লগইন করুন
উমরার সংজ্ঞা: উমরা হচ্ছে কয়েকটি কাজের নাম। যেমন- ইহরাম বাঁধা, তাওয়াফ, সাঈ এবং মাথা মুণ্ডন কিংবা চুল ছোট করা।
ইহরামের সংজ্ঞা: আর ইহরাম হলো হাজ্জ বা উমরার ইবাদাতে প্রবেশ করা এবং তা পালন করার নিয়্যাত (অন্তরের সংকল্প) করা।
- উমরা পালনে ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য সুন্নাত হলো, ফরয গোসল সম্পাদনের ন্যায় ভালভাবে গোসল করা, মাথায় ও দাড়িতে যথাসাধ্য যে কোন ভাল সুগন্ধি ব্যবহার করা। আর তার ঘ্রাণ ইহরাম করার পরে অবশিষ্ট থাকলে কোন ক্ষতি নেই। কারণ, মা আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا أَرَادَ أَنْ يُحْرِمَ يَتَطَيَّبُ بِأَطْيَبِ مَا يَجِدُ ثُمَّ أَرَى وَبِيصَ الدُّهْنِ فِي رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ بَعْدَ ذَلِكَ
আল্লাহর রসূল (সা.) ইহরাম করার ইচ্ছা করলে যথাসাধ্য সর্বাধিক ভাল সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তারপরে আমি তাঁর মাথায় ও দাড়িতে সুগন্ধির চমক দেখতে পেতাম।[1]
- আর ইহরামের পূর্বে গোসল করা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য সুন্নাত। এমনকি ঋতুবতি এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলাও গোসল করবে।
কারণ (আবূ বাকর সিদ্দীক (রা.)-এর স্ত্রী) আসমা বিন্তে উমায়সকে বিদায় হাজ্জের বছর যুলহুলাইফা নামক স্থানে মুহাম্মাদ বিন আবু বাকর ভূমিষ্ট হলে নাবী (সা.) নির্দেশ দিয়ে বলেন: তুমি গোসল করে (লজ্জাস্থানে) কাপড় ভালভাবে বেঁধে নিয়ে ইহরাম করে নাও।[2]
- গোসল করে সুগন্ধী লাগানোর পর ইহরামের কাপড় পরিধান করবে। আর তা হলো পুরুষদের জন্য সেলাই বিহীন লুঙ্গী ও চাদর। আর মহিলারা সাজ-সজ্জা ব্যতীত যে কোন রকম কাপড় পরিধান করতে পারবে।
- অতঃপর ঋতুবতী এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলা ব্যতীত অন্যরা ফরয সলাতের সময় হলে (মীক্বাতে) ফরয সলাত আদায় করবে। আর যদি ফরয সলাতের সময় না হয় তাহলে তাহইয়্যাতুল উযূর নিয়্যাতে দু’রাক‘আত সলাত আদায় করবে।
- সলাত শেষ করে ইহরাম (হাজ্জ বা উমারায় প্রবেশের অন্তরে নিয়্যাত) করবে এবং বলবে:
لَبَّيْكَ عُمْرَة
[লাব্বাইকা উমরাতান]
(হে আল্লাহ !) আমি হাজির হয়েছি উমরার উদ্দেশ্যে।
অতঃপর অধিক পরিমানে তালবিয়া পাঠ করবে।
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ
[লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল্মুলক, লা শারীকা লাকা]
তোমার নিকট আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি, আমি হাজির হয়েছি, তোমার কোন অংশীদার নেই। আমি হাজির হয়েছি, নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নিয়ামাত এবং রাজত্ব তোমারই। তোমার কোন অংশীদার নেই।[3]
ইহাই হচ্ছে নাবী (সা.)-এর তালবিয়া। তবে কখনো কখনো কিছু অতিরিক্ত বলতেন। যেমন,
لَبَّيْكَ إِلَهَ الْحَقِّ لَبَّيْكَ
[লাব্বাইকা ইলাহাল হাক্কি লাব্বাইক]
আমি হাজির হয়েছি, হে সত্য মাবূদ! আমি হাজির হয়েছি।[4]
- আর পুরুষদের জন্য উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা সুন্নাত। কেননা সায়িব বিন খাল্লাদ (রা.)-এর বর্ণিত হাদীসে রয়েছে যে, নাবী (সা.) বলেন:
