শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ ২. জাহিল সম্প্রদায় তাদের ইবাদত ও দীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ নয় শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
ফিক্বহী মাস‘আলায় মতানৈক্য অথবা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আমাদের করণীয়। কারণ ফিক্বহী বিষয়ে মতানৈক্য বর্তমানেও চালু আছে, এটা কি নিকৃষ্ট হিসাবে গণ্য?

জবাব হলো, মতভেদ দু’প্রকার:

প্রথমত: দীনি বিষয়ে মতভেদ। যেমন ইবাদত ও আক্বীদায় মতানৈক্য। এধরণের মতানৈক্য নিকৃষ্ট ও হারাম। কেননা দীনে (ইবাদত ও আক্বীদায়) ইজতিহাদ করার কোন অবকাশ নেই, রায় বা সিদ্ধান্ত দেয়ারও কোন সুযোগ নেই। বরং দীন ও আক্বীদা পরিপূর্ণ। এ বিষয়ে ইজতিহাদ (গবেষণা) করার কোন বিধান নেই।

আল্লাহ তা‘আলা দীন ও আক্বীদা হিসাবে যা কিছু আমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন, রায় ও ইজতিহাদ ছাড়াই তা আঁকড়ে ধরা আমাদের উপর ওয়াজীব-আবশ্যক। আর ইবাদতও পরিপূর্ণ। যে বিষয়ে দলীল রয়েছে তা আমাদেরকে জানতে হবে। আর যে বিষয়ে দলীল পাওয়া যায় না তা বিদ‘আত বলে গণ্য, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে,

من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد

যে আমাদের দীনে এমন নতুন কিছু আবিষ্কার করলো যা দীন নয় তা প্রত্যাখ্যাত।[1] অন্য হাদীসে এসেছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة، وكل ضلالة في النار

তোমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করা হতে বিরত থাক। কেননা প্রত্যেক নতুনত্ব বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামের কারণ।[2]

সাধারণভাবে আক্বীদা, ইবাদত ও দীনি বিষয়ে কখনো মতানৈক্যের কোন সুযোগ নেই। একমাত্র কুরআন ও সুন্নাহর বিধি-বিধান ও সালাফদের পদ্ধতিই অনুসরণীয়।

দ্বিতীয়: রায় (সিদ্ধান্ত) এর ক্ষেত্রে মতানৈক্য করার সুযোগ আছে অথবা ফিক্বহী মাস‘আলায় ইজতিহাদী ব্যাখ্যার বিষয়ে ও দলীলের ভিত্তিতে বিধান উদ্ঘাটন করার ক্ষেত্রে মতানৈক্য করার সুযোগ আছে। কেননা মানুষকে বুঝানোর ক্ষেত্রে বিধান উদ্ঘাটনে ভিন্নতা আসতে পারে। আর ইজমার মাস‘আলা সমূহ সীমাবদ্ধ, তাতে মতানৈক্য বৈধ নয়। যে সব ইজতিহাদী মাস‘আলায় ইজমা হয়নি, সে বিষয়ে ইজতিহাদ করার সুযোগ আছে। প্রত্যেক বিদ্বানকে আল্লাহ তা‘আলা উপযোগী জ্ঞান ও বুঝ দান করেন, যাতে তারা দলীল উদ্ঘাটন করতে পারে। এক্ষেত্রে ইজতিহাদ শরী‘আত সম্মত।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে যে ইজতিহাদ হতো তা ছিল কল্যাণকর। এসব ইজতিহাদী বিষয়ে মতানৈক্য হয়। তবে দীন ও আক্বীদাগত বিষয়ে কোন মতভেদ নেই। আর ফিক্বহী মাসআলায় মতানৈক্য ঘটেই থাকে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে ছাহাবীরা ইজতিহাদ করতেন আর তাতে মতানৈক্য হতো।

ইজতিহাদ (গবেষণা) দু’প্রকার:

