লগইন করুন
প্রিয় পাঠক, কুরআন শিক্ষার এই মহান মর্যাদা ও সাওয়াব যদি আমরা পেতে চাই তাহলে আমাদেরকে প্রথমে এই কুরআনের মর্যাদা হৃদয়পটে আঁকতে হবে। আমরা যদি উপরের হাদীসগুলিকে সত্যিকারের ঈমান নিয়ে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সত্যিকার অর্থে আল-আমীন, আস-সাদেক, মহাসত্যবাদী হিসাবে অবচেতন মনের গভীরে সুদৃঢ় বিশ্বাসে মেনে নিয়ে তাঁর উপর্যুক্ত বাণীগুলিকে হৃদয়ের পটে এঁকে রাখতে পারি তাহলেই আমরা পরবর্তী নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নিতে পারব।
প্রথম পদক্ষেপ : প্রথম পদক্ষেপ বিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করা। আমাদের দেশের হাজার হাজার ধার্মিক নেককার মানুষ আছেন যারা জীবনের মধ্যপ্রান্তে বা শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন দরবার, বুজুর্গ, ইসলামী দল বা গ্রুপের সাথে সংযুক্ত আছেন। হয়ত তারা নিজেদেরকে যাকির মনে করেন। কিন্তু তারা কুরআনের একটি সূরাও বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে পারেন না। তারা দেখে কুরআন পড়তেও পারেন না। কি দুর্ভাগ্য আমাদের !!
আমরা প্রতিদিন, প্রতিমাসে ও প্রতি বছর শত শত ঘণ্টা সময় গল্প গুজব করে, খবর পড়ে শুনে বা আলোচনা করে, গীবত ও পরচর্চা করে, খেলাধুলা করে বা দেখে নষ্ট করি। কিন্তু কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করার সময় পাই না। বিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিখতে বড়জোর ২/৩ মাস নিয়মিত প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক ব্যয় করলেই সম্ভব। আমরা অনেকে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় অনেক সময় সুন্নাত-সম্মত বা খেলাফে সুন্নাত যিকর আযকার করে কাটাই। অথচ এ সকল যিকরের চেয়ে বড় যিকর মুমিনের জীবনের অন্যতম নূর কুরআন করীম তিলাওয়াত শিক্ষা করি না। আল্লাহর কালামের প্রতি এই চরম অবহেলা করছেন আল্লাহর যাকিরগণ! আল্লাহ দয়া করে আমাদেরকে আহলে কুরআন হওয়ার তাওফীক দান করেন ; আমীন।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ : কুরআন বুঝার মতো আরবী ভাষা শেখা। আমি অনেক নও মুসলিমকে দেখেছি তাঁরা ইসলাম গ্রহণের পরে অতি আগ্রহের সাথে শত ব্যস্ততার মধ্যেও বিভিন্ন বই পুস্তক বা কোর্সের মাধ্যমে আরবী শিক্ষা করেন এবং কিছু সময়ের মধ্যেই কুরআন বুঝার মতো চলনসই আরবী শিখে ফেলেন। আসলে বিষয়টি ভালবাসা ও গুরুত্ব প্রদানের উপর নির্ভর করে।
তৃতীয় পদক্ষেপ : আরবী ভাষা শিক্ষা করা সম্ভব না হলে অন্তত কুরআন কারীমের এক বা একাধিক অনুবাদ গ্রন্থ বা বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষায় তাফসীর গ্রন্থ সংগ্রহ করে নিয়মিত তিলাওয়াতের সাথে সাথে নিয়মিত অর্থ পাঠ করা। এভাবে আমরা অন্তত মূল না বুঝলেও অনুবাদের মাধ্যমে কুরআনের আলোয় নিজেদের আলোকিত করতে পারব। হয়ত আমরা এভাবে কুরআনের সাথী আল্লাহর পরিজন হয়ে যেতে পারব। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক প্রদান করুন। আমি এমন অনেক ভাইকে চিনি যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বা অতি অল্প শিক্ষিত। আরবী মোটেও জানেন না। কিন্তু নিয়মিত কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর পাঠের ফলে তাদের অবস্থা এরূপ হয়েছে যে, কুরআন কারীমের যে কোনো স্থান থেকে তিলাওয়াত করলে তার অর্থ অনুধাবন করতে পারেন। শাব্দিক অর্থ বুঝেন না, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেই আয়াতগুলিতে কি বলা হয়েছে তা বুঝতে পারেন।