أَتَانِي جِبْرِيلُ فَأَمَرَنِي أَنْ آمُرَ أَصْحَابِي أَنْ يَرْفَعُوا أَصْوَاتَهُمْ بِالْإِهْلَالِ وَالتَّلْبِيَة
আমার নিকট জিবরীল (আ.) এসে নির্দেশ দিলেন যে, আমি যেন নিজ সহচরদের তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করার আদেশ প্রদান করি।[5]
এর কারণ হল যে, তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করা আল্লাহর নিদর্শন প্রকাশ করা এবং তার তাওহীদের (একত্ব) ঘোষনা করা।
- তবে মহিলারা তালবিয়া এবং অন্যান্য যিকির ও দু‘আ উচ্চস্বরে পাঠ করবে না; কারণ, তাদের ক্ষেত্রে পর্দাই হচ্ছে শারঈ বিধান।
আর তালবিয়া (لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ) এর অর্থ হল, হে আল্লাহ আপনার ডাকে হাজির হয়েছি এবং আপনার আনুগত্যে আমি অটল। কারণ, আল্লাহ পাক তাঁর দুই খালীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) ইবরাহীম (আ.) ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর ভাষায় নিজ বান্দাদেরকে হাজ্জের জন্য আহবান করে বলেন:
وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ )الحج27 (لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ
আর মানুষের মাঝে হাজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর সব (পথক্লান্ত) শীর্ণ উটের পিঠে, বহু দূরের গভীর পর্বত সংকুল পথ বেয়ে। যাতে তাদের জন্য (এখানে রাখা দুনয়া ও আখিরাতের) কল্যাণসমূহের কাজে উপস্থিত হতে পারে। আর তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যে রিযিক দান করেছেন, নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। কাজেই তোমরা (নিজেরা) তাত্থেকে খাও এবং দুঃস্থ অভাবীদের খাওয়াও।[6]
- আর ইহরামে ইচ্ছুক ব্যক্তি যদি ব্যাধি বা অন্য কোন বাধার কারণে নিজ হাজ্জের বা উমরার কার্যাবলী সম্পূর্ণ করতে অপারগ হওয়ার আশঙ্কা করে, তাহলে তার জন্য ইহরামের নিয়্যাত করার পূর্বে শর্ত লাগিয়ে নেয়া সুন্নাত। সুতরাং ইহরাম করার সময় বলবে:
اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي
[আল্লাহুম্মা মাহিল্লী হাইসু হাবাসতানী]
হে আল্লাহ! যেখানে তুমি আমাকে বাধা প্রদান করবে সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।[7]
(অর্থাৎ যেখানে আমার হাজ্জ বা উমরার ইবাদাত সম্পূর্ণ করায় কোন কারণে বাধা সৃষ্টি হবে, যেমন রোগ, হাজ্জের স্থানে পৌঁছতে বিলম্ব বা অন্য কোন অসুবিধা, সেখানেই আমি নিজ ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাব। কেননা মা আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ضُبَاعَةَ بِنْتِ الزُّبَيْرِ فَقَالَ لَهَا لَعَلَّكِ أَرَدْتِ الْحَجَّ قَالَتْ وَاللَّهِ لَا أَجِدُنِي إِلَّا وَجِعَةً فَقَالَ لَهَا حُجِّي وَاشْتَرِطِي وَقُولِي اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي
নাবী (সা.) যুবাইর (রা.)-এর মেয়ে যুবাআ’হ (রা.)-এর নিকট গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, মনে হচ্ছে তুমি হাজ্জের নিয়্যাত করেছ? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি খুব অসুস্থ। তখন রসূল (সা.) বললেন: তুমি হাজ্জ কর এবং এভাবে বলে শর্ত করে নাও (আল্লাহুম্মা মাহিল্লী হাইসু হাবাসতানী) হে আল্লাহ! যেখানে তুমি আমাকে বাধা দিবে সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।[8]
