লগইন করুন
অতঃপর ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
لَيْسَ بَعْدَ خَلْقِ الْخَلْقِ اسْتَفَادَ اسم الْخَالِق وَلَا بِإِحْدَاثِهِ الْبَرِيَّةَ اسْتَفَادَ اسم الْبَارِي
সৃষ্টি করার পর তার গুণবাচক নাম খালেক হয়নি এবং সৃষ্টিজগৎ উদ্ভাবন করার কারণে তার গুণবাচক নাম উদ্ভাবক হয়নি।
..................................................................
ব্যাখ্যা: শাইখের কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি অতীতে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির ধারাবাহিকতা থাকার বিষয়টি সমর্থন করেন না। সামনে আলোচনা করা হবে যে, ভবিষ্যতে তিনি সৃষ্টির ধারাবাহিকতা সাব্যস্ত করেন। সেখানে তিনি বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নাম পূর্বেই সৃষ্ট করা হয়েছে। এ দু’টি কোনোদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে না এবং ক্ষয় প্রাপ্তও হবে না। এটিই অধিকাংশ আলেমের মত। যেমনটি পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। যারা বলেছে অতীত ও ভবিষ্যতের কখনোই ধারাবাহিকতা সম্ভব নয়, তাদের কথা নিঃসন্দেহে বাতিল। জাহাম বিন সাফওয়ান এবং তার অনুসারীরা এ কথাই বলেছে। সে বলেছে, জান্নাত ও জাহান্নাম ধ্বংস হয়ে যাবে। তার কথা যেমন সম্পূর্ণ বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীলগুলো সামনে আসছে, ইনশা-আল্লাহ।
আর অবিনশ্বর সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকার কথা স্বীকারকারীদের মধ্য থেকে যারা বলেছে যে, এমন সৃষ্টি থাকা সম্ভব, যার কোনো সূচনা নেই, তাদের কথা ঐসব লোকদের চেয়ে অধিক সুস্পষ্ট ও সত্য, যারা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেছে। অর্থাৎ যারা বলেছে, অতীতে সৃষ্টির সূচনাহীন ধারাবাহিকতা থাকা সম্ভব নয়; কিন্তু ভবিষ্যতে সম্ভব। এ মত ঠিক নয়; কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সর্বদাই জীবন্ত। আর জীবিত থাকার দাবিই হলো সব সময় সক্রিয় থাকা। সুতরাং তিনি সবসময় স্বীয় ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদনকারী। তিনি নিজেকে এ বিশেষণেই বিশেষিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ ذُو الْعَرْشِ الْمَجِيدُ
‘‘আরশের মালিক, শ্রেষ্ঠ সম্মানিত এবং তিনি যা চান তাই করেন’’ (সূরা বুরুজ: ১৫-১৬)। উপরোক্ত আয়াত একাধিক বিষয়ের প্রমাণ করে,
(১) আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইচ্ছা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করেন।
(২) তিনি সর্বদা একই রকম। কেননা তিনি নিজের প্রশংসা ও গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়েই উপরোক্ত কথা বলেছেন। সর্বদা সক্রিয় থাকাই তার পূর্ণতার প্রমাণ। কোনো সময়ই এ পূর্ণতা থেকে খালি থাকা বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَفَمَن يَخْلُقُ كَمَن لَّا يَخْلُقُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
‘‘তাহলে ভেবে দেখতো যিনি সৃষ্টি করেন এবং যে কিছুই সৃষ্টি করে না তারা উভয় কি সমান? তোমরা কি সজাগ হবে না?’’ (সূরা আন নাহাল: ১৭)
সুতরাং সৃষ্টি করা কিংবা কাজ করা যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতা ও বড়ত্বের বিশেষণ, তাই তার অবস্থা এমন নয় যে, প্রথমে তা ছিল না, পরে সৃষ্টি হয়েছে।
(৩) আল্লাহ তা‘আলা যখন যা ইচ্ছা তাই করেন। فعال لما يريد এর মধ্যে ما শব্দটি সাধারণ মাওসুলা। অর্থাৎ এর অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা যা করার ইচ্ছা করেন, তা সবই করেন। তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত ইচ্ছার ব্যাপারে এ কথা। তার যে ইচ্ছা বান্দার কাজের সাথে সম্পৃক্ত, তার জন্য রয়েছে আরেক অবস্থা। বান্দা থেকে তিনি যে কাজ সম্পাদিত হওয়ার ইচ্ছা করেন, কিন্তু নিজের পক্ষ হতে বান্দাকে যদি উক্ত কাজ করতে সাহায্য না করেন এবং বান্দাকে কর্ম বাস্তবায়নকারী না বানান তাহলে সে কাজ সংঘটিত হয় না। যদিও তিনি শরীয়াতগত দিক থেকে তার ইচ্ছা করেন। কিন্তু বান্দাকে কর্ম সম্পাদনকারী না বানানো পর্যন্ত সে কাজ সংঘটিত হয় না।