বিশেষ সাবধানতা : আমরা সাধারণত আল্লাহর কিতাবের জন্য এত পরিশ্রম! করার সময় পাই না। এত আগ্রহও আমাদের নেই। কিন্তু যদি কেউ সেই তাওফীক পান, তবে শয়তান অন্য পথে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেষ্টা করে। শয়তান তার মধ্যে অহঙ্কার প্রবেশ করায়। তিনি মনে করতে থাকেন যে, তিনি একজন প্রাজ্ঞ মানুষ, তিনি সমাজের অন্য অনেকের চেয়ে ইসলাম ভাল জানেন, সমাজের আলিমগণ কুরআন বুঝেন না, আলিমরাই ইসলাম নষ্ট করলেন, ইত্যাদি।
পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব যে, সকল প্রকারের অহঙ্কারই কঠিন পাপ ও ধ্বংসের কারণ। সবচেয়ে খারাপ অহঙ্কার জ্ঞান বা ধার্মিকতার অহঙ্কার। বস্তুত মুমিন কুরআন পাঠ করেন ও অন্যান্য ইবাদত বনেদগি পালন করেন একান্তই নিজের জন্য। কুরআন পাঠ করে মুমিন আল্লাহর রহমত ও পুরস্কার আশা করেন। মুমিন কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেন নিজের ভুলত্রুটি সংশোধন করে নিজের জীবনকে পরিচালিত করার জন্য। অহঙ্কারের উৎপত্তি হয় অন্যের দিকে তাকানোর কারণে। মুমিন কখনোই অন্যের ভুল ধরার জন্য বা অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করার জন্য ইবাদত করেন না। যখনই মনে হবে যে, আমি একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষ হয়ে কুরআন পড়ি, কয়েকখানা তাফসীর পড়েছি, অথচ অমুক আলিম বা তমুক ব্যক্তি তা পড়েনি, অথবা সমাজের আলিমগণ কুরআন পড়ে না... ইত্যাদি তখনই বুঝতে হবে যে, শয়তান মুমিনের এত কষ্টের উপার্জন ধ্বংস করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। বাঁচতে হলে সতর্ক হতে হবে। অন্য মানুষদের ভুলভ্রান্তি চিন্তা করা অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। সর্বদা আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে হবে যে, আল্লাহ যেন কুরআন তিলাওয়াত, চর্চা ও পালনের ইবাদত কবুল করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই নিয়ামত বহাল রাখেন।
অহঙ্কারের আরেকটি প্রকাশ যে, আল্লাহর তাওফীকে কিছুদিন কুরআন চর্চার পরে নিজেকে বড় আলিম মনে করা এবং বিভিন্ন শরয়ী মাসআলা বা ফাতওয়া প্রদান করতে থাকা। কুরআন চর্চাকে নিজের আখেরাত গড়া ও আল্লাহর দরবারে অগ্রসর হওয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে। নিজের জীবন সে অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। ফাতওয়ার দায়িত্ব আলিমদের উপর ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রত্যেক মুসলিমই কুরআন পড়বেন, শিখবেন ও চর্চা করবেন নিজের জন্য। তবে প্রত্যেক মুসলিমই বিশেষজ্ঞ আলিম হবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে চিরশত্রু শয়তানের ধোঁকা থেকে রক্ষা করুন।
(গ) কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত
কুরআনী যিকরের সর্বপ্রথম কাজ তিলাওয়াত। আল্লাহর মহান বাণী তিলাওয়াত করার চেয়ে বড় যিকর বা মহান কর্ম আর কিছুই হতে পারে না। তিলাওয়াত বলতে মূলত কুরআন ও হাদীস বুঝে ও হৃদয় দিয়ে তিলাওয়াত করা বুঝান হয়েছে। তবে আমরা আশা করব, অপারগতার কারণে আমরা না বুঝে তিলাওয়াত করলেও আল্লাহ দয়া করে আমাদেরকে এ সকল সাওয়াব ও পুরস্কার প্রদান করবেন। বিশেষত যদি আমরা তিলাওয়াতের পাশাপাশি অনুবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ বুঝার চেষ্টা করতে থাকি।
কুরআনের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, কুরআন তিলাওয়াত অর্থ বুঝে এবং হৃদয়কে অর্থের সাথে একাত্ম করে দিয়ে তিলাওয়াত করা। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا
“যখন তাঁদের (মুমিনদের) নিকট আল্লাহর (কুরআনের) আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয়, তখন তাঁদের ঈমান বৃদ্ধি পায়।”[1] আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি যে, আয়াতের অর্থ যদি হৃদয়কে আলোড়িত না করতে পারে তাহলে ঈমান বৃদ্ধি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ
“আল্লাহ্ সর্বোত্তম বাণীকে সুসমঞ্জস এবং বারংবার আবৃত্তিকৃত গ্রন্থ হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন। যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে এই গ্রন্থ থেকে (এই গ্রন্থ পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে) তাদের শরীর রোমাঞ্চিত ও শিহরিত হয়। অতঃপর তাদের দেহ ও মন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর যিকরের প্রতি ঝুকে পড়ে।”[2]
কুরআনের অর্থ হৃদয়ে প্রবেশ করে হৃদয়কে নাড়া না দিলে শরীর কিভাবে শিহরিত হবে? মন কিভাবে প্রশান্ত হবে? তিলাওয়াতের সাথে সাথে অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব। এখানে প্রথমে তিলাওয়াতের ফযীলত বিষয়ক কিছু হাদীস উল্লেখ করছি।
(১) ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি বর্ণ পাঠ করবে সে একটি পুণ্য বা নেকী অর্জন করবে। পুণ্য বা নেকীকে দশগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে। আমি বলছি না যে, (আলিফ-লাম-মিম) একটি বর্ণ। বরং ‘আলিফ’ একটি বর্ণ, ‘লাম’ একটি বর্ণ ও ‘মীম’ একটি বর্ণ।” হাদীসটি সহীহ।[3]
(২) আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
الماهر بالقرآن مع السفرة الكرام البررة والذي يقرأ القرآن ويتتعتع فيه وهو عليه شاق له أجران
“যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াতে সুপারদর্শী সে সম্মানিত ফিরিশতাগণের সঙ্গে। আর কুরআন তিলাওয়াত করতে যার জিহ্বা জড়িয়ে যায়, উচ্চারণে কষ্ট হয়, কিন্তু কষ্ট করে অপারগতা সত্ত্বেও সে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার।”[4]
(৩) অন্য হাদীসে আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ وَهُوَ حَافِظٌ لَهُ مَعَ السَّفَرَةِ الكِرَامِ البَرَرَةِ وَمَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ وَهُوَ يَتَعَاهَدُهُ وَهُوَ عَلَيْهِ شَدِيدٌ فَلَهُ أَجْرَانِ
“যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করে তা তিলাওয়াত করেন তিনি নেককার সম্মানিত ফিরিশতাগণের সঙ্গে। আর যিনি বারবার কুরআন তিলাওয়াত করে তা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন এবং তার জন্য খুব কষ্টকর হচ্ছে, তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে।”[5]
(৪) আবু উমামা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি,
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ ، فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ
“তোমরা কুরআন পাঠ করবে; কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার সঙ্গীদের (কুরআন পাঠকারীগণের) জন্য শাফা’আত করবে।”[6]
(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة يقول الصيام رب منعته الطعام والشرب بالنهار فشفعني فيه ويقول القرآن رب منعته النوم بالليل فشفعني فيه فيشفعان
“সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য শাফা’আত করবে। সিয়াম বলবে, হে প্রভু, আমি একে দিনের বেলায় খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফা’আত কবুল করুন। কুরআন বলবে, হে প্রভু, আমি রাতের বেলায় তাকে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফা’আত কবুল করুন। তখন তাদের উভয়ের শাফা’আত কবুল করা হবে।”[7]
(৬) মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন :
وَاذْكُر رَّبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ الْغَافِلِينَ
“সকালে ও বিকালে তোমার মনের মধ্যে বিনয়, আকুতি ও ভয়ভীতির সাথে অনুচ্চ শব্দে আল্লাহর যিকর কর এবং গাফিল বা অমনোযোগীদের অন্তভর্ক্তু হবে না।”[8]