প্রথম: ভিন্নমতের দু’দলের কোন একটির নিকট স্পষ্ট দলীল থাকলে দলীলসহ ঐ মতামত গ্রহণ আবশ্যক। আর এক্ষেত্রে দলীলবিহীন মতামত পরিত্যাজ্য। ফকীহগণের রায় (সিদ্ধান্ত) দলীল ভিত্তিক পেশ করা হয়। তাই যে বিষয়ে দলীল পাওয়া যাবে তা গ্রহণ করা আবশ্যক নচেৎ তা পরিত্যাগ করতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত না হলে ও দলীলের অনুপস্থিতিতে হক্বকে গ্রহণ করা ও সঠিক বিষয়ের দিকে ফিরে আসা মুজতাহিদগণের উপর আবশ্যক। ভুল ইজতিহাদে বহাল থাকা মুজতাহিদ (গবেষক) এর জন্য বৈধ নয়। আর ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও মানুষের জন্য বৈধ নয়। সম্মানিত ইমামগণ এ বিষয়ে আমাদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেন,

(اعرضوا أقوالنا على الكتاب والسنة)

অর্থাৎ তোমরা আমাদের কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কথা পরিত্যাগ করবে।

ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ বলেন,

إذا جاء الحديث عن الرسول صلى الله عليه وسلم فعلى الرأس والعين، وإذا جاء الحديث عن صحابة رسول الله صلى الله عليه وسلم فعلى الرأس والعين، وإذا جاء الحديث عن التابعين فنحن رجال وهم رجال

যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন হাদীছ পাবে তার উপরই অটল থাকবে। আর ছাহাবীদের থেকে হাদীছ পেলে তার উপর বহাল থাকবে। আর তাবিয়ীনদের থেকে হাদীছ পাওয়া গেলে এ ক্ষেত্রে (সঠিক ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে) কারণ তারা ও আমরা উভয়ই মানুষ। এটা ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহ কথা যিনি সম্মানিত চার ইমামের একজন।

অনুরূপভাবে ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ কবর বাসী অর্থাৎ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যাখ্যানকারী ও প্রত্যাখ্যাত। তিনি আরোও বলেন,

একজন অপরজন থেকে বেশি বিতর্ককারী আমাদের নিকট আসে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জিবরীল আলাইহিস সালাম যা নিয়ে এসেছেন ঐসব বিতর্ককারীদের তর্কের কারণে আমরা কি তা পরিত্যাগ করতে পারি!? এটা ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ এর কথা। তিনি আরোও বলেন,

প্রথম শ্রেষ্টতর ব্যতীত এই উম্মাতের অন্য কোন শ্রেষ্টতর নেই। এখানে প্রথম শ্রেষ্টতর কি? উত্তর হলো কুরআন ও সুন্নাহ। এটা ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ এর কথা। ইমাম শাফিয়ী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

মুসলিমদের ঐকমত্যে যার নিকট রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত স্পষ্ট হবে, এক্ষেত্রে অন্যের কথা সে গ্রহণ করবে না। তিনি আরোও বলেন: আমার কথা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথার বিরোধী হলে আমার কথা ধিক্কারের সাথে বর্জন করবে। তিনি আরোও বলেন, যখন কোন ছ্বহীহ হাদীছ পাওয়া যাবে সেটাই হবে আমার মাযহাব। এটা ইমাম শাফিয়ী রহিমাহুল্লাহ এর কথা।[3]

ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি এমন সম্প্রদায়ের ব্যাপারে আশ্চার্যবোধ করি, যারা সনদের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও সুফইয়ানের রায়কে গ্রহণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ) [النور: 63]

অতএব যারা তার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে (সূরা আন নূর ২৪:৬৩)।

তুমি কি জান ফিতনা কি? ফিতনা হলো শিরক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন কথা প্রত্যাখ্যান করলে অন্তরে সংশয় সৃষ্টি হবে যা ধ্বংসকর।

আশ্চর্যজনক! এগুলো মুজতাহিদ (দীনি গবেষক) ইমামগণের কথা। তারা তাদের জ্ঞান ও যোগ্যতার মাধ্যমে ইজতিহাদ (গবেষণা) করেন। কিন্তু তারা কখনো নিজেদেরকে ত্রুটিমুক্ত দাবি করেননি। বরং তাদের দলীল ভিত্তিক কথাকে গ্রহণ করার উপদেশ দেন। শাফিয়ী মাযহাবের স্পষ্ট দলীল পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করা হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের উপর আবশ্যক। আর হানাফী মাযহাবের স্পষ্ট দলীল পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করা শাফিয়ীদের উপর আবশ্যক। অনুরূপভাবে মালিকীরাও হাম্বলী মাযহাবের স্পষ্ট দলীল গ্রহণ করবে। কারণ দলীল গ্রহণ করাই মূল উদ্দেশ্য। কারও অনুসরণ করা উদ্দেশ্য নয়। ইমামদের পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। কেবলমাত্র দলীলের পক্ষপাতিত্ব করা হবে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কাইয়ুম ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবসহ প্রত্যেকেই এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে বলেন,

