেন, কিন্তু তোমরা বলো: আল্লাহ যা চেয়েছেন তারপর মুহাম্মদ যা চেয়েছেন।”[2]

আর যখন ছোট এক মেয়ে বলেছিল, ‘আমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল আছেন তিনি আগামীকাল যা হবে তা সম্পর্কে জানেন’, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«دَعِي هَذَا وَقُولِي الَّذِي كُنْتِ تَقُولِينَ»

“এটা ছেড়ে দাও এবং যেটা বলছিলে সেটা বলতে থাক।”[3]

তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

«لا تطروني كما أطرت النصارى عيسى بن مريم فإنما أنا عبد فقولوا عبد الله ورسوله»

“তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না যেরূপে নাসারারা ইবন মারইয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি তো একজন বান্দা বা দাস। অতএব, তোমরা বলো: “আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল”।[4]

আর যখন সাহাবীগণ তাঁর পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন,

«لَا تَقُومُوا كَمَا تَقُومُ الْأَعَاجِمُ، يُعَظِّمُ بَعْضُهَا بَعْضًا»

“তোমরা অনারবী লোকজন যে পদ্ধতিতে একে অপরকে দাঁড়িয়ে সম্মান করে সেভাবে আমাকে সম্মান করবে না।”[5]

অনুরূপ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, সাহাবীগণের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে আর কোনো প্রিয় ব্যক্তি ছিল না, আর সাহাবীগণ যখন তাঁকে দেখতো তখন দাঁড়াত না, যেহেতু তারা জানত যে, তিনি এটা অপছন্দ করেন।

তদ্রূপ মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাজদাহ করে বসল, তখন তিনি তাকে তা করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন,

«لَا يَصْلُحُ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ، وَلَوْ صَلَحَ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ، لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا، مِنْ عِظَمِ حَقِّهِ عَلَيْهَا»

“মানুষের জন্য অন্য কোনো মানুষকে সাজদাহ করা উপযোগী নয়। আর যদি আমি কাউকে সাজদাহ করার অনুমতি দিতাম তবে অবশ্যই তোমাদের স্ত্রীদের আদেশ দিতাম তারা যেন তার স্বামীকে সাজদাহ করে যেহেতু তার অধিকার বেশি।”[6]

অনুরূপভাবে “যখন আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে সে সব যিন্দীকদের নিয়ে আসা হলো যারা তার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল, সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং তার ওপর ইলাহ হওয়ার বিশ্বাস আরোপ করেছিল তখন তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”

এই হচ্ছে আল্লাহর নবী ও অলীগণের কাজ। (তারা তাওহীদের সীমারেখা রক্ষা করে চলেন)। একমাত্র যে যমীনে অহংকার ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় সে-ই তো কেবল বাড়াবাড়ি ও অযথা সম্মান প্রদর্শনের স্বীকৃতি দেয়। যেমন, ফির‘আউন ও অন্যান্যরা; অনুরূপ পথভ্রষ্ট পীর-মাশাইখরাও এ কাজের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, যারা উদ্দেশ্য হলো যমীনের বাড়াবাড়ি করা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করা। আর নবী ও ওলীদের নিয়ে ফেতনায় ফেলা এবং তাদেরকে রব সাব্যস্ত করা আর তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করা, এসবই তাদের অনুপস্থিতিতে এবং তাদের মৃত্যুর পরই কেবল সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন, মসীহ ও উযাইয়ের সাথে (তাদের অনুসারীদের) শির্ক। (কারণ, তারা কেবল মাসীহ ও উযায়ের এর অনুপস্থিতি ও মৃত্যুর পরই তা করতে সমর্থ হয়েছিল)।

সুতরাং এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নেককার লোকদের জীবদ্দশায় ও উপস্থিতিতে চাওয়া এবং তাদের মৃত্যুর পর ও অনুপস্থিতিতে চাওয়ার পার্থক্য নির্দেশ করে। সাহাবী, তাবে‘ঈ ও তাবে-তাবে‘ঈগণের মধ্য থেকে এ উম্মতের কোনো গ্রহণযোগ্য পূর্বসূরী কেউই নবীগণের কবরে সালাত, দো‘আ ও তাদের নিকট অন্য কিছু প্রার্থনা করত না। আর তারা তাদের দ্বারা কোনো উদ্ধারও কামনা করতো না। তাদের অনুপস্থিতিতেও নয়, কবরের কাছেও নয়। অনুরূপভাবে তারা কবরের কাছে অবস্থানও করতো না।

অন্যতম বড় শির্ক হলো: কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো মৃত ব্যক্তি বা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। যেমনটি প্রশ্নকারী উল্লেখ করেছেন। অনুরূপ বড় শির্ক হচ্ছে, বিপদের সময় তাদের দ্বারা উদ্ধার কামনা করা। যেমন এটা বলা যে, হে আমার অমুক নেতা! মনে হচ্ছে সে যেন এ আহ্বান দ্বারা তার কাছে কোনো ক্ষতি বা অনিষ্ট দূর করার প্রার্থনা করছে অথবা উপকার লাভ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করছে। বস্তুত এটাই তো ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার মা, পাদ্রী ও সংসার বিরাগীদের সাথে নাসারাদের আচরণ। অথচ সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টিজীব হলেন, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তার সাহাবীগণ তার মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তারপরও তাদের কেউ তার অনুপস্থিতিতে এবং মৃত্যুর পরে এমনটি করেন নি।