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহর যিকর না করলে সে অমনোযোগী এবং অমনোযোগী হওয়া নিষিদ্ধ। রাত্রে অন্তত কুরআনের ১০০ টি আয়াত তিলাওয়াত করলে বা তাহাজ্জুদের সালাতে তিলাওয়াত করলে বান্দা আল্লাহর দরবারে যাকির হিসাবে গণ্য হবে এবং অমনোযোগী হওয়ার অপরাধ থেকে মুক্তি পাবে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من صلى في ليلة بمائة آية لم يكتب من الغافلين، ومن صلى في ليلة بمائتى آية فإنه يكتب من القانتين المخلصين
“যে ব্যক্তি রাত্রের (তাহাজ্জুদের) সালাতে ১০০ আয়াত পাঠ করবে তাঁকে গাফিল বা অমনোযোগীদের তালিকায় লেখা হবে না। আর যে ব্যক্তি রাত্রের (তাহাজ্জুদের) সালাতে ২০০ আয়াত পাঠ করবে তাঁকে আল্লাহর খাঁটি, মুখলিস নেককার বান্দা হিসাবে লেখা হবে।” হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।[9]
অন্য হাদীস থেকে জানা যায় যে, অন্তত দশটি আয়াত তিলাওয়াত করলে বা তাহাজ্জুদের সালাতে দশটি আয়াত পাঠ করলেও বান্দা অমনোযোগী হওয়ার অপরাধ থেকে মুক্তি পাবে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من قرأ عشر ايات في ليلة لم يكتب من الغافلين
“যে ব্যক্তি রাত্রে দশটি আয়াত পাঠ করবে তাকে গাফিল বা অমনোযোগীদের দলভুক্ত হিসাবে লেখা হবে না।” হাদীসটি সহীহ।[10]
(৭) আব্দল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فَقَدِ اسْتَدْرَجَ النُّبُوَّةَ بَيْنَ جَنْبَيْهِ غَيْرَ أَنَّهُ لا يُوحى إِلَيْهِ، لا يَنْبَغي لِصاحِبِ الْقُرْآنِ أَنْ يَجِدَّ مَعَ مَنْ جَدّ وَلا يَجْهَلَ مَعَ مَنْ جَهِلَ وَفي جَوْفِهِ كلامُ الله
“যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করল সে ধাপেধাপে নবুয়তের সিঁড়ি বেয়ে নিজের দেহের মধ্যে নবুয়ত গ্রহণ করল। পার্থক্য এই যে তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করা হবে না। (অর্থাৎ সে ওহী পেল না, তবে ওহীর ও নবুয়তের জ্ঞান সে গ্রহণ করল)। কুরআনের অধিকারী বা কুরআনের সঙ্গীর জন্য উচিত নয় যে, নিজের মধ্যে আল্লাহর কালাম থাকা অবস্থায় সে অন্যান্য মানুষদের মতো আবেগ তাড়িত হবে, অথবা কেউ রাগ করলে বা উত্তেজিত হলে সেও রাগ করবে বা উত্তেজিত হবে।”[11]
স্বভাবতই এসকল হাদীসে কুরআন পাঠ করা বলতে বুঝে ও অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে পড়া বুঝানো হয়েছে। তোতাপাখিকে তো আর আলিম বলা যায় না। যিনি অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে কুরআন পাঠ করেন তিনিই তার হৃদয়ে নবুয়তের ইলম ধারণ করেন।
(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ : اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ ، كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدُّنْيَا ، فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا
“কিয়ামতের দিন কুরআনের সাথীকে (কুরাআনের মানুষকে) বলা হবে, তুমি দুনিয়াতে যেভাবে সুন্দর তারতীলের সাথে কুরআন পাঠ করতে সেভাবে পাঠ করতে থাক এবং উপরে উঠতে থাক। তোমার পড়া যে আয়াতে শেষ হবে সেখানে তোমার আবাসস্থাল হবে।” সহীহ।[12] অর্থাৎ, জান্নাতের উঁচু মর্যাদার উপরে উঠার ধাপ হবে কুরআন করীমের আয়াতের সংখ্যা অনুসারে। যে ব্যক্তি যত আয়াত পাঠ করতে পারবেন তিনি তত উপরে উঠে উচ্চ মর্যাদায় নিজেকে আসীন করবেন।
বিশুদ্ধ তিলাওয়াত অপরিহার্য
অপরদিকে কুরআন তিলাওয়াতের অর্থ আরবী ভাষা ও আরবী রীতি অনুযায়ী বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাত অনুসারে ধীরে ধীরে, পরিপূর্ণ ভক্তি ও ভালবাসা সহকারে পাঠ করা।
