লগইন করুন
যাকির ও আল্লাহর পথের পথিককে অবশ্যই ফজরের সালাত ও অন্যান্য সকল সালাত জামাতে আদায় করতে হবে। অনেক যাকির ফজরের সালাত একাকী ঘরে আদায় করেন। এরপর অনেক সময় যিকর ওযীফা করেন। অথচ সারা দিনরাত নফল যিকর ওযীফা করার চেয়ে শুধুমাত্র ফরয সালাতগুলি জামাতে আদায় করা হাজার গুণ বেশি উত্তম। অন্য নফল যিকর্ তো দূরের কথা মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় যিকর ও বড় নফল ইবাদত তাহাজ্জুদের চেয়েও জামাতে সালাত আদায় করা বেশি ফযীলতের। উমার (রাঃ) একদিন সুলাইমান ইবনু আবী হাসমা নামাক একজন সাহাবীকে ফজরের জামাতে উপস্থিত না দেখে তার বাড়িতে যেয়ে তার আম্মাকে তার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলেন রাত জেগে তাহাজ্জুদের সালাত পড়ে সে কলান্ত হয়ে যায়। এজন্য ফজরের সালাত ঘরে আদায় করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। উমার (রাঃ) বলেনঃ
لأن أشهد صلاة الصبح في جماعة أحب إلي من أن أقوم
“সারারাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায় করার চেয়ে ফজরের সালাত জামাতে আদায় করাকে আমি বেশি ভালবাসি ও ভালো বলে মনে করি।”[1]
প্রিয় পাঠক, নিয়মিত জামাতে সালাত আদায় করতে পারা মুমিনের অন্যতম কারামত। আওলিয়ায়ে কেরাম জামাতে সালাত আদায়কে বেলায়েতের পরিচয় বলে মনে করেছেন। তাঁরা বার বার বলেছেনঃ ‘যদি কাউকে পানির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে বা বাতাসে উড়ে যেতে দেখ, তাহলে তাকে ওলী ভেব না, কিন্তু যদি কাউকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ঠিকমতো জামাতে আদায় করতে দেখ তাহলে তাঁকে ওলী জানবে।’ কারণ বাতাসে উড়তে, পানিতে হাঁটতে, মনের কথা বলতে ঈমান বা বেলায়েতের দরকার হয় না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, কাফির, মুশরিক সকলের মধ্যেই এরূপ মানুষ পাওয়া যায়। যা মুসলিম ও কাফির সবার মধ্যে পাওয়া যায় তা কখনো বেলায়েতের আলামত হতে পারে না। অপরপক্ষে যে ব্যক্তি সুন্নাতের অনুসরণ করার তাওফীক পেয়েছে তাঁকে ওলী জানতে হবে। তার সবচেয়ে বড় কারামত এই যে, তাঁর অন্তর ও প্রবৃত্তি সুন্নাতের অনুসারী হয়ে গিয়েছে।
সকল ফরয সালাত মসজিদে জামা’আতে আদায় করা ওয়াজিব। “বিদাইয়া ওয়ান নিহাইয়া” ও হানাফী মাযহাবের অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে জামাতে সালাতকে ওয়াজিবই লিখা হয়েছে। পরবর্তী কোনো কোনো গ্রন্থে সুন্নাত লিখা হলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা ওয়াজিবের পর্যায়ের। আবার সুন্নাতের বিষয়েও আমাদের ধারণা বড় অদ্ভুত। ফিকহের হিসাবে অনেক কাজই সুন্নাত। কিন্তু কোন্ সুন্নাতের কতটুকু গুরুত্ব তা হাদীসের আলোকে জানতে হবে। টুপি মাথায় দেওয়া একটি সুন্নাত, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে আগে ও পরে কিছু সালাত সুন্নাত, আবার জামাতে সালাতও সুন্নাত। কিন্তু সব সুন্নাত একই গুরুত্বের নয়। দেখতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোন্ সুন্নাতকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন। ততটুকু গুরুত্ব দিয়েই তা পালন করতে হবে। গুরুত্বের ক্ষেত্রে তাঁর রীতির ব্যতিক্রম করার অর্থ তাঁর সুন্নাতকে অবহেলা করা ও নিজের মনগড়া মতে চলা।
টুপি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ পরেছেন তাই সুন্নাত। কিন্তু তিনি তা পরার কোনো নির্দেশ দেননি। আবার সুন্নাতে মুআক্কাদা সালাতগুলি তিনি পড়েছেন এবং পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু না পড়লে কোনো ধমক বা শাস্তির কথা বলেননি। আর জামা’আতে সালাত তিনি আজীবন পালন করেছেন, পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং পালন না করলে কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন। অথচ আমাদের যাকিরীনদের মধ্যে অনেকে টুপির সুন্নাত বা অন্যান্য অনেক মুস্তাহাব, সুন্নাতে যায়েদা বাধ্য না হলে ত্যগ করেন না বা করতে চান না, সুন্নাতে মুআক্কাদা সালাত ত্যাগ করেন না, অথচ অকাতরে জামাত ত্যাগ করেন। মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের প্রবৃত্তি ও মনকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সু্ন্নাতের অনুগত ও অনুসারী করে দেন।
