লগইন করুন
مايجري في يوم القيامة
কিয়ামতের দিন আরো যা হবে:
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
وَتَدْنُو مِنْهُمُ الشَّمْسُ وَيُلْجِمُهُمُ الْعَرَقُ تُنْصَبُ الْمَوَازِينُ فَتُوزَنُ بِهَا أَعْمَالُ الْعِبَادِ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ وَتُنْشَرُ الدَّوَاوِينُ وَهِيَ صَحَائِفُ الْأَعْمَالِ فَآخِذٌ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ وَآخِذٌ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ أَوْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِهِ كَمَا قَالَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا وَيُحَاسِبُ اللهُ الخَلائِقَ وَيَخْلُو بِعَبْدِهِ الْمُؤْمِنِ فَيُقَرِّرُهُ بِذُنُوبِهِ كَمَا وُصِفَ ذَلِكَ فِي الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَأَمَّا الْكُفَّارُ فَلا يُحَاسَبُونَ مُحَاسَبَةَ مَنْ تُوزَنُ حَسَنَاتُهُ وَسَيِّئَاتُهُ؛ فَإِنَّهُ لاَ حَسَنَاتَ لَهُمْ، وَلَكِنْ تُعَدُّ أَعْمَالُهُمْ فَتُحْصَى فَيُوقَفُونَ عَلَيْهَا وَيُقَرَّرُونَ بِهَا
কিয়ামতের দিন সূর্য মানুষের নিকটবর্তী হবে, মানুষের শরীর হতে নির্গত ঘাম তাদের নাক-মুখ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।[1] সেদিন দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে এবং উহার মাধ্যমে বান্দাদের আমলসমূহ ওজন করা হবে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّورِ فَلَا أَنسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءَلُونَ فَمَن ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَٰئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ فِي جَهَنَّمَ خَالِدُونَ﴾
‘‘তারপর যখনই শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, তখন তাদের মধ্যে আর কোন আত্মীয়তা বা সম্পর্ক থাকবেনা এবং তারা পরস্পরকে জিজ্ঞাসাও করবেনা৷ সে সময় যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই হবে এমনসব লোক যারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ তারা জাহান্নামে থাকবে চিরকাল’’। (সূরা মুমিনূনঃ ১০১-১০৩)[2]
সেদিন আমলনামা উন্মুক্ত করা হবে। কেউ সেই আমলনামা গ্রহণ করবে ডান হাতে, কেউ গ্রহণ করবে বাম হাতে অথবা পিছন দিক থেকে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَكُلَّ إِنسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنشُورًا اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَىٰ بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا﴾
‘‘প্রত্যেক মানুষের ভালমন্দ কাজের আমলনামা আমি তার গলায় ঝুলিয়ে দিবো এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য বের করবো একটি কিতাব, যাকে সে খোলা আকারে পাবে। বলা হবেঃ পড়ো নিজের আমলনামা নিজেই। আজ নিজের হিসাব করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৩-১৪)
আল্লাহ তাআলা সমস্ত সৃষ্টির হিসাব নিবেন। তিনি তাঁর মুমিন বান্দার সাথে নিবৃত্তে মিলিত হবেন এবং বান্দাকে পাপরাশির কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। যেমন এ বিষয়ে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে।
আর কাফেরদের ব্যাপারে কথা হলো, তাদের হিসাব ঐসব লোকদের হিসাবের মত হবেনা, যাদের ভাল-মন্দ আমলসমূহ ওজন করা হবে। কেননা কিয়ামতের দিন তাদের কোন ভাল আমলই থাকবেনা। কিন্তু তাদের দুনিয়ার অপকর্মসমূহ গণনা করে রাখা হবে এবং তা সংরক্ষণ করা হবে। কিয়ামতের দিন তাদের আমলগুলোর কারণে তাদেরকে আটকানো হবে, তাদেরকে তা স্বীকার করানো হবে। অতঃপর তাদের আমলের বদলা দেয়া হবে।