আমাদের দেশে সাধারণ ধার্মিক মুসলিম ছাড়াও অনেক আলিম, ইমাম, ক্বারীও বাংলায় বা ‘বাংরবি’ ভাষায় কুরআন তিলাওয়াত করেন। ‘হামি টুমাকে ওয়ালোওয়াছি’ - কথাটির সকল শব্দ মূলত বাংলা হলেও একে আমরা বাংলা বলতে পারি না। হয়ত ‘ইংলা’ বা ‘বাংলিশ’ বলা যেতে পারে। তেমনি বাংলা উচ্চারণ পদ্ধতিতে আরবী কুরআন তিলাওয়াত করলেও তা কখনই আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করা হবে না।
আরবী ভাষায় প্রতিটি বর্ণের নির্দিষ্ট উচ্চারণ স্থল, উচ্চারণ পদ্ধতি, সিফাত বা গুণাবলী, মদ বা দীর্ঘতা ও অন্যান্য উচ্চারণ বিষয়ক নিয়মাবলী রয়েছে। মহান আল্লাহ কুরআন কারীমকে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল করেছেন। আরবী ভাষার রীতি অনুসারে না পড়লে কখনই কুরআন তিলাওয়াত করা হবে না। এ বিষয়ে সাধারণ মুসলিম তো দূরের কথা অধিকাংশ মাদ্রাসাতেও অমার্জনীয় অবহেলা বিরাজমান। সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের যুগে লক্ষ লক্ষ অনারব ইসলামের ছায়াতলে আসেন। তারা কুরআনের বিশুদ্ধ আরবী উচ্চারণের বিষয়ে কিরূপ গুরুত্ব আরোপ করতেন ও উচ্চারণের সামান্যতম বিচ্যুতিকে কিভাবে কঠিন গোনাহ ও ভয়ঙ্কর বেয়াদবী বলে মনে করতেন সে বিষয়ে অনেক বিবরণ আমরা হাদীসের গ্রন্থসমূহে পাই।[13]
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিলাওয়াত পদ্ধতি
বিশুদ্ধ আরবী উচ্চারণের পাশাপাশি কুরআন কারীমকে শান্তভাবে, ধীরে, স্পষ্টকরে ও টেনে টেনে পড়তে হবে। এটি আল্লাহর নির্দেশিত ফরয। এ বিষয়ে আমাদের অপরাধ বড় কঠিন। অধিকাংশ হাফিজই দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করেন। তারাবীহের সালাতে যদি কোনো হাফিজ একটু ধীরে তিলাওয়াত করেন তাহলে মুসল্লীগণ ঘোর আপত্তি শুরু করেন। বাধ্য হয়ে হাফিজ সাহেব এমনভাবে কুরআন তিলাওয়াত করেন যাতে তিলাওয়াতকারী ও শ্রোতা প্রথম ও শেষের কয়েকটি শব্দ ছাড়া কিছুই বুঝতে পারেন না বা শুনতেও পারেন না। কাজেই, সাওয়াব তো দূরের কথা কুরআনের সাথে বেয়াদবীর অপরাধ কঠিন হয়ে পড়ে।
মহান আল্লাহ কুরআন করীমে ইরশাদ করেছেনঃ
وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
“এবং আপনি ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে কুরআন আবৃত্তি করুন।”[14]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, মুজাহিদ, আতা, হাসান বাসরী, কাতাদাহ ও অন্যান্য সকল সাহাবী ও তাবেয়ী মুফাসসির বলেছেন যে, তারতীল অর্থ কুরআনকে ধীরে ধীরে, শান্তভাবে, স্পষ্ট করে ও টেনে টেনে পড়া, যেন তা বুঝা ও তার অর্থ চিন্তা করা সহজ হয়।[15]
রাসূলুল্লাহ (সা.) এভাবেই কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন:
كان يقرأ السورة فيرتلها حتى تكون أطول من أطول منها
“রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরআনের সূরা তিলাওয়াত করলে তারতীলসহ ধীরে ও টেনে তিলাওয়াত করতেন, ফলে সূরাটি যতটুকু লম্বা তার চেয় অনেক বেশি লম্বা হয়ে যেত।”[16]
আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সা.) তিলাওয়াত পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, (كانت مدا) তাঁর কিরাআত ছিল টেনে টেনে।[17]
উম্মু সালামাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কিরাআত পদ্ধতি সম্পর্কে বলেনঃ
كان يقطع قراءته اية اية
তিনি প্রত্যেক আয়াতে থামতেন (একসাথে কখনো দুই আয়াত তিলাওয়াত করতেন না।)[18]
হাফসকে (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কিরাআত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: “তোমরা তাঁর মতো তিলাওয়াত করতে পারবে না।” প্রশ্নকারীগণ তবুও একটু শোনাতে অনুরোধ করেন। তখন তিনি খুব ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করেন।[19]
হুযাইফা (রাঃ) বলেন :
صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَافْتَتَحَ الْبَقَرَةَ، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَةِ، ثُمَّ مَضَى، فَقُلْتُ: يُصَلِّي بِهَا فِي رَكْعَةٍ، فَمَضَى، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ بِهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ النِّسَاءَ، فَقَرَأَهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ، فَقَرَأَهَا، يَقْرَأُ مُتَرَسِّلًا، إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيهَا تَسْبِيحٌ سَبَّحَ، وَإِذَا مَرَّ بِسُؤَالٍ سَأَلَ، وَإِذَا مَرَّ بِتَعَوُّذٍ تَعَوَّذَ
“এক রাতে আমি (তাহাজ্জুদের সালাতে) নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর সাথে সালাতে দাঁড়ালাম। তিনি সূরা বাকারাহ শুরু করলেন। আমি ভাবলাম তিনি হয়ত ১০০ আয়াত পাঠ করে রুকুতে যাবেন। কিন্তু তিনি ১০০ আয়াত পার হয়ে গেলেন। আমি ভাবলাম তিনি হয়ত এই সূরা শেষ করে রুকু করবেন। কিন্তু তিনি সূরা ‘নিসা’ শুরু করলেন এবং তা পুরোপুরি পাঠ করলেন। এরপর তিনি সূরা ‘আলে ইমরান’ শুরু করলেন এবং তা শেষ করলেন। তিনি ধীরে ধীরে টেনে টেনে তিলাওয়াত করলেন। যখন তাসবীহের উল্লেখ আছে এমন কোনো আয়াত তিনি পড়ছিলেন তখন তিনি তাসবীহ পাঠ করছিলেন। যখন কোনো প্রার্থনার উল্লেখ আছে এমন কোনো আয়াত পাঠ করছিলেন, তখন তিনি প্রার্থনা করছিলেন। আবার আশ্রয় চাওয়ার উল্লেখ আছে এমন আয়াত আসলে তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। ...।”[20]
বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও ধীরে ধীরে টেনে টেনে পড়ার সাথে সাথে যথাসম্ভব সুন্দর ও মধুর স্বরে কুরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করতে হবে। বিভিন্ন হাদীসে সাধ্যমতো মধুর ও সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি হাদীসে বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
زينوا القران بأصواتكم
“তোমরা কুরআনকে তোমাদের শব্দ ও উচ্চারণ দিয়ে মধুর ও সৌন্দর্যমন্ডিত কর।”[21]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ বলেন,
لا تنثروه نثر الرمل، ولا تهذوه هذ الشعر، قفوا عند عجائبه، وحركوا به القلوب، ولا يكون هم أحدكم آخر السورة
“তোমরা কুরআনকে বালি ছিটানোর মতো ছিটিয়ে দেবে না বা কবিতার মতো দ্রুত আবৃত্তি করবে না। কুরআনের আশ্চর্য বাণী থেমে ও বুঝে পড়বে। কুরআন দিয়ে হৃদয়কে নাড়া দেবে। কখন সূরার শেষে পৌঁছাব এই চিন্তা করে কখনো কুরআন তিলাওয়াত করবেন না।”[22]
(ঘ) কুরআনের অর্থ চিন্তা ও হৃদয়ঙ্গম করার ফযীলত
কুরআন করীমকে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন অনুধাবন করার জন্য, শুধুমাত্র তিলাওয়াতের জন্য নয়। কুরআনের তিলাওয়াত যেমন একটি ইবাদত, কুরআন অনুধাবন করা, বুঝা ও কুরআন নিয়ে চিন্তা করা অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যই তা অনুধাবন করা। উপরের হাদীসগুলি আলোচনা করতে যেয়ে আমরা সহজেই বুঝতে পেরেছি যে, কুরআন পাঠের ফযীলত মূলত পাঠ করে তা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য। হৃদয়ঙ্গম করলেই নবুয়তের ইলম আমাদের মধ্যে সঞ্চিত হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবীগণ ও তাবেয়ীগণের যুগে বা ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলিতে এভাবেই কুরআন পাঠ করতেন মুসলিমগণ।
যেসকল অনারব দেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে সেসকল দেশের মানুষও কুরআন বুঝার মতো আরবী শিখে নিয়েছেন। কিন্তু আমরা এখন না বুঝেই পড়ি। তবুও আশা করব যে, আল্লাহ তা’লা দয়া করে আমাদেরকে কুরআন পাঠের জন্য নির্ধারিত সাওয়াব দান করবেন। আমাদের না বুঝার অসহায়ত্ব বা আলসেমী তিনি দয়া করে ক্ষমা করবেন।