কাদারীয়া এবং জাবরীয়াদের নিকট এ মাস‘আলাটি সম্পূর্ণ অস্পষ্ট রয়েছে।[1] তারা তাকদীরের মাস‘আলায় আন্দাজ-অনুমান করে এলোমেলো কথা বলেছে। এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ গাফেল। বান্দা করুক, আল্লাহ তা‘আলার এ ইচ্ছা করা এবং বান্দাকে কর্ম সম্পাদনকারী বানানোর ইচ্ছা করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাকদীরের মাস‘আলা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে। ইনশা-আল্লাহ।
(৪) আল্লাহর কর্ম এবং তার ইচ্ছা পরস্পর সংযুক্ত। অর্থাৎ উভয়ের একটি অন্যটিকে আবশ্যক করে। তিনি যা করার ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই করেন। আর যা তিনি করেছেন, তা করার ইচ্ছা অবশ্যই করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা মাখলুকের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা মাখলুক এমন ইচ্ছাও করে, যা সে বাস্তবায়ন করে না, কিংবা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে না। সে সঙ্গে বান্দা এমন কাজও করে, যা সে করার ইচ্ছাই রাখে না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত এমন কোনো ক্রিয়া সম্পন্নকারী সত্তা নেই, সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
(৫) আল্লাহ তা‘আলার কর্ম যেহেতু বিভিন্ন, তাই কর্ম অনুযায়ী তার ইচ্ছাও একাধিক ও বিভিন্ন। তার প্রত্যেক কাজের জন্যই খাস ইচ্ছা রয়েছে। সৃষ্টি ও প্রকৃতিগত স্বভাব দ্বারাই এ অর্থ বোধগম্য। আল্লাহ তা‘আলার মর্যাদা হলো, তিনি সবসময়ই ইচ্ছা করেন এবং যা ইচ্ছা তাই করেন।
(৬) আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সাথে যা কিছুই সম্পৃক্ত হওয়া বৈধ, তা সৃষ্টি করা ও সংঘটিত করা তার জন্য জায়েয। সুতরাং তিনি যখন প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসার ইচ্ছা করেন, তখন তথায় নেমে আসেন। কিয়ামতের দিন যখন বান্দাদের মধ্যে ফায়ছালা করার জন্য কিয়ামতের আঙ্গিনায় নেমে আসার ইচ্ছা করবেন, সৃষ্টিকে দেখানোর জন্য স্বীয় সত্তাকে প্রকাশ করবেন, যেভাবে ইচ্ছা তাদের সামনে পর্দা উন্মুক্ত করবেন, তাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলবেন, হাসবেন এবং ইত্যাদি আরো যেসব বিষয়ের ইচ্ছা করবেন, তা সংঘটিত করা তার জন্য অসম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা তাই করেন। আল্লাহ তা‘আলা যা করার ইচ্ছা করেন অর্থাৎ তার জন্য যা সাব্যস্ত করা হবে কিংবা তাকে যা থেকে পবিত্র করা হবে, তা কেবল রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্য খবরের উপরই নির্ভর করেই করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও তার সিফাত সম্পর্কে তিনি যে সংবাদ দিয়েছেন, তা সত্যায়ন করা জরুরী।
এমনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা যা ইচ্ছা লাওহে মাহফুয থেকে মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা তথায় বহাল রাখেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো কাজে রত আছেন।
যদি বলা হয় যে, সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট একটি সূচনার সময় রয়েছে, তাহলে এ কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, সে সময়ের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি থেকে অকেজো ও বেকার ছিলেন। (নাউযুবিল্লাহ)[2]
সে সঙ্গে আরো আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা প্রথমে ক্রিয়াশীল ছিলেন না, অতঃপর ক্রিয়াশীল হয়েছেন। এতে করে সৃষ্টিজগতের জন্য অনাদি ও প্রারম্ভহীনতা আবশ্যক হয় না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া বাকিসব বস্তুই সৃষ্টি। এগুলো অতীতের যে কোনো সময় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল। আল্লাহ তা‘আলা এগুলো সৃষ্টি করেছেন বলেই অস্তিত্বে এসেছে। এগুলো মূলতঃ অস্তিত্বহীন ছিল। আল্লাহ ছাড়া যত বস্তু রয়েছে, দারিদ্র ও মুখাপেক্ষীতা তার প্রত্যেকটির মৌলিক বিশেষণ। আল্লাহ তা‘আলা নিজে নিজেই অসত্মীত্বশীল এবং সত্তাগত দিক থেকে অমুখাপেক্ষী। অমুখাপেক্ষীতা তার সত্তাগত বিশেষণ।
