লগইন করুন
গুনাহের পরকালীন শাস্তির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা অনেকেই গুনাহের ইহকালীন কুপ্রভাব সম্পর্কে জানি না। আসলে আমাদের ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে গুনাহের অনেক কুপ্রভাব রয়েছে। গুনাহ আমাদের জীবনযাপনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। কখনো কখনো ব্যক্তির করা গুনাহের প্রভাব ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, আবার কখনো সেই প্রভাব ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে এমনকি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা নিয়মিত গুনাহ করে যাচ্ছি। অথচ এসব গুনাহ আমাদের জীবনে কিভাবে কুপ্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে তা আমরা অনেকেই বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না। খারাপ থেকে বাঁচার জন্যই খারাপকে চিনতে হবে।
কবি আবূ ফারাস আল হামদানী[1] বলেছেন :
عرفت الشَّرَّ لا للشَّر ... لكن لتوقِّيهِ
ومن لا يعرف الشَّرَّ ... من النَّاس يقع فيهِ
‘‘আমি খারাপকে চিনেছি, খারাপ কিছু করার জন্য নয় বরং খারাবী থেকে বাঁচার জন্য; আর যে মানুষ খারাপকে চিনবে না সে তাতে পতিত হবে।’’[2]
কিন্তু কুরআন, হাদীস এবং সালাফে সালিহীনের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে জানা যায়, এই গুনাহগুলো আমাদের জীবনে কী ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করছে। গুনাহ থেকে বাঁচার অনুভূতি মনের মধ্যে তৈরি করার জন্য গুনাহের কুপ্রভাব জানা জরুরি। তাই গুনাহ মাফের উপায় বর্ণনা করার আগে আমাদের জীবনে গুনাহের কিছু প্রভাব আলোচনা করা জরুরি মনে করছি। নিম্নে কিছু কুপ্রভাব উল্লেখ করা হলো :
১. জ্ঞান ও মুখস্থশক্তি কমে যাওয়া :
জ্ঞান ও মুখস্থ শক্তি আল্লাহর দেয়া অনন্য নি‘আমত। গুনাহের কারণে আল্লাহ এই নি‘আমত তুলে নেন। ইমাম শাফি‘ঈ (রহিমাহুল্লাহ)[3]একদিন মাদীনায় ইমাম মালিক (রহিমাহুল্লাহ)[4]-এর সামনে বসা ছিলেন। তখন ইমাম মালিক ইমাম শাফি‘ঈকে দেখে বুঝলেন যে, ছেলেটির মধ্যে প্রতিভা আছে। তাই তিনি তাকে নসীহত হিসেবে বলেন,
إني أرى الله قد ألقى على قلبك نوراً فلا تطفئه بظلمة المعصية
‘‘আমি দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ তোমার অন্তরে আলো (জ্ঞান) দান করেছেন, অতএব তুমি এই আলোকে গুনাহের অন্ধকার দিয়ে নিভিয়ে দিও না।’’
ইমাম শাফি‘ঈ (রহিমাহুল্লাহ) নিজেই বলেন :
شكوت إلى وكيع سوء حفظي *** فأرشدني إلى ترك المعاصي
وأخبرني بأن العلم نور *** ونور الله لا يهدى لعاصي
‘‘আমি আমার শিক্ষক ওয়াকি‘-এর নিকট দুর্বল মুখস্থশক্তির ব্যপারে অভিযোগ করলাম (অর্থাৎ আমি বললাম যে, আমার মুখস্থশক্তি/স্মৃতিশক্তি দুর্বল। এখন আমি কী করতে পারি?) জবাবে তিনি আমাকে বললেন, আমি যেন গুনাহের কাজ পরিত্যাগ করি। তিনি আরও বললেন, জেনে রাখো, জ্ঞান হচ্ছে আলো। আর আল্লাহর আলো তিনি কোন গুনাহগারকে দেন না।’’[5]
অনেকে বিভ্রান্ত হন যখন দেখেন, কোন গুনাহগারকেও আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞান ও মুখস্থশক্তি দান করেন। এটা কেন? এর উত্তর জানতে নিচের আয়াত দু’টি পড়ুন :
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ الَّذِىْ آتَيْنَاهُ آيَاتِنَا فَانْسَلَخَ مِنْهَا فَأَتْبَعَهُ الشَّيْطَانُ فَكَانَ مِنَ الْغَاوِينَ -175 وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهٗ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَمَثَلُهٗ كَمَثَلِ الْكَلْبِ إِنْ تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَثْ ذٰلِكَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا فَاقْصُصِ الْقَصَصَ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ 176
