শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ২৩- কিয়ামতের দিন মুমিনগণ তাদের রবকে দেখবে ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
কিয়ামতের দিন মুমিনগণ তাদের রবকে দেখবে

২৩- إثبات رؤية المؤمنين لربهم يوم القيامة

২৩- কিয়ামতের দিন মুমিনগণ তাদের রবকে দেখবে:

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'তের আকীদাহ এই যে, কিয়ামতের দিন মুমিনগণ আল্লাহকে সেরকমই দেখতে পাবে, যেমন পরিস্কার আকাশে দিনের বেলায় সূর্য এবং রাতের বেলায় পূর্ণিমার চাঁদকে দেখা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ﴿وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ﴾ ‘‘সেদিন অনেক মুখ-মন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’’। (সূরা কিয়ামাহঃ ২২-২৩) আল্লাহ তাআলা সূরা মুতাফফিফীনের ৩৫ নং আয়াতে আরো বলেনঃ ﴿عَلَى الْأَرَائِكِ يَنظُرُونَ﴾ ‘‘উঁচু আসনে বসে তারা দেখতে থাকবে’’। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনুসের ২৬ নং আয়াতে আরো বলেনঃ ﴿لِّلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ﴾ ‘‘যারা উত্তম আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং আরো বেশী’’। আল্লাহ তাআলা সূরা কাফএর ৩৫ নং আয়াতে আরো বলেনঃ ﴿لَهُم مَّا يَشَاءُونَ فِيهَاوَلَدَيْنَا مَزِيدٌ﴾ সেখানে তারা যা চাইবে তাই তাদের জন্য প্রস্ত্তত থাকবে৷ আর আমার কাছে আরো কিছু অতিরিক্ত জিনিষও থাকবে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর কিতাবে এ বিষয়ে আরো অনেক আলোচনা রয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে, তার জন্য সত্যের পথ পরিস্কার হবে।


ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন মুমিনদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। ناضرة শব্দটি النضارة থেকে যোয়াদ বর্ণ দিয়ে পড়তে হবে। এর অর্থ হচ্ছে উজ্জ্বল ও সুন্দর হওয়া অর্থাৎ আলোকোজ্জল, তরতাজা, সুন্দর এবং জ্যোতির্ময় হওয়া। সেদিন তারা তাদের প্রভু ও সৃষ্টিকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা তাদের চোখ দ্বারাই তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে মুতাওয়াতির সূত্রে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে সাহাবী, তাবেঈ এবং উম্মতের সালাফগণের ইজমা হয়েছে এবং ইসলামের ইমামগণ তাতে একমত হয়েছেন।

আয়াতে কারীমার মাধ্যমে সাব্যস্ত হলো যে, মুমিনগণ কিয়ামতের দিন তাদের রবকে দেখতে পাবেন।

عَلَى الْأَرَائِكِ يَنظُرُونَ উঁচু আসনে বসে তারা দেখতে থাকবেনঃ الأرائك শব্দটি أريكة এর বহুবচন। এর অর্থ হচ্ছে সিংহাসন বা খাঁট। মুমিনগণ সিংহাসনে বসে তাদের রব আল্লাহ তাআলার দিকে তাকিয়ে দেখবে। আর কাফেরদের ব্যাপারে কথা হচ্ছে যেমন এই আয়াতের পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে, তারা عن ربهم لمحجوبون নিশ্চয়ই সেদিন তাদের রবের দর্শন থেকে তাদেরকে বঞ্চিত রাখা হবে।

এই আয়াত থেকেও কিয়ামতের দিন মুমিনদের জন্য তাদের রবকে দেখার বিষয়টি প্রমাণিত হলো।

لِّلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ ‘‘যারা উত্তম আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং আরো বেশীঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেসব আমল ওয়াজিব করেছেন, উহা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এবং যেসব পাপাচার থেকে তাদেরকে নিষেধ করেছেন, যারা তা বর্জন করার মাধ্যমে কল্যাণের পথ অবলম্বন করবে, তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ তথা উত্তম বিনিময়। এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেছেনঃ উহা হচ্ছে জান্নাত। وزيادة (আরো বেশী) এর তাফসীরে সহীহ মুসলিম এবং অন্যান্য কিতাবে সহীহ সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে যিয়াদাহ বা বেশী বলতে আল্লাহর মহান চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা। এই উম্মতের সালাফে সালেহীনগণও এই ব্যাখ্যা করেছেন।