এ সৃষ্টিজগৎ কোনো পদার্থ ও ধাতু থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে কি না, এ সম্পর্কে লোকদের দু’টি মত রয়েছে। সর্বপ্রথম সৃষ্টি কোনটি সে সম্পর্কেও তারা মতভেদ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ
‘‘তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, যখন এর আগে তার আরশ পানির উপর ছিল’’। (সূরা হুদ: ৭)
ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য ইমামগণ ইমরান হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, ইয়ামানের অধিবাসী রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো,
جِئْنَاكَ لِنَتَفَقَّهَ فِي الدِّينِ، وَلِنَسْأَلَكَ عَنْ أَوَّلِ هَذَا الْأَمْرِ فَقَالَ: كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ قَبْلَهُ وَفِي رِوَايَةٍ: وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ مَعَهُ وَفِي رِوَايَةِ غَيْرِهِ: وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ؛ وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كُلَّ شَيْءٍ، وَخَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ"، وَفِي لَفْظٍ: ثُمَّ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
‘‘দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার জন্য এবং সর্বপ্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করার জন্য আমরা আপনার কাছে এসেছি। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ছিলেন, তার পূর্বে কিছুই ছিল না’’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ مَعَهُ ‘‘তার সাথে কিছুই ছিল না’’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ তখন তার আরশ পানির উপর ছিল। তিনি যিকিরের মধ্যে সবকিছু লিখে দিয়েছেন এবং আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে,ثُمَّ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ‘‘অতঃপর তিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন’’।[3] এখানে যিকির বলতে লাওহে মাহফুয উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ
‘‘আর যাবুরে আমি উপদেশের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, যমীনের উত্তরাধিকারী হবে আমার নেক বান্দারা’’। (সূরা আম্বীয়া: ১০৫)
যিকিরের (লাওহে মাহফুযের) মধ্যে যা লিখা হয়, তাকে যিকির বলা হয় যেমন কিতাবের মধ্যে লিখিত বিষয়কে কিতাব বলে নামকরণ করা হয়।
উপরোক্ত হাদীছের ব্যাপারে লোকদের দু’টি মত রয়েছে। প্রথম মত তাদের কেউ কেউ বলেন, এ হাদীছের মধ্যে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য হলো, এ খবর দেয়া যে, অনাদিতে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সর্বদা ছিলেন। অতঃপর তিনি সমস্ত সৃষ্টির সূচনা করেছেন। সুতরাং বিভিন্ন সত্তা ও প্রকৃতির সৃষ্টি এবং অস্তিত্বশীল বস্তুগুলো প্রথমে ছিল না, পরে আবিস্কৃত হয়েছে। কাল ও যুগ সৃষ্টি করা হয়েছে, তবে কোনো কালের মধ্যে তা সৃষ্টি করেননি। কারণ তখন কালের অস্তিত্বই ছিল না। সৃষ্টির সূচনা করা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা কোনো ক্রিয়া সম্পাদন করতেন না। অথচ তিনি সবসময় সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন। সৃষ্টি করা সবসময় তার জন্য সম্ভব ছিল।
দ্বিতীয় মত হলো, এখানে হাদীছের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ দৃশ্যমান সৃষ্টিজগতের সূচনা সম্পর্কে সংবাদ দেয়া, যা তিনি ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। কুরআনের একাধিক স্থানে এ সংবাদ দেয়া হয়েছে। ছহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
«كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ قَالَ: وَكان عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ»
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত মাখলুকের তাকদীর লিখে দিয়েছেন। তখন তার আরশ ছিল পানির উপরে’’।[4]
সুতরাং নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, আসমানসমূহ সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বেই ছয়দিনে এ সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টির তাকদীর বা পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। তখনও তার আরশ পানির উপরই ছিল।