‘‘আর তুমি তাদের নিকট সে ব্যক্তির সংবাদ পাঠ কর, যাকে আমি আমার আয়াতসমূহ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং শয়তান তার পেছনে লেগেছিল। ফলে সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর আমি ইচ্ছা করলে উক্ত নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চ মর্যাদা দিতাম, কিন্তু সে পৃথিবীর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুকুরের মতো। যদি তার উপর বোঝা চাপিয়ে দাও তাহলে সে জিহবা বের করে হাঁপাবে অথবা যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহলেও সে জিহবা বের করে হাঁপাবে। এটি হচ্ছে সে কওমের দৃষ্টান্ত যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে। অতএব তুমি কাহিনীসমূহ বর্ণনা কর, যাতে তারা চিন্তা করে।’’[6]
ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম আল জাউযিয়্যাহ্ (রহিমাহুল্লাহ)[7] বলেন,
"ففي الآية دليل على أنه ليس كل من آتاه الله العلم فقد رفعه به، إنما الرفعة بالعلم درجة فوق مجرد إتيانه"
‘‘এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ যাকে জ্ঞান দান করেন তাকেই উচ্চমর্যাদা দান করেন না। যথাযথ জ্ঞানের মাধ্যমে উচ্চমর্যাদা লাভ শুধু জ্ঞানার্জনের চেয়ে অনেক উত্তম ব্যাপার।’’
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা বোঝা গেলো যে, আল্লাহ কোন গুনাহগারকে জ্ঞানের আলো দেন না। বাহ্যিকভাবে কাউকে দিয়েছেন বলে দেখা গেলে বুঝে নিতে হবে যে, এটি তার জন্য পরীক্ষা। ক্বিয়ামাতের বিচারের মাঠে তার এই জ্ঞান তার বিরুদ্ধেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে। তাই জ্ঞান ও মুখস্থশক্তি বৃদ্ধির জন্য এবং অর্জিত জ্ঞান ধরে রাখার জন্য গুনাহের কাজ বর্জনের ও জ্ঞানানুযায়ী ‘আমলের কোন বিকল্প নেই। সকল মানুষের বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে বেশি সচেতন হওয়া জরুরি।
২. রিযক্ব থেকে বঞ্চিত হওয়া :
গুনাহের কুপ্রভাবগুলো মধ্যে অন্যতম হলো, গুনাহ করলে তা গুনাহকারীর জীবিকা কমিয়ে দেয় বা সে বরকতপূর্ণ জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা অনেকেই একসময় ভালো ও পর্যাপ্ত খাবার এবং অন্যান্য নি‘আমত ভোগ করলেও হঠাৎ দেখি রিযক্ব ও নি‘আমত কমে যাওয়া শুরু করেছে। তখন আমরা হতাশ হই, এর কারণ খুঁজি। আসল কারণের কথা হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে। সাওবান হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
«لَا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلَّا الدُّعَاءُ وَلَا يَزِيدُ فِي الْعُمُرِ إِلَّا الْبِرُّ وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُه”»
‘‘দু‘আ ব্যতীত আর কিছুই ভাগ্যকে ফেরায় (পরিবর্তন করে) না, পুণ্য ব্যতীত আর কিছু্ আয়ুকে বাড়ায় না এবং কৃত পাপের কারণেই বান্দা জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়।’’[8]
৩. আল্লাহর আনুগত্য কঠিন মনে হওয়া :
গুনাহের কাজের অন্যতম কুপ্রভাব হলো আল্লাহর আদেশ-নিষেধ না মানা এবং নিজের মনের ইচ্ছার লাগামহীন অনুসরণ করা। মানুষ যখন গুনাহ করতে থাকে এবং গুনাহের পরিমাণ বাড়াতে থাকে তখন ধীরে ধীরে তার ‘ইবাদাতের পরিমাণ কমতে থাকে, ঈমান সঙ্কুচিত হতে থাকে, ‘ইবাদাতের প্রতি মনোযোগে ঘাটতি দেখা দেয়, আল্লাহর আনুগত্য করতে না পারলে দুঃখ বা আফসোস লাগে না। গুনাহের প্রভাবে আল্লাহর ‘ইবাদাত করা কঠিন মনে হতে থাকে। অন্যায়-অশ্লীলতার চর্চায় সুখ লাভ করে এবং তা অভ্যাসে পরিণত হয়।
