লগইন করুন
ইসলামে সম্ভাষণ রীতি হ’ল পরস্পরকে সালাম করা। ‘সালাম’ অর্থ ‘শান্তি’। আল্লাহর অপর নাম ‘সালাম’। জান্নাতকে বলা হয় ‘দারুস সালাম’ (শান্তির গৃহ)। ইসলাম শব্দের মাদ্দাহ হ’ল ‘সালাম’। ইসলামের অনুসারীকে বলা হয় মুসলিম বা মুসলমান। অতএব মুসলমানের জীবন ও সমাজ ‘সালাম’ তথা শান্তি দ্বারা পূর্ণ। তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হ’ল পরকালে দারুস সালামে প্রবেশ করা। অতএব মুসলিম সমাজে কেবলই থাকে সালাম আর সালাম অর্থাৎ শান্তি আর শান্তি। এই সম্ভাষণ দ্বারা মুসলমান তার পক্ষ হ’তে আগন্তুক ব্যক্তিকে শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তোমরা বেশী বেশী সালাম কর। চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম কর। আরোহী পায়ে হাঁটা লোককে সালাম দিবে। কম সংখ্যক লোক অধিক সংখ্যক লোককে সালাম দিবে। ছোটরা বড়দের সালাম দিবে। দলের পক্ষ থেকে একজন সালাম বা সালামের জবাব দিলে চলবে।[32] কোন গাছ, দেওয়াল বা পাথরের আড়াল পেরিয়ে দেখা হ’লে পুনরায় পরস্পরে সালাম দিবে।[33] কোন মজলিসে প্রবেশকালে ও বসার সময় এবং উঠে যাওয়ার সময় সালাম দিবে।[34] তিনি বলেন, আল্লাহর নিকটে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি, যিনি প্রথমে সালাম দেন’।[35] কোন সম্মানী ব্যক্তিকে এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানানো মুস্তাহাব। [36]
উল্লেখ্য যে, সম্ভাষণ কালে حَيَّاكَ اللهُ হাইয়া-কাল্লা-হ (আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখুন) বলার হাদীছ ‘যঈফ’।[37] তবে حَفِظَكَ اللهُ হাফেযাকাল্লা-হ (আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন) বলার হাদীছ ‘ছহীহ’।[38] কেউ আহবান করলে لَبَّيْكَ লাববায়েক (আমি হাযির) বলে জওয়াব দেওয়ার হাদীছ ‘ছহীহ’। [39]
ফাসেক ব্যক্তিকে সালাম না দেওয়াই ছিল সালাফে ছালেহীনের রীতি। যেমন ছাহাবী জাবের (রাঃ) ফাসেক গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে সালাম দেননি। [40] রাষ্ট্রনেতাদেরকে ইসলামী সালাম ব্যতীত অতিরঞ্জিত কোন বিশেষণে সম্ভাষণ জানানো ঠিক নয়। ওছমান বিন হুনাইফ আনছারী (রাঃ) আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে স্রেফ ইসলামী সালাম দিয়েছিলেন, যেভাবে তিনি খলীফা আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-কে দিতেন। [41]
(ক) সালাম : اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ ‘আসসালা-মু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লা-হ’। অর্থ : ‘আপনার (বা আপনাদের) উপর শান্তি ও আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হৌক’।
(খ) জওয়াবে বলবে- وَعَلَيْكُمُ السَّلاَمُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ ‘ওয়া আলাইকুমুস সালা-মু ওয়া রাহমাতুল্লা-হি ওয়া বারাকা-তুহূ’। অর্থ: ‘আপনার (বা আপনাদের) উপরেও শান্তি এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া সমূহ বর্ষিত হৌক’। ‘আসসালা-মু আলায়কুম’ বললে ১০ নেকী, ‘ওয়া রাহমাতুল্লা-হ’ যোগ করলে ২০ নেকী এবং ‘ওয়া বারাকা-তুহূ’ যোগ করলে ৩০ নেকী পাবে।[42] ‘ওয়া মাগফিরাতুহূ’- যোগ করার হাদীছটি ‘যঈফ’।[43]
(গ) যদি কেউ কাউকে সালাম পাঠায়, তবে জওয়াবে বলবে- ‘আলায়কা ওয়া আলাইহিস সালাম’ অর্থ : ‘আপনার ও তাঁর উপরে শান্তি বর্ষিত হউক’। [44]
(ঘ) ছালাত অবস্থায় কেউ সালাম দিলে মুখে জওয়াব দেওয়া যাবে না। কেবল (ডান হাতের) আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা যাবে।[45]
প্রকাশ থাকে যে, জাহেলী যুগে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে أَنْعَمَ اللهُ بِكَ عَيْنًا আন‘আমাল্লা-হু বিকা ‘আইনান’ (আল্লাহ আপনার চক্ষু শীতল করুন) এবং اَنْعِمْ صَبَاحًا ‘আন‘ইম ছাবা-হান’ ‘সুপ্রভাত’ (Good morning) বলা হ’ত। ইসলাম আসার পরে উক্ত প্রথা বাতিল হয় [46] এবং সালামের প্রচলন হয়।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুসলিম-অমুসলিম মিলিত মজলিস এবং মহিলা ও শিশুদেরকে সালাম দিতেন’।[47]
(ঙ) অমুসলিমরা সালাম দিলে উত্তরে বলবে ‘ওয়া আলায়কুম’ (আপনার উপরেও)।[48]
(চ) অমুসলিমদের শিষ্টাচার মূলক সম্ভাষণ করা যাবে। কিন্তু আক্বীদা ও আমল বিরোধী কিছু বলা বা করা যাবে না। যেমন কোন হিন্দুকে ‘নমস্কার’ বলা যাবে না। কেননা এর অর্থ ‘আমি আপনার সামনে মাথা ঝুঁকাচ্ছি। আপনি কবুল করুন’। অমনিভাবে ‘নমস্তে’ বলা যাবে না। কেননা এর অর্থ ‘আমি আপনার সামনে ঝুঁকছি’। বরং উভয়ে উভয়কে ‘আদাব’ বলা উচিৎ। যার অর্থ ‘আমি আপনার প্রতি শিষ্টাচার প্রদর্শন করছি’।