একাধিক কারণে এ দ্বিতীয় প্রকার মতটির সত্যতা প্রমাণিত।
(১) ইয়ামানবাসীদের কথা, جِئْنَاكَ لِنَسْأَلَكَ عَنْ أَوَّلِ هَذَا الْأَمْرِ ‘‘সর্বপ্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করার জন্য আমরা আপনার কাছে এসেছি’’। এখানে هذا اسم إشارة -এর মাধ্যমে অস্তিত্বশীল দৃশ্যমান এ বর্তমান সৃষ্টিজগতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। الأمر শব্দটি এখানে المأمور অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তার আদেশের মাধ্যমে যে সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কেই ছিল ইয়ামানবাসীর প্রশ্ন। তাই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্তিত্বশীল এ সৃষ্টিজগতের সূচনা সম্পর্কে তাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। সর্বপ্রথম সৃষ্টিকৃত মাখলুক বা সৃষ্টির জাতি-প্রকৃতি ও প্রকারভেদ সম্পর্কে তাদেরকে সংবাদ দেয়া হয়নি। কেননা তারা এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেনি। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আসমান-যমীন সৃষ্টি সম্পর্কে তাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন, তখন তার আরশ পানির উপরই ছিল। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আরশ সৃষ্টি সম্পর্কে খবর দেননি। আসমান-যমীন সৃষ্টির পূর্বেই আরশ সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ছিলেন, তার পূর্বে কিছুই ছিল না’’।
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ مَعَهُ ‘‘তার সাথে কিছুই ছিল না’’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ غيره ‘‘তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ছিল না’’। একই মজলিসে এবং একই বিষয়ে বর্ণিত হাদীছে বিভিন্ন শব্দে এসেছে। এতে বুঝা গেল, তিনি মাত্র একটি শব্দ বলেছেন। আর বাকী শব্দ দু’টি দ্বারা একই অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। قبل শব্দটি নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ হাদীছ ছাড়াও অন্যান্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় বলতেন,
«اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ»
‘‘হে আল্লাহ! তুমি أَوَّل (সর্বপ্রথম)। তোমার পূর্বে কেউ ছিল না। তুমি آخِر (সর্বশেষ), তোমার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তুমি ظَاهِر (সকল সৃষ্টির উপরে), তোমার উপরে আর কিছুই নেই। তুমি بَاطِن (মাখলুকের অতি নিকটে এবং জ্ঞানের মাধ্যমে সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী), তোমার চেয়ে অধিক নিকটে আর কিছুই নেই’’।[5]
উপরের হাদীছে অর্থাৎ ইয়ামানবাসীদের হাদীছে বর্ণিত, معه এবং غيره শব্দ দু’টির কোনো একটি শব্দও অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। এ জন্যই অনেক মুহাদ্দিছ শুধু قبل শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করে থাকেন। যেমন ইমাম হুমাইদী, বগবী এবং ইবনুল আছীর এ রকম বর্ণনা করেছেন। সুতরাং বিষয়টি যখন ঠিক এ রকম, তাই জানা গেল যে ইয়ামান বাসীদের হাদীছে সকল সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে কোনো কথা বলা হয়নি। এমনকি সর্বপ্রথম সৃষ্টি কোন্টি সে ব্যাপারেও কোনো কথা আসেনি। আরো বলা যেতে পারে যে,
«كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ قَبْلَهُ أَوْمَعَهُ أَوْغَيْرَهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كُلَّ شَيْءٍ»
‘‘আল্লাহ ছিলেন, তার পূর্বে আর কিছুই ছিল না অথবা তার সাথে আর কেউ ছিল না অথবা তিনি ব্যতীত আর কেউ ছিল না। তার আরশ ছিল তখন পানির উপর। তিনি লাওহে মাহফুযের মধ্যে সবকিছু লিখে রেখেছেন’’। এখানে واو -এর মাধ্যমে আতফ (যুক্ত) করে এ তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছেন।
