লগইন করুন
এমন কতিপয় ওয়াজিব রয়েছে যা ছুটে গেলেও হাজ্জ সিদ্ধ হয়ে যায়, যেগুলোকে ফিকহের পরিভাষায় হাজ্জের ওয়াজিব বলা হয়। তা হলো:
১। শরিয়াত নির্ধারিত মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধা। এর দলীল নাবী (সা.)-এর বাণী:
يُهِلُّ أَهْلُ الْمَدِينَةِ مِنْ ذِي الْحُلَيْفَةِ وَيُهِلُّ أَهْلُ الشَّأْمِ مِنْ الْجُحْفَةِ
মদীনাবাসী যুলহুলায়ফা থেকে ইহরাম করবে এবং শামবাসী জুহফা থেকে ইহরাম করবে।[1]এ হাদীসের অর্থ হচ্ছে নির্দেশসূচক।
যার প্রমাণ ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত অপর একটি বর্ণনা, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, আমি কোন স্থান থেকে উমরা করব? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সা.) নাজদবাসীদের জন্য ‘কারন মানাযিল’ নামক স্থানকে নির্ধারিত করেন।[2]
২। যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারীখে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা। কারণ, নাবী (সা.) সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করেছেন। আর তিনি একথাও বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[3]
আর সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে আরাফা হতে প্রস্থান করায় জাহিলী যুগের বিজাতীর সাদৃশ্যতা হয়ে যায়; কেননা তারা সূর্য ডুবার পূর্বেই আরাফা হতে রওনা হয়ে যেত।
৩। ঈদের রাত্রে মুযদালিফায় রাত্রী যাপন করা। এর দলীল মহান আল্লাহর বাণী:
فَإِذَا أَفَضْتُم مِّنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُواْ اللّهَ عِندَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ
আর যখন তোমরা আরাফাত হতে ফিরবে তখন মাশ‘আরুল হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করবে।[4]
আর তার শেষ সময় হচ্ছে ফজর সলাতের সময় পর্যন্ত। কারণ, নাবী (সা.) উরওয়া বিন মুযাররিস (রা.)-কে সম্বোধন করে বলেন:
مَنْ شَهِدَ صَلَاتَنَا هَذِهِ وَوَقَفَ مَعَنَا حَتَّى نَدْفَعَ وَقَدْ وَقَفَ بِعَرَفَةَ قَبْلَ ذَلِكَ لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَقَدْ أَتَمَّ حَجَّهُ وَقَضَى تَفَثَه
যে ব্যক্তি আমাদের এ (ফজর) সলাতে উপস্থিত হবে এবং এখান থেকে রওনা হওয়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে অবস্থান করবে। আর এর পূর্বে সে আরাফায় রাত্রে কিংবা দিনে অবস্থানও করেছে, তাহলে সে তার হাজ্জ সম্পূর্ণ করে নিল এবং তার দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে ফেলল।[5]
আর দুর্বলরা; যেমন, নারী ও শিশুরা, যাদের জন্য মানুষের ভীড়-ভাড় কষ্টের কারণ হতে পারে, তাদের জন্য ঈদের রাতের শেষভাগে মুযদালিফা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া জায়েয; যাতে করে তারা মিনায় মানুষের ভীড়ের পূর্বেই পাথর মেরে নিতে পারে।
কারণ, আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) তাঁর পরিবারের দুর্বলদের আগেই মিনা পাঠিয়ে দিতেন। তাঁদের কেউ তো মিনায় এসে ফজর সলাত আদায় করতেন আবার কেউ তার কিছুক্ষণ পরে পৌঁছতেন। তাঁরা মিনা পৌঁছে জামরায় পাথর মেরে নিতেন। আর তিনি লোকদেরকে বলতেন, আল্লাহর রসূল (সা.) এ ধরণের দুর্বলদের জন্য ছাড় দিয়েছেন।[6]
অনুরূপ আবূ বাকর (রা.)-এর মেয়ে আসমা (রা.) চন্দ্র অস্তমিত হওয়ার অপেক্ষা করতেন। তারপর তিনি মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যেতেন এবং জামরায় পাথর মেরে নিতেন। অতঃপর নিজ তাঁবুতে ফিরে এসে ফজরের সলাত আদায় করতেন এবং তিনি বলতেন যে, আল্লাহর রসূল (সা.) মহিলাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন।[7]
আর মুযদালিফার সমস্ত জায়গায় হচ্ছে অবস্থান স্থল। তবে হাজীদের জন্য মুযদালিফার সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক; যাতে করে কোন হাজী তার বাইরে অবস্থান না করে।
৪। ঈদের দিন (১০ তারিখে) জামরায়ে আক্বাবায় (বড় জামরায়) এবং তাশরীকের দিনগুলিতে ( ১১, ১২, ১৩ তারিখে) সময় মত তিনটি জামরাতেই কংকর নিক্ষেপ করা। এর দলীল মহান আল্লাহর বাণী:
وَاذْكُرُواْ اللّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلاَ إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلا إِثْمَ عَلَيْهِ لِمَنِ اتَّقَى
তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্কে স্মরণ করবে; অতঃপর যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে দু’দিনে চলে যায় তার প্রতি কোন গুনাহ্ নেই এবং যে ব্যক্তি অধিক সময় পর্যন্ত বিলম্ব করবে, তার প্রতিও গুনাহ্ নেই, এটা তার জন্য যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে।[8]
আর নির্দিষ্ট দিনগুলোর তাফসীর হচ্ছে তাশরীকের দিনগুলি (১১, ১২ ও ১৩ যিলহাজ্জের দিনগুলি)। আর জামরাগুলিতে পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে মহান আল্লাহর যিকিরের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, নাবী (সা.) বলেছেন:
إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبِالصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْيُ الْجِمَارِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ
নিশ্চয়ই বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ায় সাঈ এবং জামরাগুলিতে কংকর নিক্ষেপ করা আল্লাহর যিকির (স্মরণ) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে বিধি-বদ্ধ করা হয়েছে।[9]
৫। পুরুষদের জন্য মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা। তবে মহিলারা শুধুমাত্র চুল ছোট করবে। কেননা নাবী (সা.) বলেছেন:
لَيْسَ عَلَى النِّسَاءِ الْحَلْقُ إِنَّمَا عَلَى النِّسَاءِ التَّقْصِيرُ
নারীদের জন্য মাথা মুণ্ডন জায়েয নয়। তাদের জন্য একমাত্র মাথার চুল ছোট করার বিধান রয়েছে।[10]
৬। আইয়ামে তাশরীক্বের রাত্রিগুলি মিনায় অতিবাহিত করা। তবে তাড়াতাড়ি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য মিনায় ১১ ও ১২ যিলহাজ্জের রাতগুলি যাপন করা। আর বিলম্ব করতে ইচ্ছুক হাজীর জন্য ১৩ যিলহাজ্জের রাত পর্যন্ত যাপন করা। কারণ, নাবী (সা.) মিনায় এ রাতগুলি যাপন করেছেন এবং তিনি বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান গ্রহণ কর।[11]
আরো আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) থেকে বর্ণিত যে, আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.) হাজীদেরকে যমযম পানি পান করাবার উদ্দেশ্যে নাবী (সা.)-এর নিকট মিনার রাতগুলি মক্কায় কাটানোর জন্য অনুমতি চাইলে, তাঁকে তিনি অনুমতি দেন।[12]
অপর একটি বর্ণনায় আছে, “তাঁকে তিনি এ ব্যাপারে ছাড় দেন।” আর ছাড় দেয়ার কথাটি প্রমাণ করে যে, কোন ওযর না থাকলে মিনায় রাত্রী যাপন করা ওয়াজিব।
উপরোক্ত ছয়টি কাজ হাজ্জের ওয়াজিব। (যা প্রত্যেক হাজীর প্রতি ওয়াজিব) তবে এগুলি ছাড়াও হাজ্জ শুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এগুলির কোন একটি ছেড়ে দিলে অধিকাংশ আলিমগণের মতে একটি ছাগল বা উঁট কিংবা গরুর সাত ভাগের একভাগ ফিদয়া (মুক্তিপণ) ওয়াজিব হয়ে যাবে। যা মক্কায় যবহ করে সেখানকার দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে দিতে হবে। (মহান আল্লাই অধিক পরিজ্ঞাত)
৭। আর তাওয়াফে বিদা’ (বিদায়ী তাওয়াফ) সমস্ত হাজীর উপর ওয়াজিব হবে যারা মক্কা থেকে নিজ দেশে প্রস্থান করবে। কারণ, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন:
أُمِرَ النَّاسُ أَنْ يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِمْ بِالْبَيْتِ إِلَّا أَنَّهُ خُفِّفَ عَنْ الْحَائِضِ
লোকদেরকে (নাবী (সা.)-এর পক্ষ হতে) নির্দেশ দেয়া হল যে, তাদের শেষ সাক্ষাৎ যেন বায়তুল্লাহর সাথে হয়। তবে হায়য অবস্থায় থাকা মহিলাকে ছাড় দেয়া হয়েছে।[13]
আরো নাবী (সা.) বিদায় হাজ্জে মক্কা থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে বায়তুল্লাহ্ও তাওয়াফ করেন। ৮। [আর কুরবানী ওয়াজিব হয় একমাত্র মক্কা বা হারামের এলাকার বাইরের অধিবাসী যারা হাজ্জে তামাত্তুকারী বা কিরানকারী হবে তাদের উপর। আর যার পক্ষে সম্ভব না হয়, সে ব্যক্তি হাজ্জের দিনগুলোর মধ্যে তিনদিন এবং গৃহে ফেরার পর সাতদিন, এ মোট দশদিন সিয়াম পালন করবে।][14]
[2]. সহীহ বুখারী ১৫২৫।
[3]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭, নাসাঈ ৩০৬২, সুনানুল কুবরা বাইহাকী ৯৪৬৫।
[4]. সূরা আল-বাক্বারাঃ ১৯৮
[5]. নাসাঈ ও তিরমিযী ৮৯১, হাদীসটি সহীহ
[6]. সহীহ বুখারী ১৬৭৬।
[7]. সহীহ বুখারী ১৬৭৯।
[8]. সূরাহ্ আল-বাক্বারাহঃ ২০৩)
[9]. সহীহ: সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ২৮৮২।
[10]. সহীহ: আবূ দাউদ ১৯৮৫।
[11]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২৯৭।
[12]. সহীহ বুখারী ১৭৪৩-১৭৪৫ ও সহীহ মুসলিম ১৩১৫।
[13]. সহীহ বুখারী ১৭৫৫ ও সহীহ মুসলিম ১৩২৮।
[14]. সূরা বাকারা ২:১৯৬