লগইন করুন
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
فَيَتَذَبْذَبُ بَيْنَ الْكُفْرِ وَالْإِيمَانِ، وَالتَّصْدِيقِ وَالتَّكْذِيبِ، وَالْإِقْرَارِ وَالْإِنْكَارِ مُوَسْوِسًا تَائِهًا، شَاكًّا، لَا مُؤْمِنًا مُصَدِّقًا، وَلَا جَاحِدًا مُكَذِّبًا
ফলে সে কুফুরী ও ঈমান, সত্যায়ন ও মিথ্যায়ন, স্বীকৃতি প্রদান ও অস্বীকৃতি, সন্দেহ-পেরেশান এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অনিশ্চয়তার বেড়াজালে ঘুরপাক খেতে থাকবে। সে না সত্যবাদী মুমিন হবে, আর না অস্বীকারকারী মিথ্যাবাদী হবে।
ব্যাখ্যা: يتذبذب অর্থ হলো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ও দোদুল্যমান থাকা। যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত থেকে সরে গিয়ে ইলমে কালামের দিকে ঝুকে পড়ে, তাদের অবস্থা ঠিক এরকম হয়ে থাকে। ইমাম ত্বহাবী উপরোক্ত বাক্যের মধ্যে তাদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। কুরআন-সুন্নাহর দলীল যখন তাদের বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী হয়, তখন তারা কুরআন-সুন্নাহর দলীল প্রত্যাখ্যান করে এবং তাদের নিজস্ব রায় এবং বিভিন্ন মতাদর্শের দিকে ঝুকে পড়ে। এতে করে তারা পেরেশানী, গোমরাহী এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিপতিত হয়। দার্শনিকদের মতাদর্শ সম্পর্কে সর্বাধিক পারদর্শী ইবনে রুশদ রহিমাহুল্লাহ তার অন্যতম কিতাব تهافت التهافت (দার্শনিকদের) অধঃপতন নামক কিতাবে বলেন, এমন কোনো দার্শনিক আছে কি যে আল্লাহ তা‘আলা ও তার উলুহীয়াত সম্পর্কে কোনো গ্রহণযোগ্য কথা বলেছে? অনরূপ ইমাম আবুল হাসান আল-আমেদীও তার যামানায় ইলমে কালামে সর্বাধিক পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও শেষ যামানায় দিশেহারা হয়েছেন। এমনি ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ শেষ জীবনে উপনীত হয়ে ইলমে কালামের মাসআলাসমূহে দিশেহারা হয়েছেন। অতঃপর তিনি তার সকল পথ পরিহার করে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের দিকে ঝুকে পড়েছেন। বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ছহীহ বুখারী বুকের উপর নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। অনুরূপ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন উমার ফখরুদ্দীন রাযী স্বীয় কিতাব أقسام اللذات -এ বলেছেন,
نِهَايَةُ إِقْدَامِ الْعُقُولِ عِقَالُ............ وَغَايَةُ سَعْيِ الْعَالَمِينَ ضَلَالُ
وَأَرْوَاحُنَا فِي وَحْشَةٍ مِنْ جُسُومِنَا....... وَحَاصِلُ دُنْيَانَا أَذَى وَوَبَالُ
وَلَمْ نَسْتَفِدْ مِنْ بَحْثِنَا طُولَ عُمْرِنَا... سِوَى أَنْ جَمَعْنَا فِيهِ: قِيلَ وَقَالُوا
فَكَمْ قَدْ رَأَيْنَا مِنْ رِجَالٍ وَدَوْلَةٍ......... فَبَادُوا جَمِيعًا مُسْرِعِينَ وَزَالُوا
وَكَمْ مِنْ جِبَالٍ قَدْ عَلَتْ شُرُفَاتِهَا.......... رِجَالٌ فَزَالُوا وَالْجِبَالُ جِبَالُ
১) আমাদের বিবেক-বুদ্ধি যখন অনর্থক কাজে অগ্রসর হলো এবং তাকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তা বাদ দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হলো, তখন তা দিশেহারা ও অনুতপ্ত হলো। আর তা অর্জনের সকল চেষ্টা গোমরাহীতে পরিণত হলো।
২) আমাদের রূহগুলো সর্বদাই দেহের মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গতা অনুভব করছে।[1] দুনিয়াতে আমরা যে সুখ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছি, তাই আমাদের জন্য দুঃখ কষ্ট ও বিপদা-পদের কারণ হয়েছে।
৩) আমাদের জীবনের দীর্ঘ সময় দর্শন ও ইলমে কালাম চর্চা করে শেষ করলাম। এতে শুধু অযথা ও অহেতুক কথা-বার্তা জমা করা ব্যতীত আর কিছুই করতে পারিনি।
৪) আমরা বহু পুরুষ ও জাতি দেখেছি। তারা সকলেই চলে গেছে ও নিঃশেষ হয়েছে।