ইয়ামান বাসীদের হাদীছে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«وَخَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ» ‘‘অতঃপর তিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন’’। এখানে خلق শব্দের পূর্বে হরফে আতফ واو এবং ثم উভয়টি এসেছে। এ থেকে পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে, ইয়ামান বাসীদেরকে শুধু আসমান-যমীন এবং তার মধ্যকার সৃষ্টিগুলোর সূচনা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়াই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল। আর এগুলোই হলো ছয়দিনে সৃষ্ট মাখলুকসমূহ। এগুলোর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা যা সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। সুতরাং নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সম্পর্কে তাদেরকে সংবাদও দেননি। আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমীনকে এমন শব্দের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন, যাতে বুঝা যায় যে, তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আসমান-যমীন সৃষ্টির পূর্বে যেসব জিনিস ছিল, সেগুলোকে এমন শব্দের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন, যা প্রমাণ করে যে, ঐগুলোও সৃষ্টি হয়েছে এবং অস্তিত্ব লাভ করেছে। কিন্তু আসমান-যমীন সৃষ্টি করার পূর্বে যেসব বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সূচনা কখন হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
ইয়ামান বাসীদের হাদীছ যেহেতু একাধিক শব্দে বর্ণিত হয়েছে, তাই বিনা দলীলে জোর দিয়ে বলা যাবে না যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলে কোন্ শব্দটি বলেছেন? যে ব্যক্তি জোর দিয়ে বলবে যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য অর্থ উদ্দেশ্য করেছেন, অর্থাৎ আসমান-যমীন সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহর কোনো ক্রিয়া বা সৃষ্টি ছিল না, -ইয়ামানবাসীদের জন্য রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ অর্থ বর্ণনা করেছেন, তারা নিশ্চিত ভুলের মধ্যেই রয়েছেন। কুরআন ও সুন্নাহ্য় এমন কোনো দলীল নেই, যা এ কথাকে সাব্যস্ত করে। সুতরাং এ কথা এমনভাবে সাব্যস্ত করা যাবে না, যাতে ধারণা হয় যে, এটিই হাদীছের অর্থ। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:
«كَانَ اللَّهُ وَلَا شَيْءَ مَعَهُ» ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ছিলেন, তার সাথে অন্য কিছুই ছিল না’’ এটি কোনো একক বর্ণনা নয়। বরং তা পূর্বোল্লেখিত বর্ণনার সাথেই বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এমন কোনো ধারণা করার সুযোগ নেই যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আসমান-যমীন সৃষ্টি করার সময় পর্যন্ত কাজশূণ্য ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ,
«كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ قَبْلَهُ أَوْمَعَهُ أَوْغَيْرَهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كُلَّ شَيْءٍ»
‘‘আল্লাহ ছিলেন, তার পূর্বে আর কিছুই ছিল না অথবা তার সাথে আর কেউ ছিল না অথবা তিনি ব্যতীত আর কেউ ছিল না। তার আরশ ছিল তখন পানির উপর। তিনি লাওহে মাহফুযের মধ্যে সবকিছু লিখে রেখেছেন’’, এ হাদীছের অর্থ এটি হওয়া ঠিক নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা একাই ছিলেন এবং তার সাথে কোনো মাখলুকই ছিল না। কেননা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী,
«وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ» ‘‘তার আরশ ছিল তখন পানির উপর’’ এ কথা উপরোক্ত ধারণাকে বাতিল সাব্যস্ত করে। কেননা এ বাক্যটি অর্থাৎ «وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ» অবস্থা জ্ঞাপক বাক্য অথবা জুমলায়ে পূর্বোক্ত বাক্যের সাথে যুক্ত বাক্য। উভয় অবস্থাতেই অর্থ হলো আসমান-যমীন সৃষ্টির পূর্বে আরশ ছিল। সুতরাং জানা গেল যে, হাদীছের উদ্দেশ্য হলো আসমান-যমীন সৃষ্টির পূর্বে বর্তমানের এ দৃশ্যমান সৃষ্টিজগতের কিছুই ছিল না।[6]