ব্যাখ্যাঃ কুরআন ও হাদীছে কিয়ামতের দিন যা হবে বলে উল্লেখিত হয়েছে, আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) তার কিয়দাংশ এখানে আলোচনা করেছেন। এই মহান দিনে যা হবে, তার বিস্তারিত বিষয়গুলো মানুষের বোধশক্তি দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হাদীছ দ্বারাই কেবল তা জানা যাবে। কেননা তিনি নিজের পক্ষ হতে কিছুই বলেন না। যা বলেন, তা কেবল অহীর মাধ্যমে অবগত হয়েই বলেন। আল্লাহ তাআলা সবকিছুই জানেন। তারপরও কিয়ামতের দিন বান্দাদের আমলের হিসাব নেয়া, আমলসমূহ ওজন করা এবং পুস্তকে লিখিত অবস্থায় তা প্রকাশ করার মধ্যে হিকমতে ইলাহী হচ্ছে, যাতে করে তিনি তাঁর বান্দাদের দ্বারা পূর্ণ প্রশংসিত হতে পারেন, তাঁর পূর্ণ আদল ও ইনসাফ বাস্তবায়ন হয়, তাঁর সুপ্রশস্ত রহমত এবং রাজত্বের সুবিশালতা প্রমাণিত হয়।
এই মহা বিপদের দিনে বান্দাদের যে অবস্থা হবে, ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে তার কিয়দাংশ আলোচনা করেছেন।
(১) সূর্য তাদের নিকটবর্তী হবেঃ সূর্য তাদের মাথার নিকটবর্তী হবে। যেমন সহীহ মুসলিমে মিকদাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ أُدْنِيَتِ الشَّمْسُ مِنَ الْعِبَادِ حَتَّى تَكُونَ قِيدَ مِيلٍ أَوِ اثْنَيْنِ ‘‘যখন কিয়ামতের দিন হবে, তখন সূর্যকে বান্দাদের নিকটবর্তী করা হবে। এত নিকটবর্তী করা হবে যে, তাদের মাঝে এবং সূর্যের মাঝে মাত্র এক বা দুই মাইলের ব্যবধান থাকবে’’।[3]
وَيُلْجِمُهُمُ الْعَرَقُ মানুষের শরীর থেকে নির্গত ঘাম তাদের জন্য লাগাম স্বরূপ হয়ে যাবেঃ অর্থাৎ ঘাম তাদের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে লাগামের মত হয়ে যাবে এবং তাদেরকে কথা বলা থেকে বারণ করবে। সূর্য তাদের নিকটে চলে আসার কারণেই এমন হবে। অধিকাংশ মানুষের জন্যই সূর্য নিকটবর্তী হবে। অর্থাৎ সূর্যের তাপ অনুভব করবে। তবে নবীদেরকে এবং আল্লাহ তাআলা যাদেরকে এর বাইরে রাখতে চাইবেন, তাদের কথা ভিন্ন।
(২) বান্দাদের আমলসমূহ মাপার জন্য দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবেঃ এই দিন আরো যা হবে, তার অন্যতম হচ্ছে, দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে এবং উহার মাধ্যমে বান্দাদের আমলসমূহ ওজন করা হবে। الموازين শব্দটি ميزان -এর বহুবচন। কিয়ামতের দিন যেই দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে, উহার দ্বারা মানুষের ভাল ও মন্দ আমলসমূহ ওজন করা হবে। সেদিন আসলেই দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। এই নিক্তির দু’টি পাল্লা এবং একটি কাঁটা থাকবে। মীযান (দাড়িপাল্লা) আখেরাতের অন্যতম একটি জিনিষ। এর বিবরণ যেমন এসেছে, সেরকমই বিশ্বাস করি। কুরআন ও হাদীছের দলীলের বাইরে আমরা উহার কায়া ও ধরণ অনুসন্ধান করতে যাবোনা।
বান্দাদের আমলসমূহ মাপার হিকমত হচ্ছে, এগুলোর পরিমাণ যাহির করা, যাতে সেই অনুপাতে বিনিময় দেয়া যায়। আল্লাহ তাআলার বাণী, ﴾ فمن ثقلت موازينه ﴿ ‘‘খারাপ আমলের তুলনায় যাদের নেকীর পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে’’। অর্থাৎ তারা সাফল্য লাভ করবে, জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি পাবে এবং জান্নাতে প্রবেশের হকদার হবে। আল্লাহ তাআলার বাণী, ﴾ ومن خفت موازينه ﴿ ‘‘এবং নেকীর তুলনায় যাদের অসৎ আমলের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে এমন লোক, যারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অর্থাৎ ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। জাহান্নামে তারা চিরস্থায়ী হবে। অর্থাৎ তারা জাহান্নামে অবস্থান করবে।
উপরোক্ত আয়াতে কারিমা দ্বারা সাব্যস্ত হলো যে, কিয়ামতের দিন দাড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। কুরআনের অনেক আয়াতে ওজন এবং মীযানের আলোচনা এসেছে। সবগুলো দলীল একসাথে মিলালে বুঝা যায়, আমলকারী, আমল এবং আমল যেই পুস্তকে লিখা আছে, সবই ওজন করা হবে। এই কথাগুলো পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। সবই ওজন করা হবে। তবে এ কথা বিশেষভাবে বিবেচ্য যে, পাল্লা ভারী বা হালকা হবে স্বয়ং আমলের কারণে; আমলকারীর ব্যক্তিসত্তা কিংবা যেই পুস্তিকায় আমল লিখা থাকবে, তার কোন বিবেচনা করা হবেনা। আল্লাহই অধিক জানেন।