অগণিত সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এবং সাহাবীগণ কখনোই কঠিন ওযর ছাড়া জামা’আত ত্যাগ করেননি। জামা’আতে অনুপস্থিত থাকাকে তাঁরা নিশ্চিত মুনাফিকের পরিচয় বলে জানতেন। অনেক সময় অন্ধ ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে বলেছেনঃ “আমাকে মসজিদে নিয়ে আসার মতো কোনো মানুষ নেই আর পথও খারাপ। আমি কি জামাতে না এসে ঘরে সালাত আদায় করে নিতে পারব ?” তিনি (নবী) অন্ধকেও জামা’আত ত্যাগের অনুমতি দেননি। বলেছেনঃ “আযান শুনলে হামাগুড়ি দিয়ে বা বুকে ছেচড়ে হলেও মসজিদে এসে তোমাকে জামাতে সালাত পড়তে হবে।” যারা জামাতে সালাতে শরীক হয় না, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি।
সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে জামাতে সালাতে শরীক না হয়ে ফরয সালাত ঘরে আদায় করাকে স্পষ্ট গোমরাহী বলে জানতেন। এ বিষয়ে বহুসংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من سمع النداء فلم يجب فلا صلاة له إلا من عذر
“যে ব্যক্তি সালাতের আহবান (আযান) শুনতে পেল কিন্তু আহবানে সাড়া দিয়ে জামাতে এলো না, তার সালাতই হবে না। তবে যদি ওযর থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।”[2]
অন্য হাদীসে ইরশাদ করা হয়েছেঃ
مَنْ سَمِعَ الْمُنَادِيَ فَلَمْ يَمْنَعْهُ مِنَ اتِّبَاعِهِ عُذْرٌ، قَالُوا وَمَا الْعُذْرُ؟ قَالَ خَوْفٌ أَوْ مَرَضٌ لَمْ تُقْبَلْ مِنْهُ الصَّلَاةُ الَّتِي صَلَّى
“যে ব্যক্তি ওযর ছাড়া আযান শুনেও সালাতের জামাতে এলো না, সে একা যে সালাত আদায় করল সেই সালাত কবুল হবে না। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেনঃ ওযর কি? তিনি বলেন: ভয় বা অসুস্থতা।”[3]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ বলেছেন :
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَلْقَى اللَّهَ غَدًا مُسْلِمًا فَلْيُحَافِظْ عَلَى هَؤُلَاءِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنَّ ، فَإِنَّ اللَّهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُنَنَ الْهُدَى ، وَإِنَّهُنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدَى ، وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّي هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِي بَيْتِهِ لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ ، وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ ، وَمَا مِنْ رَجُلٍ يَتَطَهَّرُ فَيُحْسِنُ الطُّهُورَ ، ثُمَّ يَعْمِدُ إِلَى مَسْجِدٍ مِنْ هَذِهِ الْمَسَاجِدِ إِلَّا كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ يَخْطُوهَا حَسَنَةً ، وَيَرْفَعُهُ بِهَا دَرَجَةً ، وَيَحُطُّ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً ، وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلَّا مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ ، وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِي الصَّفِّ
“যার ভালো লাগে যে, সে আগামীকাল মুসলমান হিসাবে আল্লাহ্র সাথে দেখা করবে, সে যেন এই সালাতগুলিকে যে মসজিদে আযান দেওয়া হয় সেখানে নিয়মিত জামাতে আদায় করে। কারণ আল্লাহ তোমাদের নবীর জন্য হেদায়েতের সুন্নাত প্রচলন করেছেন। আর এসকল হেদায়েতের সুন্নাতের মধ্যে অন্যতম সালাতগুলিকে মসজিদে জামাতে আদায় করা। তোমরা যদি বাড়িতে সালাত পড় তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর (সা.) সুন্নাত ছেড়ে দেবে। আর তোমাদের নবীর সুন্নাত ছেড়ে দিলে তোমরা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। ... আমাদের সময়ে আমরা দেখেছি একমাত্র সুপরিচিত মুনাফিক যাকে সবাই মুনাফিক বলে চিনত এরাই শুধু জামাতে সালাতে হাজির হতো না। অসুস্থ মানুষও দু’জন মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে এসে জামাতে শরীক হয়ে কাতারে দাঁড়িয়ে যেত।”[4]
