লগইন করুন
শিরকের মূলই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা
কুরআন কারীমের আলোকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, যুগে যুগে অধিকাংশ কাফির মুশরিক আল্লাহর উপর ঈমান থাকা সত্ত্বেও, আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, রিযিকদাতা, পালনকর্তা ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিশ্বাস করার পরেও এই দু‘আর কারণেই মুশরিক হয়ে গিয়েছে।
কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা সন্দেহাতীতভাবে জানতে পারি যে মক্কার মুশরিকগণ বিশ্বাস করতো যে - আল্লাহই এই বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সর্বময় ক্ষমতার মালিক, তাঁর উপরে কারো ক্ষমতা নেই, তিনিই একমাত্র রিযিক দাতা, জীবন ও মৃত্যুর মালিক। তারা একবাক্যে তা স্বীকার করতো। কুরআন করীমের বিভিন্ন স্থানে একথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।[1] অর্থাৎ, তারা বিশ্বাস করতো যে,- ‘লা খালিকা ইল্লাল্লাহ’ , ‘লা রাব্বা ইল্লাল্লাহ’ , ‘লা রাযিকা ইল্লাল্লাহ’ , ‘লা মালিকা ইল্লল্লাহ’ ইত্যাদি। কিন্তু তারা এই বিশ্বাস সত্ত্বেও আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি অন্যান্য নবী, ফিরিশতা, প্রতিমা, পাথর, গাছ ইত্যাদির ইবাদত বা পূজা করত। অর্থাৎ, তারা ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ মানত না।[2]
শিরকের উৎপত্তি আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের কারণে নয়। শিরকের উৎপত্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মানুষ, ফিরিশতা, গাছ, পাথর বা প্রাকৃতিক শক্তিকে অলৌকিক বা অপার্থিব কল্যাণ ও অকল্যাণের ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী মনে করে তাদের ইবাদত বা পূজা করা। বিশেষত তাদের কাছে সাহায্য, কল্যাণ, আশ্রয় ও বিপদমুক্তি প্রার্থনা করা। হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রিয়, নেককার ওলী, বুজুর্গ, নবী বা ফিরিশতাগণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, অতিভক্তি ও তাদেরকে মঙ্গল বা অমঙ্গল করার ক্ষমতার অধিকারী মনে করার কারণে মানব সমাজে শিরক প্রবেশ করেছে ও প্রতিপালিত হয়েছে। এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। হাদীস থেকে শুধুমাত্র মুসলিম সমাজে শিরক প্রবেশের দু’টি কহিনী আলোচনা করছি।
প্রথম ঘটনা : প্রথম মানব সমাজ ছিল তাওহীদবাদী মুমিন মুসলিম। আদম (আঃ)-এর পরে কয়েক শতাব্দী এভাবেই মানুষ তাওহীদ ও ঈমানের উপর ছিল। এরপর আওলিয়া কেরামের ক্ষেত্রে অতিভক্তির কারণে ক্রমান্বয়ে সমাজে শিরকের শুরু হয়। সহীহ বুখারী ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে, তাফসীরে তাবারী ও অন্যান্য তাফসীরের গ্রন্থে এ বিষয়ক অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ সকল বর্ণনার সারসংক্ষেপ নিমণরূপ: আদম সন্তানদের মধ্যে ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগূস, ইয়াঊক ও নাসর - এই পাঁচ ব্যক্তি খুব নেককার বুজুর্গ মানুষ ছিলেন। তাঁদের অনেক অনুসারী, ভক্ত ও মুরীদ ছিলেন, যারা তাঁদের বেলায়েতের বিষয়ে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। তাঁদের মৃত্যুর পরে তাঁদের বিষয়ে অতিভক্তিকারী কোনো কোনো মু’তাকীদ বলেন, আমরা যদি এঁদের ছবি বানিয়ে রেখে দিই তাহলে তা আমাদেরকে বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি করতে উৎসাহিত করবে। এরপর যখন এরাও মারা গেল তখন ইবলিস পরবর্তী যুগের মানুষদেরকে ওয়াসওয়াসা দিতে লাগল, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ তো এঁদের শুধু শুধু ছবি করে রাখেননি। তারা তো এদের ইবাদত করত এবং এদের ডাকার ফলেই তো তারা বৃষ্টি পেত। তখন সে যুগের মানুষেরা এঁদের পূজা করা শুরু করল।[3]