অপর একটি বর্ণনায় আছে, তোমার প্রতিপালকের নিকট যে শর্ত রেখেছ তা তোমার অধিকার।[9]
- তবে যার হাজ্জ বা উমরা সম্পূর্ণ করতে অপারগ হওয়ার আশঙ্কা নেই, তার জন্য শর্ত করা ঠিক নয়। কারণ, নাবী (সা.) ইহরাম করার সময় কোন শর্ত করেননি। আর তিনি উম্মাতকে সম্বোধন করে বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান নিয়ে নাও।[10]
তিনি (সা.) সকল সাহাবীকে সাধারণভাবে শর্ত করার নির্দেশ দেননি, বরং একমাত্র যুবাইরের-এর মেয়ে যুবাআ’হ-কে তাঁর ব্যধিগ্রস্ত হওয়ার কারণে হাজ্জ সম্পাদনে অপারগ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় শর্ত করার নির্দেশ দেন।
- আর মুহরিম ব্যক্তির বেশী বেশী তালবিয়া পাঠ করা উচিত; কারণ, তালবিয়াই হচ্ছে হাজ্জ ও উমরার বাচনিক নিদর্শন। বিশেষ করে অবস্থা ও কালের পরিবর্তনের সময় অধিক মাত্রায় তালবিয়া পাঠ করবে। যেমন, উঁচু স্থানে উঠা বা নীচু স্থানে অবতরণের সময়, কিংবা রাত বা দিনের আগমনের সময়, অথবা কখনো ইহরামের নিষিদ্ধ কাজের মনস্থঃ হওয়ার সময় বা কোন অবৈধ কাজের খেয়াল আসার সময় ইত্যাদি।
- আর উমরায় তালবিয়া পাঠ করা ইহরাম বাঁধার সময় থেকে শুরু করে তাওয়াফ আরম্ভ করার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত এবং হাজ্জে ইহরাম বাঁধার সময় থেকে শুরু করে ঈদের দিন জামরা আক্বাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে।
- অতঃপর মক্কায় প্রবেশ করলে সম্ভব হলে গোসল করে নেয়া সুন্নাত।
কারণ, নাবী (সা.) মক্কায় প্রবেশকালে গোসল করতেন। আরো আব্দুল্লাহ বিন উমার (সা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.) মক্কা প্রবেশের সময় বাতহা নামক উঁচু এলাকা হয়ে প্রবেশ করতেন এবং মক্কা প্রস্থানের সময় নীচু এলাকা হয়ে বের হতেন।[11]
অতএব নাবী (সা.) যে পথ হয়ে প্রবেশ করেছেন এবং যে পথ হয়ে বিদায় হতেন সে পথ দিয়ে কোন হাজী যদি প্রবেশ করতে পারে এবং বিদায় হতে পারে তাহলে তা মুসতাহাব।
- অতঃপর মাসজিদ হারামে পৌঁছে প্রবেশের সময় প্রথমে ডান পা রাখবে এবং এ দু‘আ পাঠ করবে:
بِسْمِ اللَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذُنُوبِي وَافْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ، أَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
[বিসমিল্লাহি, ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাগফিরলী যুনূবী ওয়াফ্তাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা। আউযু বিল্লাহিল আযীম, ওয়াবি ওয়াজ্হিহিল কারীম, ওয়া সুলতানিহিল ক্বাদীম মিনাশশাইত্ব-নির রাজীম]
আমি আল্লাহর নামে শুরু করছি, সলাত (দরূদ) ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূলের প্রতি। হে আল্লাহ! তুমি আমার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও এবং তোমার রাহমাতের দরজাসমূহ আমার জন্য খুলে দাও। আমি মহান আল্লাহর নিকট তাঁর সম্মানিত চেহারার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রাচীন (স্থায়ী) রাজত্বের মাধ্যমে আশ্রয় গ্রহণ করছি।[12]