মুতাযেলা সম্প্রদায়ের লোকেরা এই দলীলগুলো তাবীল করে বলেছে, এখানে আমল ওজন করা এবং দাড়িপাল্লা স্থাপন করার অর্থ হচ্ছে আদল তথা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বাতিল এবং কুরআন-সুন্নাহর দলীল, উম্মতের সালাফ ও তাদের ইমামদের ইজমা বিরোধী।
ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেনঃ এই বিষয়ে মুতাযেলাদের সর্বোচ্চ দলীল হচ্ছে, তারা বলে কবরে মৃত ব্যক্তির আযাব হয়, এই কথা মানুষের বোধশক্তির পক্ষে কবুল করে নেয়া অসম্ভব। এ ছাড়া তাদের নিকট আর কোন দলীল নেই। তাদের এই কথার মধ্যে কারো বিরুদ্ধে কোন দলীল নেই। কবরের আযাবের বিষয়টি তাদের বোধশক্তি মেনে না নিলেও তা এমন অনেক লোকের আকল কবুল করে নিয়েছে, যাদের বোধশক্তি তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। সাহাবী, তাবেঈ এবং তাদের অনুসারীদের আকল কবরের আযাবকে সহজভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছে। পরবর্তীতে অন্ধকার রাতের ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্ন বিদআতের আগমণ ঘটল এবং যার যা ইচ্ছা বলতে লাগল ও শরীয়তের দলীলগুলোকে তারা প্রত্যাখ্যান করল। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, আখেরাতের বিষয়গুলো এমন কোন বিষয় নয়, যে বোধশক্তি দ্বারা তা বুঝা সম্ভব।
(৩) সেদিন আমলনামা উন্মুক্ত করা হবেঃ এই মহা প্রলয় দিবসের ঘটনাসমূহ থেকে শাইখুল ইসলাম আরো যা উল্লেখ করেছেন, সেদিন আমলনামাসমূহ উন্মুক্ত করা হবে। এখানে দফতর বলতে সেই দফতর উদ্দেশ্য, যাতে বান্দাদের ঐসব আমল লিখিত আছে, যা তারা দুনিয়াতে সম্পাদন করেছিল। সম্মানিত লেখকগণ তাদের আমলসমূহ সংরক্ষণ করে রেখেছেন। দফতর খোলা হবে, এই কথা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মৃত্যুর সময় বান্দার আমল লিখার দফতর বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই কিয়ামতের দিন হিসাব নেয়ার সময় সেই আমলনামা খোলা হবে। যাতে প্রত্যেক মানুষ তার আমলনামা দেখতে পারে এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে, সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
কেউ আমলনামা গ্রহণ করবে ডান হাতে, কেউ গ্রহণ করবে বাম হাতে অথবা পিছন দিক থেকেঃ এই অংশের মধ্যে কিয়ামতের দিন মানুষের আমলনামা গ্রহণ করার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন কুরআনুল কারীমে এর বিবরণ এসেছে। মানুষ সেদিন দুইভাবে নিজ নিজ আমলনামা গ্রহণ করবে। (ক) কেউ তার আমলনামা গ্রহণ করবে ডান হাতে। মুমিন ব্যক্তিই ডান হাতে আমলনামা পাবে (খ) কেউ তার আমলনামা গ্রহণ করবে বাম হাতে অথবা পিছন দিক থেকে। কাফের তার আমলনামা বাম হাতে পাবে। তার বাম হাতকে বাঁকিয়ে পিছনের দিকে নিয়ে তাতে আমলনামা প্রদান করা হবে। আয়াতে কাফেরের আমলনামা উভয়ভাবেই দেয়ার কথা এসেছে। উভয়ের মাঝে কোন বৈপরিত্য নেই। কেননা কাফেরের ডান হাত সেদিন তার গলার সাথে বেঁধে রাখা হবে এবং তার বাম হাত পিছনে টেনে নেয়া হবে। অতঃপর সে বাম হাতে তার আমলনামা গ্রহণ করবে।
অতঃপর শাইখ আমলনামা প্রদানের উপর আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ﴾ ﴿ ‘‘প্রত্যেক মানুষের ভালমন্দ কাজের আমলনামা আমি তার গলায় ঝুলিয়ে দিবোঃ طائره এর অর্থ হচ্ছে, তার থেকে ভাল-মন্দ যেসব আমল প্রকাশিত হয়েছে। উহা তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। আমল তাকে জড়িয়ে থাকবে এবং তাকে উহার বিনিময় দেয়া হবে। আমলনামা হতে তার পালিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। হার বা মালা যেমন গলাকে পেচিয়ে থাকে তেমনি আমলনামা মানুষের গলায় ঝুলতে থাকবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴾ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا ﴿ এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য বের করবো একটি কিতাব, যাকে সে খোলা আকারে পাবেঃ অর্থাৎ তার সমস্ত আমলকে একটি কিতাবে একত্র করবো এবং কিয়ামতের দিন তাকে উহা দিবো। সে যদি সৌভাগ্যবান হয়, তাহলে দিবো