মূলত এ মুশরিকরা তাদের শির্কের সাথে মিথ্যারও সংমিশ্রণ ঘটায়। কেননা মিথ্যা শির্কের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ حُرُمَٰتِ ٱللَّهِ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّهُۥ عِندَ رَبِّهِۦۗ وَأُحِلَّتۡ لَكُمُ ٱلۡأَنۡعَٰمُ إِلَّا مَا يُتۡلَىٰ عَلَيۡكُمۡۖ فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ وَٱجۡتَنِبُواْ قَوۡلَ ٱلزُّورِ ٣٠ حُنَفَآءَ لِلَّهِ غَيۡرَ مُشۡرِكِينَ بِهِ﴾ [الحج: ٣٠، ٣١]

“কাজেই তোমরা বেঁচে থাক মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে এবং বর্জন কর মিথ্যা কথা। আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে এবং তাঁর কোনো শরীক না করে।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩০-৩১]

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«عُدِلَتْ شَهَادَةُ الزُّورِ بِالْإِشْرَاكِ بِاللَّهِ» ثَلَاثَ مَرَّات»

“মিথ্যা সাক্ষ্য আল্লাহর সাথে শির্কের সমপর্যায়ে চলে গেছে” কথাটি তিনি দু’বার বা তিনবার বলেছেন।”[7]

আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ ٱلۡعِجۡلَ سَيَنَالُهُمۡ غَضَبٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَذِلَّةٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۚ وَكَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُفۡتَرِينَ ١٥٢﴾ [الاعراف: ١٥٢]

“নিশ্চয় যারা গো-বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদের ওপর তাদের রবের ক্রোধ ও লাঞ্ছনা আপতিত হবেই। আর এভাবেই আমরা মিথ্যা রটনাকারীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫২]

অনুরূপভাবে ইবরাহীম খলীল আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

﴿أَئِفۡكًا ءَالِهَةٗ دُونَ ٱللَّهِ تُرِيدُونَ ٨٦ فَمَا ظَنُّكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٨٧﴾ [الصافات: ٨٦، ٨٧]

“তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক বা মিথ্যা ইলাহগুলোকে চাও? ‘তাহলে সকল সৃষ্টির রব সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কী?” [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৮৬-৮৭] তাদের মারাত্মক মিথ্যাচারের উদাহরণ হলো, তাদের কেউ কেউ তার পীর সাহেব সম্পর্কে বলে, মুরীদ বা ভক্ত যদি পশ্চিমে থাকে আর তার পীর পূর্বে থাকে, তাতেও তাদের মধ্যকার পর্দা উন্মোচিত হয়ে যায় এবং সে মুরীদের ডাকে সাড়া দিবে। তারা আরও বলে, যদি পীর সাহেব এমন না হবেন তো তিনি পীর হতে পারেন না। আবার কখনও কখনও শয়তান তাদের গোমরাহ করে দেয়, যেমনিভাবে সে মুর্তিপজকদেরকে পথভ্রষ্ট করে। যেভাবে শয়তান জাহেলী যুগে আরবদেরকে মূর্তির মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করত এবং তারকাপূজারী ও তন্ত্র-মন্ত্রবাদীদেরকে শির্ক ও জাদুর মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করে। যেমনিভাবে তাতারী, হিন্দী, সুদানীসহ অন্যান্য মুশরিকদের মধ্যেও শয়তান প্রলুব্ধ ও সম্বোধণ ইত্যাদি করে বিভিন্নভাবে পথভ্রষ্ট করতো। ঠিক এসব পীর মুরিদদের বেলাতেও একই ধরনের কিছু কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে শিষধ্বনি ও হাততালি শুনার সময়। কেননা শয়তান তাদের ওপর অবতীর্ণ হয়। আবার তাদের কারও কারও অবস্থা হয় মূর্ছিতের অবস্থার মতো, যেমন তাদের মুখ থেকে ফেনা বের হয়, ময়লা বের হয়, বিকট চিৎকার হতে থাকে, এমনসব কথা বলে যা সে নিজে কিংবা উপস্থিত কেউই বুঝতে পারে না। অনুরূপ আরও কত কিছু যে এসব পথভ্রষ্টদের দ্বারা ঘটে থাকে তার ইয়ত্তা নেই।

>
[1] হাদীসটির সনদ হাসান পর্যায়ের। সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২১১৭; মুসনাদে আহমাদ (১/২১৪)।

[2] হাদীসটির সনদ সহীহ। সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২১১৮; মুসনাদে আহমাদ(৫/৩৯৩)।

[3] সহীহ বুখারী (২/৩৫২); মুসনাদে আহমাদ (৬/৩৫৯-৩৬০)।

[4] সহীহ বুখারী (৬/৩৫৪-৩৫৫); মুসনাদে আহমাদ (১/২৩-২৪)।

[5] হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবু দাউদ, হাদীস নং ৫২৩০; মুসনাদে আহমাদ (৫/২৫৩)।

[6] হাদীসটির সনদ দুর্বল, হাদীস সহীহ। মুসনাদে আহমদ (৫/২২৭); মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবাহ (৪/৩০৫)।

[7] হাদীসটির সনদ দুর্বল। আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৫৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৩০০।