লগইন করুন
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তরবিয়তী পরিবারের আদব-শিষ্টাচার ও আচার ব্যবহার। কারণ, মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধন এবং জাগরণ সৃষ্টিকরণ পারিবারিক আদব-শিষ্টাচারের মধ্যেই নিহিত। এজন্য বেশ কয়েকটি কারণে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কৃতজ্ঞ, চিন্তাবিদ ও গবেষকদেরকে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পারিবারিক আদব-শিষ্টাচারকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করছি।
প্রথমত: পারিবারিক তত্ত্বাবধান:
শিশুর জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধিসহ আত্মিক, মানসিক ও জৈবিক গঠন ও উন্নয়ন সাধনে পারিবারিক ভূমিকা অনন্য। কারণ, একমাত্র ঘর বা পরিবারই হচ্ছে শিশুর উৎসস্থল, আরাম-আয়েশ, আশ্রয় ও বিনোদন, পারিবারিক ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক-নির্দেশনা, আচার ব্যবহার আর আদব-শিষ্টাচারের মধ্য দিয়েই একটি শিশুর বিবেক বুদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। এজন্য শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারকে রঙ্গিন চশমার সাথে তুলনা করা হয়। রঙ্গিন চশমা যেমন চোখে লাগালে প্রকৃতির দৃশ্য ও রঙ্গিন দেখায় বা চশমার রং ধারণ করে; তেমনিভাবেই একটি শিশু তার পরিবারকে এমনি অনুসরণ করে। শিশুরা কী দেখল, কী শুনল? সেটি বড় বিষয় নয়, বরং পরিবার শিশুদেরকে কী বুঝালো, শিশু কী অনুধাবন করল? সেটি হচ্ছে বড় বিষয়। তাই পরিবার যেমন হয়ে থাকে শিশুর আত্মিক মানসিক তথা জ্ঞান অনুভূতিও সে রকম হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত: পিতা-মাতার ভূমিকা:
পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং পরিবার সার্বক্ষণিকভাবে তাদের সন্তান ও শিশুদের ফিতরাত ও স্বভাব অনুযায়ী তাদের কল্যাণ কামনা করে থাকে। তারা তাদের জীবনের মান-উন্নয়ন এবং দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে গড়ে তোলা-সহ আরাম-আয়েশে ও সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট থাকেন। এজন্য একটি শিশুর ওপর তার পরিবার, বাবা-মা ও অভিভাবকদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে থাকে। তাই শিশু শিক্ষা, তা‘লীম- তরবিয়ত, আদব-শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাবা-মা, অভিভাবক তথা পরিবারের ভূমিকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয়ত:
একজন সমাজ সংস্কারক পরিশোধক লেখক গবেষক ও চিন্তাবিদ মুসলিম উম্মাহ ও জাতির বাবা-মা, ও অভিভাবকদেরকে শিশু-পরিচর্যার বিষয়াবলী, শিক্ষা-দীক্ষা, তা‘লীম-তরবিয়ত ইত্যাদি হাতে নাতে শিক্ষা দিতে পারেন। তাদের সন্তানদের জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলো সহজে বুঝিয়ে দিতে পারেন; কিন্তু একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এ কাজটি সহজে করতে পারে না। তারা যথাযথভাবে বাবা-মা ও অভিভাবকদেরকে উন্মুক্ত বক্তব্য ও সম্বোধন করতে সক্ষম হয় না। কারণ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহ সব সময়ই তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এবং সার্বক্ষণিক কল্যাণ কামনা করে থাকে। তারা প্রয়োজনের আলোকে জাতির অনুসরণে সামাজিক পরিবর্তন, পরিশোধন ও সংস্কার সাধনে সাড়া দিয়ে থাকে।