- আর মাসজিদে হারামে বিনয় ও নম্রতার সাথে এবং মহান আল্লাহর তা’যীম ভরা অন্তর নিয়ে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ যে তাঁর সম্মানিত কা’বা ঘরের উদ্দেশ্যে পৌঁছার তাওফীক দিয়েছেন সেই নিয়ামতকে স্মরণ করবে। তারপর তাওয়াফ শুরু করার নিয়্যাতে হাজরে আসওয়াদকে (কাল পাথর) উদ্দেশ্য করে কা’বা ঘরের দিকে এগিয়ে যাবে। আর এই নিয়্যাত মনে মনে হবে উচ্চারণ করে (নাওয়াতুত্ তাওয়াফা) অর্থাৎ ‘আমি তওয়াফের নিয়ত করছি’ বলবে না; কারণ, মুখে উচ্চারণ করে নিয়্যাত করার কোন প্রমাণ নাবী (সা.) হতে নেই। বরং নিয়তের স্থান হচ্ছে হৃদয়।
- অতঃপর সম্ভব হলে মহান আল্লাহর মহত্ব প্রকাশ এবং তাঁর রসূল (সা.)-এর অনুসরণের উদ্দেশ্যে ডান হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করবে এবং হাজরে আসওয়াদে চুম্বন দিবে। কখনো এ ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখবে না যে, পাথর কোন উপকার বা অপকার করতে পারে। ইহা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে।
এ মর্মে আমীরুল মু’মিনীন উমার বিন খাত্তাব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি হাজরে আসওয়াদে চুম্বন দেয়ার পর বলতেন:
إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لَا تَضُرُّ وَلَا تَنْفَعُ وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ
নিশ্চয়ই আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র, তুমি কোন ক্ষতিও করতে পার না এবং উপকারও করতে পার না। তাই আমি যদি নাবী (সা.)-কে, তোমাকে চুমা দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে কখনো চুমা দিতাম না।[13]
- তবে যদি সরাসরি চুম্বন দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে নিজ হাতে স্পর্শ করে হাতে চুম্বন দিবে।
এর দলীল আবদুল্লাহ বিন উমার (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নিজ হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলেন। অতঃপর নিজ হাতে চুম্বন দিলেন এবং বললেন, আমি যখন থেকে নাবী (সা.)-কে এভাবে চুম্বন দিতে দেখেছি তখন থেকে ইহা কখনো ছাড়িনি।[14]
- আর যদি হাত দ্বারা স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলে ভিড় করবে না; কারণ, ভিড় করলে নিজেরও কষ্ট হবে এবং অপরকেও কষ্ট দেয়া হবে। বরং অনেক সময় তা ক্ষতির কারণ হয়, ইবাদাতের বিনয় ও আন্তরিকতা বিনষ্ট হয়। যার ফলে তাওয়াফের লক্ষ্য উদ্দেশ্য যে আল্লাহর ইবাদাত তা হারিয়ে যায়। আবার কখনো কখনো আপত্তিকর কথা, ঝগড়া ও বিবাদ পর্যন্ত হয়ে যায়। তাই ভিড় থাকলে দূর থেকে হলেও ইশারা করাই যথেষ্ট।
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) উটের পিঠে চেপে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলেন এবং হাজরে আসওয়াদের সামনে আসলেই সে দিকে ইশারা করতেন।[15]
অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে, তাঁর নিকট কোন কিছু থাকলে তা দ্বারা ইশারা করতেন এবং তাকবীর পাঠ করতেন।[16]
- তারপর কা’বা ঘরকে বামে রেখে ডান দিকে এগিয়ে যাবে, অতঃপর রুকনে ইয়ামানীতে পৌঁছালে সম্ভব হলে বিনা চুমায় তা স্পর্শ করবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে তা স্পর্শ করার জন্য ভিড় করবে না।