আল্লাহর আনুগত্য ও শয়তানের আনুগত্য একই সাথে সমান গতিতে চলতে পারে না। তাই শয়তানের আনুগত্যের মাধ্যমে গুনাহ অর্জন করতে থাকলে আল্লাহর আনুগত্য করতে মন আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যারা আল্লাহর আনুগত্যে অনীহাবোধ করে, অলসতাবোধ করে অথচ তারা একসময় ‘ইবাদাতে মনোযোগী ছিল এবং অন্যকেও দা‘ওয়াত দিত তখন বুঝে নিতে হবে যে, তার উপরে তার কৃত গুনাহের কুপ্রভাব পড়েছে। তাই সে ইবাদাতে গাফিল ও পিছিয়ে। তাইতো যারা কাফির তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে মৃত বলেছেন; তারা জীবিত নয়। (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ২১) অর্থাৎ কাফিররা শারীরিকভাবে জীবিত থাকলেও আত্মিক ও মানসিকভাবে তারা মৃত।
৪. অন্তর মরে যাওয়া ও অপমানিত হওয়া :
গুনাহ মানুষের অন্তরকে মেরে ফেলে। এর কারণে অন্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। গুনাহে লিপ্ত থাকা অসম্মানেরও কারণ। সম্মান দেয়ার মালিক আল্লাহ। আল্লাহর অবাধ্যতা করে সম্মানিত হওয়া যায় না। বরং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়া যায়। ফলে সে সকলের আন্তরিক ভালোবাসায় সিক্ত হয়।
আল্লাহর ভালোবাসা পেলে যেমন মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পাওয়া যায় তেমনি আল্লাহর অবাধ্যতা করলে তার বিরাগভাজন হতে হয় এবং অপমানিত হতে হয়।
ইমাম ‘আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহিমাহুল্লাহ)[9] বলেন :
رأيت الذنوب تميت القلوب وقد يورث الذل إدمانها
وترك الذنوب حياة القلوب وخير لنفسك عصيانها
‘‘আমি দেখেছি গুনাহ অন্তরকে মেরে ফেলে আর সর্বদা গুনাহে লিপ্ত থাকা অপমান নিয়ে আসে। গুনাহ পরিত্যাগ করা অন্তরের বাঁচিয়ে রাখে আর নফস্ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ না করার মধ্যেই কল্যাণ নিহীত।’’
৫. পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়া :
মানুষের গুনাহের কারণে দুনিয়াতে বিভিন্ন রকমের বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপর্যয় হতে পারে স্থলভাগে, হতে পারে জলভাগে (সাগর-নদীতে), হতে পারে আকাশে, হতে পারে ফল-ফসলে, হতে পারে বাসস্থানে। এই বিপর্যয়ের কথাই আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’’[10]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ ، قَالَ : أَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ ﷺ ، فَقَالَ : «يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ ، خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ ، وَأَعُوذُ بِاللهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ ، لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ ، حَتّٰى يُعْلِنُوا ، بِهَا إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ وَالْأَوْجَاعُ ، الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا ، وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ ، إِلَّا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ ، وَشِدَّةِ الْمَئُونَةِ ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ ، وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللهِ ، وَعَهْدَ رَسُولِه# إِلَّا سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ ، فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ ، وَيَتَخَيَّرُوا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ إِلَّا جَعَلَ اللهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ».
