শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া খেলাফতের ক্ষেত্রে আলী (রাঃ)কে অন্য চার খলীফার উপর প্রাধান্য দেয়ার হুকুম ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
খেলাফতের ক্ষেত্রে আলী (রাঃ)কে অন্য চার খলীফার উপর প্রাধান্য দেয়ার হুকুম

حكم تقديم علي رضي الله عنه على غيره من الخلفاء الأربعة في الخلافة

খেলাফতের ক্ষেত্রে আলী (রাঃ)কে অন্য চার খলীফার উপর প্রাধান্য দেয়ার হুকুম:

وَإِنْ كَانَتْ هَذِه الْمَسْأَلَةُ مَسْأَلَةُ عُثْمَانَ وَعَلِيٍّ لَيْسَتْ مِنَ الأُصُولِ الَّتِي يُضَلَّلُ الْمُخَالِفُ فِيهَا عِنْدَ جُمْهُورِ أَهْلِ السُّنَّةِ لَكِنِ الَّتِي يُضَلَّلُ فِيهَا مَسْأَلَةُ الْخِلاَفَةِ، وَذَلِكَ أَنَّهُمْ يُؤْمِنُونَ أَنَّ الْخَلِيفَةَ بَعْدَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ ثُمَّ عُثْمَانُ ثُمَّ عَلِيٌّ وَمَنْ طَعَنَ فِي خِلاَفَةِ أَحَدٍ مِنْ هَؤُلاءِ فَهُوَ أَضَلُّ مِنْ حِمَارِ أَهْلِهِ

উছমান ও আলীর মধ্যে কে অধিক উত্তম, যদিও এই মাসআলাটি দ্বীনের ঐসব মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত নয়, যাতে কেউ বিপরীত মত পোষণ করলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ লোকের মতানুসারে তাকে গোমরাহ বলা যাবে। কিন্তু খেলাফতের মাসাআলায় যে কেউ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাবের বিপরীত মত পোষণ করবে, তাকে গোমরাহ বলা হবে। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে খলীফা হলেন আবু বকর, অতঃপর উমার, অতঃপর উছমান, অতঃপর আলী (রাঃ)। সুতরাং যে ব্যক্তি এই সমস্ত খলীফার কারো খেলাফতের বিরোধিতা করবে, সে তার গৃহে পালিত গাধার চেয়েও বোকা বলে বিবেচিত হবে।


ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম এখানে দু’টি মাসআলার মধ্যে তুলনা করেছেন। একটি হলো সম্মান ও ফযীলতের ক্ষেত্রে আলীকে উছমানের উপর প্রাধান্য দেয়ার মাসআলা এবং আরেকটি হলো খেলাফতের মাসআলায় আলীকে অন্য খলীফাদের উপর প্রাধান্য দেয়া। যার ফলে বড় ধরণের কোন ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং শাইখ বর্ণনা করেছেন যে, ফযীলতের ক্ষেত্রে আলীকে উছমানের উপর প্রাধান্য দিলে গোমরাহ বলা হবেনা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে উছমানের চেয়ে উত্তম বলল, তাকে গোমরাহ বলে হুকুম লাগানো যাবেনা। কেননা আহলে সুন্নাতের লোকদের মধ্যে এই মাসআলায় মতভেদ রয়েছে। যদিও প্রাধান্যযোগ্য মতে আলীর উপর উছমান (রাঃ)এর ফযীলত সাব্যস্ত। কিন্তু খেলাফতের মাসআলায় গোমরাহ বলা হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি খেলাফতের মাসআলায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাবের খেলাফ করবে এবং আলীকে উছমান বা তাঁর আগের কোন খলীফার উপর প্রাধান্য দিবে কিংবা তাঁকে ফযীলতের ক্ষেত্রে আবু বকর ও উমারের উপর প্রাধান্য দিবে তার উপর গোমরাহীর হুকুম লাগানো হবে।

সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা বিশ্বাস করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হলেন প্রথম খলীফা। কেননা তাঁর রয়েছে অনেক ফযীলত এবং সৎকর্মে অগ্রগামিতা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সমস্ত সাহাবীর উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর খেলাফতের বাইআতের উপর সাহাবীদের ইজমা হয়েছে।

অতঃপর আবু বকরের পরে উমার ইবনুল খাত্তাব হলেন দ্বিতীয় খলীফা।[1] কেননা তাঁরও রয়েছে অনেক ফযীলত এবং সৎকর্মে অগ্রগামিতা। আবু বকর (রাঃ) জীবিত থাকা কালেই তাঁকে পরবর্তী খেলাফতের দায়িত্বভার দিয়ে গেছেন। আবু বকর (রাঃ)এর পরে তাঁর খেলাফতের উপর উম্মতের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অতঃপর উমারের পর খলীফা হলেন উছমান বিন আফফান (রাঃ)। কেননা উমার (রাঃ)এর পক্ষ হতে নিযুক্ত শুরা পরিষদ তাকেই খেলাফতের জন্য প্রাধান্য দিয়েছে এবং মুসলিম উম্মত তাঁর খেলাফতের উপর একমত হয়েছে। অতঃপর উছমান বিন আফফানের পরে খলীফা হলেন আলী (রাঃ)। কেননা তাঁর রয়েছে অনেক ফযীলত। তাঁর খেলাফতের উপর তাঁর যুগের লোকদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে।

এই হলেন চারজন খলীফা। ইরবায বিন সারিয়ার হাদীছে তাদের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ»

‘‘আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং উহার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতের পরিণাম গোমরাহী’’।[2]