- আর হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী ছাড়া কা’বা ঘরের অন্য কোন অংশ স্পর্শ করবে না। কারণ, এই দুইটি কোনা একমাত্র ইবরাহীম (আ.)-এর নির্মিত কা’বার ভিত্তির উপর রয়েছে। (অপর দুটি কোনা কুরাইশদের কা’বা ঘরকে ছোট করে নির্মাণ করায় ইবরাহীম (আ.)-এর নির্মিত ভিত্তির উপর নেই।) আর নাবী (সা.) হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী ছাড়া কা’বা ঘরের অন্য কোন অংশ স্পর্শ করেননি।[17]
ইমাম আহমাদ প্রখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ হতে এবং তিনি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেন যে, একদা তিনি মুআবিয়া (রা.)-এর সাথে কা’বা ঘরের তাওয়াফ করেন। অতঃপর মুআবিয়া কা’বা ঘরের সমস্ত রুকুনগুলি (কোনগুলি) স্পর্শ করা আরম্ভ করলেন। তখন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বললেন, এ দুটি রুকুন (রুকনে শামী ও ইরাকী) আপনি কেন স্পর্শ করছেন অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.) তা করেননি। তখন মুআবিয়া (রা.) বললেন, বায়তুল্লাহর কোন অংশই পরিত্যক্ত নয়। তখন ইবনু আব্বাস (রা.) এই আয়াত পাঠ করলেন:
(لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ)الأحزاب 21
নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।[18] তখন মুআবিয়া (রা.) বললেন, তুমি সত্য কথাই বলেছ।[19]
- রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে এ দু‘আ পাঠ করবে:
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
[রাব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাহ্, ওয়াফিল আ-খিরাতি হাসানাহ্, ওয়া ক্বিনা আযাবান্নার]
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দাও এবং আখেরাতেও কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে রক্ষা কর [সূরাহ্ আল-বাক্বারা ২:২০১]।[20]
- আর যখনই হাজরে আসওয়াদের সামনে হয়ে অতিক্রম করবে তখন উপরোক্ত কাজগুলি করবে এবং তাকবীর পাঠ করবে। আর বাকী তাওয়াফে নিজ পছন্দ মত যিকির, দু‘আ এবং কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবে। কারণ, কা’বা ঘরের তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ এবং জামরাসমূহে কংকর নিক্ষেপ আল্লাহর যিকির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।
আর এই তাওয়াফে কুদূমের (মক্কায় প্রথম পদার্পণ করে) সাত চক্করেই ইযতিবা করা এবং প্রথম তিন চক্করে রামাল করা সুন্নাত। তবে বাকী চার চক্করে রামাল করা যাবে না। আর ইযতিবা হলো, ডান কাঁধ খোলা রাখা ও চাদরের মধ্যভাগকে ডান বগলের নীচে রাখা এবং চাদরের দু’দিক বাম কাঁধের উপর রাখা। আর রামাল হল, পায়ের ধাপ কাছাকাছি ফেলে দ্রুত চলা।
আর তাওয়াফ হচ্ছে সাত চক্কর, যা হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু হয় এবং সেখানেই শেষ হয়। আর হিজরের (হাতীম) মধ্য দিয়ে তাওয়াফ করলে তা শুদ্ধ হবে না। সুতরাং সাত চক্কর সম্পূর্ণ হলে মাকামে ইবরাহীমের দিকে এগিয়ে যাবে, অতঃপর এই আয়াতটি পাঠ করবে:
﴿وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى ﴾البقرة125
[ওয়াত্তাখিযু মিম্ মাক্বামি ইবরাহীমা মুসাল্লা]