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘‘হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোন জাতি ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টিবর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন।’’[11]
৬. সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকা ও মনস্তাত্বিক রোগে ভোগা :
গুনাহগার ব্যক্তি সবসময় জানা-অজানা ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। তাকে দেখেই বোঝা যায় যে, সে ভীত, নিরাপত্তাহীন। যখন কেউ গুনাহ করে তখন সে আল্লাহর নিরাপত্তা থেকে বের হয়ে যায়। আর আল্লাহর আনুগত্য হচ্ছে এমন এক নিরাপত্তা যার ভিতরে কেউ ঢুকলে সে দুনিয়া ও আখিরাতের শাস্তি থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে।
আর যে আল্লাহর আনুগত্যের নিরাপত্তা থেকে বের হয়ে যাবে সে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে। সে মনে মনে ভাববে, কখন না জানি মৃত্যু চলে আসে, কখন না জানি শাস্তি চলে আসে। সে মৃত্যুকে ভয় পাবে। কারণ সে জানে যে, মারা গেলে পরেই তার প্রাপ্য শাস্তি শুরু হয়ে যাবে। আর মৃত্যুকে ভয় পাবার কারণে সে ঝুঁকিপূর্ণ যে কোন কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখবে। এভাবে সারাক্ষণ সে ভয়ের মধ্যে কাটাবে, হীনমন্যতায় ভুগবে। একটা পর্যায়ে তাকে ‘‘ভয়রোগ’’ গ্রাস করে ফেলবে, যা আজকাল পৃথিবীর সবচেয়ে মহামারী রোগ হিসেবে চিহ্নিত। ফলে সে কোন সৃজনশীল কাজ করতে পারবে না।
৭. মুসলিমদের শক্তি বিনষ্ট হওয়া :
গুনাহের প্রভাবে মুসলিমদের শক্তি বিনষ্ট হয়। কাফিররা আর মুসলিমদেরকে ভয় পায় না। বর্তমানেও এমন অবস্থাই সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এই মুসলিমরাই ইসলামের প্রথম যুগে অস্ত্রশক্তিতে দুর্বল হওয়ার পরও শুধু ঈমানের ও ‘আমলের বলে বলিয়ান হয়ে কাফিরদের পরাজিত করেছিল। কিন্তু আজ মুসলিমরা গুনাহে নিমজ্জিত হয়ে নিজেদের ঈমান ও ‘আমলের শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে।
যে মুসলিমরা শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলেও মৃত্যু পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছে সেই মুসলিমরাই আজ পায়ে একটি কাঁটা বিধঁলে ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না।
মুসলিমরা আজ ইতিহাসের যে কোন সময়ের তুলনায় সংখ্যায় বেশি হলেও তাদেরকে আজ কাফির-মুশরিকরা পাত্তা দিচ্ছে না। এর কারণ কী? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মৃত্যুভয়। আর মৃত্যুভয় তৈরি হয় গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকলে, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন :
يُوشِكُ الأُمَمُ أَنْ تَدَاعٰى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الْأَكَلَةُ إِلٰى قَصْعَتِهَا فَقَالَ قَائِلٌ وَمِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ قَالَ «بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ وَلَكِنَّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السَّيْلِ وَلَيَنْزِعَنَّ اللهُ مِنْ صُدُورِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَابَةَ مِنْكُمْ وَلَيَقْذِفَنَّ اللهُ فِى قُلُوبِكُمُ الْوَهَنَ». فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا الْوَهَنُ قَالَ حُبُّ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَةُ الْمَوْتِ
‘‘অদূর ভবিষ্যতে অন্য জাতির লোকেরা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবে, যেমন খাদ্য গ্রহণকারী বড় পাত্রের দিকে আসে। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আমাদের সংখ্যা কি তখন কম হবে? তিনি বলেন, না, বরং সে সময় তোমরা সংখ্যায় অধিক হবে। কিন্তু তোমাদের অবস্থা হবে সমুদ্রের ফেনার মত। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর হতে তোমাদের ভীরুতা দূর করে দেবেন। জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! ‘আল ওয়াহ্ন’ কী? তিনি (সা.) বললেন, দুনিয়ার মোহ এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।[12]
৮. লজ্জা-শরম কমে যাওয়া :
গুনাহের কাজ করলে ধীরে ধীরে লজ্জা-শরম কমে যেতে থাকে। তখন সে যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারে, করতে পারে। হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
إِذَا لَمْ تَسْتَحْىِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ
‘‘যখন তোমার থেকে লজ্জা চলে যাবে তখন তুমি যা ইচ্ছা তা-ই করো।’’[13]
অর্থাৎ লজ্জাহীন মানুষ যা ইচছা তা-ই করতে পারে। আর লজ্জার পুরোটুকুই কল্যাণ। যার লজ্জা নাই তার কাছে কল্যাণও থাকার কথা না। তাই লজ্জাহীন মানুষ কল্যাণহীন হতে পারে। আর যখন কারো মধ্যে কল্যাণ থাকবে না তখন তার কর্মকা- বিপথে পরিচালিত হবে। এগুলো সবই তার গুনাহের কুপ্রভাবে হয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যত্র বলেছেন :
وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيمَانِ ‘‘লজ্জা ঈমানের একটি শাখা।’’[14]
৯. আল্লাহর নি‘আমত থেকে বঞ্চিত হওয়া :
গুনাহের কারণে ব্যক্তি আল্লাহর অনেক নি‘আমত থেকে বঞ্চিত হয়। ‘আলী বলেন,
إذا كنت في نعمة فارعها.....فإن الذنوب تزيل النعم.
‘‘যদি তুমি আল্লাহর অনুগ্রহের মধ্যে থাকো তাহলে তার যত্ন নাও। কারণ গুনাহ নি‘আমতকে দূর করে দেয়।’’
১০. গুনাহের কারণে গুনাহগার ও তার রবের মাঝে এবং তার ও অন্যান্য মানুষের মধ্যে দূরত্ব ও দুঃসম্পর্ক তৈরি হয় :
কোন এক পূর্ববর্তী বিদ্বান বলেছেন,
إني لأعصي الله ، فأرى ذلك في خلق دابتي وامرأتي
‘‘আমি যখন আল্লাহর অবাধ্য হই তখন তার কুপ্রভাব আমি আমার বাহন ও আমার স্ত্রীর আচার-আচরণে দেখতে পাই।’’