৫) বহু লোক পাহাড়ের চেয়ে উচু মর্যাদা লাভ করেছে। তাদের পতন ঘটেছে, কিন্তু পাহাড় স্বস্থানে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ফখরুদ্দীন রাযি আরো বলেন, আমি সত্যের সন্ধানে ইলমে কালামের সকল মাযহাব নিয়েই চিন্তা-গবেষণা করেছি এবং দার্শনিকদের সমস্ত মানহাজেই দৃষ্টি দিয়েছি। এতে কোনো রোগের চিকিৎসা হয়না এবং এটি কারো পিপাসা নিবারণ করে না। পরিশেষে আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, আল্লাহ তা‘আলার কিতাব আল-কুরআনই সত্য ও সঠিক জ্ঞান অর্জনের সর্বোত্তম উৎস।[2]
তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ সিফাতসমূহ সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আপনি এ আয়াতটি পাঠ করুন,
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’ (সূরা ত্বহা:৫)। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,
إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ
‘‘পবিত্র বাক্যসমূহ তারই দিকেই উঠে এবং সৎকর্মকে তিনি উন্নীত করেন’’। (সূরা ফাতির: ১০)
আর আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তা থেকে ত্রুটি এবং অপূর্ণতার গুণাবলী নাকোচ করার ক্ষেত্রে আপনি পাঠ করুন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ
‘‘তার সদৃশ কোন কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ (সূরা শূরা:১১)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَلاَ يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا
‘‘তারা তাদের জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না’’। (সূরা ত্বহা: ১১০)
শাইখ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল কারীম শাহরাস্তানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, দার্শনিক ও মুতাকাল্লিমীনদের নিকট দিশেহারা হওয়া এবং অনুশোচনা ছাড়া অন্য কিছু নেই। তিনি আরো বলেন,
لَعَمْرِي لَقَدْ طُفْتُ الْمَعَاهِدَ كُلَّهَا. وَسَيَّرْتُ طَرْفِي بَيْنَ تِلْكَ الْمَعَالِمِ
فَلَمْ أَرَ إِلَّا وَاضِعًا كَفَّ حَائِرٍ... عَلَى ذَقَنٍ أَوْ قَارِعًا سِنَّ نَادِمِ
আমার জীবনের শপথ! আমি পৃথিবীর সমস্ত ইলমে কালাম ও দর্শনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিভ্রমণ করেছি এবং সেগুলোতে চোখ রেখেছি। আমি সেখানকার সকলকেই দিশেহারা হয়ে স্বীয় গালে হাত রাখতে দেখেছি অথবা শেষ বয়সে উপনীত হয়ে অনুশোচনা করতে দেখেছি।
এমনি ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, হে বন্ধুগণ! তোমরা ইলমে কালামের পিছে পড়ো না। আমি যদি জানতাম, ইলমে কালাম আমাকে এতদূর নিয়ে যাবে, তাহলে আমি এ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম না। মৃত্যুর সময় তিনি বলেছেন, আমি এক সুবিশাল মহাসাগরে ডুব দিয়েছি, মুসলিমদেরকে বর্জন করেছি এবং তাদের ইলম থেকেও বহু দূরে সরে এসেছি। এর মাধ্যমে আমি ঐ জিনিসের মধ্যেই ঢুকে পরেছি, যাতে প্রবেশ করতে তারা আমাকে নিষেধ করেছে। এখন আল্লাহ তা‘আলা যদি তার অপার কৃপায় আমাকে ক্ষমা না করেন, তাহলে ইবনুল জুওয়াইনীর জন্য ধ্বংস অনিবার্য।
অতঃপর ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনি রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ তো আমি এখন আমার মায়ের আকীদার উপরই মৃত্যু বরণ করছি অথবা তিনি বলেছেন, আমি নিসাপুরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আকীদার উপরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছি।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ শিষ্য শামসুদ্দিন খুসরাওশাহীও অনুরূপ কথা বলেছেন। তার কাছে একদা যখন একজন জ্ঞানী লোক প্রবেশ করলেন, তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আল্লাহর ব্যাপারে কী আক্বীদাহ পোষণ করো? সেই জ্ঞানী লোক বললেন, সাধারণ মুসলিমগণ যে আক্বীদাহ পোষণ করে, আমিও তা পোষণ করি। খুসরাওশাহী তখন বললেন, তুমি কি প্রশস্ত মনে নিশ্চিতভাবে অন্তরের গভীর থেকে তা বিশ্বাস করে থাকো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। এ কথা শুনে খুসরাওশাহী বললেন, তুমি এর কারণে আল্লাহর শোকর আদায় করো। আর আমার অবস্থা হলো, আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর ব্যাপারে কী আক্বীদাহ পোষণ করি, তা আমি নিজেই জানি না। আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর ব্যাপারে কী আক্বীদাহ পোষণ করি, তা আমি নিজেই জানি না। আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর ব্যাপারে কী আক্বীদাহ পোষণ করি, তা আমি নিজেই জানি না। এ কথা বলে তিনি কাদতে লাগলেন। ক্রন্দনের কারণে তার দাড়ি ভিজে গেল।