আর মাকামে ইবরাহীমকে সলাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর।[21]
- অতঃপর তার পেছনে সম্ভব হলে নিকটবর্তী হয়ে দু’রাক’আত সলাত আদায় করবে। তবে ইহা সম্ভব না হলে দূরে যে কোন জায়গায় তা আদায় করবে। প্রথম রাকা’তে সূরাহ্ আল-ফাতিহার পরে সূরাহ্ আল-কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকা’তে সূরাহ আল-ফাতিহার পরে সূরাহ্ ইখলাস পাঠ করবে।[22]
- অতঃপর হাজরে আসওয়াদের নিকট ফিরে এসে সহজসাধ্য হলে ইসতিলাম করবে (চুম্বন দিবে) আর তা সম্ভব না হলে তার দিকে ইশারা করবে না।
- তারপর সাঈ করার উদ্দেশ্যে সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হবে এবং এই আয়াতটি পাঠ করবে:
(إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ)البقرة 158
[ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ’ইরিল্লাহ্]
নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম।[23]
একমাত্র এ জায়গা ব্যতীত অন্য কোন জায়গায় এই আয়াতটি পাঠ করবে না। অতঃপর সাফা পাহাড়ের উপর এমনভাবে চড়বে, যাতে কা’বা ঘর দেখা যায়।
- তারপর কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে মহান আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং নিজ ইচ্ছা মত দু‘আ করবে। এস্থানে নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত দু‘আ হচ্ছে:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ
[লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহু ওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু, আনজাযা ওয়া’দাহু, ওয়া নাসারা আব্দাহু, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহ্দাহু]
আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, যিনি এক ও একক, যাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, তাঁরই সমস্ত প্রশংসা, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, তিনি নিজ প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সমস্ত ভ্রান্ত দলসমূহকে পরাজিত করেছেন।[24]
এ যিকিরটি তিনবার করে করবে এবং তার মাঝে-মাঝে দু‘আ করবে। অতঃপর ‘সাফা’ পর্বত হতে নেমে মারওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। তারপর সবুজ বাতী পর্যন্ত পৌঁছিলে কোন মানুষকে কষ্ট না দিয়ে যথাসাধ্য জোরে দৌঁড় দিবে। অতঃপর আগের সবুজ বাতী পর্যন্ত পৌঁছে ‘মারওয়া’ পর্বত পর্যন্ত সাধারণ গতিতে চলতে থাকবে।
- অতঃপর ‘মারওয়া’ পর্বতের উপর চেপে কিবলামুখী হয়ে দু’হাত উত্তোলন করে সে সব যিকির ও দু‘আ পাঠ করবে যা ‘সাফা’ পর্বতের উপর করা সুন্নাত। তারপর ‘মারওয়া’ পর্বত হতে নেমে ‘সাফা’ পর্বতের উদ্দেশ্যে চলার স্থানে চলবে এবং দৌঁড়ের স্থানে দৌঁড় দিবে।
- তারপর ‘সাফা’ পর্বেতের উপর চেপে কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে সে সব যিকির ও দুআ পাঠ করবে যা প্রথমবার সাফার পর্বতের উপর করা হয়েছে।
- আর অবশিষ্ট সাঈতে নিজ পছন্দ মত যে কোন যিকির, কুরআনের তিলাওয়াত এবং দুআ পাঠ করতে থাকবে। আর ‘সাফা’ ও মারওয়া পর্বতের উপর আরোহণ করা এবং দুই সবুজ বাতীর মাঝখানে দৌড় দেয়া সুন্নাত, ইহা ওয়াজিব নয়।