এজন্য মুসলিম উম্মাহ ও জাতির শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিবিদ, চিন্তাবিদ, পরিশোধক ও গবেষকদেরকে পরিবার এবং শিশুদের জন্য পারিবারিক তা‘লীম-তরবিয়ত শিক্ষা দীক্ষার বিষয়গুলোকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। বিশেষ করে বাবা-মা ও অভিভাবকদের জন্য তা‘লীম-তরবিয়ত সংক্রান্ত আদব-শিষ্টাচার, সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বাবা-মা ও অভিভাবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে তারা সঠিকভাবে যোগ্য ও উপযুক্ত বাবা-মা হিসেবে সন্তানদের তারবিয়তে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা নানা ধরনের অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিকভাবে তাদের সন্তানদের ও শিশুদের আত্মিক-মানসিক, জৈবিক এবং শারীরিকসহ সার্বিক বিষয়াবলী বিবেচনা করে তাদেরকে আদব-শিষ্টাচার, তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা, দীক্ষা ইত্যাদি প্রদান করতে সক্ষম হতে পারে এবং তাদের সন্তানদের ইসলামের মূল্যবোধ অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে।
এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই বাবা-মা পরিবার এবং অভিভাবকদের অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, তারাই হচ্ছে যুগ ও জাতির পরিশোধনের শুভ-যাত্রা। তাই ইসলামী সংস্কৃতি-বিদ, সমাজ সেবক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও গবেষকদেরকে সাধ্যানুযায়ী তাদের বিদ্যা বুদ্ধি, যোগ্যতা অভিজ্ঞতার আলোকে বিশুদ্ধ নিয়ত ও এখলাছের সাথে বাবা-মা ও অভিভাবকদের জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কারণ, সন্তানদের ওপর তাদের বাবা-মা ও অভিভাবক এবং পরিবারের ভূমিকাই সরাসরি বিনা বাধায় সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তারাই তাদের সন্তানদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে, আচার-আচরণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে পারে। সন্তানেরাও সহজে তাদের বাবা-মা অভিভাবক এবং পরিবারের আচার-আচরণ, বক্তব্য, আদব-শিষ্টাচার ও উপদেশাবলি মান্য করতে ও বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করে। এ সম্পর্কে আমাদের কাছে অনেক ভুরি ভুরি নজির, বাস্তব উদাহরণ রয়েছে।
একজন বাবা-মা বা অভিভাবক এবং পরিবার যদি সঠিকভাবে তাদের সন্তানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাহলে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খুব সহজেই তাদের সন্তানদেরকে তা‘লীম-তরবিয়তের যথাযথ ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। শিশুদের তারবিয়াতী শিক্ষা, আদব-শিষ্টাচার ও পরিশোধন স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন থেকেই শুরু হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন যদি সঠিকভাবে গড়ে ওঠে তাহলে তার প্রভাব যেমন সন্তানদের ওপর পড়ে, তেমিনভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি কলহ-বিবাদ লেগেই থাকে, তাহলে তার প্রভাবও সন্তানদের ওপর পড়ে, সন্তানদের তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-শিষ্টাচার ইত্যাদির বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
এজন্য স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন এবং পারিবারিক জীবনে ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ইত্যাদি অবশ্যই থাকতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি পরিবারে এ গুণগুলো প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবারে আরাম-আয়েশ, শান্তি বিরাজ করতে পারবে না। সে পরিবার তাদের সন্তান সন্ততিদের তা‘লীম-তরবিয়ত, আদব-শিষ্টাচার, আত্মিক ও মানসিক বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। শিশুরা সার্বিকভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে না।
অতএব, শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা, শিষ্টাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক, পারিবারিক ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা দয়া অনুগ্রহ এবং নিরাপত্তা ইত্যাদি পূর্বশর্ত। বাবা-মায়ের বা পরিবারের সুসম্পর্ক ভালোবাসা ইত্যাদি শিশুদের হৃদয়ে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, শান্তি, নিরাপত্তার ও আনুগত্যের প্রবণতার জন্ম দেয়। শিশুরা সর্বাবস্থায় তাদের বাবা-মা ও পরিবারের ডাকে সাড়া দেয়, তারা তাদের অনুগত স্বীকার করে, তাদের কল্যাণকর বিষয়গুলো বাস্তবায়নে চেষ্টা করে। বাবা-মায়ের সঠিক ভালোবাসা আর স্নেহ মমতার মাধ্যমে শিশুদের অন্তর থেকে অহেতুক ভয়-ভীতি আর নেতিবাচক প্রভাব দূরীভূত হয়ে যায়। তারা নিজেদেরকে আত্মিক ও মানসিকভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে।