ডান হাতে। আর হতভাগ্য হলে দিবো বাম হাতে। আমলনামা সে খোলা অবস্থাতেই পাবে। সে তা পড়তে পারবে। অন্যরাও তার আমলনামা পড়তে পারবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴾ يَلْقَاهُ مَنْشُورًا ﴿ ‘‘আমলনামাকে খোলা অবস্থায় পাবে’’। এর কারণ হলো যাতে নেকীর পরিমাণ বেশী থাকলে তাকে দ্রুত সুখবর দেয়া যেতে পারে এবং অসৎ আমল বেশী থাকলে তাকে তিরস্কার করা যেতে পারে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴿اقْرَأْ كِتَابَكَ﴾ পড়ো নিজের আমলনামা নিজেইঃ অর্থাৎ দুনিয়াতে যে পড়তে পারতো এবং যে পারতোনা উভয়কেই আমি উহা পাঠ করার আগে বলবোঃ তোমার নিজের আমলনামা তুমি নিজেই পড়ো।
كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا ‘‘আজ নিজের হিসাব করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট’’ঃ حسيبا শব্দটি এখানে حاسبا অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং تمييز হিসাবে উহা মানসুব হয়েছে। এটি হচ্ছে সর্বোত্তম ন্যায় বিচার। যেখানে আল্লাহ তাআলা বান্দাকেই তার হিসাব গ্রহণকারী হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যাতে করে সে তার সমুদয় আমল দেখতে পায় এবং তা থেকে কোনটিই অস্বীকার করার সুযোগ না থাকে।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার মাধ্যমে জানা গেল যে, প্রত্যেক মানুষকেই কিয়ামতের দিন আমলনামা প্রদানের বিষয়টি সুসাব্যস্ত। সে তার আমলনামা নিজেই পড়বে এবং তার মধ্যে যা থাকবে, তা অবগত হবে। অন্যের মাধ্যমে অবগত হওয়ার কোন প্রয়োজন পড়বেনা।[4]
(৪) সেদিন মানুষের হিসাব নেওয়া হবেঃ অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া হিসাবের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা সেদিন সৃষ্টিসমূহের হিসাব নিবেন। হিসাব হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে লোকদেরকে তাদের আমল অনুযায়ী বিনিময়ের পরিমাণ সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া এবং তাদের আমলসমূহ থেকে তারা যা ভুলে গেছে তাদেরকে উহা স্মরণ করিয়ে দেয়া। অন্যভাষায় বলা যায়, হাশরের ময়দান হতে চলে যাওয়ার আগেই আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দাদেরকে তাদের ভাল-মন্দ আমলসমূহের হিসাব নেওয়ার জন্য আটকানোকে হিসাব বলা হয়।
অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) উল্লেখ করেছেন যে, হিসাব দুই প্রকার। (১) মুমিনের হিসাবঃ মুমিনের হিসাবের ব্যাপারে তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দার সাথে নিবৃত্তে মিলিত হবেন এবং পাপরাশির কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। যেমন এ বিষয়ে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا وَيَنقَلِبُ إِلَىٰ أَهْلِهِ مَسْرُورًا وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ فَسَوْفَ يَدْعُو ثُبُورًا وَيَصْلَىٰ سَعِيرًا إِنَّهُ كَانَ فِي أَهْلِهِ مَسْرُورًا إِنَّهُ ظَنَّ أَن لَّن يَحُورَ بَلَىٰ إِنَّ رَبَّهُ كَانَ بِهِ بَصِيرًا﴾
‘‘অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার কাছ থেকে হালকা হিসাব নেয়া হবে এবং সে হাসিমুখে নিজের লোকজনের কাছে ফিরে যাবে’’। (সূরা ইনশিকাকঃ ৭-৯)
বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«إِنَّ اللَّهَ يُدْنِي الْمُؤْمِنَ فَيَضَعُ عَلَيْهِ كَنَفَهُ وَيَسْتُرُهُ من الناس ويقرره بذنوبه وَيَقُولُ له: أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا؟ أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا؟ أتعرف ذنب كذا؟ حَتَّى إِذَا قَرَّرَهُ بِذُنُوبِهِ، وَرَأَى فِي نَفْسِهِ أَن قد هَلَكَ، قَالَ: فإني سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ فِي الدُّنْيَا وَأَنَا أَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ ثم يعطى كِتَابَ حَسَنَاتِهِ»