জাবরীয়াদের মাযহাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলে, বান্দা কিছুই করে না। ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলাই বান্দাকে দিয়ে করিয়ে থাকেন। এমনকি বান্দার কোনো ইচ্ছা ও স্বাধীনতাও নেই। উভয় দলের কথাই কুরআন, সুন্নাহ এবং বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা প্রত্যাখ্যাত।
[2]. এটি বিদ‘আতীদের আকলী দলীল। শাইখ এখানে সাব্যস্ত করতে চাচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলার যেমন শুরু ও সূচনা নেই তেমনি তার এমন সৃষ্টিও রয়েছে, যার কোনো সূচনা নেই। কেননা তিনি তার কর্মসহ অনাদি-অনন্ত। সুতরাং তার যেমন শুরু নেই, তেমনি তার কাজের বা সৃষ্টিরও শুরু নেই। অর্থাৎ এ কথা বলা যাবে না যে আল্লাহ এক সময় বেকার ছিলেন। পরে কাজ শুরু করেছেন। আরেকটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলতে হয় যে, তার সৃষ্টি করা বিশেষণ ও সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখা তার মতই চিরবিদ্যমান এবং তার পবিত্র সত্তার সাথে সাথেই অনাদিকাল থেকেই বিদ্যমান। তার কোনো সূচনা নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলারও কোনো শুরু ও সূচনা নেই। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান ও অস্তিত্বশীল এ সৃষ্টিগুলোর অবশ্যই একটি সূচনা রয়েছে। এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না। এগুলোর প্রত্যেকটিকে তিনি একই সময় সৃষ্টি করেননি। কুরআন-হাদীছ দ্বারা এ সত্যটি সুসাব্যস্ত। একেকটি একেক সময় সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর আরশ ও কলম প্রথম দিকের সৃষ্টি। কিন্তু তাই বলে এগুলোই যে প্রথম সৃষ্টি তা বলা কঠিন।
শাইখের কথাকে উপরোক্তভাবে ব্যাখ্যা না করলে আল্লাহর সাথে সাথে অনাদি ও সূচনাহীন একাধিক অস্তিত্বশীল বস্তু সাব্যস্ত হয়ে যায়। অথচ কুরআন, হাদীছ, প্রকৃতি ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা একাধিক অনাদি সত্তার অস্তিত্ব অকল্পনীয়।
[3]. ছহীহ বুখারী হা/৭৪১৮।
[4]. ছহীহ: মুসনাদে আহমাদ, ছহীহ বুখারী ৩১৯১, ছহীহ মুসলিম ২৮১৩।
[5] . সহীহ মুসলিম হা/২৭১৩, অধ্যায়: কিতাবুয্ যিক্র ওয়াদ্ দু’আ। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন বলেছেন, الباطن অর্থ হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টির উপরে হওয়ার সাথে সাথে তিনি তাদের অতি নিকটে। মূলতঃ আল্লাহ তাআলার উপরে হওয়া মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়ার বিরোধী নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়াকে আল্লাহর ইলম ও ক্ষমতা তাদের নিকটবর্তী হওয়ার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হলেও মূলতঃ আল্লাহর জন্য কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আল্লাহর সিফাত ও কর্মকে মাখলুকের সিফাত ও কর্ম দ্বারা বুঝা অসম্ভব। কোন সৃষ্টির জন্য একই সময় ছাদের উপরে ও ছাদের নীচে সশরীরে থাকা এবং একই সময় সিংহাসনের উপরে থাকা ও সিংহাসনের নীচে থাকা অসম্ভব। কোন রাজা (মানুষ) যখন তার সিংহাসন ছেড়ে বাইরে যায়, তখন তার সিংহাসন খালি হয়ে থাকে। কারণ তার জন্য একই সময় ও একই সাথে সিংহাসনে থাকা এবং দেশের বাইরে থাকার ধারণা অকল্পনীয়। কিন্তু সুমহান ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তা‘আলার জন্য একই সময় ও একই সাথে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া এবং রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা অসম্ভব কিছু নয়। মাখলুকের নিকটবর্তী হলে আরশ খালি হওয়া জরুরী নয়। যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে, তারা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা দ্বারা আল্লাহর বিশাল সিফাত ও ক্ষমতাকে বুঝতে চেষ্টা করেছে বলেই বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে।