এ জন্যই শাইখুল ইসলাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এই চারজনের কারো খেলাফতের স্বীকৃতি দিবেনা সে তার গৃহে পালিত গাধার চেয়েও অধিক নির্বোধ। কেননা এতে বিনা কারণে শরীয়তের দলীল এবং ইজমার খেলাফ করা হবে। যেমন রাফেযীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আলী বিন আবু তালিবকেই খেলাফতের হকদার মনে করে।আলীকে অন্য তিন খলীফার উপর প্রাধান্য দেয়ার মাসআলায় শেষ কথা হলো, (১) যারা খেলাফতের ক্ষেত্রে তাঁকে বাকী তিন খলীফার উপর প্রাধান্য দিলো, সে আহলে সুন্নাতের ঐক্যমতে গোমরাহ বলে গণ্য হবে। (২) যারা তাকে ফযীলতের ক্ষেত্রে আবু বকর সিদ্দীক এবং উমারের উপর প্রাধান্য দিবে, তারাও গোমরাহ হবে। (৩) যারা আলীকে উছমানের উপর ফযীলতের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিবে, তাদেরকে গোমরাহ বলা হবেনা। যদিও এটি প্রাধান্যযোগ্য মতের বিপরীত।

[1] - আবু বকরের পরে আমরা উমার (রাঃ)কে যোগ্য খলীফা মনে করি। কারণ আবু বকর (রা) উমারকে খলীফা নিযুক্ত করে গেছেন। মুসলিম উম্মত তাঁর খেলাফতের উপর একমত হয়েছে। তাঁর ফজীলত বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা।[1] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«اقْتَدُوا بِاللَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ»

‘‘আমার পরে তোমরা আবু বকর ও উমার- এই দু’জনের অনুসরণ করবে’’।

উমার (রাঃ)এর পরে উছমান (রাঃ)কে খেলাফতের হকদার মনে করি। কেননা উমার শহীদ হওয়ার পর মুসলমানগণ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে খলীফা নির্বাচন করেছেন এবং আলী (রাঃ) সহ সকল সাহাবী তার হাতে খেলাফতের বায়আত করেছেন। উছমান (রাঃ)এর যথেষ্ট ফজীলত রয়েছে। তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর দু’জন কন্যাকে বিয়ে করেছেন। সহীহ মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা নিজের উরু উম্মুক্ত করে শুয়েছিলেন। আবু বকর (রাঃ) প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হল। কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেভাবেই রয়ে গেলেন। আবু বকরের সাথে কথা বললেন। অতঃপর উমার (রাঃ) প্রবেশ করলেন। তিনি সেভাবেই থেকে গেলেন। পরিশেষে যখন উছমান (রাঃ) প্রবেশের অনুমতি চাইলেন তখন তিনি উঠে বসলেন এবং কাপড় ঠিক করলেন। উছমানকে অনুমতি দেয়া হলে তিনি প্রবেশ করলেন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে আলাপ-আলোচনা করলেন। উছমান (রাঃ) বের হয়ে গেলে আয়েশা জিজ্ঞাসা করলেন, আবু বকর এবং উমার (রাঃ) প্রবেশ করল কিন্তু আপনি সতর্ক হলেন না। যখন উছমান প্রবেশ করল তখন উঠে বসলেন এবং কাপড় ভাঁজ করলেন তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ «أَلَا أَسْتَحِي مِنْ رَجُلٍ تَسْتَحِي مِنْهُ الْمَلَائِكَةُ» অর্থাৎ আমি কি এমন একজন লোক থেকে লজ্জাবোধ করবোনা? যাকে দেখে ফেরেশতাগণ লজ্জাবোধ করেন। (মুসলিম, অধ্যায়ঃ ফাযায়িলুস সাহাবাহ)

হুদায়বিয়ার দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উছমান (রাঃ)কে প্রতিনিধি হিসেবে মক্কায় পাঠিয়েছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বায়আতুর্ রিযওয়ান সংঘঠিত হয়েছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় ডান হাতের দিকে ইঙ্গিত করে বললেনঃ এটি উছমানের হাত। অতঃপর তা অন্য হাতের উপর রাখলেন এবং বললেনঃ এটি উছমানের বাইআত। (শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, পৃষ্ঠা নং- ৪৯২।)

অতঃপর উছমানের পরে আলী (রাঃ)কে মুসলমানদের খলীফা মনে করি। কারণ উছমান (রাঃ) নিহত হওয়ার পর সাহাবীগণ তাঁর নিকট খেলাফতের বায়আত করেছেন। তাঁরও রয়েছে অনেক ফজীলত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ

«أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ مِنِّي بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى»

‘‘তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, তোমার মর্যাদা আমার নিকট সেরকম যেমন ছিল হারুনের মর্যাদা মূসার নিকট’’। (বুখারী, অধ্যায়ঃ আল-মানাকিব)

খায়বরের যুদ্ধের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আগামীকাল আমি এমন একজন লোককে ঝান্ডা প্রদান করবো যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাঁকে ভালবাসেন। সাহাবীগণ বললেনঃ আমরা এব্যাপারে সারা রাত আলোচনা করলাম। সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আলীকে ডাক। আলীকে ডেকে আনা হল। তাঁর চোখ অসুস্থ ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উভয় চোখে থুথু দিলেন। এতে তিনি ভাল হয়ে গেলেন। তিনি আলীর হাতে ঝান্ডা দিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর হাতে বিজয় দান করলেন। (শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, পৃষ্ঠা নং- ৪৯৫)

[2] - আবু দাউদ, তিরমিজী, হাদীছ নং- ২৮৯১।