(ছ) কথা বলার পূর্বে সালাম দিবে’।[49] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাম দিয়ে শুরু করে না, তাকে অনুমতি দিয়ো না’।[50]
(জ) মুছাফাহা : অর্থ পরস্পরের হাতের তালু মিলানো (إلصاق صفح الكف بالكف)। মুছাফাহার সময় একে অপরের ডান হাতের তালু মিলিয়ে করমর্দন করতে হয়। ছাহাবায়ে কেরাম পরস্পরে মুছাফাহা করতেন।[51] আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকল শুভ কাজ ডান হাত দিয়ে করা পসন্দ করতেন’। [52] দুইজনের চার হাত মিলানো ও বুকে হাত লাগানোর প্রচলিত প্রথা সুন্নাত বিরোধী আমল। সাক্ষাতকালে মাথা ঝুঁকানো, বুকে জড়িয়ে ধরা, কোলাকুলি করা, হাতে বা কপালে চুমু খাওয়া নয়, কেবল সালাম ও মুছাফাহা করবে।[53] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দুইজন মুসলমান সাক্ষাতকালে যখন পরস্পরে মুছাফাহা করে, তখন তাদের উভয়কে ক্ষমা করা হয়, যতক্ষণ না তারা পৃথক হয়।[54] হাতে চুমু খাওয়া ও পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করা সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছ ‘যঈফ’। [55]
অতএব ঈদের দিন কোলাকুলি নয়, বরং পরস্পরে দো‘আ করা আবশ্যক। কেননা ছাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পরে সাক্ষাতে বলতেন,‘তাক্বাব্বালাল্লা-হু মিন্না ওয়া মিনকা’ অথবা ‘মিনকুম’ (আল্লাহ আমাদের ও আপনার বা আপনাদের পক্ষ হ’তে কবুল করুন! -তামামুল মিন্নাহ ৩৫৪ পৃঃ)। অতএব সালাম ও ঈদ মোবারক বললেও সাথে সাথে উক্ত দো‘আটি পড়া উচিৎ।
[33] . আবুদাঊদ হা/৫২০০, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-১৪৯।
[34] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৬০, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ-১।
[35] . আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৬৪৬।
[36] . আবুদাঊদ হা/৫২১৫-১৭ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-১৫৮।
[37] . বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১০২৯, তাহকীক আলবানী।
[38] . আবুদাঊদ হা/৫২২৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-১৬৭।
[39] . আবুদাঊদ হা/৫২৩৩ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-৩৫, অনুচ্ছেদ-১৭০।
[40] . বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১০২৫।
[41] . বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১০২৪।
[42] . তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৪৪।
[43] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৪৫।
[44] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৫৫।
[45] . তিরমিযী, মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/৯৯১, ১০১৩, ‘ছালাতে অসিদ্ধ ও সিদ্ধ কর্ম সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৯।
[46] . আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪৬৫৪, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ-১।
[47] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৬৩৪-৩৯; আহমাদ, মিশকাত হা/৪৬৪৭।
[48] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪৬৩৭।
[49] . তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৬৫৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮১৬।
[50] . বায়হাক্বী- শু‘আব; মিশকাত হা/৪৬৭৬, ‘অনুমতি প্রার্থনা’ অনুচ্ছেদ-২; ছহীহাহ হা/৮১৭।
[51] . বুখারী, মিশকাত হা/৪৬৭৭, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘মুছাফাহা ও মু‘আনাকা’ অনুচ্ছেদ-৩।
[52] . মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৪০০ ‘তাহারৎ’ অধ্যায়-৩, ‘ওযূর সুন্নাত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৪; বুখারী হা/১৬৮, ‘ওযূ’ অধ্যায়-৪, অনুচ্ছেদ-৩১,(عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ فِي تَنَعُّلِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَطُهُوْرِهِ وَفِيْ شَأْنِهِ كُلِّهِ) মুসলিম হা/৬১৭ (২৬৮/৬৭), ‘ত্বাহারৎ’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-১৯।
[53] . ইবনু মাজাহ হা/৩৭০২; তিরমিযী হা/২৭২৮; ঐ, মিশকাত হা/৪৬৮০, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫, ‘মুছাফাহা ও মু‘আনাকা’ অনুচ্ছেদ-৩।
[54] . আবুদাঊদ হা/৫২১২; আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪৬৭৯।
[55] . তিরমিযী হা/২৭৩৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৭০৪-০৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৯৭৫-৭৬, ‘কদমবুসি’ অনুচ্ছেদ।