انظروا في أقوال العلماء، فخذوا ما قام عليه الدليل

আলেমদের কথা যাচাই কর এবং দলীল ভিত্তিক কথা গ্রহণ কর।

তাদের কিতাবাদী থেকে এ কথাগুলোই জানা যায়। এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব। যাতে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, মাযহাবসমূহ বর্জন ও পরিত্যাগ করতে হবে। বরং মাযহাবসমূহ ও ইমামগণের ফিকহ থেকে আমরা উপকার গ্রহণ করবো। কারণ এগুলো আমাদের জন্য বৃহত্তর সম্পদ। তবে আমরা দলীল অনুসরণ করবো। যার নিকট দলীল থাকবে আমাদেরকে তার কথা গ্রহণ করতে হবে। এটাই আবশ্যক। যিনি দলীল জানেন না তিনি আহলুল ইলম (أهل العلم) বিদ্বানদের নিকট থেকে জেনে নিবেন। কারণ আল্লাহ বলেন:

(فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ) [النحل: 43]

আর আমি তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরকেই রসূল হিসাবে প্রেরণ করেছি, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠিয়েছি। সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জেনে থাক (সূরা আন নাহাল ১৬:৪৩)।

কেননা তাতে দায়িত্ব মুক্ত হবে। তুমি যদি জানো তো আলহামদুলিল্লাহ। দলীল গ্রহণ করো। আর যদি না জানা যায় তবে বিদ্বানদের জিজ্ঞেস করা ওয়াজীব।

দ্বিতীয়: ফিক্বহী ইজতেহাদে দু’টি মতের উভয়টির ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দলীল নেই, দু’টি মতই সম্ভাব্য। তাই দলীল না পাওয়ায় ইজতিহাদী মাস‘আলা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। ফলে ভিন্ন মতের কোন একটি মত গ্রহণ করাতে কোন অসুবিধা নেই। এক্ষেত্রে শর্ত হলো এটা যেন নিছক পক্ষপাতিত্ব অথবা কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ না হয়। হক্ব গ্রহণ করাই যেন উদ্দেশ্য হয়। এজন্য হাম্বলীরা শাফিয়ীদেরকে এবং শাফিঈরা মালিকীদের প্রত্যাখ্যান করবে না। আর চার ইমাম ও তাদের অনুসারীরা যুগযুগ ধরে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সকল প্রশংসা আল্লাহরই, তাদের মাঝে কোন শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় না। যদিও কোন বিষয়ে এরূপ ঘটে, তবে তা কতিপয় অজ্ঞদের পক্ষপাতিত্বের কারণেই হয়। চার মাযহাবের অধিকাংশ অনুসারীদের মাঝে কোন শত্রুতা, বিদ্বেষ ও বিভেদ নেই। তারা পরস্পর বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয়। তারা পরস্পরের পিছনে ছ্বলাত আদায় করে। তাদের মাঝে সালাম বিনিময় হয় এবং বিষয় নিয়ে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও তারা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সূলভ আচরণ করে। তাদের মাঝে ইজতিহাদী মাস‘আলাগত প্রাধান্যতা নেই। এজন্য তাদের প্রসিদ্ধ কথা হলো:

لا إنكار في مسائل الاجتهاد

‘ইজতিহাদী মাস‘আলা গ্রহণযোগ্য’। ইজতিহাদী কথার ব্যাপারে যে কোন দেশে কোন মতানৈক্য ও বৈপরীত্য নেই। তাই ফিক্বহী রায়ের (সিদ্ধান্ত) উপরও তারা ঐকমত্য পোষণ করে। এই ঐকমত্যে বিভাজন সৃষ্টি করা কারো জন্য জায়েয নয়। বরং উচিত হবে সম্মতি জ্ঞাপন করা ও মতভেদ সৃষ্টি না করা।

">
[1]. ছ্বহীহ মুসলিম হা/১৭১৮।

[2]. ছ্বহীহ: সুনানে নাসাঈ হা/১৫৭৭, সুনানে আবূ দাউদ হা/৪৬০৭, ইবনে মাজাহ হা/৪২, তিরমিযী হা/২৬৮১।

[3]. সীয়ারু আলামিন নুবালা ১০/৩৪-৩৫