‘‘আল্লাহ তাআলা মুমিনকে নিকটবর্তী করে তার উপর স্বীয় (সম্মানের) পর্দা স্থাপন করে তাকে মানুষ থেকে আড়াল করবেন এবং তাকে দিয়েই তার গুনাহসমূহের স্বীকারোক্তি আদায় করবেন। আল্লাহ তাকে বলবেনঃ তুমি কি অমুক অমুক অপরাধ স্বীকার করো? তুমি কি অমুক অমুক অপরাধ স্বীকার করো? তুমি কি অমুক অমুক অপরাধ স্বীকার করো? এমনকি আল্লাহ যখন তার কাছ থেকে সকল গুনাহর স্বীকৃতি আদায় করবেন এবং বান্দা যখন দেখবে যে, সে ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে তখন আল্লাহ বলবেনঃ আমি দুনিয়াতে তোমার এ সমস্ত গুনাহ গোপন রেখেছি। আজ তোমার এ সমস্ত গুনাহ আমি ক্ষমা করে দিবো। তখন তার ভাল কাজগুলোর আমলনামা (ডান হাতে) প্রদান করা হবে
ويقرره بذنوبه তাকে দিয়েই তার গুনাহসমূহের স্বীকারোক্তি আদায় করবেনঃ অর্থাৎ তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবেন, যাতে সে তার গুনাহসমূহ স্বীকার করতে বাধ্য হবে। যেমন হাদীছে উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে একাধিকবার জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি এই গুনাহ স্বীকার করো? তুমি কি এই গুনাহ স্বীকার করো?
মুমিনদের মধ্যে এমন বহু সংখ্যক থাকবে, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমন সত্তর হাজারের হাদীছে এসেছে যে, তারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।[5]
হিসাব হবে বিভিন্ন রকম। কারো হিসাব হবে একদম সহজ। আর এটি হলো কেবল আমলগুলো পেশ করা। আরেক প্রকার হিসাব হবে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«لَيْسَ أَحَدٌ يُحَاسَبُ يوم القيامة إِلاَّ هَلَكَ فقلت يا رسول الله أَلَيْسَ قد قال اللَّهُ تَعَالَى: ﴿فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا فَقَالَ رسول الله صلى الله عليه وسلم «إِنَّمَا ذَلِكِ الْعَرْضُ وَلَيس أحد يناقش الْحِسَابَ يوم القيامة إلا عذب» (بخارى: 103)
‘‘কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে, সে অবশ্যই ধ্বংস হবে। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা কি বলেন নি ‘‘অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে অচিরেই তার সহজ হিসাব নেয়া হবে’’? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ মূলতঃ এটি হিসাব নয়; বরং তা হলো শুধু আমলগুলো পেশ করা। কিন্তু কিয়ামতের দিন যার কঠিন হিসাব নেয়া হবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে’’।
(২) কাফেরদের হিসাবঃ কাফেরদের হিসাব সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম বলেনঃ আর কাফেরদের ব্যাপারে কথা হলো, তাদের হিসাব ঐসব লোকদের হিসাবের মত হবেনা, যাদের ভাল-মন্দ আমলসমূহ ওজন করা হবে। কেননা কিয়ামতের দিন তাদের কোন ভাল আমলই থাকবেনা। অর্থাৎ তাদের এমন সৎ আমল থাকবেনা, যা অসৎ আমলের সাথে তুলনা করে ওজন করা যায়। কেননা কুফরী করার কারণে তাদের আমলসমূহ ধ্বংস হয়ে গেছে। আখেরাতে তাদের অসৎ আমল ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা। সুতরাং তাদের হিসাব নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাদের দুনিয়ার অপকর্মসমূহ গণনা করা এবং সংরক্ষণ করা। কিয়ামতের দিন তাদের আমলগুলোর কারণে তাদেরকে আটকানো হবে, তাদেরকে তা স্বীকার করানো হবে। অতঃপর তাদের আমলের বদলা দেয়া হবে। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তাদের কুফরী আমলগুলো তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের কাছ থেকে সেগুলোর স্বীকারোক্তি আদায় করার পর বদলা দেয়া হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿فَلَنُنَبِّئَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِمَا عَمِلُوا وَلَنُذِيقَنَّهُم مِّنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ﴾
‘‘আমি অবশ্যই কাফেরদের জানিয়ে দেব তারা কি কাজ করে এসেছে৷ আর তাদেরকে আমি অত্যন্ত জঘন্য শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো’’। (সূরা হামীম সাজদাহঃ ৫০) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿ وَشَهِدُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِينَ ﴾