ইরাকের সুপ্রসিদ্ধ আলেম ইবনে আবীল হাদীদ বলেছেন,
فِيكَ يَا أُغْلُوطَةَ الْفِكَرِ... حَارَ أَمْرِي وَانْقَضَى عُمُرِي
سَافَرَتْ فِيكَ الْعُقُولُ فَمَا... رَبِحَتْ إِلَّا أَذَى السَّفَرِ
فَلَحَى اللَّهُ الْأُلَى زَعَمُوا... أَنَّكَ الْمَعْرُوفُ بِالنَّظَرِ
كَذَبُوا إِنَّ الَّذِي ذَكَرُوا......... خَارِجٌ عَنْ قُوَّةِ الْبَشَرِ
(১) বিবেক-বুদ্ধি খাঁটিয়ে পরিশ্রমের মাধ্যমে ও তর্ক-বিতর্ক করে আল্লাহর মারেফত ও ইয়াকীন অর্জনের চেষ্টা করে আমি মারাত্মক ভুল করেছি। এর পিছনে ছুটে আমার আয়ু শেষ হয়ে গেলো। অথচ আমি এখনো দিশেহারা হয়ে পড়ে আছি।
(২) ওহে মহা সত্যের মারেফত! আমার বিবেক-বুদ্ধি তোমাকে অর্জন করার জন্য বহু দীর্ঘপথ পরিভ্রমণ করেছে। কিন্তু সফরের ক্লান্তি-কষ্ট ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি।
(৩) আল্লাহ তা‘আলা ঐসব লোকদেরকে ধ্বংস করুন, যারা মনে করেছে চিন্তা-ফিকির ও বুদ্ধির মাধ্যমে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
(৪) তারা যা বলেছে তাতে তারা মিথ্যুক। কারণ মানুষের বোধশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে প্রভুর মারেফত হাসিল করা অসম্ভব।[3]
কালাম শাস্ত্রের অন্যতম ইমাম মুহাম্মাদ বিন নামাউর আল-খাওয়ানজী (মৃত: ৬৪৬) মৃত্যুর সময় বলেছেন, সারা জীবন ইলমে কালাম চর্চা করে কিছুই অর্জন করতে পারিনি। শুধু এতটুকু অর্জন করতে পেরেছি যে, যার অস্তিত্ব সম্ভব, অস্তিত্ব লাভের জন্য তা একটি শক্তির প্রতি মুখাপেক্ষী। অতঃপর তিনি বলেন, এ মুখাপেক্ষীতা একটি নেতিবাচক বিশেষণ। মোট কথা, আমি এখন মারা যাচ্ছি, অথচ ইলমে কালামের পিছনে সারা জীবন পরিশ্রম করে আল্লাহর মারেফত সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি।
অন্য একজন কালামবিদ বলেছেন, আমি বিছনায় শুয়ে থাকি এবং আমার চেহারাকে কম্বল দিয়ে আবৃত করে রাখি। এমতাবস্থায় আমি দ্বীনের মূলনীতি সম্পর্কিত বিষয়সমূহে বিতর্ককারী পক্ষগুলোর দলীলগুলো যাচাই-বাছাই ও তুলনা করে দেখি। ফজর হয়ে যায়, তবুও আমি কোনো পক্ষের কথার উপর অন্য পক্ষের কথাকে প্রাধান্য দিতে পারি না।
প্রিয় ভাইগণ! উপরে যেসব আলেমদের কথা আলোচনা করা হলো, তাদের অবস্থা আপনি অবগত হলেন। যার অবস্থা এ রকম হবে, তার উপর আল্লাহর রহমত নাযিল না হলে সে নাস্তিকে পরিণত হবে। যেমন ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলমে কালাম বা তর্কশাস্ত্র-মানতেক-দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে যাবে সে নাস্তিকে পরিণত হবে, যে ব্যক্তি মাটিকে সোনা বানিয়ে ধনী হওয়ার চেষ্টা করবে, সে সর্বহারা হবে এবং দুর্লভ হাদীছের সন্ধানে বের হবে, সে মিথ্যাবাদীতে পরিণত হবে।
ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আহলে কালাম বা তর্কশাস্ত্র চর্চাকারীদের ব্যাপারে আমার ফায়ছালা হলো তাদেরকে খেজুর গাছের শাখা এবং জুতা দিয়ে পেটানো হবে। তাদেরকে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরানো হবে এবং বলা হবে যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত বাদ দিয়ে কালামশাস্ত্র নিয়ে ব্যস্ত হবে, এটিই তাদের শাস্তি। ইমাম শাফেঈ আরো বলেন, আমি আহলে কালামদের এমন এমন কথা জানতে পেরেছি, যা কোনো মুসলিমের কথা হতে পারে না। কোনো মুসলিম শির্ক ছাড়া অন্যান্য সকল পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে ইলমে কালাম চর্চা করার অপরাধ আরো বেশী।
