লগইন করুন
আত্মীয়-স্বজন বা অভাবী মানুষ কিংবা সাধারণ যে কারও প্রতি উদারতা প্রদর্শন করলে এবং তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এর বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা দাতার গুনাহ মাফ করে দেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَلَا يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ أَنْ يُؤْتُوا أُولِي الْقُرْبٰى وَالْمَسَاكِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন ক্বসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[1]
এ আয়াতটি অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট ও সংশ্লিষ্ট ঘটনার সারমর্ম উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
‘আয়িশাহ্ (রা.)-এর প্রতি অপবাদের ঘটনায় মুসলিমদের মধ্যে মিসতাহ্ ও হাস্সান জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়াত নাযিল হওয়ার পর তাদের প্রতি অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করেন। তারা উভয়েই বিশিষ্ট সাহাবী এবং বদর-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্যতম ছিলেন। কিন্তু তাদের দ্বারা একটি ভুল হয়ে যায় এবং তারা খাঁটি তাওবার তাওফীক লাভ করেন। আল্লাহ তা‘আলা যেমন ‘আয়িশার দোষমুক্ততা ঘোষণা করে প্রকাশ্যে আয়াত নাযিল করেন, এমনিভাবে এই মুসলিমদের তাওবাহ্ কবূল করা ও ক্ষমা করার কথাও ঘোষণা করে দেন।
মিসতাহ্ আবূ বাকর (রাঃ) আত্মীয় ও নিঃস্ব ছিলেন। আবূ বাকর(রাঃ) তাকে আর্থিক সাহায্য করতেন। যখন অপবাদের ঘটনার সাথে তার জড়িত থাকার কথা প্রকাশিত হল, তখন কন্যা-বৎসল পিতা আবূ বাকর সিদ্দীক কন্যাকে এমন কষ্টদানের কারণে স্বাভাবিকভাবেই মিসতার প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি ক্বসম করে বসলেন, ভবিষ্যতে তাকে কোনরূপ আর্থিক সাহায্য করবেন না।
বলাবাহুল্য, কোন বিশেষ ফকীরকে আর্থিক সাহায্য নির্দিষ্টভাবে কোন বিশেষ মুসলিমের উপর ওয়াজিব নয়। কেউ কাউকে আর্থিক সাহায্য করার পর যদি বন্ধ করে দেয়, তবে গোনাহের কোন কারণ নেই। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের দলকে আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ দলরূপে গঠন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তাই একদিকে বিচ্যুতিকারীদের খাঁটি তাওবাহ্ এবং ভবিষ্যত সংশোধনের নি‘আমত দ্বারা ভূষিত করেছেন এবং অপরদিকে যারা স্বাভাবিক মনোকষ্টের কারণে গরীবদের সাহায্য ত্যাগ করার ক্বসম করেছিলেন, তাদেরকেও আদর্শ চরিত্রের শিক্ষা আলোচ্য আয়াতে দান করেছেন। তাদেরকে বলা হয়েছে তারা যেন ক্বসম ভঙ্গ করে কাফ্ফারা দিয়ে দেয়। গরীবদের আর্থিক সাহায্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া তাদের উচ্চমর্যাদার পক্ষে সমীচীন নয়। আল্লাহ তা‘আলা যেমন তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, তেমনি তাদেরও ক্ষমা ও মার্জনা প্রদর্শন করা উচিত।[2]
আয়াতের শেষ বাক্যে বলা হয়েছে :
أَلَا تُحِبُّونَ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَكُمْ
‘‘তোমরা কি পছন্দ করো না যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের গোনাহ্ মাফ করবেন?’’ আয়াতটি শুনে আবূ বাকর তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন :
وَاللهِ إِنِّىْ لَأُحِبُّ أَنْ يَغْفِرَ اللهُ لِى