‘সাফা’ পর্বত হতে ‘মারওয়া’ পর্বত পর্যন্ত আসলে এক চক্কর এবং ‘মারওয়া’ পর্বত হতে ‘সাফা’ পর্বত পর্যন্ত আসলে আর এক চক্কর। এভাবে সাঈ সাফা থেকে শুরু হবে এবং মারওয়াতে সাত চক্কর শেষে হবে।
- সুতরাং এভাবে সাত চক্কর শেষে হলে পুরুষ ব্যক্তি মাথার চুল মুণ্ডন করবে কিংবা পুরো মাথা থেকে চুল ছোট করবে, তবে মাথা মুণ্ডন-নেড়া করাই উত্তম। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি হাজ্জে তামাত্তুর নিয়্যাতে এসে থাকে এবং হাজ্জের সময় (৮ই যিলহাজ্জ) নিকটবর্তী হয় যার মধ্যে চুল গজবে না, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য মাথার চুল ছোট করাই উত্তম। যাতে করে হাজ্জের পর চুল মুণ্ডনের জন্য বড় থাকে।
কারণ নাবী (সা.) তাঁর সাহাবীগণ যখন চার যিলহাজ্জে হাজ্জে তামাত্তুর উদ্দেশ্যে আসেন তখন তিনি তাঁদেরকে উমরা করে চুল ছোট করার মাধ্যমে হালাল হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
- পক্ষান্তরে মহিলারা সর্বাবস্থায় মাথার চুল ছোট করবে; তাদের মাথা মুণ্ডন করা নিষেধ। নারীরা তাদের প্রত্যেক বেণী হতে আঙ্গুলের এক পোর পরিমাণ ছোট করবে। মাথা মুণ্ডন বা চুল খাটো করা পুরো মাথার হবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
(مُحَلِّقِينَ رُؤُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ) الفتح 27
তোমাদের মস্তক মুণ্ডিত অবস্থায় ও চুল কেটে।[25]
আর নাবী (সা.) পুরো মাথার চুল মুণ্ডন করেছেন এবং তিনি মুসলিমদের সম্বোধন করে বলেছেন:
لِتَأْخُذُوا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم
তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হাজ্জ ও উমরার বিধি-বিধান নিয়ে নাও।[26] অনুরূপ মাথার চুল মাথার চতুর্দিক থেকে ছোট করতে হবে। উপরোক্ত কাজগুলির মাধ্যমে উমরাহ্ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে এবং পূর্ণাঙ্গরূপে হালাল হয়ে যাবে। তারপরে ইহরামের অবস্থার সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ বৈধ হয়ে যাবে।
>[2]. সহীহ মুসলিম ১২০৯-১২১০।
[3]. সহীহ বুখারী ১৫৪৯, মুসলিম ১১৮৪, ইবনে মাজাহ ২৯১৮, তিরমিযী ৮২৫, নাসাঈ ২৭৪৭।
[4]. সহীহ: ইবনে মাজাহ ২৯২০, শারহু মা‘আনিল আসার ৩৫৫৯, সহীহ ইবনে হিববান ৩৮০০।
[5]. মুসনাদে আহমাদ ১৫৫৬৮, আবূ দাউদ ১৮১৪, নাসাঈ, তিরমিযী ৮২৯ ও ইবনু মাজাহ ২৯২২
[6]. সূরাহ্ আল-হাজ্জঃ ২৭-২৮
[7]. সহীহ বুখারী ৫০৮৯ ও মুসলিম ১২০৭
[8]. সহীহ বুখারী ৫০৮৯ ও মুসলিম ১২০৭
[9]. নাসাঈ, হাদীসটি সহীহ
[10]. সহীহ বুখারী ও মুসলিম ১২৯৭
[11]. সহীহ বুখারী ১৫৭৬-১৫৭৭ ও সহীহ মুসলিম।
[12]. আবূ দাউদ ৪৬৬ ও ইবনু মাজাহ ৭৭১, হাদীসটি সহীহ
[13]. সহীহ বুখারী ১৫৯৭, ১৬০৫ ও মুসলিম ১২৭০।
[14]. সহীহ বুখারী ১৬০৬, ও সহীহ মুসলিম ১২৬৮।
[15]. সহীহ বুখারী ১৬১২।
[16]. সহীহ বুখারী ১৬১৩।
[17]. সহীহ মুসলিম ১২৬৯।
[18]. সূরা আল-আহযাবঃ ২১
[19]. হাসান লি গাইরিহী: মুসনাদে আহমাদ ১৮৭৭।
[20]. হাসান: সুনানে আবূ দাউদ ১৮৯২।
[21]. সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ১২৫
[22]. সহীহ: নাসাঈ ২৯৬৩।
[23]. সূরা আল-বাক্বারা ২:১৫৮
[24]. সহীহ মুসলিম ১২১৮
[25] সূরা আল-ফাত্হঃ ২৭
[26]. বুখারী ও মুসলিম