[5]. এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। তা এ যে, কুরআন মাজীদে জান্নাত ও জাহান্নাম বাসীদের জন্য যে চিরস্থায়ী জীবনের কথা বলা হয়েছে, তা কি ‘আল্লাহ তাআলাই সর্বশেষ’ এ কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে যে, কোন সৃষ্টিরই নিজস্ব স্থায়িত্ব নেই। যদি কোন জিনিস স্থায়ী হয় বা স্থায়ী থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা স্থায়ী রাখার কারণেই তা স্থায়ী হয় এবং থাকতে পারে। অন্যথায় আল্লাহ ছাড়া স্ব স্ব ক্ষেত্রে আর সবাই নশ্বর ও ধ্বংসশীল। আখেরাতে আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যে জান্নাত বা দোযখে চিরস্থায়িত্ব লাভ করবে- এমনটি নয়। বরং সেখানে তার স্থায়িত্ব লাভ করার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা তাকে চিরস্থায়ী জীবন দান করবেন। ফেরেশতাদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। তারা আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যে অবিনশ্বর নয়। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেছেন তখন তারা অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং যত সময় পর্যন্ত তিনি চাইবেন তত সময় পর্যন্তই তারা বেঁচে থাকবে। পরিশেষে ফেরেশতারাও ধ্বংস হবে।
কিন্তু জান্নাতবাসীগণ জান্নাতের নেয়ামতসমূহে এবং জাহান্নামী কাফেররা জাহান্নামের আযাবে চিরকাল থাকার বিষয়টি কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল দ্বারা প্রমাণিত।
[6]. উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহ হলো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অস্তিত্বের পূর্বে আর কোনো জিনিসের অস্তিত্ব ছিল না। আল্লাহর অস্তিত্ব শুরু ও সূচনাহীন অস্তিত্ব। তার অস্তিত্বের কোনো শুরু নেই, তার শেষও নেই। বাকীসব সৃষ্টির সূচনা ও শুরু রয়েছে। তার পরিসমাপ্তিও রয়েছে। আল্লাহর দ্বারা সকল সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করেছে। ভবিষ্যতে যা সৃষ্টি হবে, তাও আল্লাহর দ্বারাই সৃষ্টি হবে এবং দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আখেরাত দিবসের পর যা টিকে থাকবে, তাও আল্লাহ তাআলা টিকিয়ে রাখবেন বলেই উহা টিকে থাকবে। কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই এবং তিনি ছাড়া কোনো সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখারও কেউ নেই। সৃষ্টিগত স্বভাব-প্রকৃতি এবং বিবেক-বুদ্ধির দলীলের নিকট এটিই সুস্পষ্ট। ইয়ামানবাসীদের উপরোক্ত হাদীছে সর্বপ্রথম সৃষ্টি কোন্টি এ সম্পর্কে কোনো কথা বলা হয়নি; বরং এখানে শুধু এটি সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলার পূর্বে আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তার সাথে সাথে এমন অনাদি সৃষ্টি থাকা কিংবা এমন সৃষ্টি থাকা, যার কোনো শুরু নেই, -এ কথাকে নাকচ করা হয়নি। কারণ সৃষ্টি করা, ক্রিয়াশীল থাকা আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম সিফাত। আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত সিফাতই কামেল বা পরিপূর্ণ। তাতে কোনো ত্রুটি ও দোষ নেই। সুতরাং সৃষ্টি করা যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণগুণের অন্তর্ভুক্ত, তাই অতীতের, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবসময়ই এ সিফাতের প্রভাব জারি থাকাই তার পূর্ণতার প্রমাণ। অতীতের কোনো সময় কাজ ও ক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকার ধারণা তার কামালিয়াতের মধ্যে ত্রুটি থাকার ধারণা করারই নামান্তর। যেমনটি ধারণা করে জাহমীয়া সম্প্রদায়ের বিদ‘আতীরা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেমন কাদীম বা অনাদি, তার সমস্ত সিফাতও তেমন অনাদি ও কাদীম। তার সৃষ্টি করা ও সৃষ্টি করতে থাকা সিফাতটিও কাদীম এবং অনাদি। সে হিসাবে আল্লাহর সৃষ্টি করা সিফাতের প্রভাব হিসাবে তার সাথে সাথে কাদীম ও সূচনাহীন সৃষ্টি থাকার বিশ্বাস করা তাওহীদের খেলাফ নয়। কারণ সব সৃষ্টিই আল্লাহ তা‘আলার দ্বারা অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাওহীদের পরিপন্থী হবে কেবল তখনই, যখন বিশ্বাস করা হবে, আল্লাহর পূর্বে অন্য কেউ ছিল কিংবা আল্লাহর সাথে সাথে এমন অনাদি ও কাদীম সৃষ্টি রয়েছে, যা আল্লাহ তা‘আলার দ্বারা সৃষ্টি হয়নি কিংবা উহা আল্লাহর সৃষ্টি করা সিফাতের প্রভাব নয়; বরং স্বতন্ত্রভাবেই উহা অস্তিত্ব লাভ করেছে। (আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)