তাই উপরের আলোচনা হতে প্রমাণ মিলছে যে, মুমিনদের জন্য কিয়ামতের দিন তাদের রবকে দেখার সুযোগ রয়েছে।

لَهُم مَّا يَشَاءُونَ فِيهَا সেখানে তারা যা চাইবে তাদের জন্য তাই থাকবেঃ জান্নাতে মুমিনদের মন যা চাইবে, তাদের জন্য তাই রয়েছে সেখানে। তাদের চোখ বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত এবং অপরিমীত কল্যাণ পেয়ে শীতল হবে।

ولدينا مزيد আমার কাছে আরো কিছু অতিরিক্ত জিনিষও থাকবেঃ অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত ও কল্যাণের অতিরিক্ত যা থাকবে, তা হলো আল্লাহ তাআলার সম্মানিত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা।

আয়াতে কারীমার এই অংশ থেকেই প্রমাণ নেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে জান্নাতে আল্লাহ তাআলার সম্মানিত চেহারার দিকে মুমিনদের তাকানো প্রমাণিত হয়েছে।

উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে যা শিক্ষণীয়ঃ উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে কিয়ামতের দিন মুমিনদের জন্য আল্লাহর দিদার প্রমাণিত হলো। আর এটিই হবে মুমিনদের জন্য জান্নাতের সবচেয়ে বড় নেয়ামত। আল্লাহ তাআলাকে দেখার বিষয়ে এটিই হচ্ছে সাহাবী, তাবেঈ এবং মুসলিমদের সম্মানিত ইমামগণের কথা। শিয়াদের রাফেযী সম্প্রদায়, জাহমীয়া এবং মুতাযেলারা এই মাসআলায় খেলাফ করেছে। তারা আল্লাহর দিদারকে অস্বীকার করে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং উম্মতের সালাফ ও ইমামগণের বিরোধীতা করেছে। উপরোক্ত বাতিল ফির্কার লোকেরা আল্লাহর দিদার অস্বীকার করার পক্ষে কতিপয় দুর্বল সন্দেহ এবং ভ্রান্ত দলীল পেশ করেছে। তার মধ্যেঃ (১) আল্লাহকে দেখা যাবে এই কথা সাব্যস্ত করলে আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ তাআলা কোন একটি দিকে রয়েছেন। আর তিনি যদি কোন দিকে থাকেন, তাহলে তার জন্য জিসিম (দেহ, কায়া, আকৃতি, শরীর ইত্যাদি) সাব্যস্ত হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা জিসিম বা দেহ ও শরীর থেকে পবিত্র।

এই সন্দেহের জবাব এই যে, দিক শব্দটির মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। এর দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয় যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে ঢুকে আছেন, তাহলে এই কথা সম্পূর্ণ বাতিল। অসংখ্য দলীল এই কথাকে বাতিল প্রমাণিত করেছে। আল্লাহকে দেখা যাবে বা তাকে দেখা সম্ভব এটা সাব্যস্ত করলে, আল্লাহর জন্য দিক সাব্যস্ত হয়ে যায়না। আর যদি দিক দ্বারা উপরের দিক উদ্দেশ্য হয় তথা এটি উদ্দেশ্য হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য উপরের দিক সুসাব্যস্ত। এটি অস্বীকার করা অন্যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দিদার অর্জিত হওয়ার সাথে তিনি উপরের দিকে হওয়া সাংঘর্ষিক নয়।

(২) মুতাযেলা এবং আল্লাহর দিদারে অবিশ্বাসী অন্যান্য সম্প্রদায় দলীল হিসাবে আল্লাহর বাণী: لن تراني ‘‘তুমি আমাকে কখনই দেখতে পাবেনা’’- এই আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছে। তাদের দলীল গ্রহণের জবাবে বলা হয়েছে যে, আয়াতে দুনিয়াতে আল্লাহর দিদার নাকোচ করা হয়েছে। আখেরাতের দিদার নাকোচ করা হয়নি। যেমন অন্যান্য দলীলের মাধ্যমে আখেরাতে আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হয়েছে। আখেরাতে মানুষের অবস্থা দুনিয়ার অবস্থার চেয়ে ভিন্ন হবে।[1]

(৩) তারা আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারাও দলীল গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ﴾