দ্বিতীয় ঘটনা : তাওহীদের অন্যতম সিপাহসালার ছিলেন ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ)। তঁদেরই বংশধর আরব জাতি। তারাও তাওহীদের উপর ছিল। তাদের মধ্যে শিরকের প্রচলন সম্পর্কে ইবনু ইসহাক তার “সীরাতুন্নবী” গ্রন্থে বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ীর সূত্রে লিখেছেন : এরা বলেন যে, ইসমাঈলের বংশে আরবদের মধ্যে শিরক প্রচলনের কারণ ছিল, এরা কাবাঘরের খুবই ভক্তি করত। তারা কাবাঘর ছেড়ে যেতে চাইতেন না। যখন তাদের বাধ্য হয়ে কাবাঘর ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হতো, তখন তারা সাথে করে কাবাঘরের তাযীমের জন্য কাবাঘরের কিছু পাথর নিয়ে যেতেন। তারা যেখানেই যেতেন সেখানে এই পাথরগুলি রেখে তার তাওয়াফ করতেন ও সম্মান করতেন। পরবর্তী যুগে ক্রমান্বয়ে এ সকল পাথর ইবাদত করার প্রচলন হয়ে যায়। পরে মানুষেরা খেয়াল খুশি মতো বিভিন্ন পাথর পূজা করতে শুরু করে। এছাড়া আরবদের নেতা আমর ইবনু লুহাঈ তার কোনো কাজে সিরিয়ায় গমন করেন। সেখানের মানুষেরা মূর্তি পূজা করত। তিনি তাদের বলেন, এসকল মূর্তি তোমরা কেন পূজা কর? তারা বলে, আমরা এদের পূজা করি। এদের কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করি। তখন এরা আমাদের বৃষ্টি দান করে। বিপদে আমরা এদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। তখন এরা আমাদের সাহায্য করে। তখন তিনি তাদের থেকে কয়েকটি মূর্তি এনে মক্কায় স্থাপন করেন এবং মক্কাবাসীকে এদের তাযীম করতে নির্দেশ দেন।”[4]
আল্লাহর ফিরিশতা, নবী ও ওলীদের নিকট প্রার্থনা করার যুক্তি
আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল দুটি :
প্রথম যুক্তি - এরা সবাই আল্লাহর প্রিয়, আল্লাহর নবী বা ফিরিশতা। অথবা আল্লাহর পুত্রকন্যা। এদের ইবাদত করলে আল্লাহ নিশ্চয় খুশি হবেন এবং এভাবে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব।
কুরআন কারীমে ইরশাদ করা হয়েছেঃ
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ
“আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য আউলিয়া (অভিভাবক বা বন্ধু ) গ্রহণ করেছে তারা বলে, আমরা তো এদের শুধু এজন্যই ইবাদাত করি যেন এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবে।”[5]
দ্বিতীয় যুক্তি - আল্লাহই একমাত্র প্রভু , প্রতিপালক এবং সকল ক্ষমতার মালিক। তবে কিছু মানুষ ও ফিরেশতা আছেন যারা আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয়, তাদের সুপারিশ আল্লাহ গ্রহণ করেন। এ সকল ফিরেশতা ও মানুষের ইবাদাত করলে, এরা খুশি হয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে মানুষের বিপদ কাটিয়ে দেন, প্রয়োজন পূরণ করেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেনঃ
وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
“তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করে তারা তাদের কোনো ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী শাফায়াতকারী। আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহকে এমন কিছু জানাচ্ছ যা তিনি জানেন না, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে? সুবহানাল্লাহ! তিনি সুমহান, সুপবিত্র এবং তোমাদের শিরক থেকে তিনি ঊর্ধেব।”[6]