প্রিয় মুসলিম ভাই! আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, কালামশাস্ত্রের পন্ডিতদের কেউ কেউ মৃত্যুর সময় তাদের মাজহাব পরিত্যাগ করে সাধারণ মুসলিম ও বৃদ্ধ অশিক্ষিত মানুষের সহজ-সরল ইসলামী আকীদার দিকে ফিরে এসেছেন। তারা সাধারণ মুসলিমদের আক্বীদাহ-বিশ্বাসকেই স্বীকার করে নিয়েছেন এবং কুরআন-সুন্নাহবিরোধী তাদের সূক্ষ্ণ ও জটিল বিষয়গুলোকে পরিহার করেছেন। অথচ এ বিষয়গুলোকে তারা এক সময় অকাট্য মনে করতেন। অতঃপর যখন তাদের নিকট তা ভ্রান্ত হিসাবে ধরা পড়লো অথবা তার বিশুদ্ধতা তাদের নিকট সুস্পষ্ট হলো না তখন তারা শেষ বয়সে উপনীত হয়ে বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে হলে শিশু, বৃদ্ধ নারী ও গ্রাম্য অশিক্ষিত লোকদের আকীদার দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
যেসব লোক আল্লাহর সত্তা, তার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুণাবলী এবং দ্বীনের অন্যান্য বিষয় নিয়ে সন্দেহে পতিত হবে, তার উক্ত রোগের উপকারী চিকিৎসা কেবল তাই, যা অন্তরের রোগসমূহের সর্বোত্তম চিকিৎসক মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। তিনি রাতে ঘুম থেকে উঠে যখন ছ্বলাত শুরু করতেন, তখন বলতেন,
اللَّهُمَّ رَبَّ جِبْرِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ اهْدِنِى لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ أَنْتَ تَهْدِى مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘‘হে আল্লাহ্! তুমি জিবরীল, মিকাঈল এবং ইসরাফীলের প্রভু, আসমান-যমিন সৃষ্টিকারী, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বস্তু সম্পর্কে অবগত, তুমি তোমার বান্দাদের মতভেদের বিষয়ে চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী। যে হকের ব্যাপারে লোকেরা মতভেদে লিপ্ত রয়েছে, তোমার তাওফীকে আমাকে তাতে দৃঢ়পদ রাখো। তুমি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করে থাকো’’।[4]
ইমাম মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এখানে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীল, মিকাঈল এবং ইসরাফীলের রবের উসীলায় দু‘আ করেছেন যে, তিনি যেন স্বীয় ইচ্ছায় তাকে ঐ মহা সত্যের হেদায়াত প্রদান করেন, যে ব্যাপারে লোকেরা মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। কেননা হেদায়াত ছাড়া অন্তর জীবিত থাকতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত তিন ফেরেশতাকে সমস্ত সৃষ্টিকে জীবিত রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন। জিবরীলকে যমীনবাসীর নিকট অহী নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ অহীর মাধ্যমে মানুষের অন্তর জীবিত থাকে। মিকাঈলকে বৃষ্টি বর্ষণ করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষের শরীর জীবিত ও সতেজ থাকে এবং বাকীসব জীব-জন্তু ও উদ্ভিদ বেচে থাকে। ইসরাফীলকে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। এর মাধ্যমে সমস্ত প্রাণী মৃত্যুর পর পুনঃজীব ফিরে পাবে এবং রূহসমূহ নিজ নিজ দেহে ফিরে যাবে। সুতরাং সৃষ্টির জীবন প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব বড় বড় ফেরেশতার রবের উসীলা দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট দু‘আ করা উদ্দেশ্য হাসিল করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। আল্লাহ সহায়।
কিন্তু মানুষের শরীর যখন প্রকৃতির নিয়মে অন্যান্য জীব-জন্তুর মত স্বীয় স্বভাব অনুযায়ী চলে, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও শরীয়াতের বিধান পরিহার করে রূহের জন্য অন্য কোনো নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে, তখনই দেহ এবং রূহের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রূহ তখন একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা ও কষ্ট অনুভব করে। এ জন্যই আপনি দেখবেন যে, যারা সর্বোচ্চ দৈহিক ভোগ-বিলাস ও আমোদ-প্রমোদে ডুবে থাকে, তাদের মধ্যেই আত্মহত্যা সংঘটিত হয় সবচেয়ে বেশী। তারা তাদের রূহকে আল্লাহ তা‘আলার বিধান অনুযায়ী চালায় না বলেই তাদের দেহ এবং রূহের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তাদের রূহ নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ব অনুভব করে বলেই এমনটি হয়ে থাকে।
ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে এ কথার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যাবে। ইউরোপের সুইডেন এমন একটি রাষ্ট্র, যাতে রয়েছে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য, সুন্দর নদ-নদী ও এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ, যা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে পাওয়া দুস্কর। নাগরিকদের মাথা পিছু গড় আয় পৃথিবীর অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের মাথা পিছু গড় আয়ের চেয়ে বেশী। ভোগবিলাস ও যেনা-ব্যভিচারের ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। এমনকি পুরুষে পুরুষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তাদের সংসদে আইন রাখা হয়েছে। এত কিছুর পরও সবচেয়ে বেশী আত্ম হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয় সুইডেনে। এটি কি দেহ ও রূহের মধ্যে দূরত্ব এবং রূহের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের উজ্জল দৃষ্টান্ত নয়?
সুতরাং দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য লাভের মূলেই রয়েছে আল্লাহর প্রতি ঈমান। এর মাধ্যমেই মানুষের দেহ ও শরীরের সার্বিক চাহিদা পূরণ হয়। এতেই রূহ এবং দেহের মধ্যে পরিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়। সেই সঙ্গে সমাজের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক এবং সমগ্র মানবের সাথে প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টির সাথেও সুসম্পর্ক তৈরী হয়। এতে করে সকল সৃষ্টিই এক ও অভিন্ন লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত হয়।
[2]. বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী একদা পথ চলছিলেন। তার সাথে তখন শতাধিক ছাত্র ছিল। তারা যখন একজন বৃদ্ধ মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, তখন বৃদ্ধ মহিলা ইমামের শান-শওকত দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ইনি কে? ছাত্ররা বলল, ইনি হলেন প্রখ্যাত আলেম আবু আব্দুল্লাহ ফখরুদ্দীন রাযী। ছাত্ররা ইমামের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, তিনি আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে একহাজার সংশয়ের উত্তর জানেন। বৃদ্ধ মহিলাটি তখন বলল, আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ আছে কি? যার জন্য একহাজার দলীল দিয়ে সে সন্দেহ দূর করতে হবে? সুতরাং বৃদ্ধ মহিলাটি তার স্বভাব প্রসূত জবাবের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিল, যে ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে এত দলীল সংগ্রহ করেছে, তার অন্তরে যদি আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহ নাই থাকতো, তাহলে তিনি এত দলীল সংগ্রহ করতে যাবেন কেন?
[3]. তিনি ঠিক বলেছেন। মানুষের নিজস্ব বোধশক্তি, চিন্তা-গবেষণা করে এবং মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা অসম্ভব। গায়েবী ইলম ও অহীর উপর নির্ভর করেই মারেফতে ইলাহী হাসিল করা যাবে। যারাই কুরআন-সুন্নাহর পথ পরিহার করে নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধির মাধ্যমে স্রষ্টার সত্তা, গুণাবলী ও পরিচয় হাসিল করার চেষ্টা করেছে, শেষ জীবনে উপনীত হয়ে তারা সকলেই আফসোস করেছে। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি, ইমাম গাজ্জালী, ইমামুল হারামাইন এবং কালাম শাস্ত্রের আরো অনেক ইমামই শেষ জীবনে এসে আফসোস করেছেন। তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, যে উদ্দেশ্যে তারা ইলমুল কালাম ও তর্কশাস্ত্রের সাগরে ডুব দিয়েছিলেন, তাতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।
[4]. ছহীহ মুসলিম হা/৭৭০, অধ্যায়: রাতের ছবলাতের দু‘আ।