১১. দৈনন্দিন কাজে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া ও সমস্যায় পড়া :
গুনাহের কুপ্রভাবে গুনাহগার যখনই কোনো কাজ করতে যায় তখনই সে তাতে বাধাপ্রাপ্ত ও সমস্যায় পতিত হয়। তার উপরে কাজটি কঠিন হয়ে যায়। এর বিপরীতে মুত্তাকী ব্যক্তি যখন কোনো কাজ করতে যায় তখন আল্লাহ তার জন্য সে কাজকে সহজ করে দেন। তবে তাকে আল্লাহ কখনো কখনো পরীক্ষাও করেন।
১২. গুনাহ গুনাহগারের জীবনকে অন্ধকারময় করে দেয় :
গুনাহগার ব্যক্তি তার অন্তরে অন্ধকার অনুভব করে। রাতের অন্ধকারে আলোহীন পথিকের যে অবস্থা হয় গুনাহের ভারে নিমজ্জিত ব্যক্তিরও তেমন অবস্থা হয়।
চোখ না থাকার কারণে যেমন অন্ধ ব্যক্তির সামনে দুনিয়ার সবকিছু অন্ধকার মনে হয় তেমনি গুনাহের কারণে চামড়ার চোখ থাকার পরও গুনাহের অন্ধকারে গুনাহগারও হাবুডুবু খায়। কারণ আল্লাহর আনুগত্য করাই হচ্ছে আসল আলো। আর তাঁর অবাধ্যতাই হচ্ছে অন্ধকার।
অন্ধকার যত বাড়তে থাকে আলোহীন পথিক যেমন বেশি পথ হারায় তেমনি গুনাহগারও যখন গুনাহ মাফ না করিয়ে নতুন নতুন গুনাহ করতে থাকে তখন ধীরে ধীরে সে বিদ্‘আত, বিভ্রান্তি ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অথচ সে বুঝতেই পারে না যে সে বিপথে চলছে। একসময় সে কোন কিছুকেই গুনাহ মনে করে না। সবকিছুকেই বৈধ ও সঠিক কাজ মনে করে।
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আববাস বলেন,
إن للحسنة ضياءً في الوجه، ونوراً في القلب ، وسعةً في الرزق، وقوةً في البدن، ومحبةً في قلوب الخلق، وإن للسيئة سواداً في الوجه ، وظلمةً في القلب، ووهناً في البدن ونقصاً في الرزق، وبغضةً في قلوب الخلق
‘‘সাওয়াবের কাজ হলো চেহারা উজ্জ্বলতা, অন্তরের আলো, রিয্ক্বের প্রশস্তি, শরীরের শক্তি এবং মানুষের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টিকারী। আর গুনাহ হচ্ছে চেহারার কলুষতা, অন্তরের অন্ধকার, শরীরের দুর্বলতা, রিয্ক্বের সংকট ও মানুষের অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী।’’
১৩. গুনাহের কারণে আল্লাহর আনুগত্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় :
আল্লাহর আনুগত্য থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়া গুনাহের আর যদি কোনো কুপ্রভাব না থাকতো তাহলে শাস্তি হিসেবে এটাই যথেষ্ট হতো। আমরা যদি একবার চিন্তা করে দেখি যে, গুনাহের শাস্তি হিসেবে আমরা আর আল্লাহর আনুগত্য করতে পারবো না- এমন যদি হতো তাহলে তা কতই না ভয়াবহ একটি ব্যাপার হতো। (আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন, আ-মীন।)
গুনাহের কারণে আল্লাহর আনুগত্যের পথ ও সুযোগ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে একটি, দু’টি, তিনটি করতে করতে আনুগত্যের সকল পথ বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এসব আনুগত্যের পথগুলোর এক একটি দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম ছিল।