মুশরিকগণ যদিও মনে করত যে, একমাত্র আল্লাহই সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং এসকল উপাস্য আল্লাহর নিকট থেকেই সুপারিশ করে এনে দেন, তবুও তাদের ধারণা ছিল আল্লাহর সাথে এদের যে সম্পর্ক তাতে এদের সুপারিশ আল্লাহ ফেলতে পারবেন না। এভাবে এদের মধ্যে ‘মানুষের মঙ্গল বা অমঙ্গল করার এক ধরনের ক্ষমতা’ আছে বলেই তারা মনে করত। অর্থাৎ, তারা মনে করতো যে, মূল ক্ষমতা আল্লাহরই। তবে এদেরকে তিনি (আল্লাহ) কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। এজন্য কুরআন করীমে বিভিন্ন স্থানে ইহুদি, নাসারা ও কাফিরদের শিরকের প্রতিবাদে আল্লাহ বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, “এরা আল্লাহকে ছাড়াও যে সকল নবী, ফিরিশতা, ওলী বা প্রতিমার ইবাদত বা পূজা করে তারা কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গলের ক্ষমতা রাখে না।”[7]
তাহলে শিরকের ভিত্তি ছিল আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো নবী, ফিরিশতা, ওলী বা কোনো প্রাকৃতিক শক্তিকে অপার্থিব ও অলৌকিক মঙ্গল ও অমঙ্গলের ক্ষমতার অধিকারী মনে করে বা তাদের সাথে আল্লাহর সরাসরি বিশেষ সম্পর্ক ও সুপারিশের বিশেষ অধিকার আছে মনে করে এদের কাছে প্রার্থনা করা। দু‘আ বা প্রার্থনাই মূলত সকল শিরকের মূল। উৎসর্গ, কুরবানি (sacrifice), নযর, মানত, ফুল, সাজদা, গড়াগড়ি ইত্যাদি সবই মূলত দু‘আর জন্যই। যেন পূজিত ব্যক্তি বা বস্তু এ সকল ভেট বা উৎসর্গে খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি প্রার্থনা পূরণ করেন বা হাজত মিটিয়ে দেন সে জন্যই বাকি সকল প্রকারের ইবাদত ও কর্ম। অপরদিকে এদের কাছে প্রার্থনা মূলত জাগতিক। ফসল, রোগব্যাধি, বিপদাপদ, সন্তান, বিবাহ, ইত্যাদি জাগতিক প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়ার জন্যই এদের কাছে প্রার্থনা করা হয়। জান্নাত বা স্বর্গ লাভ, ক্ষমা, স্রষ্টার প্রেম, আখেরাতের উন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে এদের কাছে চাওয়া হয় না।
এজন্য আমরা কুরআন করীমের বিবরণ থেকে দেখতে পাই যে, মুশরিকরা ফিরিশতা, নবী, প্রতিমা ইত্যাদির ইবাদত করত মূলত দু‘আর মাধ্যমে। সাধারণভাবে মুশরিকদের শিরকই ছিল যে, তারা আল্লাহকেও ডাকত বা আল্লাহর কাছে দু‘আ চাইত, আবার আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য নবী, ফিরিশতা, বুজুর্গ, পাথর, প্রতিমা ইত্যাদির কাছেও দু‘আ চাইত। এজন্য কুরআন করীমে এদের শিরককে অধিকাংশ স্থানে ‘দু‘আ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রায় ৭০ এরও অধিক স্থানে মুশরিকদের শিরককে ‘দু‘আ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
সাধারণ বিপদ ও হাজত বনাম বড় বিপদ ও হাজত
এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে, মুশরিকদের এসকল দু‘আ-প্রার্থনা সবই ছিল মূলত পার্থিব ও জাগতিক সমস্যাদি কেন্দ্রিক।
রোগ, ব্যধি, বৃষ্টিপাত, সন্তান, বাণিজ্যে উন্নতি, বরকত, বিপদমুক্তি, রিযিক বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়েই মুশরিকগণ এসকল উপাস্যের কাছে প্রার্থনা করত, যেন তারা আল্লাহর নিকট থেকে তাদের হাজত পূর্ণ করে দেয়। আখেরাতের মুক্তি, জান্নাত, কামালাত ইত্যাদির জন্য এদের কাছে কেউ যেত না। মূলত অধিকাংশ মুশরিক আখেরাতে অবিশ্বাস করতো।
জাগতিক এ সকল প্রার্থনার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মুশরিকের সাধারণ নিয়ম ছিল, ছোটখাট বিপদ আপদ প্রয়োজনে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যদের কাছে চাওয়া। আর খুব কঠিন বিপদে আল্লাহর কাছে চাওয়া। সম্ভবত তারা ভাবতো, ছোটখাট বিষয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে বিরক্ত করার কী দরকার। এজন্য তো আল্লাহর প্রিয় ফিরিশতা, নবী, আল্লাহর মেয়ে, স্ত্রী ইত্যাদি রয়েছে। একান্ত যে সকল কঠিন বিপদে এরা কূল পান না, সেখানে মহাপ্রভু সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহকে ডাকা যেতে পারে।