‘‘দৃষ্টিশক্তি তাঁকে আয়ত্ত করতে পারেনা। কিন্তু তিনি দৃষ্টিকে আয়ত্ত করে নেন৷ তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা আনআমঃ ১০৩) এর জবাবে বলা হয়েছে যে, এই আয়াতে ইদরাক তথা আল্লাহকে আয়ত্ত করার নফী এসেছে। আল্লাহর দিদার নফী করা হয়নি। إدراك অর্থ হচ্ছে আয়ত্ত ও বেষ্টন করা। মুমিনগণ আল্লাহ তাআলাকে দেখবে; কিন্তু তাঁকে আয়ত্ত করতে পারবেনা।[2] বরং মানুষের দৃষ্টিসমূহ আল্লাহকে বেষ্টন করতে পারবেনা, এই কথা থেকেও আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হয়। সুতরাং এই আয়াতটি আল্লাহর দর্শন সাব্যস্ত করার অন্যতম দলীল। আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক জানেন।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর কিতাবে এ বিষয়ে আরো অনেক আলোচনা রয়েছে। অর্থাৎ কুরআনে আল্লাহর জন্য নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করার বিষয়ে অনেক আলোচনা এসেছে। গ্রন্থকার এখানে তা থেকে সামান্য কিছু উল্লেখ করেছেন। কুরআনের অনেক আয়াতে আল্লাহর নাম এবং তাঁর সিফাতের বর্ণনা এসেছে। এগুলো আল্লাহর জন্য ঠিক সেভাবেই সাব্যস্ত করতে হবে, যেভাবে সাব্যস্ত করলে আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় হয়। যে ব্যক্তি কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে অর্থাৎ তাতে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং কুরআন যেই হেদায়াতের প্রমাণ বহন করে, তার উপর দৃষ্টি দিবে, তার জন্য সত্যের পথ উন্মুক্ত হবে। সত্যের রাস্তা তার জন্য পরিস্কার হবে। কুরআন নিয়ে গবেষণা করাই হচ্ছে উহা পাঠ করার মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ﴾

‘‘এটি একটি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ[3] কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে এরা তার আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলরা তা থেকে শিক্ষা নেয়’’। (সূরা সোয়াদঃ ২৯) আল্লাহ তাআলা সূরা মুহাম্মাদের ২৪ নং আয়াতে আরো বলেনঃ

﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا﴾

‘‘তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেনা? নাকি তাদের হৃদয়ের উপর তালা লাগানো আছে?’’ আল্লাহ তাআলা সূরা মুমিনুনের ৬৮ নং আয়াতে আরো বলেনঃ

أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ أَمْ جَاءَهُم مَّا لَمْ يَأْتِ آبَاءَهُمُ الْأَوَّلِينَ ‘‘তারা কি কখনো এ বাণী সম্পর্কে চিন্তা করেনি? না কি সে এমন কথা নিয়ে এসেছে যা কখনো তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে আসেনি?

[1] - দুনিয়াতে মানুষের চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে দুনিয়ায় তৈরী করা হয়নি। পাহাড়ের গঠন মানুষ গঠনের চেয়ে অধিক মজবুত ও শক্ত হওয়ার পরও যেহেতু পাহাড় আল্লাহর নূরের সামনে টিকে থাকতে পারেনি এবং আল্লাহ তাআলা যখন পাহাড়ের উপর স্বীয় জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, তাই বুঝা গেল যে মানুষ চর্ম চক্ষু দিয়ে দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখতে সক্ষম নয়। (আল্লাহই সর্বাধিক জানেন)

[2] - আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল সৃষ্টিকে দেখেন এবং সৃষ্টিকে সকল দিক থেকেই বেষ্টন করে আছেন। কিন্তু মানুষের পক্ষে তো আল্লাহকে পুরাপুরি আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আল্লাহর শান এর অনেক উর্ধ্বে। সুতরাং বেষ্টন করাকে অস্বীকার করার দ্বারা দেখার নফী হয়না। বেষ্টন ছাড়াও আল্লাহকে দেখা সম্ভব। দেখার জন্য বেষ্টন অপরিহার্য নয়।

[3] - বরকতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, কল্যাণ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি। কুরআন মজীদকে বরকত সম্পন্ন কিতাব বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব। এ কিতাবটি তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বোত্তম বিধান দান করে। এর বিধান মেনে চলায় মানুষের কেবল লাভই হয়; কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা নেই।