১৪. গুনাহ চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় :
গুনাহ ধীরে ধীরে গুনাহগারের অন্তরে গুনাহ থেকে বাঁচার ইচ্ছাকে দুর্বল করে দেয়। আর আরো বেশি গুনাহ করার ইচ্ছাকে শক্তিশালী ও বৃদ্ধি করে দেয়। তার অন্তর থেকে তাওবার ইচ্ছাকে দূর করে দেয়। একসময় সে পুরোপুরিভাবে তাওবাকে পরিত্যাগ করে। একসময় সে মিথ্যাবাদীদের মত শুধু মৌখিক ইস্তিগফার ও তাওবাহ্ করে কিন্তু তার অন্তর থাকে গুনাহের সাথে বাঁধা। সে দিনরাত গুনাহ করতেই থাকে। আর এটিই হচ্ছে অন্তরের সবচেয়ে বড় রোগ। আর এটিই তাকে আসেত্ম আসেত্ম চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
১৫. গুনাহের কাজের প্রতি ঘৃণাভাব দূর হয়ে যায় :
নিয়মিত গুনাহ করতে থাকলে গুনাহ গুনাহগারের অন্তর থেকে গুনাহের প্রতি ঘৃণাভাব দূর করে দেয়। ফলে সে আর গুনাহকে খারাপ কিছু মনে করে না। তার কাছে গুনাহের কাজগুলো স্বাভাবিক মনে হয়। তাকে গুনাহের কাজ করতে মানুষ দেখছে বা মানুষ তার খারাপ দিক নিয়ে সমালোচনা করছে তাতেও তার কিছুই আশে যায় না। সে কিছুই মনে করে না। তার অন্তরে গুনাহের প্রতি কোনো ঘৃণা জাগে না।
১৬. গুনাহ অন্তরকে গাফিল করে দেয় :
গুনাহগার যখন অতিমাত্রায় গুনাহ করতে থাকে তখন তার অন্তরে মোহর পড়ে যায়। ফলে তার অন্তরে ভালো কিছুর প্রভাব পড়ে না। তখন সে গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।[15]
উপরোল্লিখিত কুপ্রভাবগুলো ছাড়াও গুনাহের আরো অনেক কুপ্রভাব মানবজীবনে রয়েছে। অনেক প্রভাব রয়েছে যেগুলো শুধু ভুক্তভোগীই জানে এবং অনুভব করে। গুনাহের কুপ্রভাবে যেমন জীবন সংকীর্ণ ও কষ্টকর হয়ে যায় তেমনি গুনাহ থেকে মুক্তি জীবনকে করে উচ্ছ্বল, সফল ও সুখময়।
[2]. আল হামাসাহ আল মাগরিবিয়্যাহ, পৃ. ১২৪ (আল মাকতাবাতুশ শামিলাহ)।
[3]. জন্ম : ১৫০ হি./৭৬৭ ঈ. - মৃত্যু : ২০৪ হি./৮২০ ঈ.।
[4]. জন্ম : ৯৩ হি./৭১১ ঈ. - মৃত্যু : ১৭৯ হি./৭৯৫ ঈ.।
[5]. ই‘য়ানাতুত্ তালিবীন ‘আলা হাল্লি আলফাযি ফাতহিল মু‘ঈন, খ. ২, পৃ. ১৬৭।
[6] সূরা আল আ‘রাফ ৭ : ১৭৫-১৭৬।
[7]. জন্ম ৬৯১ হি./১২৯২ ঈ. - মৃত্যু ৭৫১ হি./১৩৫০ ঈ.।
[8]. সুনান ইবনু মাজাহ : ৪০২২, মুসনাদ আহমাদ : ২২৪১৩; মিশকাত : ৪৯২৫, হাদীসটির প্রথমাংশ হাসান লিগাইরিহী, তবে শেষাংশের ইসনাদ য‘ঈফ।
[9]. জন্ম : ১১৮ হি. - মৃত্যু : ১৮১ হি.।
[10] সূরা আর্ রূম ৩০ : ৪১।
[11]. সুনান ইবনু মাজাহ : ৪০১৯, হাদীসটির সনদ হাসান।
[12]. সুনান আবূ দাঊদ : ৪২৯৯, মুসনাদে আহমাদ : ২২৩৯৭, হাদীসটি সহীহ।
[13]. সহীহুল বুখারী : ৬১২০।
[14]. সহীহুল বুখারী : ৯।
[15]. https ://islamqa.info/ar/23425; ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম আল জাওযিয়্যাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) তার ‘‘আল জাওয়াব আল কাফী’’ গ্রন্থে উক্ত কুপ্রভাবগুলোর অনেকগুলো উল্লেখ করেছেন।