মহান আল্লাহ্ কুরআন কারীমে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এই গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তা বুঝার জন্য সহজ করেছেন যেন সবাই তা বুঝতে পারে ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। “এই কুরআনে আমি বিভিন্ন উপদেশ, উদাহরণ, বিধান ইত্যাদি উল্লেখ করেছি যেন তারা অনুধাবন করতে ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।” প্রায় ৫০ স্থানে এভাবে বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
“এক বরকতময় কল্যাণময় গ্রন্থ আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যেন তারা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।”[23]
কুরআন কারীমে চার স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ
“নিশ্চয় আমি কুরআনকে বুঝার ও উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি , কে আছে উপদেশ গ্রহণ করার?”[24]
যারা কুরআন অনুধাবন করতে, বুঝতে ও শিক্ষা গ্রহণ করতে চেষ্টা করে না তাদের বিষয়ে অন্য আয়াতে ইরশাদ করা হয়েছে :
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
“তারা কি কুরআনকে অনুধাবন করে না? না কি তাদের অন্তর তালাবব্ধ?”[25]
বিভিন্ন হাদীসে কুরআন তিলাওয়াতের সাথে সাথে অনুধাবন করতে ও চিন্তা করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এমনি কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে যে, যারা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করবে কিন্তু তার অর্থ নিয়ে চিন্তা করবে না তাদের জন্য শাস্তি রয়েছে।[26]
আল্লাহর কিতাব পাঠ করাকে কুরআন কারীমে ‘তিলাওয়াত’ বলা হয়েছে, কারণ তিলাওয়াত অর্থ অনুসরণ করা। এজন্য কুরআন শুধুমাত্র না বুঝে পাঠ করলে তিলাওয়াত হয় না। বুঝে পাঠ করে তা অনুসরণ করে চললেই তা তিলাওয়াত বলে গণ্য হবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেনঃ
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَٰئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ
“যাদেরকে আমি কিতাব প্রদান করেছি তাঁরা তা সত্যিকারভাবে তেলাওয়াত করে, তাঁরাই এই কিতাবের উপর ঈমান এনেছে।”[27]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সকল সাহাবী ও তাবেয়ী মুফাসসির একমত যে দুটি গুণ থাকলেই সেই তিলাওয়াতকে ‘সত্যিকারের তিলাওয়াত’ বলা যাবে : (১). পঠিত আয়াতের অর্থ বুঝে হৃদয়কে তার সাথে একাত্ম করে তিলাওয়াত করতে হবে। (২). পঠিত আয়াতের সকল বিধান ও নির্দেশনা অনুসরণ ও পালন করতে হবে। হৃদয়ঙ্গম ও অনুসরণ ছাড়া কখনই সত্যিকারের তিলাওয়াত বলে গণ্য হবে না।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উমার (রাঃ) বলেন, সত্যিকার তিলাওয়াতে পঠিত আয়াতের সাথে হৃদয় আলোড়িত হবে। যে আয়াতে শাস্তির কথা বলা হয়েছে সেখানে থেমে আল্লাহর কাছে শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। যে আয়াতে জান্নাতের কথা বলা হয়েছে, সেখানে থেমে আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করতে হবে। এভাবে হৃদয় দিয়ে তিলাওয়াত করলেই তা ‘সত্যিকার তিলাওয়াত’ বলে গণ্য হবে।[28]
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও হানাফী মাযহাবের অন্যান্য ইমাম সালাতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াতের সময়েও আয়াতের অর্থ অনুযায়ী থেমে থেমে আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে পছন্দ করতেন। জাহান্নামের কথা আসলে আশ্রয় প্রার্থনা করা, জান্নাতের কথা আসলে জান্নাত চাওয়া, ক্ষমার কথা আসলে ইস্তিগফার করা এবং এভাবে হৃদয়কে আলোড়িত করে সালাতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করতে তিনি উৎসাহ দিয়েছেন, বিশেষত সকল প্রকার সুন্নাত-নফল সালাতে। শুধুমাত্র ফরয সালাত যেহেতু জামাতে আদায় করতে হয় সেহেতু সেক্ষেত্রে যথাসাধ্য সংক্ষেপ করার ও সকল মক্তাদীর দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য তিলাওয়াতের মধ্যে না থামাই পছনদ করতেন। তবে ফরয সালাতেও কেউ কুরআন তিলাওয়াতের সময় এভাবে দু‘আ করলে সালাতের ক্ষতি হবে না বলে তিনি বলেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) তাঁর মাবসূত গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।[29]