কুরআন কারীমে এ বিষয়ে অনেক স্থানে বলা হয়েছে। বারবার বলা হয়েছে যে, মুশরিকগণ যখন কঠিন বিপদে পড়ে, নদীতে বা সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে, বা আল্লাহর আযাব বা প্রাকৃতিক গজব এসে উপস্থিত হয় তখন মনেপ্রাণে আল্লাহর নিকট বিপদমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। অথচ সাধারণ হাজত প্রয়োজনে তারা তাদের অন্যান্য উপাস্যদের নিকট প্রার্থনা করে।[8]
কুরআনের বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, অধিকাংশ মুশরিকই এইভাবে চলত। সূরা হজ্বের একটি বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, কিছু মানুষ সাধারণভাবে আল্লাহর ইবাদত করত। কিন্তু আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও ঈমানের দৃঢ়তা খুবই কম। এজন্য কঠিন বিপদে পড়লে তারা ঈমান হারিয়ে ফেলত এবং শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ত। তখন আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যর কাছে চাওয়া শুরু করত।[9]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো নবী, ওলী, ফিরিশতা বা কারো কাছে প্রার্থনা করা শিরকের মূল। এবং একারণেই অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর উপর ঈমান থাকা সত্ত্বেও শিরকে লিপ্ত হয়। এজন্যই মহান আল্লাহ কুরআন করীমে ইরশাদ করেছেনঃ
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ
“অধিকাংশ মানুষই শিরকে রত অবস্থায় আল্লাহর উপর ঈমান আনে।”[10]
এই আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ), মুজাহিদ, আতা, ইকরিমাহ, আমির, ইবনু সিরীন, হাসান বসরী, কাতাদাহ, ইবনু যাইদ প্রমুখ সকল সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী, মুফাসসির একথাই বলেছেন যে, সকল মুশরিকই বিশ্বাস করে যে,আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, মৃত্যুদাতা, প্রভু, প্রতিপালক এবং আল্লাহই রাব্বুল আলামীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে তার সাথে শিরক করে।[11]
মুসলিম সমাজের ‘দু‘আ কেন্দ্রিক শিরক’
দু‘আর আলোচনার মধ্যে উপরের ‘দু‘আ কেন্দ্রিক শিরক’-এর আলোচনার উদ্দেশ্য এই শিরক থেকে আত্মরক্ষার বিষয়ে সতর্ক থাকা। আমরা অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, বিভিন্ন মুসলিম সমাজে পূর্বতন ধর্মের প্রভাবে, ইসলামের মূলনীতি ও বিশ্বাস সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বিপদে আপদে মূর্ত কাউকে আঁকড়ে ধরে মনের আকুতি জানানোর মানবীয় দুর্বলাতার কারণে, আল্লাহর প্রতি আস্থার অভাবে ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণে দু‘আ কেন্দ্রিক শিরক ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
আমাদের সমাজেও অগণিত মুসলিম বিপদে আপদ, রোগব্যাধি, ফসল, সন্তান, বিবাহ ইত্যাদি জাগতিক সমস্যাদির জন্য দেশের অগণিত মাযারে গিয়ে মাযারে শায়িত ব্যক্তিদের নিকট প্রার্থনা করেন। তাদের নিকট সমস্যা মেটানোর আব্দার করেন। তারা যেন খুশি হয়ে সমস্যা মেটানোর ব্যবস্থা করেন এই আশায় প্রার্থনার পূর্বে নযর, মানত, উৎসর্গ, ভেট, টাকা-পয়সা, সাজদা, ক্রন্দন ইত্যাদি পেশ করা হয়। এই কঠিন শিরক থেকে আত্মরক্ষা করা মুমিনের অন্যতম কাজ। শিরক থেকে মুক্ত হতে না পারলে বাকি সকল কর্মই ব্যর্থ। অনন্ত ধ্বংস থেকে মুক্তির কোনো উপায় থাকবে না।
