লগইন করুন
ক- অসিয়তের পরিচিতি:
অসিয়ত হলো কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরে কোনো কিছু করা বা হওয়ার নির্দেশনা প্রদান। আমানত পৌঁছে দেওয়া, সম্পদ দান করা, কন্যা বিয়ে দেওয়া, মৃতব্যক্তিকে গোসল দেওয়া, তার জানাযা পড়ানো, মৃতব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বন্টন করা ইত্যাদি অসিয়তের অন্তর্ভুক্ত।
খ- অসিয়ত শরী‘আতসম্মত হওয়ার মূলভিত্তি:
কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দ্বারা অসিয়ত শরী‘আতসম্মত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمۡ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلۡمَوۡتُ إِن تَرَكَ خَيۡرًا ٱلۡوَصِيَّةُ﴾ [البقرة: ١٨٠]
“তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোনো সম্পদ রেখে যায়, তবে তা অসিয়ত করবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮০]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُوصِي فِيهِ، يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلَّا وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوبَةٌ عِنْدَهُ».
“কোনো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় যে, তার অসিয়তযোগ্য কিছু রয়েছে আর সে দু’রাত কাটাবে অথচ তার কাছে তার অসিয়ত লিখিত থাকবে না।”[1]
গ- যেসব শব্দ দ্বারা অসিয়ত কার্যকর হবে:
১- মুখে বলার দ্বারা।
২- লেখার দ্বারা।
৩- স্পষ্ট বুঝা যায় এমন ইশারার দ্বারা।
প্রথমত: মুখে বলার দ্বারা:
আলেমদের মধ্যে মুখে স্পষ্ট বলার দ্বারা অসিয়ত কার্যকর হওয়াতে কোনো মতভেদ নেই। যেমন কেউ বলল, আমি অমুককে এ অসিয়ত করলাম। অথবা মুখে স্পষ্ট শব্দে না বলে এমন অস্পষ্ট শব্দে বলা যাতে ঈঙ্গিত বহন করে যে তিনি এ শব্দ দ্বারা অসিয়ত করেছেন। যেমন, কেউ কাউকে বলল,
“আমি আমার মৃত্যুর পরে অমুককে এটার মালিক বানালাম অথবা তোমরা সাক্ষ্য থাকো আমি অমুককে এ জিনিসের অসিয়ত করলাম ইত্যাদি”।
দ্বিতীয়ত: লিখিতভাবে অসিয়ত করা:
কেউ কথা বলতে অক্ষম হলে যেমন বোবা বা জিহ্বায় সমস্যা থাকলে তখন তার আক্বল (জ্ঞান) থাকলে এবং কখা উচ্চারণের সম্ভাবনা আর না থাকলে সে লিখিতভাবে অসিয়ত করলে তা কার্যকর হবে।
তৃতীয়ত: বুঝার মতো ইশারা দ্বারা:
বোবা বা জিহ্বায় সমস্যা থাকলে সে ব্যক্তি ইশারায় অসিয়ত করলে তার অসিয়ত কার্যকর হবে, তবে শর্ত হলো যার জিহ্বায় সমস্যা আছে তার চিরতরে কথা বলার সম্ভাবনা না থাকা।
ঘ- অসিয়তের হুকুম:
অসিয়ত করা শরী‘আতসম্মত ও এটি শরী‘আতির আদিষ্ট বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ شَهَٰدَةُ بَيۡنِكُمۡ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلۡمَوۡتُ حِينَ ٱلۡوَصِيَّةِ ٱثۡنَانِ﴾ [المائدة: ١٠٦]
“হে মুমিনগণ, যখন তোমাদের কারো নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন অসিয়তকালে তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন (ন্যায়পরায়ণ) ব্যক্তি সাক্ষী হবে।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ১০৬]
ঙ- অসিয়তের প্রকারভেদ:
১- ওয়াজিব অসিয়ত।
যার ওপর ঋণ, অন্যের হক, আমানত ও অঙ্গিকার রয়েছে তাকে এসব কিছু স্পষ্টভাবে লিখিত রাখা ওয়াজিব যাতে নগদ ও বাকী সব দেনা-পাওয়ানা নির্দিষ্ট করা থাকে। যার কাছে অন্যের আমানত ও অঙ্গিকার রয়েছে তা এমনভাবে স্পষ্ট থাকা যাতে অসিয়তকৃত ব্যক্তি ওয়ারিশদের সাথে স্পষ্টভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
২- সুন্নাত অসিয়ত:
এ ধরণের অসিয়ত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অসিয়তকারী তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ ওয়ারিশ ব্যতীত অন্যদের জন্য অসিয়ত করবে। এ ধরণের কল্যাণকর ও জনহিতকর কাজে অসিয়ত করা মুস্তাহাব, চাই তা আত্মীয়-স্বজন বা অনাত্মীয় বা নির্দিষ্ট স্থান যেমন অমুক মসজিদ বা অনির্দিষ্ট স্থান যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, লাইব্রেরী, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল ইত্যাদি যাই হোক।
চ- অসিয়তের পরিমাণ:
মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করা জায়েয নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেছেন,
«أُوصِي بِمَالِي كُلِّهِ؟ قَالَ: «لاَ» ، قُلْتُ: فَالشَّطْرُ، قَالَ: «لاَ» ، قُلْتُ: الثُّلُثُ، قَالَ: «فَالثُّلُثُ، وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ».
“হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি কি আমার সমুদয় মালের অসিয়ত করে যাব? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তবে অর্ধেক? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তবে এক তৃতীয়াংশ। তিনি বললেন, আর এক তৃতীয়াংশও অনেক।”[2]
ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করা জায়েয নেই, এমনিভাবে ওয়ারিশ ছাড়া অন্যদের জন্য ওয়ারিশের অনুমতি ব্যতীত এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করাও জায়েয নেই।
ছ- যেসব কাজে অসিয়ত শুদ্ধ হবে:
১- ন্যায়-সঙ্গতভাবে অসিয়ত করতে হবে।
২- আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যেভাবে অসিয়ত শরী‘আতসম্মত করেছেন অসিয়ত সেভাবে হতে হবে।
৩- অসিয়তকারী তার কাজে একনিষ্ঠ থাকতে হবে এবং অসিয়তের দ্বারা ভালো ও কল্যাণকর কাজের নিয়ত করবে।
জ- অসিয়তকারীর শর্তাবলী:
১- অসিয়তকারী দান করার যোগ্য হতে হবে।
২- সে অসিয়তকৃত বস্তুর মালিক হতে হবে।
৩- সে খুশী মনে ও স্বেচ্ছায় অসিয়ত করতে হবে।
ঝ- অসিয়তকৃত ব্যক্তি বা সংস্থার শর্তাবলী:
১- অসিয়তটি কল্যাণ ও বৈধ স্থানে হতে হবে।
২- অসিয়ত করার সময় যার জন্য অসিয়ত করবে তার বাস্তবে বা উহ্যভাবে অস্তিত্ব থাকতে হবে। অতএব, অস্তিত্বহীন কিছুর জন্য অসিয়ত করা শুদ্ধ নয়। কেবল জানা ব্যক্তি বা সংস্থার জন্যই অসিয়ত শুদ্ধ হবে।
৩- অসিয়তকৃত ব্যক্তি নির্দিষ্ট হওয়া।
৪- অসিয়তকৃত ব্যক্তি মালিকানার যোগ্য হওয়া বা মালিকানার অধিকারী হওয়া।
৫- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়তকারীর হত্যাকারী না হওয়া।
৬- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়তকারীর ওয়ারিশ না হওয়া।
ঞ- অসিয়তকৃত বস্তুর শর্তাবলী:
১- অসিয়তকৃত বস্তুটি ওয়ারিশ হওয়ার যোগ্য সম্পদ হওয়া।
২- অসিয়তকৃত বস্তুটি শরী‘আতের মাপকাঠিতে মূল্যমান সম্পদ হওয়া।
৩- সম্পদটি মালিকানা হওয়ার যোগ্য হওয়া, যদিও অসিয়ত করার সময় তার অস্তিত্ব না থাকে।
৪- অসিয়তকৃত বস্তুটি অসিয়ত করার সময় অসিয়তকারীর মালিকানায় থাকা।
৫- অসিয়তকৃত বস্তুটি শর‘ঈ গুনাহ বা হারাম বস্তু না হওয়া।
ট- যেভাবে অসিয়ত সাব্যস্ত হবে:
সর্বসম্মতভাবে লিখিত আকারে অসিয়ত করা মুস্তাহাব। অসিয়তের শুরুতে বিসমিল্লাহ, আল্লাহর সানা ও হামদ লিখবে। অতঃপর, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত ও সালাম জানাবে। অতঃপর বিসমিল্লাহ, আল্লাহর হামদ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত ও সালামের পরে লিখিত আকারে বা মৌখিকভাবে অসিয়তের সাক্ষ্যদ্বয়ের নাম ঘোষণা করবে।
ঠ- অসিয়তের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি:
১- শাসকের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
২- বিচারকের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
৩- মুসলিমের পক্ষ থেকে নির্বাচিত কোনো ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
ড- অসিয়ত ভঙ্গের কারণসমূহ:
১- স্পষ্ট বা ইশারায় অসিয়ত ফেরত নেওয়া।
২- শর্তযুক্ত অসিয়তে শর্ত পাওয়া না গেলে।
৩- অসিয়তের জন্য ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি না থাকলে।
৪- অসিয়তকারী অসিয়ত করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেললে।
৫- অসিয়তকারী মুরতাদ হয়ে গেলে কতিপয় আলেমের মতে অসিয়ত ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৬- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়ত ফেরত দিলে।
৭- অসিয়তকারীর আগে অসিয়তকৃত ব্যক্তি মারা গেলে।
৮- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়তকারীকে হত্যা করলে।
৯- অসিয়তকৃত বস্তুটি ধ্বংস হয়ে গেলে বা তাতে অন্যের মালিকানা প্রকাশ পেলে।১০- ওয়ারিশদের অনুমতি ব্যতীত কোনো ওয়ারিশকে অসিয়ত করলে অসিয়ত ভঙ্গ হয়ে যাবে।
[2] সহীহ বুখারী, অসাইয়া, হাদীস নং ২৫৯১; সহীহ মুসলিম, অসিয়ত, হাদীস নং ১৬২৮; তিরমিযী, অসাইয়া, হাদীস নং ২১১৬; নাসাঈ, অসাইয়া, হাদীস নং ৩৬২৮; আবু দাউদ, অসাইয়া, হাদীস নং ২৮৬৪; মুসনাদ আহমদ, ১/১৬৮; মুয়াত্তা মালিক, আকদিয়া, হাদীস নং ১৪৯৫; দারেমী, অসাইয়া, হাদীস নং ৩১৯৬।