‘‘এবং তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যে, বাস্তবেই তারা ছিল কাফের’’। (সূরা আরাফঃ ৩৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿فَاعْتَرَفُوا بِذَنبِهِمْ فَسُحْقًا لِّأَصْحَابِ السَّعِيرِ﴾
‘‘তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করবে৷ জাহান্নামের অধিবাসীদের উপর আল্লাহর লানত’’। (সূরা মুলকঃ ১১)
تَدْنُوْ الشَّمْسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنَ الْخَلْقِ حَتَّى تَكُونَ مِنْهُمْ كَمِقْدَارِ مِيلٍ فَيَكُونُ النَّاسُ عَلَى قَدْرِ أَعْمَالِهِمْ فِي الْعَرَقِ فَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى كَعْبَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ إِلَى حَقْوَيْهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يُلْجِمُهُ الْعَرَقُ إِلْجَامًا قَالَ وَأَشَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِهِ إِلَى فِيهِ
‘‘কিয়ামতের দিন সূর্য মানুষের মাথার উপরে চলে আসবে। মাত্র এক মাইলের ব্যবধান থাকবে। মানুষেরা তাদের নিজ নিজ আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে হাবুডুবু খাবে। মানুষের শরীরের পঁচা ঘাম কারো টাখনু পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। কারো হাঁটু পর্যন্ত, কারো কোমর পর্যন্ত এবং কারো নাকের ডগা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। একথা বলার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মুখের দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন’’। (সহীহ মুসলিম)
[2] - আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, হাশরের মাঠে আল্লাহ তাআলা মানুষের আমলসমূহ মাপার জন্য বিশাল একটি দাড়িপাল্লা স্থাপন করবেন। তার দু’টি পাল্লা থাকবে। আমল অনুযায়ী বিনিময় প্রদান করার জন্যেই আমল সমূহ ওজন করা হবে। কুরআনের অনেক আয়াতে এর বিশদ বিবরণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ﴾
‘‘আমি কিয়ামতের দিন ন্যায় বিচারের মান দন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি যুলুম হবেনা। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করবো এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ৪৭) আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَالْوَزْنُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ﴾
‘‘আর সে দিন যথাযথই ওজন হবে। অতঃপর যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে’’। (সূরা আরাফঃ ৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُوْلَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ﴾
‘‘আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারা এমন হবে, যারা নিজেদের ক্ষতি করেছে’’। (সূরা আরাফঃ ৯) অর্থাৎ তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ نَارٌ حَامِيَةٌ﴾
‘‘অতঃপর যার পাল্লা ভারী হবে সে সুখী জীবন যাপন করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে তার ঠিকানা হবে হাভীয়া। আপনি জানেন তা কি? তা হচ্ছে প্রজ্জলিত অগ্নি’’। (সূলা আল-কারিআহঃ ৬-১১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ سَيُخَلِّصُ رَجُلًا مِنْ أُمَّتِي عَلَى رُءُوسِ الْخَلَائِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيَنْشُرُ عَلَيْهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ سِجِلًّا كُلُّ سِجِلٍّ مِثْلُ مَدِّ الْبَصَرِ ثُمَّ يَقُولُ أَتُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا أَظَلَمَكَ كَتَبَتِي الْحَافِظُونَ فَيَقُولُ لَا يَا رَبِّ فَيَقُولُ أَفَلَكَ عُذْرٌ فَيَقُولُ لَا يَا رَبِّ فَيَقُولُ بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَةً فَإِنَّهُ لَا ظُلْمَ عَلَيْكَ الْيَوْمَ فَتَخْرُجُ بِطَاقَةٌ فِيهَا أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ فَيَقُولُ احْضُرْ وَزْنَكَ فَيَقُولُ يَا رَبِّ مَا هَذِهِ الْبِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلَّاتِ فَقَالَ إِنَّكَ لَا تُظْلَمُ قَالَ فَتُوضَعُ السِّجِلَّاتُ فِي كَفَّةٍ وَالْبِطَاقَةُ فِي كَفَّةٍ فَطَاشَتِ السِّجِلَّاتُ وَثَقُلَتِ الْبِطَاقَةُ فَلَا يَثْقُلُ مَعَ اسْمِ اللَّهِ شَيْءٌ
‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা সমস্ত মানুষের সামনে আমার উম্মতের একজন লোককে উপস্থিত করবেন। তার সামনে নিরানববইটি ফাইল (খাতা) বের করা হবে। প্রত্যেকটি ফাইলের বিশালতা হবে চোখের দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেনঃ এখানে যা লেখা আছে তার কোন কিছু কি তুমি অস্বীকার করতে পারবে? আমার ফেরেশতাগণ কি তোমার উপর জুলুম করেছে? তখন সে লোকটি বলবেঃ হে আমার প্রভু! আপনার ফেরেশতাগণ অন্যায় কিছু লেখে নাই। আল্লাহ বলবেনঃ তোমার কোন অযুহাত আছে কি? তখন সে লোকটি বলবেঃ হে আমার প্রভু! আমার কোন অযুহাত নেই। তখন আল্লাহ বলবেনঃ আমার কাছে তোমার একটি নেকী আছে। আজকে তোমার উপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবেনা। তারপর একটি কার্ড বের করা হবে। তাতে লিখা থাকবে,
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ বলবেনঃ দেখ! তোমার আমল ওজন করা হবে। সে বলবেঃ হে আমার প্রভু! এতোগুলো বিশাল ফাইল ভর্তি গুনার তুলনায় এই কার্ডটির কোন ওজনই হবেনা। আল্লাহ বলবেনঃ আজ তোমার উপর বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবেনা। অতঃপর মান দন্ডের এক পাল্লায় রাখা হবে নিরানববইটি ফাইল এবং অপর পাল্লায় রাখা হবে শুধু মাত্র ঐ কার্ডটি। এবার ওজনের সময় তার গুনায় ভর্তি নিরানববইটি ফাইলের পাল্লা হালকা হয়ে যাবে এবং লা-ইলাহা ইল্লাল্লার পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। আল্লাহর নামের সাথে অন্য বস্ত্তর কোন ওজনই হবেনা’’।[2]
উপরোক্ত আয়াত এবং হাদীছ প্রমাণ করে যে, অবশ্যই হাশরের মাঠে মান দন্ড স্থাপন করা হবে। তার দু’টি পাল্লা থাকবে। তাতে বনী আদমের আমলসমূহ ওজন করা হবে। যে সমস্ত বিদআতী দাড়ি পাল্লাকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপব্যাখ্যা করেছে, তাদের কথার প্রতি দৃষ্টি দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
[3] - বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী সূর্য আমাদের থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে অবস্থান করার পরও আমরা এখন দুনিয়াতে সূর্যের যেই তাপ অনুভব করি, তা কখনো এত প্রখর হয় যে, আমরা খোলা আকাশের নীচে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। কিয়ামতের দিন উহা মাত্র এক মাইলের দূরত্বে চলে আসলে অবস্থা কেমন হবে?!!!
বলা হয় যে, সূর্য এখন যেই অবস্থানে আছে, তা থেকে একচুল পরিমাণ সরে পৃথিবীর দিকে চলে আসলে পৃথিবী পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এবার চিন্তা করুন, কিয়ামতের দিন সূর্য মানুষের এত নিকটবর্তী হলে, তাদের কী অবস্থা হবে?!!! মানুষ কি পুড়ে যাবেনা?
এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো যে, কিয়ামতের দিন যখন সকল মানুষকে একত্রিত করা হবে, তখন তারা এখনকার মত দুর্বল অবস্থায় থাকবেনা, তাদের শরীরে এখন যেই ধারণ ক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
দুনিয়াতে কেউ পানাহার ব্যতীত একটানা পঞ্চাশ দিন সূর্যের তাপে থাকতে পারবেনা, মারা যাবে। কিন্তু কিয়ামতের দিন সূর্য এত নিকটবর্তী হওয়ার পরও তার নীচে পঞ্চাশ হাজার বছর পানাহার ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকবে। সেখানে তারা ভয়াবহ বিপদাপদেরও সম্মুখীন হবে। সেগুলো বরদাশত করার মত শক্তি দিয়েই তাদের দেহকে গঠন করা হবে।
আরো প্রশ্ন হচ্ছে কিয়ামতের দিন কেউ কি সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাবে? না কি মুসলিম-অমুসলিম, সৎ-অসৎ সকল মানুষই উত্তাপে জ্বলবে?