প্রকৃত প্রেমিক, আগ্রহী, সচেতন ও বিশ্বস্ত সেই ব্যক্তি, যে সঠিক কল্যাণের পথে নিজের সর্বস্ব বিলীন করে দিতে পারে, বিপদে সংকটে ধৈর্য ধারণ করতে পারে। দুঃখ কষ্ট ইত্যাদিতে বিচলিত না হয়ে ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে পারে। আর অপারগ, দুর্বল, কাপুরুষ ঐ ব্যক্তি, যে প্রয়োজনের সময় তার শক্তি-সমর্থ ব্যয় করতে পারে না। দুঃখ কষ্ট আর আপদে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে পারে না। আর এ বিষয়টিই আমাদের মুসলিম উম্মাহ ও জাতির মধ্যে সর্বস্তরে বিরাজ করছে। যেখানে ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষা তার ধৈর্য, সাহসিকতা নেই, সেখানে সঠিক তা‘লীম-তরবিয়ত আর শিক্ষা-দীক্ষার আশা করা যায় না। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধন কল্পনা করা অনুচিত।
এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী এবং পরিবারকে সজাগ ও সচেতন করতে হবে। শিশুদের আত্মিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক অনুধাবনের অনুপ্রেরণা জাগাতে হবে। পরস্পরের মধ্যে দয়া-অনুগ্রহ, স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার উৎসাহ প্রদান করতে হবে। যাতে করে প্রথমে স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের মধ্যে সে সকল গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করে, তারপর তাদের সন্তানদেরকে সেগুলোর মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা ও তা‘লীম-তরবিয়ত প্রদান করতে পারে। কারণ, হারিয়ে যাওয়া বা অস্তিত্বহীন বস্তু কোনো কিছু দিতে পারে না। তেমনিভাবে যে সংস্কার বা পরিবার হিংসা-বিদ্বেষ আর ঝগড়া-বিবাদের কারণে ভেঙ্গে গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে, সে পরিবার থেকে শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা তা‘লীম-তরবিয়তসহ ভালো কিছুর আশা করা যায় না। বরং সে সব পরিবারে ফিতনা-ফ্যাসাদ, অ-শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা আর অপরাধের প্রবণতা দিন দিন বাড়তেই থাকে।
এজন্য ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও মূলনীতি অনুযায়ী একটি পরিবারের আদব-শিষ্টাচার, আচার-আচরণ, সামাজিক, অর্থনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, তা‘লীম তরবিয়তসহ আত্মিক ও মানসিক বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, একটি পরিবার হচ্ছে সঠিক ও শক্তিশালী জাতি গঠনের প্রথম ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিপ্রস্তর। একটি জাতির অগ্রগতি উন্নতি, সংস্কার পরিশোধন ইত্যাদি সার্বিক বিষয়াবলী নির্ভর করে পরিবারের ওপর। সুতরাং মুসলিম উম্মাহ ও জাতির চিন্তাবিদ গবেষক, সংস্কৃতি-বিদ ও পরিশোধকদের পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ও বিষয়াবলীর প্রতি গুরুত্ব সহকারে মনোনিবেশ করতে হবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষণীয় সভা, সেমিনার ও আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে পারিবারিক বিষয়াবলীকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পারিবারিক শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে বিশেষ প্রোগাম ও সেমিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে সমাজের কোনোও মানুষ বা সদস্যই পারিবারিক বিষয়াবলি সম্পর্কে অজ্ঞ আর মূর্খ না থাকে। সমাজের প্রতিটি সদস্য যেন সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠে। তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়।