সাবাহী আব্দুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) এবং মুজাহিদ, আবু রাযীন, কাইস ইবনু সা’দ, ‘আতা, হাসান বাসরী, কাতাদাহ, ইকরিমাহ, আবুল আলিয়াহ, ইব্রাহীম নাখয়ী প্রমুখ সকল তাবিয়ী, তাবে-তাবিয়ী মুফাসসির বলেছেন যে, সত্যিকার তিলাওয়াতের অর্থ পঠিত সকল আয়াতের সকল প্রকার বিধানাবলী পরিপূর্ণ পালন ও অনুসরণ করা। কুরআনের সহজ সঠিক অর্থ বুঝা ও সকল প্রকার দূরবর্তী ও বিকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা থেকে দূরে থাকা। যারা এভাবে বুঝবেন ও পালন করবেন তারাই শুধু সত্যিকার তিলাওয়াতকারী বলে গণ্য হবেন।[30]
আমরা কুরআনের বর্ণনা, হাদীসের নির্দেশনা ও সাহাবীগণের বাণী থেকে জেনেছি যে, কুরআন তিলাওয়াতের অন্যতম আদব কুরআন দিয়ে অন্তরকে নাড়ানো। অন্তর নড়লেই ঈমান বৃদ্ধি পাবে, শরীর শিহরিত হবে এবং কর্ম নিয়ন্ত্রিত হবে।
[2] সূরা যুমারঃ আয়াত ২।
[3] তিরমিযী ৫/১৭৫, নং ২৯১০।
[4] সহীহ বুখারী ৬/২৭৪৩, সহীহ মুসলিম ১/৫৪৯।
[5] সহীহ বুখারী ৪/১৮৮২, নং ৪৬৫৩।
[6] সহীহ মুসলিম ১/৫৫৩।
[7] মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৪০, মুসনাদ আহমাদ ২/১৭৪, আত-তারগীব ২/১০, ৩২৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৩৮১। হাদিসটি সহীহ।
[8] সূরা আ’রাফঃ ২০৫।
[9] মুসতাদরাক হাকিম ১/৪৫২।
[10] মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৪২, আত-তারগীব ২/৩২৯। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[11] মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩৮, আত-তারগীব ২/৩২৫। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[12] সুনানে তিরমিযী, নং ২৯১৫, আবু দাউদ ২/৭৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/৪৩, মাওয়ারিদুয যামআন ৬/১৬, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/১৬২।
[13] দেখুনঃ মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা ৬/১১৭।
[14] সূরা মুযযাম্মিলঃ ৪।
[15] তাফসীরে তাবারী ২৯//১২৬-২১৭, তাফসীরে ইবনু কাসীর ৪/৪৩৫-৪৩৬।
[16] সহীহ মুসলিম ১/৫০৭, নং ৭৩৩।
[17] সহীহ বুখারী ৪/১৯২৫, নং ৪৭৫৯।
[18] মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০২, সনদ সহীহ।
[19] মুসনাদে আহমাদ ৬/২৮৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/১০৮।
[20] সহীহ মুসলিম ১/৫৩৬, নং ৭৭২।
[21] সুনানে আবু দাউদ ২/৭৪, নং ১৪৬৮, সুনানে ইবনু মাজাহ ১/৪২৬, নং ১৩৪২, সুনানুন নাসাঈ ২/১৭৯, নং ১০১৫, মুসনাদ আহমাদ ৪/২৮৩, ২৮৫, ৩০৪, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/১৭১। হাদিসটি সহীহ।
[22] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ২/৩৬০, তাফসীরে ইবনু কাসীর ৪/৪৩৫।
[23] সূরা সাদঃ ২৯।
[24] সূরা কামারঃ ১৭, ২২, ৩২, ৪০।
[25] সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪।
[26] তাফসীরে কুরতুবী ২/২০১, তাফসীরে ইবনু কাসীর ১/৪৪২।
[27] সূরা বাকারাঃ ১২১।
[28] তাফসীরে ইবনু কাসীর ১/১৬৪, ১৬৫।
[29] মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল-মাবসূত (আল-আসল) ১/২০২-২০৩।
[30] তাফসীরে তাবারী ১/৫১৯-৫২১, তাফসীরে ইবনু কাসীর ১/১৬৪-১৬৫।