জামাতে সালাত ত্যাগ করা যেমন ভয়ঙ্কর অপরাধ ও গোনাহের কাজ, তেমনি জামাতে সালাত আদায় অপরিমেয় সাওয়াব ও বরকতের কাজ। জামাতে সালাত আদায় করলে আল্লাহ ২৭ গুণ বেশি সাওয়াব দান করবেন, যারা সর্বদা জামাতে সালাত আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে মন দিয়ে রাখেন তাঁদেরকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন আল্লাহর প্রিয়তম বান্দাদের সাথে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন, জামাতের অপেক্ষা করা জিহাদের সমতুল্য, ইত্যাদি বিভিন্ন মর্যাদার কথা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الْأُولَى كُتِبَتْ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنْ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنْ النِّفَاقِ
“যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন ইমামের সাথে প্রথম তাকবীরসহ পরিপূর্ণ সালাত জামাতে আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহ দুটি মুক্তি লিখে দিবেনঃ (১). জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও (২). মুনাফিকী থেকে মুক্তি।”[5]
ফজরের সালাতের জামা’আতের অতিরিক্ত গুরুত্ব ও ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের সালাত ফজর ও ইশা’র জামা’আত।”[6]
মুনাফিক ও দুর্বল ঈমান মুসলমানদের জাগতিক লাভ অর্জনে আগ্রহ ও আল্লাহর রহমত, সাওয়াব ও আখেরাতের লাভ অর্জনে নিঃস্পৃহতার একটি চমৎকার উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেনঃ “তারা যদি জানত যে, জামাতে সালাতে হাজির হলে একটি ভালো মাংসওয়ালা হাড় পাওয়া যাবে, তাহলে তারা হাজির হয়ে যাবে।”[7] আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, “আমরা যদি কাউকে ফজর ও ইশা’র জামাতে না দেখতে পেতাম তাহলে তার বিষয়ে ধারণা খারাপ করে ফেলতাম।”[8]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :
لَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا
“ফজর ও ইশা’র সালাত জামাতে আদায় করলে কত ফযীলত তা যদি তারা বুঝত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা এই দুই সালাতে উপস্থিত হতো।”[9]
তিনি বলেছেনঃ
من صلى الصبح في جماعة فهو في ذمة الله
“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করবে, সে আল্লাহর জিম্মাদারীর মধ্যে প্রবেশ করবে।”[10]
অন্য হাদীসে তিনি বলেন :
مَنْ صَلَّى الْعِشَاءَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا قَامَ نِصْفَ اللَّيْلِ وَمَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فِي جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا صَلَّى اللَّيْلَ كُلَّهُ
“যে ব্যক্তি ইশা’র সালাত জামাতে আদায় করবে সে যেন অর্ধেক রাত্র (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের সালাতও জামাতে আদায় করবে সে ব্যক্তি যেন সারা রাত (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করল (অর্থাৎ, যে ব্যক্তি ইশা ও ফজর জামাতে আদায় করবে, সে সারা রাত তাহাজ্জুদ আদায়ের সাওয়াব পাবে)।”[11]
[2] সহীহ ইবনু হিব্বান ৫/৪১৫, ৪৫০, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৭২, ৩৭৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৪২, সহীহুত তারগীব ১/২৪০।
[3] সুনানে আবু দাউদ ১/১৫১, নং ৫৫১, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৭৩।
[4] সহীহ মুসলিম ১/৪৫৩, নং ৬৫৪।
[5] সুনানুত তিরমিযী ২/৭, নং ২৪১, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/১২৮, সহীহুত তারগীব ১/২৩৭।
[6] সহীহ মুসলিম ১/৪৫১, নং ৬৫১।
[7] সহীহ মুসলিম ১/৪৫১, নং ৬৫১।
[8] সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ২/৩৭০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫/৪৫৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৩০, মু’জামুল কাবীর, তাবারানী ১২/২৭১, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৪০, সহীহুত তারগীব ১/২৪১।
[9] সহীহ মুসলিম ১/৪৫১, নং ৬৫০।
[10] মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৪১, সহীহুত তারগীব ১/২৪২।
[11] সহীহ মুসলিম ১/৪৫৪, নং ৬৫৬। দেখুনঃ সহীহুত তারগীব ১/২৪০।