উত্তরে বলবোঃ না। তা নয়। এমন অনেক লোক রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাঁর ছায়া দিবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘যে দিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া কোন ছায়া থাকবেনা সে দিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর ছায়া দান করবেন। তারা হলেনঃ (১) ন্যায় পরায়ণ শাসক (২) যে যুবক তাঁর প্রভুর এবাদতের মাঝে প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়েছে। (৩) যে ব্যক্তির মন সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। (৪) এমন দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ভালবাসে। আল্লাহর জন্য তারা পরস্পর একত্রিত হয় এবং আল্লাহর জন্য পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়। (৫) এমন পুরুষ যাকে একজন সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলা নিজের দিকে আহবান করে, আর সে পুরুষ বলেঃ আমি আল্লাহকে ভয় করি। (তাই তোমার ডাকে সাড়া দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়)। (৬) যে দানশীল ব্যক্তি এমন গোপনে দান করে, ডান হাত দিয়ে যা দান করে, বাম হাত তা অবগত হতে পারেনা। অর্থাৎ তিনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যেই দান করেন। তাই মানুষকে শুনানো বা দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনা। (৭) যে ব্যক্তি নির্জনে বসে আল্লাহকে স্মরণ করে চোখের পানি প্রবাহিত করে’’। (বুখারী ও মুসলিম)
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেনঃ যদিও উক্ত হাদীছে সাতজনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আল্লাহর ছায়া প্রাপ্তদের সংখ্যা সাতের মধ্যে সীমিত নয়। আল্লাহ তাআলা আরও কয়েক প্রকার মানুষকে বিশেষ বিশেষ আমলের কারণে কিয়ামতের দিন তাঁর ছায়া দান করবেন। ‘যা হবে মরণের পরে’ এই নামে আমাদের অন্যতম একটি বইয়ে কিয়ামতের দিন যারা আল্লাহর ছায়াপ্রাপ্ত হবেন, এমন অনেক লোকের আলোচনা করেছি। বইটি পড়ার অনুরোধ রইল।
[4] - আল্লাহ তাআলা ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্ত মুমিনদের খুশীর অবস্থা বর্ণনা করে বলেনঃ
﴿فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَيَقُولُ هَاؤُمْ اقْرَءُوا كِتَابِيه إِنِّي ظَنَنتُ أَنِّي مُلَاقٍ حِسَابِيَه فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ﴾
‘‘অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে সে বলবেঃ এসো! তোমরাও আমার আমলনামা পড়ে দেখো। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন যাপন করবে সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত থাকবে। বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার প্রতিদান স্বরূপ তোমরা খাও এবং পান করো তৃপ্তি সহকারে।’’ (সূরা আল-হাক্কাহঃ ১৯- ২৪) আর যারা বাম হাতে পিছন দিক থেকে তাদের আমলনামা গ্রহণ করবে আল্লাহ তাআলা তাদের অবস্থা উল্লেখ করে বলেনঃ
﴿وَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِشِمَالِهِ فَيَقُولُ يَالَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِي وَلَمْ أَدْرِ مَا حِسَابِي يَالَيْتَهَا كَانَتْ الْقَاضِيَةَ مَا أَغْنَى عَنِّي مَالِيه هَلَكَ عَنِّي سُلْطَانِيه خُذُوهُ فَغُلُّوهُ ثُمَّ الْجَحِيمَ صَلُّوهُ ثُمَّ فِي سِلْسِلَةٍ ذَرْعُهَا سَبْعُونَ ذِرَاعًا فَاسْلُكُوهُ
‘‘যার আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে হায় আমাকে যদি আমলনামা না দেয়া হতো! আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায় আফসোস! আমার মৃত্যুই যদি শেষ পরিণতি হত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসলনা। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল। ফেরেশতাদেরকে বলা হবেঃ একে ধর। অতঃপর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও। অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর তাকে এমন শিকল দিয়ে বাঁধ যার দৈর্ঘ হবে সত্তর গজ।’’ (সূরা আল-হাক্কাহঃ ২৫-৩২)
[5] - তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও বাইহাকীতে সহীহ সনদ দ্বারা অপর হাদীছে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার প্রতিপালকের নিকট চাওয়ার ভিত্তিতে তিনি আমাকে উক্ত প্রতি হাজারে আরো সত্তর হাজারের ওয়াদা দিয়েছেন। সেই সাথে থাকবে আমার প্রতিপালকের আরো তিন অঞ্জলি।