এখানে লক্ষণীয় যে কাফির মুশরিক ও পৌত্তলিক সমাজের মতো আমাদের দেশের মানুষেরাও সাধারণত কোনো পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতি বা মর্যাদার জন্য এ সকল কবর, মাযার বা দরবারে যান না। আপনার সমাজের আনাচে কানাচে ছড়ানো অগণিত মাযারে গিয়ে দেখবেন সকলেই পার্থিব বিপদ আপদ, সন্তান, রোগব্যধি, মামলা ইত্যাদি জাগতিক সমস্যার দ্রুত নিস্পত্তি ও হাজত পূরণের জন্য এ সকল স্থানে নযর, মানত ইত্যাদি নিয়ে হাজিরা দেন। দ’চার জন মানুষ যারা আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যিয়ারত করেন, তাঁরা নযর, মানত ইত্যাদির ধার ধারেন না। নীরবে যিয়ারত করে চলে যান।
এই বইয়ের পরিসরে কবরে দু‘আ কেনিদ্রক শিরকের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব হচেছ না। আমার “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে আমি এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি।[12] এখানে এতটুকুই বলতে চাই যে, উপরের অগণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধুমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন। কোথাও কখনো ঘুণাক্ষরেও বলেননি যে, কোনো প্রকার বিপদে অথবা ছোটখাট প্রয়োজনে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে তোমরা প্রার্থনা করবে, অথবা কারো কবরে গিয়ে আল্লাহর কাছে চাইবে। উপরন্তু কঠিনভাবে বারবার নিষেধ করেছেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাইতে। বিশেষ করে কবর-কেন্দ্রিক ইবাদত থেকে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। কবরকে কেন্দ্র করেই যে শিরক প্রসার লাভ করে, - তা বিশেষভাবে জানিয়েছেন। এ ধরনের মানুষদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন।
সমাজে অনেক কথা প্রচলিত আছে। অমুক ব্যক্তি বিপদে পড়ে অমুক বুজুর্গকে ডেকেছিল, তিনি তাকে উদ্ধার করে দিয়েছেন। অমুক ব্যক্তি অমুকের মাযারে গিয়ে দু‘আ করে বিপদ কেটে গিয়েছে। এগুলিতে কান দেবেন না। হিন্দু, খ্রিষ্টান ও সকল মুশরিক সমাজেই এই ধরনের কথা প্রচলিত।
ভাবতে বড় অবাক লাগে, এই সকল লোকমুখের কথা আমাদের অনেক মুসলমান ভাইয়েরা কত সহজে বিশ্বাস করেন! অথচ কুরআন ও হাদীসের কথায় আমাদের আস্থা আসে না। আল্লাহর রাব্বুল আলামীন ও তাঁর মহান রাসূল (সা.) অগণিত ঘটনায় বলেছেন যে,- অমুক, অমুক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বিপদ মুক্ত হয়েছে। ইউনসূ (আ.) মাছের পেটের গভীরতম অন্ধকারে কঠিনতম বিপদে আল্লাহকে ডেকে বিপদ মুক্ত হলেন। এই কথায় আস্থা রেখে এরা আল্লাহকে ডাকতে চান না। অস্থির হয়ে শিরকের মধ্যে নিপতিত হন।
প্রিয় পাঠক, কুরআন ও হাদীসের বিবরণে আস্থা রাখুন। শুধুমাত্র আল্লাহকেই ডাকুন। তাঁর রহমত থেকে আস্থা হারাবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে শিরকের ভয়াবহ অন্ধকার থেকে রক্ষা করুন।
[2] সূরা সাফফাতঃ ৩৫-৩৬, সূরা সাদঃ ৪-৫।
[3] সহীহ বুখারী ৪/১৮৭৩, তাফসীরে তাবারী ১/৯৪-৯৫।
[4] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবীয়্যাহ ১/৯৪-৯৫।
[5] সূরা যুমারঃ ৩।
[6] সূরা ইউনুসঃ ১৮।
[7] দেখুনঃ মায়েদাঃ ৭৬, আনআমঃ ৭১, ইউনুসঃ ১৮, ৪৯, রা’দ ১৬, তাহাঃ ৮৯, আম্বিয়াঃ ৬৬, হাজ্জঃ ১২, ফুরকানঃ ৩, ৫৫, শু’আরাঃ ৭৩।
[8] দেখুনঃ সূরা আনআমঃ ৬৩, আ’রাফঃ ১৮৯, ইউনুসঃ ১২, ২২, ইসরাঃ ৬৭, আনকাবুতঃ ৬৫, রূমঃ ৩৩, লুকমানঃ ২৩, যুমারঃ ৮ ইত্যাদি।
[9] সূরা হাজ্জঃ ১১-১৩।
[10] সূরা ইউসুফঃ ১০৬।
[11] সহীহ বুখারী ৬/২৭৩৪, সুনানু সাঈদ ইবনু মানসূর ৫/৪১১, তাফসীরে তাবারী ১৩/৭৬-৭৯, তাফসীরে কুরতুবী ৯/২৭২-২৭৩, ফাতহুল বারী ১৩/৪৯৪।
[12] দেখুনঃ এহইয়াউস সুনান, পৃ. ২৩৪-২৩৮।