অর্থাৎ- ‘‘হ্যাঁ, আল্লাহর ক্বসম! হে আমাদের রব! আমরা চাই তুমি আমাদের ক্ষমা করো।’’ এরপর তিনি মিসতার আর্থিক সাহায্য পুনর্বহাল করে দেন এবং বলেন : এ সাহায্য কোন দিন বন্ধ হবে না।[3]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
يٰۤاَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘‘হে মু’মিনগণ! তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।’’[4]
হুযায়ফাহ্ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.) বলেছেন :
تَلَقَّتْ الْمَلَائِكَةُ رُوحَ رَجُلٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ قَالُوا أَعَمِلْتَ مِنْ الْخَيْرِ شَيْئًا قَالَ كُنْتُ آمُرُ فِتْيَانِي أَنْ يُنْظِرُوا وَيَتَجَاوَزُوا عَنْ الْمُوسِرِ قَالَ قَالَ فَتَجَاوَزُوا عَنْهُ
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তীগণের মধ্যে এক ব্যক্তির রূহের সাথে ফেরেশতা সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোন নেক কাজ করেছ? লোকটি উত্তর দিল, আমি আমার কর্মচারীদের আদেশ করতাম যে, তারা যেন সচ্ছল ব্যক্তিকে অবকাশ দেয় এবং তার ওপর পীড়াপীড়ি না করে। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি বলেছেন, ফেরেশতারাও তাঁকে ক্ষমা করে দেন।’’[5]
আবূ হুরায়রাহ্ থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
كَانَ رَجُلٌ يُدَايِنُ النَّاسَ فَكَانَ يَقُولُ لِفَتَاهُ إِذَا أَتَيْتَ مُعْسِرًا فَتَجَاوَزْ عَنْهُ لَعَلَّ اللهَ يَتَجَاوَزُ عَنَّا. فَلَقِىَ اللهَ فَتَجَاوَزَ عَنْهُ
‘‘এক লোক মানুষের সাথে লেন-দেন করত। সে তার গোলামকে বলে দিত, তুমি যখন কোন অভাবগ্রসেত্মর কাছে (পাওনা আদায়ের জন্য) যাবে তখন তাকে (কিছু) ক্ষমা করে দিবে। হয়ত আল্লাহ আমাদেরও ক্ষমা করে দিবেন। এরপর সে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলিত হল। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে মাফ করে দিলেন।’’[6]
আবূ মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
حُوسِبَ رَجُلٌ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَلَمْ يُوجَدْ لَه مِنَ الْخَيْرِ شَىْءٌ إِلَّا أَنَّه كَانَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَكَانَ مُوسِرًا فَكَانَ يَأْمُرُ غِلْمَانَه أَنْ يَتَجَاوَزُوا عَنِ الْمُعْسِرِ قَالَ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ نَحْنُ أَحَقُّ بِذٰلِكَ مِنْهُ تَجَاوَزُوا عَنْهُ
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেদের মধ্যে এক লোকের হিসাব গ্রহণ করা হয়, কিন্তু তার মধ্যে কোন প্রকার ভালো ‘আমল পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে মানুষের সাথে লেন-দেন করত এবং সে ছিল সচ্ছল। তাই দরিদ্র লোকেদের মাফ করে দেয়ার জন্য সে তার কর্মচারীদের নির্দেশ দিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ বললেন : ক্ষমার ব্যাপারে আমরা তার চেয়ে অধিকযোগ্য। একে ক্ষমা করে দাও।’’[7]
[2]. তাফসীরে কুরতুবীর বরাতে কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংÿÿপ্ত তাফসীর), খ. ২, পৃ. ১৮৬৪।
[3]. সহীহুল বুখারী : ৪৭৫০, সহীহ মুসলিম : ৭১৯৬।
[4]. সূরা আত্ তাগা-বুন ৬৪ : ১৪।
[5]. সহীহুল বুখারী : ২০৭৭।
[6]. সহীহুল বুখারী : ৩৪৮০, সহীহ মুসলিম : ৪০৮১।
[7]. সহীহ মুসলিম : ৪০৮০।